বঙ্গে মনসাপূজার চল বহুযুগ ধরেই। বস্তুত চচ্চড়ি, অরন্ধন, শাকরাখা, ঢেলাফেলা পার্বণ ও দশহরা এ বঙ্গের পরিচিত মনসা-পার্বণ।
দশহরার ‘দশ’ কিন্তু এখানে সংখ্যাবাচক নয়। এখানে, দশ=√দনশ্+হি (অনুজ্ঞা, মধ্যমপুরুষ-১ব)। মানে দংশন কর, কামড়াও। দশহরা মানে দশ-এর প্রতিকার বা বিষনাশকরণ।
গ্রামাঞ্চলে দশহরার দিন ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে বাড়ির চারপাশে বাইরের দেয়ালে কোনও ফাঁক না রেখে গোবরজল গোলা দিয়ে মোটা করে লাইন টানা হয়। ওটাকে বলে দশরবেড়া (দশহরবেড়া)। বাড়িতে যাতে কোনো ভাবে সাপ প্রবেশ করতে না পারে, তার জন্যে এই সাবধানতা। দশহরা তাই মনসার পূজা। শব্দটি বিষহরার মতো।
আবার দশন মানে দন্ত।
দশন= পুং, ক্লীব, [√দনশ্+ অন (ল্যুট্)-ণ, ‘ন’-লোপ নিপাতিত]। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে আছে, ‘মতি ভোলে রাধিকার দশন রসনে।’ তন্বীশ্যামাশিখরিদশনা যুবতীর কথাও শোনা যায়।
প্রশ্ন হল, দশহরার সঙ্গে দেবী মনসা জড়ালেন কী করে? আসলে জল আর জঙ্গল দিয়ে ঘেরা রাঢ়বঙ্গের জনপ্রিয় লৌকিক দেবী মনসা। যিনি একাধারে সর্পদেবী। অন্যদিকে সন্তানসন্ততির এবং সৌভাগ্যকামনারও তিনিই দেবী। মনসামঙ্গল অনুযায়ী, দেবী মনসা শিবের মানসকন্যা। তিনি নাগরাজ বাসুকির ভগিনী। বছরের নানা সময়ে বিভিন্ন জায়গায় মনসাপুজোর চল থাকলেও জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লা দশমীতে দশহরার দিনই মা মনসার বছরের প্রথম স্নানযাত্রা শুরু হয়। মনে করা হয়, বর্ষার আগে সর্পকুলের বাড়বাড়ন্ত হয় এই দিন থেকেই। তাই দশহরার দিনে মা মনসার পুজো করে দেবীকে সন্তুষ্ট রাখা হয়। মূলত, আর পাঁচটি ব্রতের মতই আত্মকল্যাণের সঙ্গে পারিবারিক কল্যাণে এই পুজোর আয়োজন।
একটি বইয়ে পাচ্ছি,
দশহরার মনসা পূজা হল বাংলার এক ঐতিহ্যবাহী ব্রত, যা জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে পালিত হয়। মূলত গ্রামবাংলায় এই পূজা প্রচলিত, তবে শহরেও অনেকেই এই ব্রত পালন করেন।
পূজার উদ্দেশ্য ও মাহাত্ম্য —
— সর্পদংশন থেকে রক্ষা পাওয়া।
— পরিবারে সুখ-সমৃদ্ধি ও সন্তানের মঙ্গল কামনা।
— মনসা দেবীকে সন্তুষ্ট করে জীবনের বিপদ-আপদ দূর করা।
পূজার নিয়মাবলী অনেকেরই জানা। তবু উল্লেখ করা দরকার।
— পূজার আগের দিন নিরামিষ আহার গ্রহণ করা হয়।
— পূজার দিন সকালে স্নান করে সিজগাছের ডাল বা মনসা দেবীর প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়।
— নৈবেদ্য হিসেবে দুধ, কলা, চিনি, সন্দেশ ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।
— মা মনসাকে ১০ প্রকার ফুল, ১০ রকমের ফল এবং, ১০টি প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করা হয়।
— ধূপ বা ধুনো ব্যবহার করা হয় না, কারণ, দেবী মনসা নাকি ধোঁয়া সহ্য করেন না।
— পূজার শেষে দুধ ও কলা প্রথমে প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
— এই পূজায় দেবী মনসার অনুচর অষ্টনাগদের উদ্দেশেও নৈবেদ্য প্রদান করা হয়।
— বাঁকুড়া জেলায় এই দিনে ঘুড়ি ওড়ানো এবং অরন্ধন (রান্না না করা) প্রথা রয়েছে।
এই পূজা সর্পদংশনের ভয় থেকে মুক্তি এবং, পরিবারের কল্যাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত।
এইদিন কলার মধ্যে করলা কুঁচি পুরে গত গেলা একটি বিশেষ প্রক্রিয়া। দশটি ফুলের পাপড়ি ভেজানো জল গায়ে ছিটিয়ে দেওয়ার প্রথা আছে। বস্তুত গ্রামবাংলা ও মফসসলে দশহরার দিন মনসাপূজার রেওয়াজ এখনও চোখে পড়ার মতো।
চমৎকার লেখা। তথ্য সমৃদ্ধ আমাদের মূলত রাঢ়বঙ্গের সংস্কৃতির একটা চমৎকার ব্যাখ্যা।