গত বছর অক্টোবর মাসের শেষ দিকে মাষ্টার আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে। মাষ্টার মানে অম্লান সরকারের কথা বলছি। অম্লান কে নাও চিনিতে পারেন শুভ কে তো নিশ্চয় চেনেন। হ্যাঁ শুভকেই মাষ্টার ডাকতাম আমি। শুভর সাথে আমার বন্ধুত্ব সেই সময় থেকে যখন ওর বাসার পাত কুয়াটা জীবিত। এখন উকিল পাড়ায় শুভর যে বাসাটা দেখে আপনি অভ্যস্ত এই বাড়িটা ত্রিশ বছর আগেও এমন ছিল না। যে কুয়ার কথা বলছি তাকে অনেকেই ইন্দারা বলতো, আমার স্মৃতি যদি বিট্রে না করে তবে কুয়াকে ইন্দারাই বলতো এই অঞ্চলের লোকজন। যাক, আগে বরং গল্পটা বলি আপনাদের। বর্তমানে সুপেয় জল পানের জন্য আধুনিক বহুমূখি ব্যবস্থা থাকলেও এক সময় কুয়া বা ইদারাই ছিল পানযোগ্য জল পাওয়ার একমাত্র ভরসা। গ্রামীণ ঐতিহ্যের এইসব কুয়া এখন প্রয়োজনহীন হয়ে পড়ায় তা এখন একেবারেই বিলুপ্তির পথে। অথচ এই কুয়া বা ইদারাই এক সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং জল পানের কার্যকরি মাধ্যম ছিল সবার কাছে। কালের বিবর্তনে প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই কুয়া বা ইদারা নতুন প্রজন্মের কাছে এখন একেবারে অচেনা। বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা অন্তর্জালে হাজারো রকম বিনোদনের ভিড়ে কখনো হয়ত চোখেই দেখেনি দড়ি দিয়ে মাটির গভীর থেকে জল টেনে তোলার অপরূপ দৃশ্য। আজকাল হয়তো আর কেউ সেসব গল্পও শোনেনা, শ্যামল রমণীরা জলের জন্য কুয়ার পাশে কিভাবে লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকতো। প্রয়োজন হারানোয় হাজার বছর ধরে মানুষের তৃষ্ণা মিটিয়ে আসা বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান এই কুয়া মানুষের স্মৃতি থেকেও আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। শুভদের বাসার ইদারাটা বেশ বড় ছিল। ছোটোদের পরিমাপ সম্পর্কে ধারণাটা বড়োদের মতো নয় বোধহয়। তবু বলছি কুয়াটা বড়ই ছিল। কারো বালতি পড়ে গেলে এর গভীরতা টের পাওয়া যেত। কুয়াটার বয়স সম্পর্কে যথাযথ ধারনা না থাকলেও ক্ষয়ে যাওয়া ইট দেখে অনুমান করা যেত কুয়াটা হয়ত আমার ঠাকুরদাদার চেয়েও প্রাচীন। সেই কুয়াতে একদিন আমি আমার নাম হারিয়ে ফেলেছিলাম। শুভর মা বাবা দুজনই শিক্ষক, আমার ও শুভর স্কুল শেষ হতো দুপুরবেলায়, সেই সময় থেকে শুভর মা বাবা না ফেরার আগে সমস্ত বিকালটা শুভর বাসায় ছিল আমার আর শুভর রাজত্ব। কুয়ার আশেপাশে যেন না যাই তার জন্য অনেক নিয়ম কানুন ও বাঁধা থাকলেও আমি আর শুভ প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে কুয়ার কাছে গিয়ে কুয়ার দিকে মুখ রেখে চিৎকার করতাম আর সেই শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতো, তখন বিজ্ঞান জানতাম না বলে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে ছিল কুয়ার ভেতর কেউ থাকে, হয়ত সে আমার মতন কেউ নয়ত সে আমার বলা কথা হুবুহু বলে কি করে। কখনো কখনো আমার খুব ইচ্ছে করতো নীচে নেমে কুয়ার তলদেশে সেই মানুষটিকে একবার দেখার এই ঠান্ডায় সে কিভাবে কুয়ার নীচে থাকে সেই রহস্যটা জানার ইচ্ছাও ছিল খুব।
একদিন স্কুল খোলা কোন একটা কারণে আমি আর শুভ স্কুল যাইনি, বাড়ি ফাঁকা শুভ আর আমি সকাল থেকেই তাদের বাড়িতে খেলেছি। শুভ আমাকে ডেকে বললো —
আমাদের একটা কুঠার আছে জানো?
আমি বোকার মতন তাকিয়ে বলি তাতে কি?
জলপরী ও কুঠারের গল্প পড়নি তুমি?
হ্যাঁ পড়েছি তো।
আমার মনে হয় কুয়াতে যে মানুষটা আমরা কথা বললে কথা ফিরিয়ে দেয় সে জলপরী!
তো?
চলো কুঠারটা ফেলে দেই।
তাহলে কি হবে?
কুঠার দিতে উপরে আসবে জলপরীটা।
গল্পে তো নদীর কথা বলেছে এটা কুয়া যদি না আসে তখন?
চলো দেখি না কি হয়।
আমি আর শুভ কুঠারটা ঘর থেকে লুকিয়ে এনে কুয়ায় ফেলতেই ঝপাস করে একটা শব্দ হলো, তারপর সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমি আর শুভ কুয়ার পাশে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম, কোন জলপরী উঠে এলো না। আমাদের সোনার রূপার কুঠার দেখালো না। শুভ যদিও আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল সেটা তো নদী ছিল এটা কুয়া আর আমরাও তো কাঠুরিয়া নই। কিন্তু সেইদিনই আমি জেনে গিয়েছিলাম গল্প আর বাস্তবতা কুয়ার উপর থেকে তলদেশের মতন দূর! তবুও আমাদের অপেক্ষা ফুরায় না। প্রতিদিন নিয়ম করে অপেক্ষা করি জলপরীর। কখনো কখনো আমাদের মনে হতো যে সময়টা আমরা কুয়ার পাশে না থেকে ঘরে থাকি বা স্কুলে যাই তখন হয়ত জলপরী কুয়ার নীচের থেকে উঠে এসে আমাদের খুঁজে গেছে। সেই সময় থেকে নানা রকম কল্পনা করতে করতে শুভ ডাইরী লেখার মতন করে পাতার পর পাতা গল্প লিখতে শুরু করে। আমি কয়েক লাইন লেখার পর আর কোন ঘটনা খুঁজে পাইনা। অদ্ভুত না?
কুয়োতে আমি কিভাবে আমার নাম হারিয়ে ফেলেছিলাম সেই গল্পটা শুনতে চাইছেন জানি। কিন্তু নাম হারিয়ে ফেলার আগে কি কি হয়েছিল তা যদি না বলি আপনি ঠিকঠাক কিছুই বুঝে উঠতে পারবেন না। জলপরীর অপেক্ষা করতে করতে শুভ দামী দামী ডায়েরী গল্পে গল্পে ভরিয়ে তুলছিল আর আমি একটি পাতাও শেষ করতে পারছিলাম না। বিষয়টা অন্যায় ছিল কিনা জানিনা আমি একদিন শুভর ডায়েরীগুলো পড়ে ফেলতে শুরু করলাম শুভর আঁড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে। একটা ডায়েরীতে জানতে পারলাম কোন এক জ্বরের সন্ধ্যায় শুভ কুয়ায় গিয়ে নিজের নাম ধরে চিৎকার করেছিল, সেই নাম বহুবার কুয়ার তলদেশ থেকে ফিরে ফিরে এসেছে। শুভ লিখেছে সেই স্বর জলপরীর ছিল। সোনা রূপার কুঠার না নিয়ে এলেও জলপরী সুস্থতা নিয়ে এসেছিল কুয়ার জল স্পর্শ করতেই ঘাম দিয়ে জ্বর নেমে গিয়েছিল। সেই দিন থেকে আমি জ্বরের অপেক্ষায়, গায়ে জ্বর এলে সন্ধ্যার অপেক্ষা কিছুতেই সবটা মিলছিল না, যেদিন মিললো জ্বরের ঘোরে আমি শুভদের বাসায় ছুটে গিয়েছিলাম, চিৎকার করে নিজের নাম ধরে ডেকেছি তারপর আর কিচ্ছু মনে করতে পারিনা। যখন জ্ঞান ফিরল জ্বরে আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছিল আমি বুঝতে পারলাম আমি হাসপাতালে শুয়ে আছি। কিন্তু আমি আমার নাম মনে করতে পারছিলাম না কিছুতেই। আমি আমার নাম হারিয়ে ফেলেছিলাম।
নাম হারানো আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। ধূসরবর্ণ কয়েকটা তুলোর মতো মেঘ ঝুলে আছে, কোনো নড়াচড়া নেই। মনে হলো আমারই জন্য যেন ওরা তখন ওখানে, যদিও কেন এমন মনে হলো বলতে পারব না। মনে পড়ে গেল, এভাবেই একবার কুয়ায় তাকিয়ে নিজের চোখ খুঁজেছিলাম জলে। আমার ভেতরে ধাবমান সময়ের অক্ষ যেন এমন সময় বড় করে একবার শ্বাস ফেলল। একটা জীর্ণ সৌধের মতো ধসে পড়ল দীর্ঘ চল্লিশটা বছর, পুরোনো আর নতুন সময় একই শরীরে জড়িয়ে গেল একটা ঘূর্ণিপাকে। সব শব্দ কোথায় অন্তর্হিত, আমার চারপাশের আলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে আমি কুয়াতে পড়ে গেলাম, যে কুয়াটা শুভর মৃত্যুর বহু আগেই বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। হৃৎপিণ্ডটা গলার পেছনে কোথাও ধকধক করে আওয়াজ করছে, হাতে-পায়ে কোনো সাড় নেই। ওইভাবে পড়ে ছিলাম বেশ কিছুটা সময়, জলে মুখ ডোবানো, উঠতে পারছি না। কিন্তু ভয় পাইনি। একটুও ভয় করছিল না। আর যেন কোথাও ভয় করার মতো কিছু নেই। সেসবের দিন কেটে গেছে। সেই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন তারপর আর দেখিনি। মাঝরাতে আর্তনাদ করে জেগে ওঠাও আর নেই। চেষ্টা করছি জীবনটা নতুন করে শুরু করতে। জানি, আমার পক্ষে হয়তো একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছে। হয়তো আর খুব বেশি দিন বাঁচব না। যত দেরিতেই হোক, শেষ অবধি যে একটা মুক্তি এসেছে, এতেই আমি কৃতার্থ, যেভাবেই হোক সামলে যে উঠতে পেরেছি। হ্যাঁ, কৃতার্থই : বিনা উদ্ধারে জীবনটা শেষ হয়ে যেতে পারত, তখনো ভয় পেয়ে আর্তনাদ করে উঠছি। শুভ এবার থামল আর তারপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কারো মুখে কোনো কথা নেই, দুজনের কেউ নড়ছে চড়ছে না, এমনকি যেন শ্বাসও নিচ্ছে না। দুজই গল্পের বাকিটুকুর অপেক্ষায় আছি। বাইরে, বাতাস থেমে গেছে, সব স্তব্ধ। শুভ এবার হাতটাকে আবার কলারের কাছে আনল, যেন কথা খুঁজছে। ‘বলা হয় যে ভয় একমাত্র ভয়কেই, তবে আমার বিশ্বাস একটু ভিন্ন,’ একবার বলে। তারপর, একমুহূর্ত পরেই যোগ করে, ‘ভয় তো আছেই। নানা সময়ে, নানা রূপে আমাদের কাছে আসে, আমাদের কাবু করে ফেলে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের কথা যেটা, সেটা হলো, এই সময় আমরা ভয়ের থেকে পালাই, চোখ বুজে ফেলি। এতে করে আমাদের ভেতরের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি নিয়ে সমর্পণ করে বসি অন্যকিছুর কাছে। আমার ক্ষেত্রে এই অন্যকিছুর ভূমিকা নিয়েছিল সেই কুয়া। আসলে যেদিন কুয়া থেকে নিজের নাম বহুবার হয়ে ফিরে এসেছিল সেদিনই আমি কুয়ার ভেতর হারিয়ে গেছিলাম, আমি জানতাম তুমি আমার ডায়েরী পড়বে তাই বেঁচে থাকার অভিনয় চালিয়ে গেছি। তোমার হারিয়ে যাওয়া নাম দিতে এসেছি, এই নাও তোমার নাম তোমার যাপন। কদিন পরে শুনলাম শুভ ক্যান্সারে মারা গেছে, জানাল ওঁর ভাগনে।
মধ্যরাত, ২ মে,২০২৪