চোখ ভর্তি টলটলে জল কিন্তু গড়িয়ে পড়ছে না। শুকনো ঠোঁট মাঝেমাঝে কেঁপে উঠছে, কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না। মাঝে মাঝে চোখ ঢাকা সানগ্লাসে। যেন লুকিয়ে রাখতে চাইছে চোখ দুটোকে। আর দর্শক ওইখানেই পাগল হয়ে যাচ্ছে সুচিত্রা সেনের জন্য। মনে করুন সেই আপামর ভারতবাসীকে পাগল করে দেওয়া গানটির কথা। “তেরে বিনা জিন্দেগী সে কোই শিক্ওয়া তো নেহী শিক্ওয়া নেহী…” একটা ধ্বংসস্তুপের চারপাশে ঘুরে ঘুরে সঞ্জীব কুমার আর সুচিত্রা সেন। যেন ওই ধ্বংসস্তুপ সম্পর্কের ভাঙনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোথাও। সুচিত্রা সেনের দিক থেকে নজর দর্শক সরাতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু নজর একটু সরালে দেখা যাবে ধ্বংসস্তুপের সৌন্দর্য থেকে চোখ সরানো কঠিন। শুধু কঠিন নয় অসম্ভব।
শ্রীনগর থেকে আঠাশ কিলোমিটার দূরে পহেলগাম যাবার রাস্তায় পুলওয়ামা জেলায় একটি অসাধারণ দ্রষ্টব্য রয়েছে। পহেলগাম যাবার রাস্তার একটু আগে একটু বাঁদিকে বাঁক নিয়ে এগোলেই পৌঁছে যাবেন অবন্তীপুরার অবন্তীস্বামী টেম্পল বা হিন্দু মন্দির। অবশ্য মন্দির নেই আর। শুধু ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু সেই ধ্বংসাবশেষের কি অপরূপ সৌন্দর্য, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। কাশ্মীরে যে গাড়িটি নিয়ে ঘোরা ফেরা হবে, নিশ্চিত জানবেন আপনার ড্রাইভার কোন হিন্দু মন্দির একেবারে চেনে না বলে আগেই জানিয়ে দেবে। তারপর বলবে এরকম নাম সে শোনেনি। তারপরও নাছোড় আপনি যখন তাকে বাধ্য করবেন মন্দিরে নিয়ে যেতেই হবে বলে, তখন সে নিয়ে যাবে। তারপর জায়গায় পৌঁছে বলবে, “দেখুন, কি দেখবেন, খন্ডহর ছাড়া আর কিছু নেই।” অবাক হয়ে দেখি গত বছর মধ্যপ্রদেশে বারেবারে হিন্দু ড্রাইভার মান্ডুতে ঠিক একই ভাষা ব্যবহার করেছিল মুসলিম স্থাপত্য দেখাতে গিয়ে। বারবার বলেছে, “ও কি দেখবেন? খন্ডহর হ্যায়। রামমন্দির যাইয়ে।” তার মানে জায়গা ভেদে মানুষের মুখ পাল্টে যায় কিন্তু ভাষা থাকে এক। ধর্ম অনুযায়ী যেটুকু ভেদ।
বিশাল একখন্ড জায়গা জুড়ে এই অবন্তীপুরা বিষ্ণু মন্দির। রাজা অবন্তীবর্মন এইখানে নগর পত্তন করেছিলেন। তিনি বিষ্ণু ও শিব মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এই অবন্তীপুরায়। বিষ্ণু মন্দির ও শিব মন্দিরের দূরত্ব এক কিলোমিটার। ১৪২৬ এর ভূমিকম্পে পুরো নগরী মাটির তলায় চলে যায়। ৫০০ বছর পর খনন কার্যের দ্বারা এই নগরীর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করেন রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও দয়ারাম সাহানী। ১৯১৩-১৯২৪ পর্যন্ত এই খনন কার্য চলে।এই খনন কার্যের ফলে পাঁচটি মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। খাঁটি রূপোর তৈরি যে বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া গেছিল সেটি সঙ্গে সঙ্গে স্থান বদল করে চলে যায় লন্ডনে। কারণ তখন ব্রিটিশ রাজত্ব চলছে। বাকি তিন মূর্তি যায় শ্রীনগরের এস. পি. এস মিউজিয়ামে। আরও একটি ব্ল্যাক স্টোনের মূল্যবান মূর্তি শ্রীনগরের মন্দিরে আজও পূজিত হন।
স্থানীয় কাশ্মীরী কাহিনী অনুযায়ী এই পাঁচমূর্তি আসলে পঞ্চপান্ডবের। কিন্তু এটি একেবারেই ভুল ধারণা বা গল্প। কারণ মহাভারতের কাহিনী অনুযায়ী পান্ডবরা হিমাচল হয়ে মহাপ্রস্থানের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন, পুলওয়ামা দিয়ে কোথাও যাননি ৫০০০ বছর আগে। সুতরাং এই মূর্তিগুলি হল বিষ্ণু, গণেশ, লক্ষ্মী, গরুড় ও ভূমিমাতার। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
রাজা অবন্তীবর্মন পহেলগাম থেকে ঝিলম নদীকে খাল কেটে নিয়ে এসে অবন্তীপুরায় জলের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই অবন্তীস্বামী মন্দিরের ছাদ এমনভাবে পিরামিডের ধাঁচে তৈরি যে কোনও বরফ এতে জমতে পারত না। মূল মন্দিরের চারদিক ঘিরে আরও ৬৯টি কক্ষ রয়েছে। সবই এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত। তবু পাথরও তো নীরবে অনেক কথা বলে। আঁধি কি সবসময় ধুলো উড়িয়ে তবেই জানান দেয়? নীরবতার মধ্যে ভাঙনের আঁধি যে লুকিয়ে থাকে তাকে বোঝাতে সুচিত্রা সেনের প্রয়োজন ছিল আর তার সঙ্গে প্রয়োজন ছিল অবন্তীপুরার এই ধ্বংসস্তুপের। এই পাষাণ কখনও হয়ত রাতে চেঁচিয়ে বলে “তফাৎ যাও। সব ঝুট হ্যায়!” তখন আশেপাশে কেউ থাকে না বলে শুনতে পায় না এই পাষাণের দীর্ঘশ্বাস।
এই যে ৬৯টি কক্ষ, এগুলিতে ছিল ছোট ছোট মন্দির। বিভিন্ন দেব দেবীর আরাধনা চলত একসময় এই ছোট ছোট কক্ষগুলিতে। ৬৯টি কক্ষ মাটির নীচ থেকে খনন করে তুলে এনেছেন রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়। কক্ষগুলিতে কোথাও হয়ত প্রদীপের শিখার দাগ আজও রয়েছে, সাদা চোখে ধরা পড়ে না। মন্দিরের মূল দরজায় রয়েছে নবগ্রহের মূর্তি। এই মন্দিরের মূল যে আকর্ষণ সেটি হচ্ছে এর সবকিছু পাথরের। এমনকি মন্দিরের দরজা, দরজার সমস্ত খিলান, সমস্ত পাথরের তৈরি ছিল। কোনও লোহা বা ধাতব বস্তু ব্যবহার করা হয়নি। পাথরের উল্টোনো স্ক্রু এর মত অংশে বড় বড় গ্রুপ কেটে যে খাঁজ, তাতে আটকে যেত লম্বা লম্বা পাথরের কারুকার্য করা স্তম্ভ। পাথরের প্যাঁচে পাথর আটকে ছিল অনন্তকাল। অন্তত তাই ভেবেই রাজা অবন্তীবর্মন এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। সাম্প্রতিক কালে অযোধ্যার রামমন্দিরে এই একই টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। এটা অবাক করে যে কত বছর আগে এইরকম টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছিল।
অবন্তীপুরা মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে অজস্র খোদিত মূর্তি। এই মন্দির প্রধানত ছিল বিষ্ণু ও শিবের। শিবের মন্দিরটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। যার চিহ্ন মাটি খুঁড়েও পাওয়া যায়নি। নবম শতাব্দীর উৎপলা বংশের রাজা যখন এটি তৈরি করেছিলেন তখন কি একবারও ভেবেছিলেন যে এই মন্দির একদিন ভূমিকম্পের ফলে মাটির নীচে চলে যাবে ততদিনের জন্য যতদিন না এক বঙ্গসন্তান সেটিকে আবার সূর্যালোকে নিয়ে আসেন। ৮৫৩-৮৫৫ এই সময়ে অবন্তীপুরা নগরী নির্মিত হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে এই মন্দিরের নাম পান্ডবলারি। কাশ্মীরী ভাষায় যার অর্থ পান্ডবদের গৃহ। যদিও এর কোন ভিত্তি নেই। রাজা অবন্তীবর্মনের নাম অনুসারে নগরের নাম হয় অবন্তীপুরা। চতুর্দশ শতাব্দী অবধি এই অঞ্চল ছিল সংস্কৃত শিক্ষা, হিন্দু দর্শন এবং শৈবদর্শনের পীঠস্থান। পঞ্চদশ শতাব্দীতে মুসলিম শাসকের দ্বারা বেশিরভাগ মন্দির ধ্বংস হয়। সুতরাং মন্দির ধ্বংসে কতটা ভূমিকম্প দায়ী আর কতটা মুসলিম আক্রমণের আঁধি দায়ী সেটা ভাবনার বিষয়।
বিষ্ণু মন্দিরের নাম অবন্তীস্বামী টেম্পল আর শিব মন্দিরের নাম অবন্তীশ্বর টেম্পল। রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও দয়ারাম সাহানী যে ভগ্নস্তুপকে সূর্যালোকে পুনরায় নিয়ে এলেন সেটি সূর্য মন্দির ‘মার্তন্ড’ মন্দিরের আদলে নির্মিত ছোট মন্দির। মার্তন্ড মন্দির কাশ্মীর উপত্যকার অনন্তনাগে অবস্থিত। এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে। এই মন্দির ধ্বংস করেছিলেন সিকান্দর শাহ মিরি। আর এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তুপগুলি আজ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় পুরোপুরি লুপ্ত।
কলহনের মতে অষ্টম শতাব্দীতে ললিতাদিত্য মুক্তপীড়া এই মার্তন্ড মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিক জোনা রাজা এবং ঐতিহাসিক হাসান আলী এদের দুজনেরই মতে সুফি মৌলবী মীর মহম্মদ হামাদানীর পরামর্শে সিকান্দর শাহ মিরি (১৩৮৯-১৪১৩) ইসলাম ধর্ম প্রসারের জন্য এই মন্দির ধ্বংস করেন। জোনা রাজার মতে সিকান্দর শাহর প্রধান পরামর্শদাতা যিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরবর্তী কালে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেন, সেই ‘শুভ ভট্ট’, তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী সিকান্দর শাহ স্থানীয় হিন্দুদের উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য এই ধ্বংসলীলা চালান। আবার হাসান আলির মতে সিকান্দর শাহ নিজের বুদ্ধিতেই এই কাজ করেছিলেন। পরবর্তী কালে ভূমিকম্প এই ধ্বংসলীলায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
মার্তন্ড মন্দির কাশ্মীর উপত্যকার সর্বোচ্চ স্থানে নির্মিত হয়েছিল যাতে মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে গোটা উপত্যকা পাখির চোখে ধরা পড়ে। এটি কাশ্মীর উপত্যকার সর্বোৎকৃষ্ট স্থাপত্যের নিদর্শন। এটিতে কাশ্মীরী স্থাপত্যের সঙ্গে গান্ধার, গুপ্ত ও চীন দেশের মেলবন্ধন ঘটেছিল। পাহাড়ের উপরে একটি বিস্তৃত সমভূমির উপর মূল মন্দির ঘিরে চারপাশে আরও চুরাশিটি অন্যান্য মন্দির ছিল পরিধি বরাবর। এগুলি ছাড়াও আগে থেকেই একটি ছোট মন্দির সেখানে ছিল। সেটি অবিকৃত রেখে এই বিশাল মন্দির নির্মাণ সম্ভব হয়। এই মন্দির পেরিস্টাইল স্থাপত্যরীতির সর্ববৃহৎ নিদর্শন। হিন্দু রীতি অনুযায়ী এই মন্দিরের প্রবেশদ্বার পশ্চিম দিকে। মূল মন্দিরের একটি নিভৃত কক্ষে বিভিন্ন দেয়ালে আছে খোদাই করা অপূর্ব সব মূর্তি। যেগুলির মধ্যে গঙ্গা, যমুনা ও সূর্যের মূর্তিও রয়েছে।
অবন্তীপুরার নাম কস্মিনকালে শোনা ছিল না। তাই কাশ্মীর যাচ্ছি শুনে যখন একজন বললেন যে পহেলগাম যাবার আগে যেন অবন্তীপুরা অবশ্যই ঘুরে যাই। বেশ আগ্রহ জাগল নতুন একটা জায়গা সম্বন্ধে। সবথেকে যেটি মন টানল সেটি ওই ‘অবন্তীপুরা’ নামটি। পুরোপুরি হিন্দু নাম। তার মানে হিন্দু রাজার রাজধানী বা বাড়ি এরকম কিছু হবে। কিন্তু কাশ্মীর পৌঁছে যেটি বুঝলাম কাশ্মীরীরা পর্যটকদের খুবই সম্মান করেন, আদর করে অভ্যর্থনা করেন। ব্যবহার অতীব মোলায়েম ও মনোরম। কিন্তু হিন্দু কোনও মন্দির ও স্থাপত্য তারা দেখাতে একেবারে আগ্রহী নন। ঠিক যেমন মধ্যপ্রদেশের মুসলিম স্থাপত্য দেখাতে আগ্রহী নন ওখানকার মানুষ। এখানেই ওই ‘আঁধি’-র অন্ধকার।
খুব সুন্দর করে লিখেছেন
ধন্যবাদ অশেষ