বুধবার | ২৩শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১০:৫৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
সই বা বন্ধুত্ব স্থাপনের উৎসব সয়লা : রিঙ্কি সামন্ত প্রথম পাঠ — “নিশিপালনের প্রহরে” নিয়ে, দুয়েকটি কথা : সোনালি চন্দ বৃহন্নলার অন্তরসত্তা : নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী দুই দশক : শৈলেন মান্না ভরা বর্ষায় জলপ্রপাতের মুখোমুখি… : বিদিশি বসু দামোদর মাউজো-এর অনুবাদ গল্প ‘হরতাল’ বঙ্গে কুবেরের পূজা : অসিত দাস বাংলা সাহিত্যের দেবতারদের দেখা মেলে ওই ঘরেই : অশোক মজুমদার মালবাণকে ছুঁয়ে রূপোলী সমুদ্রসৈকতে : নন্দিনী অধিকরী মার্ক্সবাদ, মনোবিশ্লেষণ এবং বাস্তবতা : এরিক ফ্রম, অনুবাদ ফাতিন ইশরাক সাহিত্যের প্রাণপ্রবাহে নদী : মিল্টন বিশ্বাস এবার দুর্গা পুজোকেও ছাপিয়ে গেল রানাবাঁধের লক্ষ্মীপুজো : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় দেড় হাজার বছর প্রাচীন ঘোষগ্রামের লক্ষীকথা : রিঙ্কি সমন্ত হুতোমের সময় কলকাতার দুর্গোৎসব : অসিত দাস নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘বৈতালিক’ কোজাগরীর প্রার্থনা, বাঙালির লক্ষ্মীলাভ হোক : সন্দীপন বিশ্বাস তারকেশ্বর-বিষ্ণুপুর রেল প্রকল্পের কাজ ভাবাদিঘিতে ফের জোর করে বন্ধ করা হলো : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর — অনেক বিদ্যাসাগর মাঝে তিনি একক : প্রলয় চক্রবর্তী আমেরিকা-ইসরায়েল সম্পর্কের শেকড় অনুবাদ ফাতিন ইশরাক নিয়ম নীতি আচারে লক্ষ্মী পূজার তোড়জোড় : রিঙ্কি সামন্ত আমার প্রথম বই — ঘুণপোকা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘কে জাগ রে’ জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন একটি বিপ্রলম্ভের কবিতা : প্রসেনজিৎ দাস আন্দোলন ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই : তপন মল্লিক চৌধুরী রেখা দাঁ ও বিজ্ঞান আন্দোলন : দীপাঞ্জন দে বাংলা উপন্যাসে নিম্নবর্গ : মিল্টন বিশ্বাস বদলে যাওয়ার অসুখ : বিষ্ণু সরকার বিবেকের মুখ : পার্থ রায় কল্লোলের কাল : তপন মল্লিক চৌধুরী দশমীর বিকেল, জলঙ্গী নদীতীরে মেলবন্ধনের আনন্দমুখর ছবি : অমৃতাভ দে
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই মহাঅষ্টমীর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

দামোদর মাউজো-এর অনুবাদ গল্প ‘হরতাল’

দামোদর মাউজো / ৩৮ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৪

আমি অনেকগুলো হরতাল দেখেছি। অনেক অনেক। সেই বন্ধ, সেই ষ্ট্রাইক। কিন্তু এমনটি আর দেখিনি।’’ কথাটা বলতে বলতে রাগে গজগজ করতে করতে দত্তারাম মোটরসাইকেলটাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাড়ির সামনে, একদম দোড়গোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল। তার পর বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। বাড়িতে ঢুকে জামাকাপড় না ছেড়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল।

আগে যত সব হরতাল বা বন্ধ হয়েছে তখন বাস, গাড়ি, লরি, ট্যাক্সি এ সব চলেনি। কিন্তু মোটরসাইকেল চলেছে। মোটরসাইকেলকে কেউ বাধা দেয়নি। গত বছর সেই সাধারণ ধর্মঘটের দিন মোটরসাইকেল চালিয়ে পেছনে লোক বসিয়ে আধবেলাতেও দত্তারাম প্রায় একশো সত্তর টাকা কামিয়ে নিয়েছে। এ বারে সব কিছু অন্য রকম। অনেক বিধিনিষেধ। কিচ্ছু চলবে না। এমনকী মোটরসাইকেলও না।

