বাংলাভাষার বিশেষজ্ঞদের এখন অনুষ্ঠানের ফিতে কাটার হিড়িক পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের মোড়ক উন্মোচনও চলছে।
বাংলাভাষায় বহুব্যবহৃত একটি শব্দ ‘হিড়িক’।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় শব্দটির ব্যুৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তির জায়গায় জিজ্ঞাসাচিহ্ন বসিয়েছেন। যদিও ‘ভিড়’ শব্দটি থেকে আসতে পারে বলেছেন (?) চিহ্ন যোগে।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালাভাষার অভিধান’ও জিজ্ঞাসাচিহ্ন (?) দিয়েছে। ‘হুড়’ থেকে কিনা সে বিষয়েই জিজ্ঞাসা।
কোনও কোনও অভিধানে ‘বাংলায় প্রচলিত’ বলে দায় এড়ানো হয়েছে।
গুলাম মুরশিদ সম্পাদিত বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক অভিধান জানাচ্ছে শব্দটির ব্যুৎপত্তি অজানা।
তবে প্রয়োগ দেওয়া হয়েছে উদ্ধৃতি সহকারে। ১৮৬১তে হুতোম প্যাঁচার নকশায় আছে ‘হিড়িক’ শব্দটির একাধিক প্রয়োগ। তবে বানান যুগধর্ম অনুযায়ী ‘হিড়ীক’। ‘সেই হিড়ীকে… একজন দলে বাড়লো’। ১৯৩৩য়ে জীবনানন্দ দাশ ব্যবহার করেছেন হিড়িক শব্দটি। ‘তারা খাবে হিড়িকটা কেটে গেলে’। ১৯৬৩তে মনীশ ঘটকের কবিতায় পাচ্ছি ‘কী হিড়িকই আনলে ক্ষুদিরাম’।
সময়াভাবে বিচিত্রা অনলাইন টেগোর ভেরিওরাম দেখা হল না। তাহলে বোঝা যেত হিড়িক শব্দটির প্রতি রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাতিত্ব ঠিক কতটা ছিল।
তবে সুবলচন্দ্র মিত্রর আদর্শ বাংলা অভিধানে ‘হিড়িক’ শব্দটির অর্থ দেওয়া হয়েছে, সুযোগ, ভিড়, ঠেলা, চাপ, হাঙ্গামা। শব্দটিকে দেশজ বলা হয়েছে।
তাহলে কি হিড়িকের ব্যুৎপত্তি আরবি-ফারসি থেকে আসতে পারে। নাহ্। সে গুড়েও বালি। তিন-চারটি নামকরা অভিধানেও হিড়িকের টিকি দেখতে পেলাম না।
অতএব অগতির গতি ড. সত্যনারায়ণ দাশ-প্রণীত ‘বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ (ব্যুৎপত্তিকোষ)’ বইটি।
দেখলাম, কন্নড় ভাষায় ‘হিডি’ বলে একটি শব্দ আছে। হিডি শব্দের অর্থ চেপে ধরা। ‘হিডিক’ শব্দের অর্থ চাপ। তাহলে হিডিক থেকেই কি বাংলায় হিড়িক? কে জানে, হতেও পারে। বিশেষ করে সুবলচন্দ্র মিত্রের আদর্শ বাংলা অভিধানে হিড়িক শব্দটির অন্যতম অর্থ হল, চাপ। মিলে যাচ্ছে কাঁটায় কাঁটায়।
বাংলায় কত যে দ্রাবিড় শব্দ এখনও অজ্ঞাতমূল শব্দ হিসেবে বিরাজ করছে, তার ইয়ত্তা নেই। ভাষাতাত্ত্বিকদের কাজ হল এগুলি খুঁজে বের করা। তা না করে তাঁরা সেমিনারে বক্তৃতা দিতে ও ফিতে কাটতে ব্যস্ত।