কেউ কি জানেন নদিয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজবৈদ্য ছিলেন হুগলির চুঁচুড়ার কাছের জায়গা সুগন্ধ্যার লোক? বাস্তবিকই তাই। তাঁর নাম গোবিন্দরাম রায়। তাঁর দাদার নাম জগন্নাথ রায়। গোবিন্দরাম রায়ের ভিটা এখনও হুগলির সুগন্ধ্যায় বর্তমান। তবে মালিকানা হস্তান্তর হয়েছে। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর অন্নদামঙ্গল কাব্যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ, মন্ত্রী-অমাত্য-পেয়াদা-বাজনদারদের সকলের নামই লিপিবদ্ধ করে গেছেন। গোবিন্দরাম রায়ের কথাও সেখানে সসম্মানে উল্লিখিত হয়েছে।
চন্দননগরের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর সঙ্গে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল। সেই সূত্রে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর কাছ থেকে মাঝে মাঝে অর্থ ধার নিতেন। ইন্দ্রনারায়ণের সুপারিশে তাঁর আশ্রিত কবি ভারতচন্দ্র রায় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবির পদ পান। নীরবে সাহিত্যসাধনা করার জন্যে কৃষ্ণচন্দ্র ভারতচন্দ্রকে জমি দান করেন। মূলাজোড়েও বিরাট সম্পত্তি দান করেন।
রাজবৈদ্য গোবিন্দরামও চন্দননগরের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর সুপারিশে নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজবৈদ্য নিযুক্ত হন।
রাজবৈদ্য গোবিন্দরাম রায় আর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার বিদূষক গোপাল ভাঁড় মনে হয় অভিন্ন ব্যক্তি। কারণ ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সমস্ত সভাসদ, মন্ত্রী-অমাত্য, পেয়াদা, বাজনদার, দ্বাররক্ষকের নাম ও বিবরণ থাকলেও গোপাল ভাঁড়ের নাম নেই। তাই মনে হয় উল্লিখিত রাজকর্মচারী ও পারিষদবর্গের মধ্যেই গোপাল ভাঁড় লুকিয়ে আছেন। রাজবৈদ্য গোবিন্দরামের মধ্যেই গোপাল ভাঁড় সত্তা লুকিয়ে ছিল। এ অনেক প্রমাণ আছে।
প্রসঙ্গত, চুঁচুড়া কলকাতার থেকেও প্রাচীন। এই জনপদের সংস্কৃতির ইতিহাসও সুপ্রাচীন। হুতোম প্যাঁচার নকশার স্রষ্টা কালীপ্রসন্ন সিংহ, রসরাজ অমৃতলাল বসু, খুবই গুরুত্বসহকারে চুঁচুড়ার সঙের উল্লেখ করেছেন। হুতোম প্যাঁচার নকশায় আছে, “পূর্ব্বে চুঁচড়োর মত বারোইয়ারি পূজো আর কোথাও হত না, ‘আচাভো’, ‘বোম্বা চাক’ প্রভৃতি সং প্রস্তুত হত; শহরের নানা স্থানের বাবুরা বোট, বজরা, পিনেস ও ভাউলে ভাড়া করে সং দেখতে যেতেন; লোকের এত জনতা হত যে, কলাপাত এক টাকায় একখানি বিক্রি হয়েছিল, চোরেরা আন্ডিল হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু গরিব দুঃখী গেরস্তোর হাঁড়ি চড়েনি।” কিংবা রসরাজের কথায়, “চুঁচড়োর সঙ আমার কেবল দ্যায়লা করছেন।”
এই সঙের সূত্রে গানের কথাও আসে। চুঁচুড়ার সঙের বিখ্যাত গায়ক ছিলেন রূপচাঁদ পক্ষী। তিনি গানের কথা লিখতেন, সুর দিতেন এবং সে গান নিজে গাইতেন। গানের কথা একেবারেই স্বতন্ত্র, শুনলেই নেশা ধরে যাবে — ‘গুলি হাড়কালি মা কালীর মতো রঙ। টানলে ছিটে বেড়ার ভিটে যেন চুঁচড়োর সঙ।’ এতটাই বিখ্যাত এখানকার সঙ যে প্রবাদেও পরিণত হয়েছে — “গুলিখোরের কিবা ঢঙ্, দেখতে যেন চুঁচড়োর সঙ’।
তা এই চুঁচড়ো-সুগন্ধ্যার গোবিন্দরাম রায় বৈদ্য হয়েও যে রসিক ও মনোরঞ্জনকারী মানুষ হবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি ডাক্তারি যেমন নিষ্ঠা নিয়ে করতেন, তেমনই ছিল তাঁর হাস্যরস সৃষ্টির ক্ষমতা। আচাভো ও বোম্বাচাক সঙ দেখে দেখে তিনিও সঙের কায়দাকানুন রপ্ত করে ফেলেছিলেন। তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই ডাক্তার জেকিল ও মিস্টার হাইড।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের একবার একজন রাজবদ্যির দরকার পড়ে৷ বহু পরীক্ষার্থীর মধ্যে থেকে ঠিকজনকে বেছে নেওয়ার জন্য গোপাল ভাঁড়কে পরীক্ষক নিযুক্ত করেন তিনি৷ বদ্যিচুড়ামণি না হলে এ গুরুদায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হতে না৷ গোবিন্দরাম রায় আর গোপাল ভাঁড় এইখানে ধরা পড়ে যান। তাঁরা দুজনে যে একই লোক, একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
গোপাল ভাঁড়ের গল্পে দেখা যায়, প্রায়ই নিজের মৃত্যুসংবাদ তিনি নিজেই রটাচ্ছেন৷ ডাক্তাররাই মৃত্যুকে ন্যাচারাল ফেনোমেনন বলে ভাবেন৷ তাই কোনও সংস্কার থাকে না মনে।
একজন ডাক্তারের পক্ষেই সাধারণ মানুষের প্রাতঃকৃত্য অভ্যাস সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া সম্ভব৷ তাই গোপাল ভাঁড়ও নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, ‘মহারাজ, বিষ্ঠাত্যাগ করেই সবচেয়ে সুখ ও আনন্দ।’
মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল গোপালের৷ তিনটি ভাষা সমানে বলা পণ্ডিতপ্রবরকে অজান্তে ধাক্কা মেরে গোপাল তাঁর আসল ওড়িশি ভাষাটি জেনে নিয়েছিলেন — ‘ষঁড়া অন্ধা অছি!’
শুনলে গল্পের মতই লাগবে নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র চন্দননগরের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর কাছে একজন বিদূষক আর একজন বৈদ্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেসময় ইন্দ্রনারায়ণের হাতে পাঠানোর মতো কোনও বিদূষক ছিল না। তিনি বদ্যি গোবিন্দরাম রায়কে চিনতেন। তাঁর ভাঁড়ামির সঙ্গেও তিনি সম্যকরূপে পরিচিত ছিলেন নিজের চিকিৎসা করানোর সূত্রে। তাই তিনি গোবিন্দরাম রায়কেই পাঠিয়ে দেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজেও গোবিন্দরামের বিদূষকপ্রতিভায় মোহিত হন। তাই তিনি গোবিন্দরামকেই গোপাল ভাঁড় নামে ডাকতে শুরু করেন। গোবিন্দরাম রায় ও গোপাল ভাঁড়ের অভিন্ন সত্তা তাঁর জানা ছিল। তবে এত সাবধানতা সত্ত্বেও মহারাজা ধরা পড়ে যান গোপাল ভাঁড়কে বৈদ্য নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে ফেলে।
হুগলির চুঁচুড়া-চন্দননগর- সুগন্ধ্যার লোক জানেই না, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজচিকিৎসক সেখানকারই লোক ছিলেন। হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ না পড়লে আমিও সেটা জানতে পারতাম না।