আজকে মোটরসাইকেলটা একটু আগে আগে বের করল দত্তারাম। অন্যান্য দিনের চাইতে একটু আগেই। বাড়ির সামনে কাঁচারাস্তার এক পাশে লম্বা লম্বা বাঁশ ফেলে রাখা হয়েছে। মাঝখানে রাস্তা জুড়ে লম্বা লম্বা আরও বেশ কয়েকটা বাঁশ। এ সব দেখে দত্তারাম পরোয়াই করল না। দত্তারামের মতো মোটরসাইকেল চালকের কাছে এ সব নস্যি। সে মোটর সাইকেলটাকে ধীরে ধীরে বাঁশগুলোর পাশ দিয়ে এক চিলতে ফাঁকা জায়গা দিয়ে গলিয়ে দিল। তার পর নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ দিল।

মোটরসাইকেলটা আস্তে আস্তে চালিয়ে নিয়ে পিচের রাস্তার ওপর এসে দাঁড়াল। পিচের রাস্তাটার ওপর সিটান, পিটার আর সুরেশ আড্ডা মারছিল।

সিটান জিজ্ঞেস করল, ‘‘কোথায় যাচ্ছিস, দত্তারাম?’’

‘‘মারগাঁও,’’ বলল দত্তারাম।

দত্তারাম ভাবল সিটান বোধহয় ওর সঙ্গে কোথাও যেতে চাইছে। হয়তো লিফ্ট চাইছে। কিন্তু পিটার কী করে যাবে। কী করে সম্ভব সেটা। তিন জনে একসঙ্গে একটা মোটরসাইকেলে! সিটান যেতে পারে। কিন্তু….। না। পিটারকে নেওয়া যাবে না। সম্ভব নয়।

দত্তারামের ভাবনা হোঁচট খেল। হঠাৎই সিটান বলল, ‘‘তুই জানিস না আজ হরতাল। আজ বন্ধ?’’

‘‘জানি। কিন্তু মোটরসাইকেল কে আটকাবে! মোটরসাইকেল তো মুক্ত পাখি,’’ বলল দত্তারাম।

‘‘না, আজ সব বন্ধ। এমনকী মোটরসাইকেলও। এবারকার হরতাল মাতৃভাষার জন্য। মাতৃভাষার জন্য লড়াই, প্রতিবাদ। এবারকার হরতাল অন্য রকম,’’ বলল সুরেশ।

‘‘কিন্তু এটা তো আমার নিত্য রুজি-রোজগারের ব্যাপার! আমি রোজ আনি রোজ খাই। আমায় যেতে দে,’’ বলল দত্তারাম।

সিটানের মুখের ভাবটা ছিল অন্য রকম। রীতিমত কঠিন। সিটান বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘‘দত্তারাম বাড়ি যা। এক দিন না খেলে তুই মরবি না।’’

দত্তারাম কথা বাড়াল না। একটি কথাও বলল না। বাড়ি ফিরে এল।

বন্ধু বলতে দত্তারামের দু’জন বন্ধু। এক জন সিটান অপরজন পিটার। প্রতি রবিবার বিকেলবেলা দত্তারাম ওদের সঙ্গে ফুটবল খেলে। রবিবার বিকেলে একটু সুখ, একটু খেলা, একটু অবকাশ। পাড়ায় যখনই কারও কোনও বিপদ আপদ হয় সবার আগে ছুটে যায় দত্তারাম আর সিটান। কারও কোনও সমস্যা হলে ওরা দু’জনেই সে সমস্যা মেটায়। আজ দত্তারাম সিটানের ওপর রেগে গেল। ভয়ঙ্কর রেগে গেল। ভাবল সিটান আজ এ রকম কেন! এত ক্রুদ্ধ কেন! এত গম্ভীর কেন! ও কি আমার বন্ধু নয়? ওরা কী চাইছে! একটা বন্ধের জন্য, একটা হরতালের জন্য জোরজবরদস্তি। এক ধরনের হুমকি। ওরা হরতালের দিন বাড়িতে বসে থাকতে পারে, তাস খেলতে পারে, রাজা-উজির মারতে পারে। কিন্তু যারা রোজ খেটে খায় তাদের মুখের ভাত ওরা কেড়ে নিতে পারে না। এ অধিকার ওদের কে দিয়েছে? মাতৃভাষার জন্য, কঙ্কনিভাষার জন্য এ হরতাল। এটাই ওদের দাবি। যেন আমি আমার মাতৃভাষাকে চাই না, ভালবাসি না। এটা ঠিক যে, কিছু মানুষ কঙ্কনিভাষা সম্পর্কে হাজার হাজার মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে। এ ভাষাটা নাকি নিরক্ষরদের ভাষা, এ ভাষাটা সর্ব স্তরে চলে না। কিন্তু এ সবের জন্য বন্ধ কেন!

আস্তে আস্তে বেলা বাড়তে লাগল। রোদের উত্তাপও বাড়তে লাগল। বেলা প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ পাশের বাড়ির কালিদাস এসে দত্তারামকে ডাকল। দত্তারামকে ডেকে বলল, আজকের বন্ধের ঘটনা-দুর্ঘটনা কোনওটাই মনে হয় না সঠিক পথে চলছে। আমার এ সব ভাল ঠেকছে না। দত্তারাম কালিদাসের কথাটা শুনল, মাথা নাড়ল, কিন্তু কিছু বলল না। ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ছিল দত্তারাম। ও দিকে কালিদাস বকবক করেই যাচ্ছে। দত্তারাম নীরব শ্রোতার মতো সব শুনছে কিন্তু একটি কথাও বলছে না।

এখানে যাঁরা বন্ধের বিরোধী তাঁদের বন্ধ সমর্থকরা মারধোর করছে। অন্যান্য জায়গায় এ বন্ধকে সবাই আবার গ্রহণ করছে, মেনে নিচ্ছে। বন্ধ সমর্থকদের পাশে তাঁরা। ব্যাপারটা কেমন যেন এলোমেলো। ঢিলেঢালা। কালিদাস এ সব কথা বলতে বলতে অন্য আর এক দিকে চলে গেল।

মাতৃভাষার জন্য এ বন্ধ ডাকা হয়েছে। ভাষা হল সকল মানুষকে একত্রিত করার একটি অমোঘ অস্ত্র। মানুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলে, একে অপরকে ভালবাসে। দানা বাঁধে মানুষের মনের কথা। বিভেদ কলহ সৃষ্টির জন্য ভাষা নয়। মাতৃভাষা হল মানুষের মাটির ভাষা, মনের ভাষা, হৃদয়ের ভাষা, জন্মলগ্নের ভাষা। কিন্তু কে এ সব কথা শুনছে! কে এ সব কথা শুনতে চাইছে? এ সব কথাই দত্তারাম ভাবছিল। সে নিজের সঙ্গে কথা বলছিল। একটার পর একটা সিগারেট পুড়িয়ে নতুন একটা প্যাকেট কিনতে সে যখন উদ্যত হল তখনই তার মনে পড়ল আজ হরতাল। দোকানপাট সব বন্ধ। এমনকী ছোট ছোট রাস্তার ঝুপড়ির দোকানগুলোও বন্ধ আজ।

বেলা বেড়ে চলেছে। সময় এগিয়ে চলেছে দ্রুত। এই ভাবেই সময় চলে যায়। দত্তারাম গায়ের জামাকাপড় খুলে লুঙি পরে কাঁধে গামছা নিয়ে কুয়োর পাড়ে গেল। বারবার মনে পড়ছে সাতসকালে সিটানের কথাটা— এক দিন না খেলে মরবি না। মাথাটা গরম হয়ে আছে। সেই সকাল থেকে। কুয়ো থেকে গুনে গুনে মাথায় আট বালতি জল ঢালল দত্তারাম। হঠাৎই দত্তারাম দেখল সিটান আর পিটার আসছে। ওদের দু’জনকে দেখে দত্তারামের মাথাটা আবার গরম হয়ে উঠল। ওরা দু’জনে যখন কুয়োর সামনে এসে দাঁড়াল তখন দত্তারাম একটু খোঁচা মেরে বলল, ‘‘কী ব্যাপার! তোদের হরতাল কি আমাকে স্নানটাও করতে দেবে না?’’

সিটান সাধারণত কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। কিন্তু সিটান দত্তারামের মুখ চোখের ভাব দেখে চুপ করে রইল। একটি কথাও বলল না। হঠাৎই অতি বিনয়ের সঙ্গে সিটান বলল, ‘‘দত্তারাম, তোর কাছে একটা উপকারের জন্য এসেছি। তুই স্নানটা সেরে ফেল। তার পর বলব। আমরা দু’জন অপেক্ষা করছি।’’

দত্তারাম একটু অবাক হল কথাটা শুনে। ভাবল কী বলতে এসেছে কে জানে। যাই হোক দত্তারাম গামছা দিয়ে মাথা শরীর মুছতে লাগল। সিটান বলল, ‘‘দত্তারাম আমার বাড়িতে ক’দিন আগে আমার মাসি আর মাসতুতো বোন রোজি এসেছে। রোজিকে ফাতোরপা মন্দিরে নিয়ে যেতে হবে আবার ঠিকমত ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।’’

দত্তারাম তখনও মনে মনে রাগটা পুষে রেখেছে। দত্তারাম গামছা দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে বলল, ‘‘আমায় ছেড়ে দে। আজ হরতালের দিন। আজ সব কিছু বন্ধ।’’

পিটার বলল, ‘‘দত্তারাম প্লিজ, তুই ছাড়া কোনও গতি নেই। প্লিজ।’’

‘‘আমি কাজটা হরতালের দিন জোর করে করব। তার পর কাল কী হবে! কাল আমার দফারফা হবে। আমরা হরতাল ডেকেছি মাতৃভাষার জন্য, তাই নয় কী!’’ মজা করে হাসতে হাসতে কথাটা বলল দত্তারাম।

সিটান দত্তারামের কথাটাকে হজম করে হাত দুটো জোড় করে বলল, ‘‘দত্তারাম প্লিজ, তোকে এ এলাকার, এ মহল্লার সবাই চেনে জানে। তোকে রাস্তায় কেউ বাধা দেবে না। তুই ছাড়া এ কাজ কেউ পারবে না। তোকে আমি ডাবল টাকা, মানে দ্বিগুণ টাকা দেব। দয়া করে রাজি হয়ে যা।’’

‘‘সকালবেলার কথাটা মনে আছে? তুই বললি, এক দিন না খেলে মরবি না। তুই ঘুষ দিতে চাইছিস। মানে ডাবল ফেয়ার! মানে দ্বিগুণ টাকা,’’ বলল দত্তারাম।

সিটান কিছু বলল না। চুপ করে রইল। সিটান জানে দত্তারাম ঘুষ খাওয়ার ছেলে নয়। বেশি টাকা, অতিরিক্ত টাকা নেওয়া তার চরিত্রে নেই। ন্যায্য পাওনাটা তার কাছে যথেষ্ট। বাধ্য হয়েই সিটান বলল, ‘‘কী আর বলব, এটা তোর ব্যাপার। রোজি সপ্তাহখানেক এখানে আছে। রোজি চণ্ডীগড়ে থাকে। একটা স্কুলে পড়ায়। এখানে ছুটিতে এসেছে। আজ রাতের ট্রেনে মুম্বই চলে যাবে। কিন্তু তার আগে দেবী শান্তাদুর্গার মন্দিরে ফাতোরপাতে পুজো দেবে। মানত ছিল রোজির। দেবী শান্তাদুর্গার আশীর্বাদে রোজির কত কী ভাল হয়েছে। স্কুলে চাকরি, মোটা মাইনে। সেই রোগা লিকলিকে রোজি এখন কী সুন্দর দেখতে হয়েছে। এ জন্যই তোর কাছে আসা। তোর যখন এত আপত্তি, তুই যখন যাবি না তা হলে আর কী করার আছে।’’

দত্তারাম এতক্ষণে ঠাণ্ডা হয়েছে। মেজাজটা একদম আর গরম নেই বললেই চলে। দত্তারাম একটু ইতস্তত করে বলল, ‘‘ঠিক আছে, যাব।’’ দত্তারাম ভাবল হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা ঠিক হবে না। আবার ভাবল সিটান খুশি হবে। সিটানের কৃতজ্ঞতা বোধ বাড়বে। পাড়ায় মহল্লায় সুনাম হবে। সবাই সুখ্যাতি করবে। উপরন্তু টাকারও প্রয়োজন আছে। সেটাই বা কম কীসে। দত্তারাম নিজের ঘরে ঢুকে জামাকাপড় পরে নিয়ে মোটরসাইকেলটায় স্টার্ট দিয়ে ভটভট আওয়াজ করতে করতে সিটানকে পেছনের সিটে বসিয়ে সটান চলে এল সিটানের বাড়িতে। যাওয়ার সময় পিটারকে বলল, তুই সিটানের বাড়ির সামনে চলে আয়।

রোজি তৈরি ছিল। একটা হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি, সঙ্গে ম্যাচ করা গোলাপি রঙের ব্লাউজ পরে রোজিকে ভালই দেখাচ্ছিল। রোজির বয়স প্রায় তিরিশের কাছাকাছি। বিয়ে-থা এখনও হয়নি। সুশ্রী, যদিও সুন্দরী নয়। রোজি হাসছিল। মিষ্টি হাসি।

সিটান দত্তারামের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘‘শুনেছি রাস্তায় কোথাও কোথাও গোলমাল হচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড করে রেখে দিয়েছে। তুই ওদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে যেতে পারবি। তোর কথা ওরা শুনবে।’’

দত্তারাম বলতে যাচ্ছিল সকালবেলা তোদের বোঝাতে পারিনি। আমার কথাও শুনিসনি। যেতেই দিলি না। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। সামনে রোজি দাঁড়িয়ে। রোজির মুখের দিকে তাকিয়ে দত্তারাম চুপ করে গেল।

রোজিকে মোটরসাইকেলের পেছনে চাপিয়ে দত্তারাম ইঞ্জিনে লাথি মারল। মোটরসাইকেলটা গর্জন করে উঠল। রোজির মা ছুটে এল। দত্তারামের হাত দুটো ধরে বলল, ‘‘আমার একমাত্র মেয়ে। একটু খেয়াল রেখো। সাবধানে যেও। ঠিকমত ফিরে এসো। মা শান্তাদুর্গা তোমাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করবে।’’

দত্তারাম মোটরসাইকেলের গিয়ারে হাত রাখল। মোটরসাইকেলের ক্লাচটাকে ছেড়ে দিল। গর্জন করতে করতে মুহূর্তের মধ্যে মোটরসাইকেলটা সবার চোখের আড়ালে চলে গেল।

দত্তারাম দুরন্ত গতিতে মোটরসাইকেলটা নিয়ে ছোট ছোট ব্যারিকেড পেরিয়ে হাইওয়েতে এসে পড়ল। আকাশের দিকে তাকাল দত্তারাম। খটখটে আকাশ। রোদের উত্তাপ অথচ মৃদু মৃদু বাতাস। আকাশে কোনও মেঘ নেই। হাইওয়েতে জায়গায় জায়গায় ইলেকট্রিক পোল, গ্রানাইটের বোল্ডার, বড় বড় সিমেন্টের চাঁই, টেলিগ্রাফ পোস্ট পড়ে আছে। এতটা পথ আসতে দত্তারামকে প্রায় বারো-তেরো বার থামতে হয়েছে। জায়গায় জায়গায় কাউকে বোঝাতে হয়েছে আমার বোন চণ্ডীগড় থেকে এসেছে, আজই চলে যাবে মুম্বই। পুজো দিতে যাচ্ছে মা শান্তাদুর্গার মন্দিরে। কাউকে বলতে হয়েছে, আমার প্রতিবেশী। পুজো দিতে যাচ্ছে ফাতোরপাতে। কারও কারও সঙ্গে হালকা রসিকতা করতে হয়েছে। এতটা পথ কেউ কিছু বলেনি। ছেড়ে দিয়েছে সবাই।

দত্তারাম কুনকোলিম পৌঁছে দেখল রাস্তার ওপর বিশাল একটা গাছ। কে বা কারা আড়াআড়ি ভাবে গাছটাকে রাস্তায় ফেলে রেখে দিয়েছে। দত্তারাম রোজিকে বলল, ‘‘নেমে দাঁড়াও।’’ দু’জনে হেঁটে হেঁটে মোটরসাইকেলটা নিয়ে সন্তর্পণে গাছটা পেরিয়ে গেল। গাছটা পেরিয়ে দত্তারাম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। রোজির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘এখান থেকে ফাতোরপা দশ মিনিটও নয়।’’

মোটরসাইকেলটা স্টার্ট দিয়ে দত্তারাম রোজিকে বলল, ‘‘চলো, উঠে পড়ো।’’ দত্তারাম মোটরসাইকেলটা নিয়ে এগোতেই হঠাৎ দেখল রাস্তা অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে জনা দশ-বারো যুবক। দত্তারাম ভাবল খুব তাড়াতাড়ি মোটরসাইকেলটা চালিয়ে বেরিয়ে যাবে পাশ কাটিয়ে। পরক্ষণেই ভাবল ওদের সঙ্গে সামনে গিয়ে কথা বলি। অনুমতি নেওয়াটাই ভাল। দত্তারাম মোটরসাইকেলটা ওদের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল।

একটা লম্বা মোটাসোটা চেহারার ছেলে বলল, ‘‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে বাবুসাহেব?’’

দত্তারাম বুঝল ছেলেটির মতিগতি ভাল নয়। দত্তারাম ঠাণ্ডা মাথায় মোলায়েম সুরে বলল, ‘‘ফাতোরপা।’’ সঙ্গে সঙ্গে বাকি ছেলেগুলো মোটরসাইকেলটাকে ঘিরে ধরল। হঠাৎই পেছন থেকে একটা ছেলে বলল, ‘‘ওদের নামিয়ে দাও। আগে পেছনের সিট। মেয়েটাকে।’’

‘‘আমাদের যেতে দাও।’’ কথাটা বলে দত্তারাম সিলিণ্ডার পাইপ দিয়ে একটু ধোঁয়া ছাড়ল। রোজি এতটা পথ দত্তারামের কাঁধে একটা হাত রেখে এসেছে। এ বার সে দত্তারামের কোমরটা শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে বসল।

‘‘তোমরা কোথাও যেতে পারবে না।’’ একটা শক্তপোক্ত চেহারার বেঁটে মতো ছেলে কথাটা বলে দত্তারামের হাতটা এক্সেলেটরের ওপর থেকে ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল। তখন আবার আর একটা কালো মতো ছেলে রোজির ঘাড়ে একটা হাত দিয়ে বলল, ‘‘এই মেয়েছেলেটা কে? ভাড়া করেছিস? নাকি ও তোকে ভাড়া করেছে? কে ভাড়া খাটছে রে?’’

দত্তারাম রাগে জ্বলে উঠল। মাথাটা ঘুরিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে এক ধাক্কায় রোজির ঘাড় থেকে ছেলেটার হাতটা সরিয়ে দিল। ছেলেটা লাফিয়ে উঠে বলল, ‘‘কুত্তার বাচ্চা!’’ তার পরেই রোজির একটা হাত ধরে জোর করে মোটরসাইকেল থেকে নামানোর চেষ্টা করল রোজিকে। দত্তারাম হিংস্র বাঘের মতো মোটরসাইকেলের এক্সেলেটরে চাপ দিল। বেশ জোরে। মোটরসাইকেলটা লাফ দিয়ে সামনে দু’তিনটে ছেলেকে সজোরে ধাক্কা দিল। ও দিকে ওই ছেলেটি রোজির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখার জন্য রোজি ছিটকে গিয়ে ওই ছেলেটার ঘাড়ের ওপর পড়ল।

দত্তারাম মোটরসাইকেলটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে ছেলেগুলোর সামনে এসে দাঁড়াল। ছেলেগুলো ধাক্কা দিয়ে মোটরসাইকেল থেকে দত্তারামকে ফেলে দিল। মোটরসাইকেলের সামনের বড় লাইটটা ভেঙে ফেলল। অবস্থা খারাপ দেখে দত্তারাম কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘‘ভাই মেয়েটি আমার প্রতিবেশী। দয়া করে আমাদের যেতে দাও।’’ দত্তারাম বোঝানোর চেষ্টা করল ছেলেগুলোকে। একটি ছেলে বলল, ‘‘ঠিক আছে তুমি যাও, মেয়েটি আমাদের কাছে জমা থাকবে।’’

দত্তারাম খেয়াল করল রাস্তার এক পাশে মোটরসাইকেলটা কাত হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু দত্তারামের মনে পড়ে গেল রোজির মায়ের কথা। মনে পড়ল দেবী শান্তাদুর্গার কথা। দত্তারামের চোখেমুখে ভয়ঙ্কর এক রাগ ফুটে উঠল। এমন রাগ তখনই হয় যখন মানুষ খুন করে। ও দিকে রোজি চেঁচাচ্ছে, ‘বাঁচাও বাঁচাও’। একটা ছেলে রোজিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রোজির ব্লাউজ ছিঁড়ে দিল।

দত্তারাম হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ওই ছেলেগুলোর ওপর। যুদ্ধের সৈনিকের মতো একটা একটা ছেলেকে ঘুষি মেরে মেরে ধরাশায়ী করে দিল। যে দত্তারামের সামনে আসছে সেই মুখথুবড়ে পড়ে যাচ্ছে। দত্তারামের ঘাড়ে পিঠে মাথায় কপালে ঘুষি মারছে অন্যান্য কয়েকটি ছেলে। দত্তারামের ওসবে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে তখন ভাবছে হয় মরব, নয় মারব। মা শান্তাদুর্গা আমার মাথায়। দত্তারামের কাছে মার খেয়ে ছেলেগুলো সব পালাতে শুরু করল। দত্তারাম চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে বলল, ‘‘এই মেয়েটি যাচ্ছে মা শান্তাদুর্গার কাছে। পুজো দিতে। সেই ফাতোরপা। তোরা ওর ব্লাউজ ছিঁড়েছিস, তোরা আর একটা মায়ের শরীরে হাত দিয়েছিস। মা শান্তাদুর্গা তোদের ক্ষমা করবে না।’’

মোটরসাইকেলটা রাস্তা থেকে তুলে নিল দত্তারাম। আর দেরি না করে রোজির হাত ধরে রোজিকে মোটরসাইকেলের পেছনের সিটে চাপিয়ে মোটরসাইকেলটায় লাথি মারল। মোটরসাইকেলটা গর্জন করে উঠল। তার পর দুরন্ত গতিতে ভটভট আওয়াজ করতে করতে অদৃশ্য হয়ে গেল। দত্তারামের পেছনের সিটে বসে রোজি কাঁপছে। রোজির ঘাম ঝরছে। রোজি মাথাটা নিচু করে আছে।

মন্দির থেকে যখন ওরা দু’জনে মানে দত্তারাম আর রোজি ফিরে এল তখন বিকেল-বিকেল। ফিরে আসার পথে ওদের কেউ কিছু বলল না। কেউ কোনও বাধাও দিল না। সবাই শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল দত্তারামের কপাল ফুলে গিয়েছে, জামাটা শরীরে পুরো ফালাফালা, একটা চোখ ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে। হাঁটু আর কনুই দিয়ে রক্ত ঝরছে। দত্তারামের এ সবে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে শুধু শান্ত গম্ভীর এই ভেবে যে রোজিকে সে ফাতোরপা নিয়ে যেতে পেরেছে, যেখানে মা শান্তাদুর্গা বিরাজ করছেন। আবার নিজের মায়ের কাছেও ফিরিয়ে দিচ্ছে। দত্তারাম কথা রেখেছে, দায়িত্ব পালন করেছে।

সিটানের বাড়ির সামনে গর্জন করে মোটরসাইকেলটা থামল। সিটান ছুটে এল। দত্তারামের বীভৎস চেহারা দেখে বলল, ‘‘কী হয়েছে?’’ রোজি ও দিকে মোটরসাইকেল থেকে নেমে টলতে টলতে বাড়ির ভেতর চলে গেল। দত্তারাম একটি কথাও বলল না। শুধু সিটানের মুখের সামনে একরাশ থুথু ফেলে বলল, ‘‘ছিঃ! ছিঃ! লজ্জার কথা। এই তোমাদের মাতৃভাষার লড়াই! এই তোমাদের কৃষ্টি, এই তোমাদের সংস্কৃতি! নরকে গিয়ে তোমাদের বাস করা উচিত। ছিঃ! ধিক মাতৃভাষা, ধিক তোমাদের হরতাল!’’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন