শুক্রবার | ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:৪৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
নানা পরিচয়ে গৌরী আইয়ুব : গোলাম মুরশিদ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় কেন বারবার মণিপুরে আগুন জ্বলে আর রক্ত ঝড়ে : তপন মল্লিক চৌধুরী শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (শেষ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (প্রথম পর্ব) : অভিজিৎ রায় শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (ষষ্ঠ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (শেষ পর্ব) : বিজয়া দেব শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (পঞ্চম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ? : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (চতুর্থ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার শতবর্ষে সঙ্গীতের ‘জাদুকর’ সলিল চৌধুরী : সন্দীপন বিশ্বাস সাজানো বাগান, প্রায় পঞ্চাশ : অমর মিত্র শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (তৃতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (একাদশ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার খাদ্যদ্রব্যের লাগামছাড়া দামে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের : তপন মল্লিক চৌধুরী মিয়ানমারের সীমান্ত ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্যোগ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (দ্বিতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (দশম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার বুদ্ধদেব গুহ-র ছোটগল্প ‘পহেলি পেয়ার’ ‘দক্ষিণী’ সংবর্ধনা জানাল সাইকেলদাদা ক্যানসারজয়ীকে : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (প্রথম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (নবম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘তোমার নাম’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (অষ্টম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘হাওয়া-বদল’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (সপ্তম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার প্রবোধিনী একাদশী ও হলদিয়ায় ইসকন মন্দির : রিঙ্কি সামন্ত সেনিয়া-মাইহার ঘরানার শুদ্ধতম প্রতিনিধি অন্নপূর্ণা খাঁ : আবদুশ শাকুর নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘শুভ লাভ’
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

নানা পরিচয়ে গৌরী আইয়ুব : গোলাম মুরশিদ

গোলাম মুরশিদ / ১৭ জন পড়েছেন
আপডেট বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

নবজাতক আর ব্রাদার্স ফেইস পত্রিকার মারফত গৌরী আইয়ুবের কথা বেশ ভালো করেই জেনেছিলাম আগে থেকে। ১৯৬৪ সালের গোড়ায় ভারতের জব্বলপুর ইত্যাদি এলাকায় মুসলমান হত্যার প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু হত্যার যে তাণ্ডব হয়েছিল, তার সব রোমহর্ষক খবর-অখবর ছাপা হতো কলকাতার পত্রিকায়। এই ঘটনার ঠিক পরে সুলেখিকা এবং সমাজসেবী মৈত্রেয়ী দেবী কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি বাড়ানোর জন্য একটি সমিতি গঠন করেন ‘কাউন্সিল ফর দ্য প্রোমোশন অব কমিউনাল হার্মনি’ নামে। সংগঠনের মুখপত্র হিশেবে দুটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। বাংলা পত্রিকাটির নাম নবজাতক আর ইংরেজিটির নাম ব্রাদার্স ফেইস। এই কাজে মৈত্রেয়ী দেবীর ডান হাত হিশেবে যিনি কাজ করেন, তিনি গৌরী আইয়ুব। এর সাত বছর পরে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলো, তখনো মার্চ মাসের শেষ থেকেই তাতে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন এঁরা দুজন।

মৈত্রেয়ী দেবী ছিলেন প্রখ্যাত দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কন্যা। আর গৌরী আইয়ুব ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক ধীরেন্দ্রমোহন দত্তের কন্যা। দুজনই ছিলেন লেখিকা। মৈত্রেয়ী দেবী অনেক বই লিখেছিলেন। গৌরী আইয়ুব সে তুলনায় লিখেছিলেন খুবই সামান্য। কিন্তু তাঁর লেখার মান যে উন্নত ছিল তুচ্ছ কিছু সুখদুঃখ তার প্রমাণ। তাঁরা থাকতেনও একই পাড়ায়। অধ্যাপনা আর স্বাস্থ্যহীন স্বামীর সেবায় গৌরী আইয়ুবের সময় চলে যেত। মৈত্রেয়ী দেবীর সে সমস্যা ছিল না। তাঁর আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যও ছিল বেশি। কিন্তু দুজনেরই অভিন্ন পরিচয় সমাজসেবী হিশেবে। গৌরী দত্ত একটি অভিজাত এবং রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে করেছিলেন তাঁর থেকে দ্বিগুণ বয়সেরও বেশি প্রৌঢ় অধ্যাপক আবু সয়ীদ আইয়ুবকে। এই বিয়েকেও কলকাতার সমাজ দেখেছিল ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হিশেবে। যে-সময়ে তাঁরা বিয়ে করেন, তখন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিয়ে খুব কমই হতো। এ বিয়ে তাঁর পরিবার কখনো মেনে নেয়নি। বিশেষ করে তাঁর পণ্ডিত পিতা ডি এম দত্ত আর কখনো তাঁর মুখদর্শন করেননি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে প্রাণের ভয়ে বাংলাদেশের অন্তত ৭০ লাখ অসহায় শরণার্থী পালিয়ে গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। তাঁদের আশ্রয় এবং খাদ্য দিয়ে সাহায্য করার উৎসাহে যে-বান ডেকেছিল, তার কোনো তুলনা ছিল না। সে রকমের দৃষ্টান্ত বসনিয়া অথবা রুয়ান্ডায় তৈরি হয়নি। ৭১-এ যাঁর যা কিছু ছিল, তা দিয়ে যথাসম্ভব সাহায্য করেছিলেন তাঁরা। আমাদের পরিচিত এক প্রবীণ বন্ধু আছেন, শশবিন্দু চৌধুরী। নিতান্তই মধ্যবিত্ত। ছোট্ট বাড়ি। কিন্তু কোনো একটা সময়ে তাঁর বাড়িতে ২১ জন শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা শুধু আশ্রয় দেননি, সেই সঙ্গে সাহায্য দেওয়ার জন্য তাঁরা সরকারকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। পত্রিকাগুলোও জনমত তৈরি করেছিল। সুপরিচিত ব্যক্তি হিশেবে জাস্টিস মাসুদ, মৈত্রেয়ী দেবী অথবা গৌরী আইয়ুব যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন জনমত গঠনে এবং আর্ত মানবতার সেবায়। শেষের দুজনেরই ছিল হাঁটার সমস্যা। তা সত্ত্বেও প্রায়ই তাঁরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যেতেন শরণার্থী শিবিরে—সেবা করার জন্য। বিশেষ করে কলেরার রোগীদের সেবা করার উদ্দেশ্যে। আমরা যাঁরা বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী, তখন একদিনও এগিয়ে যাইনি মানবতার সেবায়। একবার মৈত্রেয়ী দেবী আর গৌরী আইয়ুব বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত মহিলা এমপিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার জন্য। যাননি।

যদ্দুর মনে পড়ে, ৮ এপ্রিল জাস্টিস মাসুদের ফ্ল্যাটে আশ্রয় পাওয়ার পরের দিনই গিয়েছিলাম তিন-চার শ গজ দূরে—আইয়ুবের ফ্ল্যাটে। আইয়ুব শান্ত, সৌম্য। এত আস্তে কথা বলেন যে প্রায় শোনা যায় না। তাঁর আন্তরিকতা ছিল লুকানো। অপর পক্ষে, গৌরীদি ছিলেন হাসি-খুশি, আইয়ুবের তুলনায় অনেক উচ্ছল। তাঁর আন্তরিকতার দৃষ্টান্ত দেব পরে।

আবু সয়ীদ আইয়ুবের লেখা আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটি রাজশাহীতে থাকার সময়ে স্মাগলারদের হাত দিয়ে পাচার করে আনিয়েছিলাম। পূর্ব আর পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে তখন পাচারকারী ছাড়া বড় একটা কেউ অথবা কিছু চলাচল করতে পারত না। বই তো নয়ই। বই আর পত্রিকার ওপর বিশেষ কড়াক্কড়ির কারণ, পাকিস্তান সরকারের আশঙ্কা ছিল, এসব পড়ার জিনিস এসে কওমের তমদ্দুনকে প্রভাবিত করে পাকিস্তানের ভিত্তি দুর্বল করবে। আমি ছিলাম আইয়ুবের ভক্ত পাঠক। কলেজ জীবনে তাঁর পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা বইটি উপহার হিশেবে পেয়েছিলাম—একটি প্রতিযোগিতায়। আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের যে-ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে মৌলিকত্ব ছিল—বাংলার পণ্ডিতদের লেখায় যা কখনো পড়িনি। তা ছাড়া তাঁর বাংলা ছিল সুললিত, সুখপাঠ্য, সাবলীল। অথচ আশ্চর্য, তাঁর মাতৃভাষা বাংলা ছিল না। অনুবাদেগীতাঞ্জলি পড়ে এতই ভালো লেগেছিল যে তিনি বড় হয়ে বাংলা শিখেছিলেন। তারপর নিজেই অমন অসাধারণ বাংলায় লিখতেন। একাত্তরের তেসরা এপ্রিল আমরা যখন সীমান্ত অতিক্রম করে মুর্শিদাবাদে ঢুকি, তার পরের সপ্তাহে দেশ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে তাঁর একটা লেখা বেরিয়েছিল। তাও আমাদের আকৃষ্ট করেছিল।

গৌরীদি আমার কথা আগে থেকেই শুনেছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে। মৈত্রেয়ীদির সঙ্গে চিঠিপত্রের যোগাযোগ ঘটে—যদ্দুর মনে পড়ে, ৬৫ সালে। তার দুই বছর আগেই পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিশেবে যোগ দিয়েছিলাম। তারপর থেকে মৈত্রেয়ীদি আমাকে নবজাতক এবং ব্রাদার্স ফেইস পাঠাতেন নিয়মিতভাবে। মংপুতে রবীন্দ্রনাথ এবং বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ—বই দুটিও পাঠিয়েছিলেন। আমার দু-একটা লেখাও বোধ হয় নবজাতক-এ বেরিয়েছিল। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই ৪ এপ্রিল বহরমপুর থেকে তাঁকে ফোন করেছিলাম সবার আগে। পশ্চিমবঙ্গে আমার পরিচিত অন্য কেউ ছিলেন না। আত্মীয়ও তো নয়ই। পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা বেঁচে আছ!’ তারপর তিনি তাঁর বাড়িতে ওঠার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু যখন শুনলেন, আমরা সর্বসাকল্যে আটজন, তখন দুদিন পরে যেতে বললেন। এই আশ্বাসেই কলকাতায় গিয়েছিলাম।

তিনিই জাস্টিস মাসুদের একটা খালি ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিয়েছিলেন আমার জন্য। সেখানে আমার আগে, কত আগে জানিনে—বাস করতেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তখনো দরজার ওপরে তাঁর সুন্দর হাতের লেখায় নোটিশ ছিল ‘দুপুরে খাওয়ার পর বিরক্ত করবেন না। তখন ঘুমাই।’ এই ফ্ল্যাটেরই সামনে ডান পাশে আমাদের ফ্ল্যাট থেকে ১৫-২০ গজ দূরে বাস করতেন শম্ভু এবং তৃপ্তি মিত্র, তাঁদের কন্যা শাঁওলিকে নিয়ে। মাঝেমধ্যেই সেখানে আসর বসত ‘বহুরূপী’ গোষ্ঠীর। মহড়াও হতো।

এলিজা আর আমি যাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারি, তার জন্য গৌরীদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন। এমনকি, আমাদের বিয়ে কবে হয়েছিল, তা-ও। যখন শুনলেন, এলিজা ছিল আমার ছাত্রী, তখন আইয়ুব মুচকি হেসে বলেছিলেন, যাহা হাম, তাহা তোম। ফের যাওয়ার কথাও বলেছিলেন তাঁরা। তারপর প্রায়ই যেতাম।

গৌরী দত্তের জন্ম পাটনায়, ১৯৩১ সালে। সেখানেই স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেন। বিএ ক্লাসে উঠে রাজনৈতিক কর্মী হিশেবে কারাবরণ করেন। তাই পাস করার পর পিতা তাঁকে পাঠিয়ে দেন শান্তিনিকেতনে (১৯৫০)। সেখানে দর্শনে ভর্তি হন তিনি। তখন সেই বিভাগে একজন অধ্যাপক ছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। লেখাপড়ায় ভালো বলে যাঁদের আইয়ুব পছন্দ করতেন, গৌরী ছিলেন তাঁদের একজন। শিক্ষক এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্যে গৌরীদিও পছন্দ করতেন তাঁকে। কিন্তু আইয়ুব দুটো কারণে তাঁর ভালো লাগা দীর্ঘ দিন গোপন রেখেছিলেন। এক. তাঁর বয়স অনেক বেশি। দুই. তিনি অসুস্থ। যক্ষ্মায় ভুগে উঠে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল। কত দিন বাঁচবেন, সে বিষয়ে বেশি আশাবাদী ছিলেন না। বিশেষ করে বান্ধবীদের ঠাট্টা থেকে এ বিষয়ে গৌরীদি সচেতন হয়ে ওঠেন। ইতিমধ্যে আরেক দফা অসুস্থ হয়ে আইয়ুব হাসপাতালে আশ্রয় নেন। তবু দুজনের প্রতি দুজনের ভালো লাগা, ভালোবাসা বিদায় নেয়নি।

তত দিনে গৌরীদির পরিবারও এসে বাসা বাঁধেন শান্তিনিকেতনে। আর, ১৯৫২ সালে গৌরীদি অনার্স পাস করে সেখানেই শিক্ষা ভবনে ভর্তি হন বিটি পরীক্ষার জন্য। পরের বছর, ’৫৩ সালে—বিটি পাস করে চলে যান কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অতঃপর এডুকেশনে এমএ পাস করেন ’৫৫ সালে। পিএইচডির কাজও করেছিলেন, কিন্তু শেষ করেছিলেন কি না, আমার জানা নেই। ’৫৬ সালের জুন মাসে আইয়ুব আর গৌরীদি অনাড়ম্বরভাবে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করলেন।

পাস করার পর থেকেই একটা নাম-করা কলেজে অধ্যাপনা করতেন তিনি। কিন্তু অধ্যাপনার জন্য নয়, সমাজসেবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিশেবেই তাঁর পরিচয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর অবদান কেবল শরণার্থী শিবিরে অসুস্থ ও অসহায়দের সেবা করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। যুদ্ধের সময়ে যে-শিশুরা অনাথ হয়েছিল, তাদের নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবী আর তিনি গড়ে তুলেছিলেন কলকাতার বাইরে মধ্যমগ্রামে ‘খেলাঘর’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে তাদের ভরণপোষণ এবং শিক্ষার আয়োজন করেন তাঁরা। মৈত্রেয়ী দেবী মারা যাওয়ার পর (১৯৯০) জীবনের শেষ পর্যন্ত আরথ্রাইটিসের তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করেও খেলাঘরের প্রধান হিশেবে কাজ করেছেন গৌরীদি। কেবল দরিদ্র শরণার্থীদের সেবা করেননি তিনি, যে-মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদেরও যথাসম্ভব শান্তি ও সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছিলেন।

দুটি মাত্র ঘটনার উল্লেখ করব এখানে, তা থেকেই বোঝা যাবে তিনি কেমন মানুষ ছিলেন।

পঁচিশে মে তারিখের ভোরবেলায় তখনো ঘুম থেকে উঠিনি। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। আমাদের সহকর্মী ফারুক খলিল সাহেব এসেছেন মনে করে দারুণ বিরক্ত হলাম। এ রকমের অসময়ে এসে তিনি নৈরাশ্যের কথা প্রায়ই শোনাতেন। দরজা খুলে দেখি একটা ট্রে হাতে গৌরীদির এক গৃহভৃত্য দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেতে ঢাকনা দেওয়া একটা কিছু। কিন্তু বাইরে দেখতে পেলাম একগুচ্ছ ফুল আর একটি কার্ড। কার্ডে লেখা আছে, ‘তোমাদের এই শুভদিনে আন্তরিক শুভেচ্ছা।’ কলকাতায় গিয়ে ঠেলার চোটে নিজেদের বিবাহবার্ষিকীর কথাই ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু গৌরীদি মনে রেখেছিলেন এবং পাঠিয়েছিলেন কিছু ফুল আর খাবার। পরে নিমন্ত্রণ করেও খাইয়েছেন। খাবারও পাঠিয়েছেন।

এ রকমের আরেকটি ঘটনা আমাদের অন্য দুই সহকর্মী আলি আনোয়ার আর হোসনে আরা সম্পর্কে। অক্টোবর মাসের দিকে তাঁদের তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয়। তাঁরা থাকতেন পার্ক সার্কাস থেকে অনেক দূরে—বেহালা অথবা চেতলায়। আমরা এই সন্তানকে দেখতে যাইনি। ঠিক কবে হয়েছিল, তারও খবর রাখিনি। কিন্তু গৌরীদি গিয়েছিলেন শুভেচ্ছা আর কাপড়চোপড়ের উপহার নিয়ে। তাঁর আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। কারণ অসুস্থ আইয়ুবের কোনো আয় ছিল না। সংসার চলত তাঁর একার আয়ে। কিন্তু তারই মধ্যে যথাসম্ভব করতেন সবার জন্য।

তিনি বেশি লেখেননি, কিন্তু অসাধারণ হাত ছিল লেখার। কেবল প্রবন্ধ নয়, তিনি অল্প কয়েকটি গল্পও লিখেছেন। প্রবন্ধ এবং গল্প—উভয়ের ভাষা ছিল সরল, সুন্দর এবং সাবলীল। আইয়ুব শেষ দিকে খুবই অসুস্থ ছিলেন কয়েক বছর। আইয়ুব যখন শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন, তখন তাঁর দুটি গ্রন্থের মূল্যবান ভূমিকা লেখেন গৌরীদি। তাঁর গল্পগুলো প্রকাশিত হয়েছিল তুচ্ছ কিছু সুখদুঃখ গ্রন্থে।

গ্রন্থের একটি গল্প ‘চিরন্তনী’। সেই গল্প থেকে একটা দৃষ্টান্ত দিলেই তাঁর ভাষা যে কত সহজ অথবা সুন্দর ছিল, তা বোঝা যাবে :

‘বড় বৌটা সেয়ানা হতে হতেই ভিন্ন হয়ে গেল। এদিকে রহিমার স্বামীর চোখ দুটোতে আর আলো নেই—গত চৈত্র মাস থেকেই আর দেখতে পায় না। মেজ ছেলে হাশেমটা বড় হয়েছে তাই ভরসা। নইলে কে যে আজ খেতখামার দেখত, ঘর সামলাত! এখন এরও একটা বিয়ে দেখতে হয়। কিন্তু বিয়ে দিলেই পাছে পরের বাড়ির মেয়ে এসে কুমন্ত্রণা দিয়ে এই ছেলেটাকেও পর করে নেয়—সেই ভয় রহিমার! মেয়ে দুটো ছোট, ছোট ছেলেটা এখনও নাবলক, তার ওপর স্বামী তার কানা মানুষ—সেই জন্যেই তো যত ভাবনা। জন-মজুর লাগিয়ে যদি ঐ আড়াই বিঘা জমি চাষ করাতে হয় তবে আর নিজের থাকবে কি? এমনিতে মেজ ছোলেটার স্বভাব ভালো, মনও ভালো, বাপমা ভাইবোনের উপর টানও আছে বেশ। তা টান কি আর বড় ছেলেটার ছিল না? অথচ এই ক’টা বছরেই পাল্টে গেল—এখন বৌয়ের বুদ্ধিতে ওঠে বসে। তাই অনেক ভেবেচিন্তে মেজবুবু শাকিলার ছোটমেয়ে হুসনার সঙ্গে প্রস্তাব করবে রহিমা। নিজের বোনের মেয়ে তো একটু রহম-সহম করবে।’

গল্পটি গ্রামের একটি মুসলমান পরিবার নিয়ে। মা তার বোন-ঝিকে আনতে চায় ঘরের বউ হিশেবে। কিন্তু প্রথমে বলতে গেলে দর কষাকষিতে বিয়ে ভেঙেই যায়। শেষ পর্যন্ত বিয়ের প্রস্তাব মেনে নেয় কন্যাপক্ষ। উপসংহারটি খুব নাটকীয় নয়। কিন্তু গল্পটি তার সহজ সৌন্দর্যের জন্য গল্প হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে আজীবন শহরে লালিত একটি রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের কন্যা হয়েও তিনি যে-চিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন গ্রামের একটি দরিদ্র মুসলমান পরিবার সম্পর্কে, বাস্তবতার আলোতে তা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এ গল্পের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ভাষার সহজ সৌন্দর্যে।

তাঁর পরিচয় নানা রকমের। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন মানবদরদি, সমাজসেবী। দুঃস্থ মানুষের সেবিকা। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে তিনি সাধারণ মানুষের অনেক ঊর্ধ্বে। তিনি একজন দেবী, যদি দেবী বলে কিছু থাকে। ১৩ জুলাই তাঁর দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সব শরণার্থী বাংলাদেশিদের তরফ থেকে তাঁকে আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন