শনিবার | ১৭ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ৮:১৫
Logo
এই মুহূর্তে ::
হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা — আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংকট : সুব্রত কুমার দাস সিন্ধুসভ্যতার ভাষা যে ছিল প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তার প্রমাণ মেলুহা তথা শস্যভাণ্ডার : অসিত দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (শেষ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস জাতিভিত্তিক জনগণনার বিজেপি রাজনীতি : তপন মল্লিক চৌধুরী গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তালশাঁসের চাহিদা : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (ষষ্ঠ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস ভারতের সংবিধান রচনার নেপথ্য কারিগর ও শিল্পীরা : দিলীপ মজুমদার চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (পঞ্চম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস আলোর পথযাত্রী : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (চতুর্থ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস কন্নড় মেল্ল থেকেই সিন্ধুসভ্যতার ভূখণ্ডের প্রাচীন নাম মেলুহা : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (তৃতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস লোকভুবন থেকে রাজনীতিভুবন : পুরুষোত্তম সিংহ চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (দ্বিতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত রবীন্দ্রনাথের ইরান যাত্রা : অভিজিৎ ব্যানার্জি ঠাকুরকে ঠাকুর না বানিয়ে আসুন একটু চেনার চেষ্টা করি : দিলীপ মজুমদার যুদ্ধ দারিদ্র কিংবা বেকারত্বের বিরুদ্ধে নয় তাই অশ্লীল উন্মত্ত উল্লাস : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ, পঁচিশে বৈশাখ ও জয়ঢাক : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী ও শান্তিনিকেতন : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বাঙালী রবীন্দ্রনাথ : সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক দূর পর্যন্ত ভেবেছিলেন আমাদের ঠাকুর : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি জীবনী : সুব্রত কুমার দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (প্রথম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস শুক্লাম্বর দিঘী, বিশ্বাস করে দিঘীর কাছে কিছু চাইলে পাওয়া যায় : মুন দাশ মোহিনী একাদশীর ব্রতকথা ও মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত নিজের আংশিক বর্ণান্ধতা নিয়ে কবিগুরুর স্বীকারোক্তি : অসিত দাস ঝকঝকে ও মজবুত দাঁতের জন্য ভিটামিন : ডাঃ পিয়ালী চ্যাটার্জী (ব্যানার্জী) সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা : লুৎফর রহমান রিটন
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা — আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংকট : সুব্রত কুমার দাস

সুব্রত কুমার দাস / ৭০ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

ভূমিকা

বিশ্ব ভ্রামণিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কটি দেশে সবচেয়ে বেশি ভ্রমণে গেছেন তাদের একটি হলো আমেরিকা। ১৯১২-১৯৩০ কাল পর্বে সুদূর সে দেশটিতে তাঁর মোট পাঁচবার যাত্রা। ১৯১২ সালের ২৭ অক্টোবর প্রথমবার যখন তিনি আমেরিকায় পৌঁছান ততদিনে ইংরেজি ভাষায় গীতাঞ্জলি ছাপা হয়ে আসে নি। সে যাত্রায় সারা আমেরিকা জুড়ে তাঁর ভ্রমণের ছাপ পড়ার কোন সম্ভবনাও ছিল না,  যদিও স্থানীয়ভাবে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে নিয়ে আলোচনা-অনুষ্ঠান হয়েছিল বেশ কটি। The Daily Illini নামের সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকাটিতে তাঁর উপস্থিতি ও বক্তৃতার সংবাদও ছাপা হয়। ড. সেইমুর (Mayce F. Seymour) নামের অধ্যাপকের রবীন্দ্র বন্দনার কথাও সকলের জানা। মিশিগান, শিকাগো এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বক্তৃতা দানের জন্য আমন্ত্রণ পাওয়াও ছিল কবির জন্য বিশেষ সম্মানের। ব্যক্তিগত উদ্যোগের সাড়ে পাঁচ মাস দীর্ঘ সে যাত্রা শেষ করে কবি লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দেন ১৯১৩ সালের ১২ এপ্রিল। এর ঠিক ছয় মাস পর প্রথম অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি আমেরিকায় তাঁকে ক্রমে ক্রমে জনপ্রিয়তার চূড়ান্তে নিয়ে যায়। ১৯১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো আটলান্টিক পাড়ের সে দেশটিতে তিনি পৌঁছালে তাঁকে নিয়ে বিপুল সংবর্ধনার বহু সংবাদ দেশটির পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। বিখ্যাত সব দৈনিক পত্রিকার পৃষ্ঠা জুড়ে রবীন্দ্রনাথের ছবিসহ সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত হয়। উচ্চ প্রবেশ মূল্য দিয়ে এশিয় লেখকের বক্তৃতা শোনার লোকের অভাব হয়নি শ্বেতাঙ্গ সে সমাজেও। সামান্য বিরূপ যে কিছুই ঘটেনি তেমনটিও আশা করা যায় না। ধর্মানুভূতির কবিকে নিয়ে কার্টুন-ব্যাঙ্গোক্তিও দেখা গেছে পত্র-পত্রিকায়। তবে তাঁকে নিয়ে মারাত্মক যে ঘটনাটি ঘটে সেটির মূল নায়ক তাঁর স্বদেশের স্বাধীনতাকামি কিছু মানুষ। ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি সানফ্রান্সিসকোতে আসার পর ৫ অক্টোবর অনাকাঙ্ক্ষিত সে ঘটনার সংবাদরূপ এমন ‘Tagore Visitor Hit by Hindus’, ‘Plot to Slay Sir Rabindranath Tagore Nipped in S.F’ ইত্যাদি। সে ঘটনা দ্রুত নিষ্পত্তি হলেও স্বদেশী আন্দোলকদের কর্মকাণ্ড এত সুদূর প্রসারি ছিল যার পরিণতিতে আমেরিকার আদালত প্রত্যক্ষ করে রোমহর্ষক এক ঘটনা। ১৯১৮ সালের ২৩ এপ্রিল হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার রায় ঘোষণার দিন কোর্ট প্রাঙ্গণে ভারতীয় স্বদেশী নেতা উর্দুভাষী গদর পত্রিকার সম্পাদক রাম চন্দ্র নিহত হন তারই আরেক সহমতাবলম্বী রাম সিঙের পিস্তলের গুলিতে। ভারতের স্বাধীনতার জন্য আমেরিকার মাটিতে বসে বিপ্লবের বীজ উত্তাপকারী সে মানুষদের বিচার চলাকালে জবানবন্দির এক পর্যায়ে আমেরিকার পত্রিকায় ফেব্রুয়ারি শেষ সপ্তাহে একটি  চাঞ্চল্যকর সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘Tagore Named with Japanese at plot Trial’ যার খেসারত দিতে রবীন্দ্রনাথকে সন্দেহাতীতভাবে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।

১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি।

গদর পার্টি এবং কোমাগাতা মারু জাহাজের ঘটনা

রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ পর্বে আমেরিকা ভ্রমণের শুরুতে প্রথমবারের মত জাপান ভ্রমণে যান। বিপুলভাবে অভিনন্দিত  কবির সে ভ্রমণ যদিও শেষ হয়েছিল বিরূপ এক চিত্রের ভিতর দিয়ে।  জাপানের জাতীয়তাবাদে কড়া সমালোচনার জন্য তাঁর জাপান ত্যাগ হয়েছিল বন্ধু ও ভক্ত শূন্যভাবে। রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার সংবাদ আমেরিকার পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় কবি সে দেশের পৌঁছানোর আগেই। ফলে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেন আমেরিকাতে বসবাসরত ভারতীয় বিপ্লবীরাও।

বিপ্লবীদের সাথে রবীন্দ্রনাথের  যোগাযোগ বিষয়ে প্রধান দুটি আকর গ্রন্থ হলো বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত চিন্মোহন সেহানবীশের রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজ এবং কলকাতার সাহিত্যায়ন থেকে প্রকাশিত সমীর রায়চৌধুরীর প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী ও রবীন্দ্রনাথ। চিন্মোহনের গ্রন্থটি ১৪০৪ বঙ্গাব্দে পুনর্মুদ্রিত হলেও এটি প্রকৃতপক্ষে ১৩৯২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত গ্রন্থ। অর্থাৎ ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত সমীরের বই থেকে সেটি   অন্তত ১২ বছর পূর্বে রচিত। প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী ও রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে সমীর তাই সুযোগ পেয়েছেন চিন্মোহনের ব্যবহৃত তথ্যকে পরিমার্জন ও সংযোজন করতে। সাম্প্রতিককালে আমেরিকার অধিকাংশ পত্রিকার শতাব্দিকাল পূর্বে প্রকাশিত পৃষ্ঠাগুলো ইন্টারনেটে সহজলভ্য হওয়ায় ধারণা হয় সে তথ্যরাজিতে নতুন মার্জনা সম্ভব। আমেরিকার প্রধান কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এ বিষয়ের সংবাদগুলোকে পর্যালোচনা  করলে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটটি উজ্জলতর হবে বলে বিশ্বাস। তবে তার আগে স্পষ্ট করা দরকার গদর বিদ্রোহ ও সম্পর্কিত প্রসঙ্গগুলো।

একথা এখন সবার জানা যে এক সময় ব্রিটিশ বিরোধিতা করতে যেয়েই ভারত স্বাধীনতার দাবিদাররা বন্ধু ভেবেছিলেন জার্মানি ও জাপানকে। আমেরিকাও তাদের পছন্দের তালিকায় একটি উল্লেখযোগ্য দেশ ছিল। সে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে বিংশ শতাব্দির প্রথম দশকে জীবিকার প্রয়োজনে আবাস গড়েছিলেন বিপুল সংখ্যক ভারতীয় যাদের অধিকাংশ ছিলেন পাঞ্জাবী ও শিখ। এক সময় সেখানে পৌঁছান লালা হরদয়াল (১৮৮৪-১৯৩৯)। লেলান্ড স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক হরদয়াল চেষ্টা চালান ভারতীয়দের সংগঠিত করতে। ১৯১১ সালে শুরু সে প্রচেষ্টা দু বছরের মাথায় ‘প্যাসিফিক কোস্ট হিন্দুস্তানী এসোসিয়েশন’-এ রূপ নেয় যার মুখপত্র হলো গদর। ১ নভেম্বর শুরু গদর-এর সম্পাদক ছিলেন হরদয়াল নিজেই। উর্দু ভাষায় প্রকাশিত আরবী ‘গদর’ শব্দের অর্থ বিদ্রোহ। পরবর্তীকালে সে পত্রিকার নাম বদলে রাখা হয় হিন্দুস্তান গদর। গদরের কোষাগারে অর্থ আসতো জার্মানি থেকে। পুলিশী ঝামেলায় পড়ে হরদয়াল নিজেই একসময় আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য হন। আর তখন গদর পার্টির দায়িত্ব এসে পড়ে রাম চন্দ্র ভরদ্বাজের উপর। পেশোয়ারের বাসিন্দাদের প্রথা অনুযায়ী অঞ্চলের নাম নিজের নামের সাথে যুক্ত করার কারণে রাম চন্দ্রের নাম হয়ে যায় রাম চন্দ্র পেশোয়ার।

প্রথমবার আমেরিকা সফরের সময় হরদয়ালের সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়নি, যদিও কবি তাঁকে চিনতেন। তবে দেখা যাঁর সাথে হয়েছিল তিনি হলেন বসন্তকুমার রায়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে বসন্তকুমার কিন্তু The Open Court পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন এবং সে পত্রিকাতে হরদয়াল ও রাম চন্দ্র উভয়ের লেখাই প্রকাশিত হতো। ১৯১২ সালের মার্চ মাসে সে পত্রিকায় প্রকাশিত হরদয়ালের একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘What the World is Waiting For’। মজার তথ্য হলো রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের পত্রিকা Modern Review-তেও হরদয়ালের লেখা ছাপা হয়েছে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত তেমন প্রবন্ধ হলো ‘Woman in the West’ ও ‘Indian Philosophy and Art in the West’। জানা যায় ১৯১৭ সালের মার্চে The Open Court পত্রিকাটির ‘ভারত’ বিষয়ক সংখ্যায় একই সাথে রাম চন্দ্র ও বসন্তকুমারের লেখা ছাপা হয়েছিল। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (১৮৮৭-১৯৫৫) স্মৃতিকথা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সমীর জানিয়েছেন যে বসন্তকুমার যদিও বিপ্লবী ছিলেন না কিন্তু অন্যান্য ভারতীয় বিপ্লবী যেমন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮০-১৯৬১) এবং তারকনাথ দাসের (১৮৮৪-১৯৫৮) সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল (পৃ. ৪৫)। তাই কবির সাথে বসন্তকুমারের যোগাযোগের বিষয়টি শুধুমাত্র সাহিত্যিক, অন্য কিছু নয়, এমনটি ভাবার কোন কারণ নাই। বসন্তকুমার যখন কবিকে নিয়ে বই লেখেন তাতে ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রসঙ্গটি উল্লেখ পেয়েছিল। কবি সে বইকে অবহেলা করেছিলেন বলে আমরা জেনেছি। অবহেলার কারণটি কি এমন যে বসন্তকুমার ব্যক্তিগত যোগাযোগের বিষয়টিকে মুদ্রিত আকারে প্রচার করে ফেলেছিলেন? ভবিষ্যৎ গবেষক নিশ্চয়ই এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করবেন।

১৯১৪ সালে ভ্যাঙ্কুভারে কোমোগাতা মারু জাহাজ।

অন্য যে আরেকজন আমেরিকা-প্রবাসী মেধাবী সাহিত্যিকের সাথে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের কথা সকলের জানা তিনি হলেন বহু গ্রন্থের লেখক ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৩৬) যিনি নিজে ছিলেন বিপ্লবী এবং যাঁর সাথে বিপ্লবীদের সকলের পরিচয় ছিল। ১৯১০ সালে ধনগোপাল জাপান যান এবং সেখান থেকে স্বল্পকাল পরেই চলে যান সানফ্রান্সিসকোতে। ১৯১৬ সালে সেখান থেকেই প্রকাশিত হয় তাঁর দুটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ Sandhya, Songs of Twilight এবং Rajani or Songs of the Night। ১৯২৭ সালে Gay Neck, the Story of a Pigeon শিশুতোষ গ্রন্থের আমেরিকায় পুরস্কারপ্রাপ্ত সে লেখকের সাথে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের বিষয়টি স্পষ্ট হলেও ১৯১২ সালে কবির আমেরিকা ভ্রমণের সময় সে যোগাযোগ স্থাপনের কোন তথ্যসূত্র এখনও অনাবিষ্কৃত।

রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই যে আন্তর্জাতিক ঘটনাটি কবিকে ভীষণভাবে বিচলিত করেছিল সেটা হলো কোমাগাতা মারু জাহাজ প্রসঙ্গ। সে জাহাজে পাঞ্জাব থেকে একদল লোক তাদের সহায় সম্পত্তি বিক্রয় করে কানাডার উদ্দেশে পাড়ি জমায়। জাহাজে ৩৭৬ জন যাত্রীর ৩৪০ জন ছিলেন শিখ। নেতা ছিলেন বাবা গুরদিত সিং (১৮৬০-১৯৫৪)। কিন্তু কানাডা সরকার তাঁদের অনুপ্রবেশে আপত্তি তোলে। ১৯১৪ সালের ২৩ মে পৌঁছালেও ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে সে জাহাজ ভিড়তে পারেনি। এমনকি প্রয়োজনমত সামান্য পানি ও খাদ্যও সরবরাহ করা হয়নি। সবশেষে হুমকি দেওয়া হয় কামান দিয়ে জাহাজটি উড়িয়ে দেয়ার। আর তাই বাধ্য হয়ে সে জাহাজ ২৩ জুলাই ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ২৭ সেপ্টেম্বর কলকাতার খিদিরপুরে এসে থামে। ক্ষুধার্ত ও পরিশ্রান্ত সে জাহাজে যাত্রীদের উপর  ব্রিটিশ পুলিশ গুলি চালায়। নিহত হন ১৯ জন। কেউ কেউ পালাতে সক্ষম হলেও বিপুল সংখ্যক বন্দী হন পুলিশের হাতে। ভারতীয়দের প্রতি এই অসম্মানের প্রতিবাদেই কিন্তু দীর্ঘকাল রবীন্দ্রনাথ কানাডা ভ্রমণে যেতে অস্বীকৃতি জানান। এমন অস্বীকৃতি ছিল তাঁর অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের ব্যাপারেও। কোমাগাতা মারু জাহাজে সংঘটিত অমানবিক সে ঘটনা গদর পার্টিকে অধিক তৎপর  করে তুলেছিল সন্দেহ নেই।

সানফ্রান্সিসকোতে ৫ অক্টোবরের ঘটনা

১৯১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কবি আমেরিকার সিয়াটল বন্দরে গিয়ে নামেন। ৩০ সেপ্টেম্বর পৌঁছান সানফ্রান্সিসকোতে। আমেরিকায় যাওয়ার পথে জাপান ভ্রমণকালে কট্টর জাতীয়তাবাদের যে নিন্দা কবি  করেছিলেন তা প্রবাসী ভারতীয়দের নিকট সুখপ্রদ হয়নি ফলে শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের সাথে গদর পার্টির দ্বন্দ্ব। আমেরিকায় কবিকে স্বাগত জানাতে পারেননি গদর পার্টি ও এর মুখপত্র হিন্দুস্তান গদর-এর সম্পাদক রাম চন্দ্র। তাঁদের বক্তব্য ছিল কবির আমেরিকার যাত্রার উদ্দেশ্য হিন্দু বিপ্লবকে মন্থর করা। ২ অক্টোবর সেন্ট ফ্রান্সিস হোটেলে রবীন্দ্রনাথ এক বক্তৃতায় বলেন যে, মোগল সাম্রাজ্য এবং অন্যান্য সকল শাসকবর্গের তুলনায় ব্রিটিশ শাসক শ্রেয়। তিনি এমনও বলেন যে ‘ভারত স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রস্তুত নয়।‘ তাঁর এমন সব কথাবার্তা যেন আগুনে ঘি ঢালে। গদর পার্টি আপ্রাণ হলো রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা বন্ধ করার ব্যাপারে। খালসা দিওয়ান সোসাইটির প্রধান অধ্যাপক বিষেণ সিং মাট্টু তাঁর দুই সঙ্গী উমরাও সিং এবং পারদাম সিংকে নিয়ে হোটেলে রবীন্দ্রনাথকে বক্তৃতার দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে গেলে রাম চন্দ্রের দুই সহযোগি এক-হাত-কাটা জিওয়ান সিং ও এইচ সিং হাতেশি তাদের বাধা দেয়। বচসায় এক পর্যায়ে বিষেণ সিংয়ের পাগড়ী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাধাদানকারীদের পুলিশ গ্রেফতার করলে তাদের পরিচয় স্পষ্ট হয়। বিচারে যে অর্থদণ্ড হয় তাদের, সেটি পরিশোধ করেন রাম চন্দ্র।

১৯১৭ সালের ১৩ আগস্ট তাকোমা টাইমস্ পত্রিকায় প্রকাশিত পরিবারসহ রাম চন্দ্রের ছবি।

ঘটনাটি সাধারণ হলেও সংবাদপত্রে এর পরিণামটি ছিল অসাধারণ। ‘Tagore Visitor Hit by Hindus’ থেকে শুরু করে ‘Plot Against Hindu Poet’ বহু কিছু হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ শহর থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন এমন সংবাদও ছাপা হয়েছিল ‘Hindu Poet Flees from Reported Assassination Plot’। সমীর জানিয়েছেন ০৬ অক্টোবর ২২টি পত্রিকায় বিভিন্নভাবে আগের দিনের ঘটনাটি বহু রঙ চড়িয়ে প্রকাশিত হয়।

পত্র-পত্রিকায় হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা সংবাদ

১৯১৭ সালের ৫ জানুয়ারি শিকাগোর The Day Book পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘WOMEN CHAMPIONS OF HINDU/COUSE INTERNED BY BRITISH’ প্রতিবেদক ছিলেন হিন্দুস্তান গদর পত্রিকার সম্পাদক রাম চন্দ্র। হিন্দু বিপ্লবে আগ্রহী নারীরা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের দ্বারা আটক ও জেরার সম্মুখীন হচ্ছেন তা নিয়ে রাম চন্দ্রের এ প্রতিবেদন। আরো জানানো হয়েছে কলকাতা ও বোম্বের (মুম্বাই) শিক্ষিত ও ধনী অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত নারী কর্মীরাও এমন ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে প্যারিস থেকে প্রকাশিত বন্দেমাতরম পত্রিকার সম্পাদিকা মাদাম বি কমাকে প্যারিসে ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধে জেরা করার কথা। এ সংবাদটি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রাম চন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে সাহায্য করবে বলে বর্তমান প্রবন্ধে আমরা উল্লেখ করলাম।

৮ মার্চ তারিখে New York Tribune লিখেছিল ‘U.S Jury Sifting India Plot to Get Von Igel’s Papers’। অভিযুক্ত হিসেবে যাদের নাম ছাপা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ডা. চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী (১৮৭৭-১৯৭১)। বলা হয়েছে চন্দ্র নিয়মিত রাম চন্দ্রের নিকট সংবাদ পাঠাতেন। দীর্ঘ সংবাদটির নিচে আরো একটি সম্পর্কযুক্ত সংবাদ হলো  ‘German Plots to Aid Revolutions in India known at Washington’। একই তারিখে  The day book পত্রিকাটি সংবাদ  ছেপেছিল ‘Sun Fransisco Hindus plant Revolution’ শিরোনামে। বলা হয়েছিল দুই মাস তদন্ত শেষে প্রমাণিত হয়েছে যে সানফ্রান্সিসকোতে বসবাসরত হিন্দুদের ইন্ধনে চিনের সহযোগিতায় সারা ভারত জুড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশ দখলের ষড়যন্ত্র চলছে। United States Dis’t Att’n জন ডব্লিউ পেস্টন বলেছেন যে Hindustan Gadar-এর সম্পাদক এমন একটি  বিষয়ে জ্ঞাত। তিনি আরো বলেন যে নিউইয়র্কে গিয়ে ষড়যন্ত্রের উন্মোচন ঘটেছিল সেটির সাথে এটির কোনো সম্পর্ক আছে কি না তা জানা যায়নি। যদিও রাম চন্দ্র এমন ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন।  ৯ মার্চ তারিখেও একই সংবাদ পরিবেশন  করা হয় পত্রিকাটিতে।

এক মাস পর ৮ এপ্রিল Daily Missourian পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয় রাম চন্দ্রকে আটক করা নিয়ে। বলা হয়েছে মোট নয় জনকে আটক করেছে পুলিশ। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভারতের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনায় দোষী আটককৃত ব্যক্তিরা বিচারের মুখোমুখি হবেন। তিন মাস পর ১৩ জুলাই Ogden Standard পত্রিকায় এ বিষয়েও সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘HINDU CONSPIRATOR BROUGHT/TO OGDEN AND HIS HEARING/ SET BY JUDGE W. H. REEDER’। প্রতিবেদনটিতে চারটি অংশ ছিল। পরবর্তী তিনটি ছোট ছোট উপশিরোনাম ছিল ‘Planned Mutiny Concord’, ‘Denies Part in Plot’, ‘Had Charge of Farm’ এবং ‘Two other Prisoners’। যে ষড়যন্ত্রকারী এখানে আটক তাঁর নাম মুন্সী রাম বা মুঙ্গা রাম। মুঙ্গা রাম আদালতে তাঁর যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো তিনি হিন্দু বিপ্লবী  নেতা রাম চন্দ্রের নির্দেশে প্রথমে লস এঞ্জেলেস ও পরে দক্ষিণ কালির্ফোনিয়াতে ষড়যন্ত্র বিস্তারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এক মাস পর ১৩ আগস্ট তারিখে Tacoma Times পত্রিকায় রাম চন্দ্রের স্ত্রী ও আঠারো মাস বয়সী শিশু কন্যাসহ ছবি ছাপানো হয়। শিরোনাম ছিল Hindu Editor In Jail, Denied/ Chance to See New Baby Girl’। জেলখানায় যাবার পর রাম চন্দ্রের স্ত্রী যে শিশু সন্তান প্রসব করেছেন তাকে দেখতে জেলের বাইরে যাওয়ার জন্য রাম চন্দ্রের আপ্রাণ চেষ্টার কথা বলা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। ২৬ ডিসেম্বর Ogden Standard পত্রিকা ‘H’ নামে আটককৃত জার্মান গুপ্তচরকে নিয়ে এক সংবাদ  ছাপে। সে সংবাদটিতে উল্লেখ ছিল ‘H’-এর উদ্দেশ্য ছিল রাম চন্দ্রের সাথে সাক্ষাৎ করা।

হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলায় ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৮ তে প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন-এ রবীন্দ্রনাথের নামটি যুক্ত হয়ে যায়

১৯১৮ সালের ১০ জানুয়ারি নিউইয়র্ক ট্রিবিউন ‘Hindu Plot Witness Brings in Braun’ শিরোনামে লেখে যে চিন থেকে দশ লাখ রাইফেল ক্রয়ের সাথে জড়িতদের মধ্যে আটককৃতদের একজনের সে সংবাদ। ২৫ ফেব্রুয়ারিতে একই পত্রিকায় ‘Goldman Worked with German Spy, Letters Indicate’ শিরোনামের সংবাদে ‘Letters Made Public’ উপশিরোনামে জানানো হয়েছে সানফ্রান্সিসকো থেকে প্রকাশিত ‘Ghadr’ নামের যে পত্রিকাটির বর্তমান সম্পাদক রাম চন্দ্রের সেটির প্রতিষ্ঠাতা হরদয়াল। আরো জানানো হয় ১৯১৪ সাল থেকে বার্লিনে রয়েছেন এবং জার্মান বিদেশী দূতাবাসের সহযোগিতায় বিদ্রোহ সংগঠনের চেষ্টা করছেন। পত্রিকাটি ২৬ অক্টোবর তারিখে লেখা একটি চিঠি ছেপে দিয়েছে যাতে হরদয়াল জার্মানিতে বিপ্লবের সহযোগিতার জন্য লোক চেয়েছেন। পরের মাসে ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘El Paso Herald’ পত্রিকাটি ব্যানার হেডিং করে লেখে ‘LANCING TO TESTIFY IN HINDU PLOT’। যদিও সংবাদটি ডানদিকে মাত্র দুই  কলামে ছাপা হয়েছিল। প্রতিবেদনের একটি উপশিরোনাম ছিল ‘Tagore’s Testimony’। তখন জাপান ভ্রমণরত রবীন্দ্রনাথ ‘Testimony’ করতে গিয়ে আমেরিকাতে যাবেন স্বীকারোক্তিতে এমন  কথা বলেছিলেন রাম চন্দ্র। আর এভাবেই ক্রমে ক্রমে রবীন্দ্রনাথের নামটি হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা বা গদর বিদ্রোহের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। পরদিন ২৬ ফেব্রয়ারি Democratic Banner ৩১ জন বন্দির মুক্তির  ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট উইলসনের কেবিনেটের দু’জন সদস্য ও নোবেল জয়ী কবি রবীন্দ্রনাথকে ডাকা হবে বলে সংবাদটিতে উল্লেখ করা হয়। একই তারিখে নিউইয়র্ক ট্রিবিউনও অনুরূপ সংবাদ ছাপে।

দুইদিন পরেই ২৮ ফেব্রুয়ারির সংবাদে বোমা ফাটল যেন। নিউইয়র্ক ট্রিবিউন লিখলো ‘Tagore Named with Japanese at Plot Trial’। উপশিরোনাম হিসেবে এল ‘Ocuma and Terauchi Figure in Hindu Correspondence’ উল্লেখ করে বলা হলো যে সরকার কর্তৃক গোপন নথিপত্রের ভিত্তিতে এটি দাবি করা হয় যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি, তার আগের প্রধানমন্ত্রী কাউন্ট ওকুমা এবং রবীন্দ্রনাথের সাথে ভারতীয় ষড়যন্ত্রীদের যোগাযোগ রয়েছে। দীর্ঘ সে সংবাদের একটি ছায়া সংবাদ প্রকাশিত হয় ১ মার্চ তারিখে Interior Journal পত্রিকায়। ১৯ মার্চ তারিখে ‘Two German Plots Exposed’ শিরোনামের সংবাদে একটি অংশ হলো ’ Two Arrests in Second Gmp’। আটককৃতদের মধ্যে শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষের নাম এসেছে। সে সময় নিউইয়র্ক ট্রিবিউন পত্রিকায় রবীন্দ্র বিরোধিতা এমন তীব্র পর্যায়ে পৌঁছায় যে ২২ মার্চ তারিখে মিসেস লুই এস ফিলিম্যান নামের এক ভদ্র মহিলার সংসার ভাঙার জন্য দায়ী করা হয় রবীন্দ্রনাথকে। স্বামীর অভিযোগ তার স্ত্রী দিনরাত রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে তুলে তুলে কথা বলেন। ২৮ মার্চে দুটি সংবাদ ছাপা হয় ‘Hindu Ploters had Two Marked for Death Here এবং Hindu on Trial Gets many Death Threats, He Admits to Police’ শিরোনামে এখানে ‘He’ হলেন চন্দ্রকে চক্রবর্তী। Evening Public Ledger ২ এপ্রিল তারিখে ছেপেছে ‘US INDICTS AMERICAN GIRLS AND FIVE HINDUS‘। নাম এসেছে পুলিন বি বোস, তারকনাথ দাস, যদুগোপাল মুখার্জি এবং ভগবান সিঙের। ২৪ এপ্রিল নিউইয়র্ক ট্রিবিউন-এ প্রকাশিত ‘Hindu Kills and Skilled at Plot Trail’ শিরোনামটি চমকে দেওয়ার মতো। ১৩ এপ্রিল ছিল ষড়যন্ত্র মামলার রায় ঘোষণার দিন। ঘোষণার পর যখন দর্শকরা বেরুচ্ছিলেন এবং অভিযুক্তদের মধ্যে রাম চন্দ্র অস্থিরভাবে বিচরণ করছিলেন, রাম সিং পিস্তল বের করে রাম চন্দ্রকে গুলি করে এবং এতে তাৎক্ষণিকভাবে তার মৃত্যু হয় যদিও কোর্টে দায়িত্বরত অস্ত্র বহনকারী কর্মকর্তা (মার্শাল) মুহূর্তেই পিস্তলের গুলিতে ভূপতিত করেন রাম সিঙকে। ভয়াবহ উত্তেজনা সৃষ্টিকারী দিনটি নিয়ে ২৮ এপ্রিল নিউইয়ক ট্রিবিউন পৃষ্ঠাজোড়া সংবাদ ছাপে। শিরোনাম দেয় HINDU PAWNS LOST IN KAISER’S GAME OF EMPIRE। প্রতিবেদকের নাম L. J. D. BEKKER। আধা পৃষ্ঠাজোড়া সংবাদের মাঝে ছয়টি ছবি ছিল যাদের একটি হলো রাম চন্দ্রের, আরেকটি রাম চন্দ্রের হত্যাকারী রাম সিঙের। ২৩ এপ্রিল সানফ্রান্সিসকো কোর্টে রাম চন্দ্রের হত্যাকাণ্ডসহ পুরো বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ এ প্রতিবেদন।

ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেতে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগ

আমরা দেখেছি ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এসে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলায় রবীন্দ্রনাথের নামটি যুক্ত হয়ে যায়। যুক্ত করার পেছনের মানুষটি ছিলেন চন্দ্রকান্ত। ভারতে বিপ্লব চালনার জন্য তিনি জার্মানি থেকে আর্থিক সহায়তা পেতেন। ১৯১৬ সালে ২১ নভেম্বর এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন ‘Rabindranath has come at our suggestion and saw Count Okuma, Baron Shrimpei Goto, Massaburo Suzuki, Marquis Yamanuchi, Count Terauchi and others. Terauchi is favourable and others are sympathetic.’ পরবর্তীকালে ১৯১৭ সালে গদর পার্টি বার্লিন কমিটিকে তিনি লিখেছিলেন যে ‘Rabindranath Tagore thinks, if he now goes to Sweden, he may be suspected and his usefulness curtailed. His intention is to hasten home and do whatever he can. …We have given him 12,000 dollars.’। চিঠি দুটির অংশ দুটি আমরা প্রশান্তকুমার পালের রবিজীবনীর সপ্তম খণ্ড থেকে (পৃ. ৩৪২) উৎকলন করলাম। নিজের নাম যুক্ত হওয়ার কথা রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ১১ মে দিল্লী থেকে এ্যনড্রুজ ফিরে আসেন এই সংবাদ নিয়ে। যদিও ততদিনে মামলাটির রায় ঘোষিত হয়ে গেছে। ১১ মে তারিখে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের (১৮৫৬-১৯২৪) নিকট একটি চিঠি পাঠান। চিঠিটি পৌঁছাতে দেরি হবে বিবেচনা করে একটি টেলিগ্রামও পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। টেলিগ্রামে লেখা ছিল ‘Newspapers received concerning conspiracy trial San Francisco wherein prosecution counsel implicated me. I claim from you and your country protection against such lying calumny.’।  অনেক দর কষাকষির পর ১৭ জুন তারিখে ভারতবর্ষের ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড চেমসফোর্ড-এর ব্যক্তিগত সচিব রবীন্দ্রনাথকে একটি সহমর্মিতামূলক টেলিগ্রাম পাঠান যাতে লেখা ছিল যে আমেরিকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত ‘Unwarrantable Prominence’-এর সাথে রবীন্দ্রনাথের নাম যুক্ত থাকায় তিনি দুঃখ  প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন যে এ সংবাদের কোন ভিত্তি নেই। তিনি এও বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজন মনে করলে এ চিঠির কপি ব্যবহার করতে পারেন।

২৮ এপ্রিল ১৯১৮ তে প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন-এ ১৩ এপ্রিল ষড়যন্ত্র মামলার রায় ঘোষণার পরের ঘটনা নিয়ে সংবাদ যাতে রাম সিং-এর পিস্তলের গুলিতে রাম চন্দ্র এবং কোর্টে দায়িত্বরত অস্ত্র বহনকারী কর্মকর্তার (মার্শাল) পিস্তলের গুলিতে নিহত রাম সিং-এর ছবি-সহ পৃষ্ঠাব্যাপী সংবাদ প্রকাশিত হয়।

১৯১৭ সালের ২০ নভেম্বর শুরু সে মামলার ৩২ জন আসামীর মধ্যে ২৯ জন কম বেশি মেয়াদে সাজা পান। কোর্ট প্রাঙ্গণে মৃত্যু হয় দু’জনার। আর একজন বেকসুর খালাস পান। যদিও মামলার রায় হলেও রবীন্দ্রনাথ মুক্তি পাননি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযুক্তি থেকে। রায় ঘোষণার চার মাস পর ১৬ আগস্ট কোর্টের বরাত দিয়ে Ocean Standard পত্রিকাটি লেখে ‘Woman Attorney Exonerates Tagore।‘ জানানো হয় ষড়যন্ত্রে রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ ছিল একটি দুর্ঘটনা মাত্র। পত্রিকাটির ভাষায়: ‘Tagore was mentioned incidentally in the letters of the conspirators as having favoured a change in the Indian government. There was no evidence of any sort against him and any connection he may have had with the conspirators was entirely innocent of wrong doing.’ ১৯১৮ সালের ১৭ আগস্ট তারিখে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ‘Tagore Maintains Loyalty / Offers Letter  From Indian / Governor to Disprove Plot. ‘

ষড়যন্ত্র মামলায় নিজের নাম যুক্ত হয়ে পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হওয়ায় ১৯১৮ সালে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব পরিকল্পিত আমেরিকার সফর বাতিল করতে বাধ্য হন। তৃতীয়বার যখন তিনি আমেরিকা যাত্রা করলেন ততদিনে দুই বছর পার হয়ে গেছে। ১৯২০ সালে ২৮ অক্টোবর পুনশ্চ তাঁর আমেরিকা পদার্পণ। কিন্তু ইতোমধ্যে বদলে গেছে অনেক কিছু। ১৯১৬ সালে তাঁকে নিয়ে মাতামাতিতে ব্যস্ত যে আমেরিকা তিনি রেখে এসেছিলেন জীবনের বাকি ২০ বছরেও আমেরিকা থেকে সে উষ্ণতা তাঁর আর ফিরে আসেনি। আর ১৯২৯ সালে কানাডা থেকে যখন আমেরিকায় রওনা হওয়ার পথে তাঁর পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটল তখন তো পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষ নোবেল জয়ী কবিকে চূড়ান্ত অপমান  করতেও সামান্য দ্বিধা করেননি।

সুব্রত কুমার দাস

২০১৩ সাল থেকে কানাডার টরন্টোতে সপরিবার অভিবাসী সুব্রত কুমার দাসের জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কামারখালীতে; ১৯৬৪ সালের ৪ মার্চ। ২০১৮ সালে তিনি আমেরিকার নিউ জার্সি শহর থেকে গায়ত্রী গ্যামার্স মেমোরিয়াল পুরস্কার লাভ করেন। ২০২৩ সালে ব্রাম্পটন শহরে আয়োজিত কানাডার দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসবে তিনি কানাডার শ্রেষ্ঠ বাঙালি লেখকের পুরস্কার লাভ করেন। ২০২১ সালে কানাডার শীর্ষ ২৫ অভিবাসী পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত প্রার্থী তালিকায় উঠে এসেছিল সুব্রত কুমার দাসের নাম। কানাডায় বসবাসকারী বাঙালি লেখকদের নিয়ে সুব্রতর সাম্প্রতিক উদ্যোগ কানাডা জার্নাল (https://www.c-j.ca/)।

কানাডার মূলধারার লেখকদের সাথে বাঙালি লেখকদের সেতুবন্ধ রচনায় সুব্রত কুমার দাসের অবদান বিশেষভাবে উচ্চারিত। ২০২০, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে  তিনি টরন্টো ইন্টারন্যশনাল ফেস্টিভ্যাল অব অথরস (টিফা)-তে অংশ নেন এবং কানাডাবাসী বাঙালি কবি-লেখকদের নেতৃত্ব দেন।

২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে ওয়েবসাইট বাংলাদেশি নভেলস্ (https://bdnovels.org/) নিয়ে কাজ করে চলেছেন। ১৯৯২ সাল থেকে লেখালেখির সাথে যুক্ত সুব্রত’র গ্রন্থসংখ্যা একত্রিশ।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন