তথাকথিত রূপোলি পর্দার নায়কদের মতো রূপবান নন, ছোটখাটো সাদামাটা চেহারা নিয়েই রাজত্ব করে গেছেন অভিনয় জগতের উপরে। এমনকি এর জন্য রবি ঘোষের মধ্যে লেশমাত্র হীনমান্যতা ছিলনা বরং সেটাই কখনো কখনো তার উপভোগের বিষয় হয়ে উঠতো। আশুতোষ কলেজে পড়বার সময় সেখানকার ব্যয়ামাগারে শরীর চর্চা করতেন। কে জানতো শরীরের এই বিভঙ্গের জন্যই তিনি একদিন কোর্টের কেরানি হওয়ার বদলে হয়ে উঠবেন একজন শ্রেষ্ঠ অভিনেতা।
এ নিয়ে কতগুলি গল্প বলি।
জিতেন্দ্রনাথ ছিলেন বরিশালের কাঠ বাঙাল।কিশোর বয়সেই রবি ঘোষ প্রথম অভিনয় চর্চার দিকে ঝুঁকছিলেন বাড়ির অমতেই বিশেষ করে বাবা জিতেন্দ্রনাথ ঘোষের সায় না পেয়েই। দুজনেরই প্রচন্ড জেদ।চাপা মান অভিমানের পালা চলতে থাকে দিনের পর দিন। পরে এনিয়েও রবি ঘোষ কৌতুক করতে ছাড়েননি। তার ভাষাতেই বলি, ‘বাবা একদিন মা’কে ডেকে বললেন রবু নাকি অভিনয়ের শখ হইসে? ওর তো চাকর ছাড়া আর কোন পার্ট কোনওদিন জুটব না!’
ভবিষ্যতে তপন সিংহের ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে ধনঞ্জয় চরিত্রটিতে রূপ দিয়ে এই চাকর চরিত্রকে অবিস্মরণীয় করে গিয়েছেন রবি ঘোষ।দুর্ভাগ্যের কথা, ছেলের এই অসাধারণ সাফল্য জিতেন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাননি। বলতে গেলে রবি ঘোষের কোন সাফল্যই তিনি চোখে দেখে যেতে পারেননি।
১৯৫৯ সালে উৎপল দত্তের রচনা ও পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনীত হল রাণীগঞ্জ-আসানসোল অঞ্চলের শেলডন কোলিয়ারির ধূসর জগৎ এর শ্রমিকদের জীবন ও সংগ্রামের ইতিবৃত্ত ‘অঙ্গার’ নাটক। মঞ্চে সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভা সেন, নিমাই ঘোষ, উৎপল দত্তের মতো বিরাট মাপের অভিনেতারা থাকলেও, সনাতন চরিত্রের রূপ দিয়ে প্রথম সকলের নজর করেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দোস্তিদার ওরফে রবি ঘোষ। তিনশো রাত্রির ওপর হাউসফুল থাকে অঙ্গার।
অঙ্গার নাটকের অ্যানাউন্সমেন্ট এর পর জিতেন্দ্রনাথ একসাথে পনেরোটা টিকিট কেটেছিলেন বন্ধুবান্ধব আত্মীয়দের নিয়ে সন্তানের অভিনয় দেখবেন বলে। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, এত সুখ লেখা ছিল না রবি ঘোষের কপালে। অঙ্গার নাটক মঞ্চস্থ হাওয়ার সেই রাত্রির মাত্র চার পাঁচ দিন আগে জিতেন্দ্রনাথ প্রয়াত হন। খবর পেয়ে উৎপল দত্ত নাটকটিকে পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তখন তরুণ রবি বলেছিলেন,’শোক তো শিল্পীর ব্যক্তিগত ব্যাপার, তার জন্য নাটক পিছবে কেন?’ গলায় কাছাবাঁধা অবস্থাতেই ‘সনাতন’ চরিত্রে অভিনয় করলেন। এই নাটকের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন।
দর্শককে আকর্ষণ করার পেছনে থাকে কঠোর অনুশীলন, গভীর ভাবনা, নিরলস জ্ঞানচর্চা ও আরও কিছু। অবিস্মরণীয় অভিনেতা রবি ঘোষের মধ্যে যে এসবেরই এক সম্পৃক্ত মিশ্রণ ঘটেছিল, তা বলাইবাহুল্য। যারা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বৃত্তের মধ্যে ছিলেন, তারা বলতেন— আড্ডায় বসে অবাক হতাম তার অদৃশ্য ঝুলির অফুরান গল্প সম্ভারে। আর সেগুলো পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে একান্ত আপনজন,এমনকি স্বয়ং নিজেকেও নিয়েও রসিকতা করতে তাঁর কিছুমাত্র দ্বিধা ছিল না। একটা গল্প বলি —
একদিন সত্যজিৎ রায়ের বৈঠকখানায় রীতিমতো আড্ডা চলছে। যথারীতি সেই মুহূর্তে হাতের একটি কাজ নিয়ে তিনি মনোনিবেশ করে আছেন সত্যজিৎ। কথায় কথায় একটা গুরুতর বিষয় চলে এলো, ‘নাটকের হিরো কেমন হওয়া উচিত?’সকলেই নিজের মতামত জানালেন। সর্বোপরি রবি ঘোষ সাহস করে সত্যজিৎ বাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন— মানিকদা আপনি কিছু বলবেন না?
— কি ব্যাপার? সত্যজিৎ বাবু মুখ ঘুরিয়ে জানতে চান।
রবি ঘোষ উৎসাহের সঙ্গে বললেন,– আমাদের আলোচনার বিষয় হলো……ইয়ে মানে নাটকের হিরো কেমন হবে?
সত্যজিৎবাবু তার কাজের দিকে মুখ ফেরাতে ফেরাতে পরিষ্কার এককথায় জানান,—- আর যেমনই হোক তোমার মত হবে না।
আরো একটি গল্প বলি —
১৯৬৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল। সেই সূত্রে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন সত্যজিৎ-বিজয়া-সন্দীপ রাযের সঙ্গে তপেন চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ। এটাই ছিল প্রথম বিদেশ পারে। রবি ঘোষের ইচ্ছা হয়েছিল সেখান থেকে নিজের জন্য কোর্ট প্যান্ট জুতো জামা কিনবেন। কিন্তু মুশকিল হলো যখন বিভিন্ন দোকানে গিয়ে পছন্দ হলেও গড়ে জার্মানদের চেহারার মাপ রবি ঘোষের চেহারার মাপের সাথে কিছুতেই মিল ছিলনা। রীতিমতো হতাশ যখন হয়ে পড়েছিলেন তখন দোকানের এক সহৃদয় মহিলা কর্মী ফিতে নিয়ে এগিয়ে এলেন সাহায্য করতে।
তার বুকের ছাতি-হাত-পা ইত্যাদি মাপার পর মহিলা বললেন, ‘ইউ বেটার গো টু আওয়ার চিলড্রেন্স ডিপার্টমেন্ট’।রবি ঘোষ সত্যি সেখানকার চিলড্রেন্স ডিপার্টমেন্ট এ গিয়ে তার মাপের জামাপ্যান্ট এমনকি জুতো পেয়ে গিয়েছিলেন।
রবি ঘোষের মুখ সুন্দর ছিলনা, ছিল না আজকাল নায়কদের মতো জিমচর্চিত ফিজিক। তাই হয়তো উত্তম-সৌমিত্র-বসন্ত হওয়ায় তার নায়ক হওয়া হয়নি। ব্যায়াম করে শরীর প্রদর্শন নয় তার কাছে ছিল অভিনয়টাই প্রধান।
বাবার ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হলেও রবি ঘোষ তার প্যাশন বিসর্জন দিলেন না। ‘হরিপদ একজন বেঁটে খাটো সাদামাটা লোক’ হয়েই সারা জীবন অনন্য হয়ে রইলেন সিনেমার জগতে।বড় বড় ছবির ব্যানারে নায়ক নায়িকার পাশে তার জায়গা হল কিনা ঠিকই কিন্তু তা নিয়ে তিনি কোনোদিন মাথা ঘামাতেন না , কাজটাকেই তিনি সাধনা মনে করতেন। এই শিক্ষায় তিনি দিয়েছিলেন তার সুযোগ্য শিষ্য খরাজ মুখোপাধ্যায়কে। তার শেষ কাজ কলকাতা দূরদর্শনে গোপাল ভাঁড় দেখতে প্রতি রবিবার দুপুরে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত।।
কমেডিয়ান হিসেবে সিনেমা জগতে পরিচিত হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত রাশভারী এবং বিচক্ষণ সম্পন্ন মানুষ। সে নিয়ে একটি গল্প বলি।
একদিন এক প্রযোজক ভদ্রলোক ছবির মুক্তির আগে ছবিটির বিশেষ একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন এবং সেই উপলক্ষে ছবির শিল্পী হিসেবে রবি ঘোষকে আমন্ত্রণ জানাতে তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হলেন। রবি ঘোষ জানতে চাইলেন, ‘কেমন হয়েছে ছবি?’
ভদ্রলোক দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে প্রায় চিৎকার করে বললেন– দারুন দারুন।
রবি ঘোষ খুব ছোট্ট করে বললেন — বাহ।
এবার ভদ্রলোক বললেন, ‘দাদা যাই বলুন এর আগে আপনি কিন্তু এমন রোল পাননি সত্যজিৎ বাবুর কাছ থেকেও নয়।’
একটুও উত্তেজিত বা রাগ না করে রবি ঘোষ বললেন, —
‘না’
ভদ্রলোক তার ধারণার সমর্থন পেয়ে এবার বললেন, ‘আবার একবার হইচই পড়ে যাবে আপনাকে নিয়ে।’
রবি ঘোষ বললেন, ‘তাই?’
ভদ্রলোক হাঁটুতে চাপড় মেরে বললেন, ‘আমি বলে যাচ্ছি আপনি দেখে নেবেন।’
রবি ঘোষ বললেন, ‘দেখব’।
ভদ্রলোক হামবড়াভাবে যা খুশি তাই বলে চলেছেন আর রবি ঘোষ শুনে যাচ্ছেন অবলীলায়। উনি কি এসব বিশ্বাস করছেন? সেই ঘরে উপস্থিত ছিলেন তার এক সাংবাদিক বন্ধু।
চা কফি খেয়ে ভদ্রলোক একসময় উঠলেন। রবি ঘোষ তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দরজার ছিটকিনি দিতে দিতে বন্ধুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘কি বুঝলে? নিজের আনন্দেই আছে!’
অর্বাচীন ভদ্রলোক সম্পর্কে রবি ঘোষের এই চটজলদি মন্তব্যে, বন্ধুটি স্বস্তির হাসি হেসে ফেললেন। মাত্র একটি কথায় সব পরিষ্কার করে দিলেন তিনি।
গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ছিলো, রবি ঘোষের মৃত্যুর ২৮ বছর। রসবোধে পরিপূর্ণ এই অভিনেতা ২৮ বছর ধরে ‘নেই’।তবে তিনি আজীবন অমর থাকবেন দর্শকদের মনে। টলিউড তাকে যোগ্য সম্মান দিক বা নাই দিক, দর্শকরা রবি ঘোষের গুণের কদর আজও করেন।তিনি ছিলেন ‘ধনঞ্জয়’, যাঁরা মুসাফিরের মতো নিখাদ আনন্দ অনুভব করাতে আসেন, আবার চলেও যান। তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের এই স্মৃতিচারণার ইতি টানলাম।
খুব সুন্দর একটা অভিনেতা কে আপনি লিখেছেন,,,, আমাদের ছোটোবেলা এদের অভিনয় দেখেই বড় হওয়া
একদম তাই। আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে