য়োহান ভোল্ফগ্যাং ফন গোয়েটে এবং হাইনরিখ হাইনে (Heinrich Heine), এই দুই চিরস্মরণীয় জার্মান কবির প্রতি রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভাবে অনুরক্ত ছিলেন। ‘ছিন্নপত্রাবলী’র একাধিক স্থানে রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করেছেন গোয়েটেকে; তিনি অনুবাদ করেছেন গোয়েটে ও ফ্রিডরিশ শিলারের যৌথ সৃষ্টি ‘উপহার’ (তীক্ষ্ণ, ক্ষুদ্র কবিতার সমাহার), এবং কবির বয়স যখন মাত্র সতেরো তখনই তিনি ‘ভারতী’ পত্রিকায় লিখেছিলেন সেই বহুপঠিত নিবন্ধ ‘গেটে ও তাঁহার প্রণয়নীগণ’। এমনকী, গোয়েটের নাট্যকাব্য ‘ফাউস্ট’-এর প্রকৃত সৌন্দর্য আস্বাদনের জন্য তিনি মূল জার্মান রচনাটি পড়তে উদ্যোগী হন। ১৯২৪-এ, পিকিং-এ একটি ভাষণে রবীন্দ্রনাথ অকপট স্বীকারোক্তি করেন, ‘‘আমার স্বল্প জার্মানজ্ঞানের সাহায্যে আমি গোয়েটে-পাঠে প্রবৃত্ত হই। ‘ফাউস্ট’-ও পড়ে ফেলি… (কিন্তু) গোয়েটেকে আমি আত্মস্থ করতে পারিনি। একই অর্থে আরও অনেক জ্যোতিষ্ক আমার কাছে অনালোকিত রয়ে গেছে।’’
নাট্যকাব্য ‘ফাউস্ট’-এর দুরূহতার পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথ যদি প্রথমে নিমগ্ন হতেন গোয়েটের গীতিকবিতার সারল্যে, তাঁর প্রতিক্রিয়া কি ভিন্ন হত? এই প্রশ্নটি উঠে আসে যখন আমরা তুলনা করি হাইনরিখ হাইনের কবিতাকে ঘিরে তাঁর অনাবিল উচ্ছ্বাস। পিকিং-এ দেওয়া সেই একই ভাষণে, তাই হাইনে-পাঠ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘বরাবর আমি জার্মান সাহিত্যের পাঠক হতে চেয়েছি এবং অনুবাদে হাইনের কবিতা পড়ে আমার মনে হয় যে, তাঁর সৃষ্টির সৌন্দর্য্যের আভাস আমি পেয়েছি। সৌভাগ্যবশত আমার আলাপ হয় এক জার্মান যাজিকার সঙ্গে এবং আমি তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করি। বেশ কয়েক মাস আমি পরিশ্রম করি… আর আমার শিক্ষক ভাবতে শুরু করেন যে, আমি জার্মান ভাষাটি আয়ত্ত করেছি। এই বিচার সত্য নয়। তা সত্ত্বেও আমি হাইনের কাব্যরাজ্যে পরিভ্রমণ করি সহজে, অনায়াসে। অনেকটা নিদ্রিত মানুষের স্বপ্নযাত্রার মতো অজানা পথ বেয়ে। সর্বোপরি আমি দারুণ আনন্দলাভ করি।’’
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, হাইনের কবিতাপাঠ যেন নিবিড় নিদ্রাপর্বে স্বপ্নাবিষ্টের পথপরিক্রমা, অলক্ষ্যে-অজান্তে যেন ঘুমঘোরে তাঁর লিরিক পাঠককে আচ্ছন্ন করে। সেই আবেশের পর্বেই কবি আলোকিত হয়ে ওঠেন। প্রসঙ্গত, হাইনে গোয়েটেপাঠ শুরু করেছিলেন গীতিকবিতার হাত ধরে।
১৮৯২ সালের বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ মূল জার্মান থেকে হাইনের ন’টি কবিতা অনুবাদ করেন। ‘বুখ ড্যের লিডার’ বা গীতিগ্রন্থের বিভিন্ন পর্বে সংকলিত এই ন’টি কবিতার ভাষান্তরে প্রকাশ পেয়েছে মূলের সেই রোমান্টিক আর্তি, হরষ-বিষাদ-প্রেম-বিরহ। লক্ষণীয়, আক্ষরিক অনুবাদের শৃঙ্খল ছিন্ন করে রবীন্দ্রনাথ মূলানুগত থেকেও সৃষ্টি করেন স্বতন্ত্র এক-একটি লিরিক। যখন তাঁর তর্জমা পড়ি
আঁখি পানে যবে আঁখি তুলি,
দুখজ্বালা সব যাই ভুলি
অধরে অধর পরশিয়া
প্রাণ মন ওঠে হরষিয়া!
মাথা রাখি যবে ঐ বুকে
ডুবে যাই আমি মহাসুখে,
যবে বল তুমি, ‘ভালবাসি’,
শুনে শুধু আঁখি জলে ভাসি।
তখন হাইনে আলোকিত হয়ে ওঠেন সার্থক অনুবাদের সহজ নিবিড়তায়। অন্য দিকে, রবীন্দ্রনাথই হাইনের সৃষ্টির ভিন্ন সম্পদ, তাঁর তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবোধ, শ্লেষ এবং পরিহাসপ্রিয়তা লক্ষ করতে ভোলেননি। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এই মূল্যায়নের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছেন, ‘‘ভারতীয় চেতনাকে নিয়ে কবির লঘুগুরু মনোভঙ্গি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথই ধরতে পেরেছিলেন।’’
তাই রাজা বিশ্বামিত্র সম্পর্কে হাইনের ক্ষুদ্র কবিতাও রবীন্দ্রনাথের ভাষান্তরের অংশ
বিশ্বামিত্র তোমার মতো গরু
দুটি এমন দেখিনি বিশ্বে!
নইলে একটি গাভী পাবার তরে
এত যুদ্ধ এত তপিস্যে!।
রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে যে হাইনে-বর্ণনার শুরু, তা-ই গত একশো বছরে বহু কবির প্রয়াসে পরিপুষ্ট হয়ে এক বর্ণাঢ্য প্রবাদে পরিণত। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, মোহিতলাল মজুমদার, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এমনকী অজ্ঞাত অনুবাদকেরাও বারবার ফিরে গেছেন তাঁর কবিতায়। এই প্রচেষ্টার ফসল অন্তত ছ’টি স্বতন্ত্র অনুবাদ সংকলন, যার প্রথমটি ‘হাইনের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১-তে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায়। এই ‘(fine excees)’ বা ‘সুচারু আধিক্য’ দেখে দাবি জানাতে ইচ্ছা করে, ‘‘অন্য কোনও ইউরোপীও কবি, সম্ভবত বের্টল্ট ব্রেখট ছাড়া এত ভালবাসা অর্জন করেনি এই বঙ্গভূমিতে।’’ বিষ্ণু দে এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হাইনে-প্রেম প্রত্যাশিত। কিছুটা বিস্মিত হই, যখন দেখি স্তেফান মালার্মের ভিন্ন কাব্যাদর্শের প্রতি অনুগত স্বয়ং সুধীন্দ্রনাথ তাঁর অনুবাদ সংকলন ‘প্রতিধ্বনি’-তে হাইনের ষোলটি কবিতাকে স্থান দিয়েছেন, যেখানে প্রিয় মালার্মের কবিতার সংখ্যা ছয়। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নাবেশ ধ্রুপদী সুধীন্দ্রনাথকে অনুপ্রাণিত করেনি। তাঁর কথিত ‘নিরন্তর সংশোধনের ফলেই’ মহাকবিদের ‘প্রতিধ্বনি’গুলি আবার বেজে উঠেছে, যার একটি অনবদ্য দৃষ্টান্ত হাইনের ‘অবিশ্বাসী’ কবিতাটির অনুবাদ
পাব আমি আজ তোমাকে আলিঙ্গনে!
সুখের উৎস, অবরোধ টুটে,
বারে বারে তাই বুকে নেচে উঠে;
তাই বিমোহন স্বপনের রং ধরেছে মনে;
সত্য পাব কি তোমাকে আলিঙ্গনে?
বাংলার কবিরা ভারতকে ঘিরে হাইনের স্বপ্ন -কল্পনা- ভালবাসার প্রত্যুত্তর জানিয়েছেন অকৃপণ অনুবাদ-চর্চায়। একাধিক কবিতাতে হাইনের এই ভারতপ্রেম মন্দ্রিত, আর তাঁর গদ্যগ্রন্থ ‘আইডিয়াস বুক ল গ্রঁদ’-এর পঞ্চম পরিচ্ছেদে আমাদের দেশের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপন করে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমি গঙ্গার অধিপতি নই, কলকাতায়ও কোনোদিন যাইনি… তবু আমার প্রপিতামহরা এসেছেন হিন্দুস্তান থেকেই … আমার এমনও মনে হয় যে সমগ্র মহাভারত আসলে একটি রূপকাশ্রয়ী প্রেমপত্র, লিখেছেন আমার প্রপিতামহ আমার প্রপিতামহীকে।’’
রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরিরা হাইনের প্রতিবাদী কবিসত্তার স্বরূপটিকেও সম্মানজ্ঞাপন করেছেন বারংবার। কোনও রকম ভণিতা না করে কার্ল মার্ক্সের বন্ধু হাইনে ঘোষণা করেছিলেন ১৯২৮-এ লেখা ভ্রমণবৃত্তান্তে, ‘‘কাব্যমহিমাকে আমি কোনোদিন বেশি মূল্য দিইনি। আমার গানগুলো লোকে ভাল বলুক বা মন্দ বলুক তাতে আমার কিছু এসে যায় না। কিন্তু আমার শবদেহের ওপর একটি তরবারি রেখো, কারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধে আমি বরাবর একজন ভাল সৈনিক ছিলাম।’’ হাইনের অক্ষয় শোষণমুক্তির কবিতা ‘সাইলেসিয়ার তাঁতী’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস এবং তার পর ‘জার্মানিতে কমিউনিজম’ গ্রন্থে তিনি লেখেন, ‘‘জীবিত জার্মান কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হাইনে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তাঁর এই কবিতাটির শক্তি অসাধারণ।’’ হাইন আর এঙ্গেলসের যৌথ প্রেরণায় ‘সাইলেসিয়ার তাঁতী’র তিনটি বাংলা ভাষান্তর হয়েছে, হয়তো আরও হবে। মণীন্দ্র রায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, দেবতোষ বসুর অনুবাদে কবিদের নিজস্ব শৈলী অতিক্রম করে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে নির্যাতনের অভিন্ন বাস্তব
মাকু চলে আর কেঁপে ওঠে তাঁত
দুঃখের শিরা বুনে চলি দিনরাত;
পুরনো দিনের বুড়ো জার্মানি
মৃতদেহ ঐ ঢাকতে কেমন কফিন বুনছি আজ
— মণীন্দ্র রায়।
এ ভাবেই আমাদের কবিরা বেছে নিয়েছেন হাইনের কবিতা, এক-একটি কবিতার একাধিক অনুবাদ উদ্ঘাটন করেছেন প্রতিধ্বনির অভিন্নতা আর বৈচিত্র। আজ যখন এই শতবর্ষ দীর্ঘ প্রচেষ্টার মূল্যায়নে সচেষ্ট হই, লক্ষ করি যে আমাদের কবিরা হাইনের কাব্যপ্রতিভার তিনটি দিকের প্রতি সমান যত্নবান। তাঁর রোমান্টিক তন্ময়তা, ব্যঙ্গঋদ্ধ মনোভঙ্গি আর প্রতিবাদী দীপ্তি, এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই ভাস্বর হয়ে উঠেছে অক্লান্ত ভাষান্তরে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেখানে দাবি করেছেন, ‘‘প্রেমের এমন আহত মুখশ্রী পেত্রার্কার পরে আর দেখা যায়নি,’’ অলোকরঞ্জন সেখানে এই বিয়োগান্ত প্রেমেরই মাধ্যমে পৌঁছে যান হাইনের রাজনৈতিক অঙ্গীকারে। যে-হাইনে বালি- ভরা বার্লিন ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন রৌদ্রদীপ্ত ভারতের সাধনায়, সে ভারতের একটি রাজ্যে তাঁকে ঘিরে এই ভালবাসা প্রাচ্য-প্রতীচ্যকে নিঃসন্দেহে একাত্ম করে, প্রার্থিত ও বিকল্প বিশ্বায়নের মন্ত্রে।