প্রায় পঞ্চাশ বছর সম্রাটের সিংহাসনে বসে মুঘল সাম্রাজ্য শাসন করলেও তিনি বাবর, আকবর, জাহাঙ্গির কিংবা শাহজাহানের মতো জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন নি। অন্যান্য মুঘল শাসকেরা নানা কারণে যে সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি বরং ভীষণভাবেই সমালোচিত হয়েছিলেন। এমনকি ঐতিহাসিকেরাও তাঁকে ‘শেষ কার্যকর মুঘল সম্রাট’ অভিহিত করলেও নির্দয় অত্যাচারী শাসক হিসেবে বর্ণিত করেছেন। ইতিহাসবিদদের এ ধরনের মনোভাবের কারণ, তিনি নিজের বাবাকে বন্দি ও বড় ভাইকে হত্যা করে মুঘল সিংহাসন দখল করেছিলেন। অন্যান্য মুঘল শাসকদের তুলনায় তাঁর খুব একটা সুনাম ছিল না। অথচ আওরঙ্গজেবের প্রপিতামহ আকবরকে বলা হত ধর্মনিরপেক্ষ ও সহৃদয় শাসক, পিতামহ জাহাঙ্গীর পরিচিত ছিলেন শিল্প ও স্থাপত্যকলার প্রতি ভালোবাসার জন্য আর পিতা শাহজাহান ছিলেন রোম্যান্টিক ও তাজমহলের নির্মাতা। যদিও ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান, কিন্তু তাঁকে নির্দয় অত্যাচারী শাসক বিবেচনা করা হয়েছে। কারণ, সাম্রাজ্য বিস্তারকারী আওরঙ্গজেব কঠোর শরিয়া আইন প্রচলন করেছিলেন এবং পৃথকভাবে হিন্দু প্রজাদের জন্য জিজিয়া কর ফিরিয়ে আনেন, এই নীতি সন্দেহাতীতভাবেই বৈষম্যমূলক, হিন্দুরা নিজেদের নিরাপত্তার কারণে তা প্রদান করত। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে প্রচারিত যে তিনি সঙ্গীত এবং অন্যান্য শিল্পকলাকে ঘৃণা করতেন এবং তিনি বেশ কয়েকটি মন্দির ধ্বংস করে ফেলারও নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তিনশ’ বছরেরও বেশি সময় আগে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মারা যাওয়ার পরেও তাঁকে নিয়ে বোটকা গন্ধময়, মাছি ভনভন করা কথাগুলি ভারতবর্ষের ইতিহাসের পাতায় রয়ে গিয়েছে। তাছাড়া সমাজ-সভ্যতা অথবা সংস্কৃতি-রাজনীতি সরিয়ে রেখে যদি ইতিহাস চর্চা হয় তাহলে কার রাজত্বের সীমা কতদূর বিস্তৃত ছিল, কে কতগুলি মন্দির-মসজিদ গড়েছিল অথবা ভেঙেছিল, কার কতজন বউ ছিল তার আদ্যপান্ত হিসাব-নিকাষ যে ইতিহাসের বিষয় অথবা চর্চার অন্যতম উপজীব্য হবে তা বলাই বাহুল্য। যদিও সবই কয়েকশো’ বছর আগের ঘটনা, তা হোক; কিন্তু রাজা যদি ধর্মে মুসলমান হন তাহলে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করেন যে মুসলমানরা কয়েকশো বছর ধরে হিন্দুদের নির্যাতন করেছে, সুতরাং শাস্তি হিসেবে এখন মুসলমানদেরকে নির্যাতন করতে হবে। যেসব হিন্দু রাজা, সামন্তরা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন তাঁরা আসলে প্রকৃত হিন্দু ছিলেন না। ভারতের ইতিহাসকে বানাতে হবে মুসলমান মানেই অত্যাচারী আক্রমণকারী এই সত্যের উপর। এই হল হিন্দুত্ববাদীদের মত ও বিশ্বাস এবং উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট — হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঘৃণা ছড়িয়ে বিভাজন তৈরি করা। সর্বত্র প্রাণপণ চেষ্টা হচ্ছে যে হিন্দুরা মুসলমানদের কারণে বিপদে রয়েছে। একমাত্র বিজেপিই দল হিসাবে হিন্দুদের পাশে রয়েছে, যারা এই বিপদ থেকে তাঁদের বাঁচাতে পারবে। আর লক্ষ্য হল সম্প্রীতি, সদ্ভাব, সহিষ্ণুতা, সহযোগিতা এবং সহমর্মিতাকে সমূলে মুছে দেওয়া।
৩০০ বছর আগে আওরঙ্গজেব মারা যাওয়ার পরও তাঁর নামে এদেশে অশান্তি ছড়াচ্ছে। আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যুব সংগঠন বজরঙ্গ দল মিছিল করে আওরঙ্গজেবের কুশপুতুল পোড়ায়, আর সেই মিছিলকে ঘিরেই হিংসা, ইঁট-পাথরবৃষ্টি, অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ-অশান্তির কিছুই বাদ গেল না। কিন্তু কেন আওরঙ্গজেবের সমাধি ভাঙার দাবি, কেনই বা তা নিয়ে হিংসা অশান্তি সংঘর্ষ? নেপথ্যে হিন্দুত্ববাদী ঘৃণ্য রাজনীতি। সমাধি হলেও তা বজরং দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এর মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলির রাজনীতি ও আদর্শের সংঘর্ষের বিষয়। তার উপর সমাধিটি আওরঙ্গজেবের মতো মুসলমান সম্রাটের। যার ইচ্ছেকে স্বীকৃতি দিয়েই তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু শেখ জৈনুদ্দিনের দরগার কাছেই মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদে সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু আওরঙ্গজেব অন্য মুঘল সম্রাটদের মতো রাজকীয় সমাধি চাননি বরং সাধারণ মানুষের মতো সমাধি চেয়েছিলেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ খুলদাবাদ থেকে সমাধি সরানোর দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়ণবীসের কাছে স্মারকলিপি জমা করেছে। তারা এও জানিয়েছে, ছত্রপতি সম্ভাজীনগর থেকে আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানো না হলে বাবরি মসজিদের মতো পরিণতি হবে। বজরঙ্গ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মারাঠা শাসকদের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের সংঘাতের ইতিহাস, শিবাজিপুত্র ছত্রপতি সম্ভাজীর মৃত্যু, কাশী, মথুরা এবং সোমনাথে আওরঙ্গজেবের মন্দির ভাঙা ইত্যাদির সঙ্গে সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘ছাওয়া’ ছবি ইত্যাদি থেকে নতুন করে জেগে উঠেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। তবে মুসলমানবিদ্বেষ রাজনৈতিক খেলায় কেবল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরঙ্গ দল নয়, আসল হল বিজেপির বিভাজন রাজনীতি যার মূল লক্ষ্য হল ‘ভাগ করো ও শাসন করো’।
আওরঙ্গজেবের শাসনকে প্রচার করতে হবে অত্যাচারের কাল হিসাবে যেখানে শত শত হিন্দু মন্দির ধ্বংস এবং হাজার হাজার হিন্দু প্রজা নিধনের উল্লেখ থাকবে। আর সেই ইতিহাস নামক গল্পকথা মাত্র একটি নির্বাচনেই ফুরিয়ে যাবে না, চলতেই থাকবে। হিন্দু ভোটারদের অবিরাম প্রক্রিয়ায় বোঝানোর চেষ্টা চলবে যে হিন্দু পূর্বপুরুষরা হাজার হাজার বছর ধরে মুসলমানদের দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল, আর যেসব হিন্দু রাজা, সামন্তরা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন তাঁরা আসলে হিন্দু ধর্মের কলঙ্ক। হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সুসম্পর্ক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সম্প্রীতির সাংস্কৃতি ইত্যাদি আসলে মিথ্যে। একইভাবে শিবাজির বাবা ছিলেন শাহাজির কাকা শরিফজির নামকরণ হয়েছিল একজন সুফি সাধকের নামে, যা শিবাজির পরিবারে হিন্দু ও মুসলিম সাধকদের প্রতি শ্রদ্ধার ইঙ্গিত দেয় কিন্তু এই ইতিহাস বলা যাবে না। শিবাজি যে মুসলমানদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সমর্থন করতেন এবং প্রায়শই সুফি সাধক ইয়াকুত বাবার কাছে আশীর্বাদ নিতে যেতেন এই ইতিহাসকে মিথ্যা বলতে হবে। শিবাজি যে প্রত্যেকের ধর্ম অনুসরণ করার স্বাধীনতার কথা বলতেন এবং তা বিঘ্নিত না করার আদেশ দিয়েছিলেন — এই ইতিহাসও মিথ্যা, তাঁর সৈন্যরা কোনো মহিলা, কুরআন বা মসজিদের ক্ষতি করলে অবধারিত ছিল কঠিন শাস্তি, তাঁর সেনাবাহিনীতে বহু মুসলমান ছিলেন, যার মধ্যে জেনারেল যেমন নুর খান বেগ (পদাতিক প্রধান), শামা খান (লেফটেন্যান্ট) এবং নৌবাহিনী প্রধান দৌলত খান ও দরিয়া সরং ছিলেন। সিদ্দি হিলাল ও ইব্রাহিম খান তাঁর আর্টিলারি কমান্ড করতেন এবং তার গোয়েন্দা বিভাগের সচিব ছিলেন মৌলানা হায়দার আলি — একেও ইতিহাস বলা যাবে না। অন্যদিকে, পুরন্দরের যুদ্ধে, আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হিন্দু রাজপুত মির্জা রাজা জয় সিং, তাঁর প্রধান দেওয়ান ছিলেন একজন হিন্দু, রাজা রঘুনাথ রায়, যাঁকে আওরঙ্গজেব তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশাসক হিসাবে বর্ণনা করেছেন, আওরঙ্গজেবের শাসন আমলে মুঘল প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে হিন্দুদের অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৬৭৯ সালে, আওরঙ্গজেবের প্রায় ৭২ জন রাজপুত এবং ৯৬ জন মারাঠা মনসবদার ছিলেন এও ইতিহাস নয়। তবে এটাও ঐতিহাসিক সত্য যে আওরঙ্গজেব ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন এবং হিন্দু ব্যবসায়ীদের উপর কর বাড়িয়েছিলেন। আবার ১৬৫৪ সালের একটি লিখিত দলিলে পাওয়া যাচ্ছে তিনি একজন হিন্দু রাজপুত রাজাকে একটি রাজকীয় আদেশ পাঠিয়ে সব ধর্মের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধির কথা বলেছিলেন এবং উপাসনালয় ধ্বংসের সমালোচনা করেছিলেন। ১৬৫৯ সালে আওরঙ্গজেবের নির্দেশ ছিল, বেনারাসে কোনও হিন্দু বা ব্রাহ্মণকে ক্ষতি না করার। ১৬৮৭ সালে নির্দেশ দিয়েছিলেন বেনারাসে ব্রাহ্মণ ও ফকিরদের জন্য বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার। কিন্তু বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদীরা এই ইতিহাস উচ্ছেদ করে, ধ্বংস করে বিভাজনের রাজনীতি চালাতে চায়।