শনিবার | ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৬:৪৬
Logo
এই মুহূর্তে ::
পুজোর পরিবর্তন, পরিবর্তনের পুজো : সন্দীপন বিশ্বাস পিতৃপক্ষের মধ্যে পালিত একাদশী — ইন্দিরা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত অরণ্যের অন্তরালে তাম্বদি সূরলা : নন্দিনী অধিকারী ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ হীরালাল সেন : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্যাসাগরের অন্তরালে ঈশ্বরচন্দ্র, পূর্ব পুরুষের ভিটে আজও অবহেলিত : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব সুধীর চক্রবর্তী স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার : দীপাঞ্জন দে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে দুর্গা রূপে আরাধনা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালির নিজস্ব দুর্গা : শৌনক দত্ত সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার : দিলীপ মজুমদার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘প্রাতঃভ্রমণ’ বন্যায় পুনর্জীবন বেহুলার : রিঙ্কি সামন্ত গরানহাটা কি ছিল ভেড়ার হাট : অসিত দাস ডিভিসি-র ছাড়া জলে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ নাজেহাল, দায় কার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সুধীর চক্রবর্তী মুক্তধারা ভাষণমালা : দীপাঞ্জন দে বোর্হেসের গোলকধাঁধা : অশ্রুকুমার সিকদার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের দুর্গোৎসব : রিঙ্কি সামন্ত মর্ত্যে দুর্গাপূজার সেকাল ও একাল : অসিত দাস বই-বাই : নবনীতা দেব সেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘প্রবাসী’ ম্যান মেড নয় ডিভিসি-র পরিকল্পনা আর রূপায়নে গলদ : তপন মল্লিক চৌধুরী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে রাখাইনে সেইফ জোন তৈরি করা আবশ্যক : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন ফলের নামটি পাকা কলা : রিঙ্কি সামন্ত বই-বাই : নবনীতা দেব সেন হেমচন্দ্র বাগচীর ১২০তম জন্মবর্ষ : দীপাঞ্জন দে নিম্ন চাপের অতিবৃষ্টি ও ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত আরামবাগ : দেবাশিস শেঠ আরামবাগে ভয়াবহ বন্যা, দুর্যোগের পদধ্বনি, ক্ষোভ জনমানসে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন মেয়েদের ক্ষমতায়নের পক্ষেও আওয়াজ তুলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী কবি দেবদাস আচার্য-র কবিতাজগৎ — বহমান পৃথিবীর জীবনপ্রবাহ, চেতনাপ্রবাহ : অমৃতাভ দে মনসার নাম কেন ঢেলাফেলা : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

চির বিপ্লবী চে গুয়েভারা — মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা : মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার

মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার / ১৭৩ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ১৬ জুন, ২০২৪

চে গুয়েভারার নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে আসে একজন রোমান্টিক বিপ্লবীর অবয়ব। চির বিপ্লবী চে গুয়েভারা বা চে গেভারা জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনায়। জনমানুষ তাকে ডেকেছিল স্নেহ শ্রদ্বায় ‘চে’। কিউবায় তিনি ‘কমাদান্তে’ ও ‘মেজর চে’ হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছে চে ছিল অনুপম অনুপ্রেরণা। মৃত্যুর (১৯৬৭) পরও দশকের পর দশক জুড়ে চে হয়ে রয়েছেন তারুন্যের প্রতীক। যে তরুন সুন্দর ও বৈষম্যহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে। শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নয়, চে এখনও অন্যায়, বৈষম্য, দূর্নীতি, লুন্ঠন, ও শোষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আইকন।

পাহাড়ে যুদ্ধরত দু’পক্ষই পড়ছে চে এর বই

চে গুয়েভারার শক্তি ও অনুপ্রেরণার কথা আশ্চর্য্য এক পরিবেশে প্রথম উপলদ্ধি করি। ১৯৮৫ সাল। আমাদের পদাতিক ব্যাটালিয়ন তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী সৃষ্ট বিদ্রোহ দমনের কাজে পরিচালিত অভিযানে কাপ্তাই-বিলাইছড়ি-ফারুয়া এলাকায় নিয়োজিত। ১৯৭৬ সাল থেকে অসাধারণ সৌন্দর্য্যময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বইছিল হিংসার প্রবল ঝর্ণাধারা। তবে এই ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে সাধারন জনগণ মোটেই প্রতিপক্ষ ছিল না। এই যুদ্ধের মূলমন্ত্র-‘‘স্থানীয় জনগণের হৃদয় মন জয়’’।

একদিন আমাদের একটি পেট্রল বা টহল দল পাহাড়ী অরন্যে শান্তি বাহিনীর অস্থায়ী এক ক্যাম্পে রেইড (আক্রমণ) করে অনেক কিছুর মধ্যে চে গুয়েভারার বিখ্যাত ‘‘গেরিলা যুদ্ধ’’ বইটা উদ্ধার করেছিল। জব্দ তালিকায় অন্তভূক্ত হয়ে উর্ধ্বতন হেড কোয়ার্টারে পাঠানোর আগেই বইটি বাঁশ-ছনের তৈরী ক্যাম্পে সারা রাত ধরে হারিকেনের আলোয় পড়েছিলেন এক জন তরুন সেনা কর্মকর্তা। বই এর একেবারে শেষের দিকে এসে কেরোসিনের অভাবে হারিকেন বন্ধ হয়ে গেলেও তরুন মনে এর আবেদন রয়ে গেল। চে গুয়েভারার কি অদ্ভুত শক্তি। যুদ্ধের ময়দানে দু’পক্ষই পড়ছে তাঁর বই!

একজন মেজর চে

অনবদ্য বডি ল্যাংগুয়েজ, লম্বা চুল ওপরে লম্বা গোলাকার কালো চ্যাপ্টা টুপি, কাঁধে অস্ত্র আর হাতের আঙ্গুলে ধরা চুরুট-কিংবদন্তি কমাদান্তের এই ইমেজ সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়। ষাটের দশকে এই আর্জেন্টাইন বীর চে ছাত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতীকে পরিনত হন। চে ছিলেন প্রগতিবাদের নব অনুপ্রেরণা ও তরুনদের কাছে বিপ্লবী আকাঙ্খার সমার্থক। চে বলতেন, বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। যা বিশ্বের বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। ১৯৬৭ সালে তাঁকে হত্যার পর তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বময় অসংখ্য তরুনের স্বপ্নের নায়ক, বিপ্লবের জীবন্ত আইকন। ‘চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়/আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে…। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘‘গুয়েভারার প্রতি’ এই কবিতায় সশ্রদ্ধ উচ্চারণের মতো সারা বিশ্বের লাখো-কোটি মানুষের চে’র স্মরণে মাথা নত হয়ে আসে”।

কিংবদন্তি এই বিপ্লবীর দৃপ্ত মুখচ্ছবি ঠাঁই করে নিয়েছে টি-শার্টে, পোষ্টারে, আর্মব্যান্ডে, ব্যাজে, টাকায়, ডাকটিকিটে, কফির মগে, চাবির রিংয়ে, ক্যাপে, বইয়ের প্রচ্ছদে ও ব্যানারে। একাধিক দেশে তাকে নিয়ে নাটক হচ্ছে। তিনি উঠে এসেছেন কবিতায়, উপন্যাসে, সংগীতে, চলচ্চিত্রে, শিল্প প্রদর্শনীতে। তিনি কিংবদন্তি হয়ে আছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে; শুধু লাতিন আমেরিকায় নয়, পৃথিবীর সব জায়গায়, সব দেশে।

কিংবদন্তির জীবন যেরকম

চে গুয়েভারা আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী। একাধারে বিপ্লবী, লেখক, গেরিলা নেতা, বুদ্ধিজীবী, সমরতাত্ত্বিক, কূটনীতিবিদ ও কিউবা বিপ্লবের অন্যতম নেতা। বিপ্লবীদের আদর্শ চের জন্ম আর্জেন্টিনার রোজারি শহরে ১৯২৮ সালের ১৪ জুন। পুরো নাম অ্যারনেস্তো গুয়েভারা দে লা সেরনা। ছোটবেলায়ই চে সমাজের দরিদ্র অংশের সঙ্গে মেলামেশায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। বামঘেঁষা পরিবার থেকে আসা চে মার্কস-এঙ্গেলসের আদর্শে উজ্জীবিত হন।

চিলির খনিশ্রমিকদের দুর্দশা দেখে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন। চে পেশায় ছিলেন একজন ডাক্তার এবং ফিদেল কাস্ত্রোর দলে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে পরিচয়ের পর কিউবার বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। কাস্ত্রো ক্ষমতায় গেলে চে কিউবার ন্যাশনাল ব্যাংকের সভাপতি ও পরে শিল্পমন্ত্রী হন। ১৯৬৫ সালে কিউবা থেকে হঠাৎ চলে যান কঙ্গো রণাঙ্গনে। এরপর বলিভিয়ায় আসেন কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে। দুর্ভাগ্য, ১৯৬৭ সালে এক ব্যর্থ মিশনে ধরা পড়েন বেশ কিছু সহযোদ্ধাসহ। পরদিন ৯ অক্টোবর মার্কিন সমর্থনপুষ্ট বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট রেনে বরিওন্তোসের নির্দেশে তাঁকে হত্যা করা হয়।

তাঁকে সমাহিত করা হয় বলিভিয়ার এক গ্রামে। প্রায় ৩০ বছর পর অবসরপ্রাপ্ত এক বলিভিয়ান সেনা অফিসার খোঁজ দেন চের কবরের। অবশেষে ১৯৯৭ সালে তাঁর দেহ ফিরিয়ে আনা হয় কিউবায়। সমাহিত করা হয় সান্তা ক্লারায়। তবে সবার কাছে চে হয়তো বীর নন। বিপ্লবোত্তর কিউবায় কয়েকশো কারাবন্দি হত্যায় চে গুয়েভারার কথিত সংশ্লিষ্টতা তাঁর ইমেজ ক্ষুণ্ণ করেছে। চে গুয়েভারা বেশ কয়েকটি বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো: মোটর সাইকেল ডায়েরী, গেরিলাযুদ্ধ, ও বলিভিয়ার ডায়েরী।

বাংলাদেশে এসেছিলেন চে গুয়েভারা!

এ ‘আন্তর্জাতিক বিপ্লবী’র একক কোনো দেশ ছিলো না। সারা বিশ্বই ছিলো তার দেশ। বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আলজেরিয়ার স্বাধীনতার উৎসবে (১৯৬২) পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সেই উৎসবে চের সঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দেখা হয়। ১৯৫৯ সালে চে ভারত ও পাকিস্তান সফর করেন। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ‘‘দৈনিক বনিক বার্তায়’’ প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, চে ১৯৫৯ সালে জুলাইয়ে ছদ্মবেশে নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুট মিলে এসেছিলেন। সেখানে তিনি শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। তবে চে গুয়েভারার বাংলাদেশে আসার বিষয়টি আরো যাচাই ও অনুসন্ধানের দাবী রাখে। ২০২৩ সালে কলকাতায় এসেছিলেন চে এর জেষ্ঠ কন্যা অ্যালেইদা গুয়েভারা।

নমপেনে চে-‘সমাজতন্ত্রের গোরস্থানে’ও একজন বিপ্লবীর আলো

১৯৯২ সাল। কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন তখন আন্তর্জাতিক এক শহর। কম্বোডিয়ায় শান্তি আনতে হাজার হাজার শান্তিরক্ষী কাজ করছে। বাংলাদেশ থেকেও এসেছে প্রায় এক হাজার শান্তি-সেনা। এই জাতিসংঘ মিশনটির নাম আনটাক। আনটাক- তথ্য কেন্দ্রে কাজ করছে আমেরিকান তরুন লেখক-গবেষক ডেভিড এশলে। এশলে কম্বোডিয়া ও খেমাররুজ (কম্বোডিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টি) বিষয়ক একজন সিরিয়াস গবেষক। এশলের সদ্য প্রকাশিত বই ‘দি নিউ খেমাররুজ’ পাঠকদের দৃষ্টি কেঁড়েছে।

কমিউনিস্ট পার্টি অব কমপুচিয়ার (খেমাররুজ নামে অধিক পরিচিত) নেতৃত্বে বিপ্লবের যে দাবানল সমগ্র কম্বোডিয়াকে জ্বালিয়েছিল (এপ্রিল ১৯৭৫-জানুয়ারি ১৯৭৯) তা ছিল পৃথিবীর বিপ্লবের ইতিহাসে নৃশংসতম ও অন্যতম প্রাণঘাতী। মনে করা হয় খেমাররুজ শাসনামলে প্রায় দশ লক্ষ কম্বোডিয় যুদ্ধ, অনাহারে, অতিরিক্ত খাটুনি/পরিশ্রম, বিনা চিকিৎসা এবং হত্যাকান্ডে মৃত্যুবরণ করে। কম্বোডিয়ার খেমাররুজ বিপ্লবের গতিপ্রকৃতি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। খেমাররুজ নেতৃবৃন্দ মূলত কোন আদর্শের ভিত্তিতে এই বিপ্লব সংগঠিত করেছিল, তা এখনো অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। খেমাররুজ নেতৃবৃন্দ প্রচার করতো যে, তারা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পথ অনুসরণ করে বিপ্লব করেছে। কুখ্যাত পলপটের নেতৃত্বে খেমাররুজ দল কম্বোডিয়াকে একটি মানব সৃষ্ট দোজখে পরিনত করে। একজন লেখকের মতে “সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্রের সূতিকাগার হলে কম্বোডিয়া হলো সমাজতন্ত্রের গোরস্থান”। জাতিসংঘ স্বেচ্ছাসেবক (ইউএনভি) হিসেবে প্রায় শতাধিক অসামরিক বাংলাদেশী কম্বোডিয়ায় কাজ করছিলেন। ছাত্র জীবনে তাদের কেউ কেউ বামপন্থি ছিলেন। তারাও খেমাররুজ বিপ্লবের জঘন্য রূপ দেখে বিস্মিত হয়েছেন।

১৯৯৭০ সাল থেকে কম্বোডিয়ায় শুরু হলো ভয়ংকর গৃহযুদ্ধ। তার পর এলো ভয়াবহ রক্তখেকো খেমাররুজ বিপ্লব। ১৯৮০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত চললো আরেক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। আমরা যখন শান্তিরক্ষী হিসেবে কম্বোডিয়ায় এলাম (১৯৯২) তখন কম্বোডিয়ার মানুষ বিপ্লব ও যুদ্ধে রীতিমতো মহাক্লান্ত…। কম্বোডিয়ার এই (সমাজতন্ত্র বিরোধী) পরিবেশে, একদিন আমার আমেরিকান বন্ধু ডেভিড এশলের টেবিলে চে গুয়েভারার ‘‘গেরিলা যুদ্ধ’’ বইটা দেখে বেশ অবাক হই। ডেভিড এশলে নিজেই বললো- ‘‘আমি কিন্তু এখনো চে গুয়েভারার এডমায়ারার’’। চে বিষয়ে আমার নতুন ভাবনার শুরু সেই থেকে।

আবাক হয়ে ভাবি, এই বিপ্লবী কীভাবে এখনো এই আমেরিকান যুবক এশলেকে টানছে? এশলেকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘বলো তো চে গুয়েভারা বেঁচে থাকলে খেমাররুজদের কম্বোডীয় বিপ্লব নিয়ে তিনি কি ভাবতেন’’? ডেভিড এশলে বললেন- ‘‘চে গুয়েভারার মতো মানবতাবাদী বিপ্লবী কম্বোডিয়ার এই রক্তখেকো বিপ্লবকে অবশ্যই সমর্থন করতেন না’’।

চে-মুক্তিযুদ্ধের অনুপম অনুপ্রেরণা

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিপ্লবী চে গুয়েভারার ইমেজ, ব্যক্তিত্ব ও গেরিলা রণকৌশল ছিল মহৎ অনুপ্রেরণা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি ‘গণযুদ্ধ’। এর মূলে ছিল গেরিলা রণকৌশল। তখন ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছিল। অনেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মনে করতেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্ভবত ভিয়েতনামের গেরিলা যুদ্ধের মত দীর্ঘতর হবে। তাই গেরিলা যুদ্ধকৌশল নিয়েই সবচেয়ে আলোচনা হতো।

বেশ কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার, সাব সেক্টর কমান্ডার ও বিভিন্ন পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ চীনের মাও সেতুং, ‍কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রো, চে গুয়েভারা ও ভিয়েতনামের জেনারেল গিয়াপের গেরিলা রণকৌশল অনুসরন করতেন এবং প্রশিক্ষণের সময় তরুন মুক্তিযোদ্ধাদের এই রণকৌশল রেফার করতেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন; লেঃ কর্ণেল খালেদ মোশাররফ (পরে মেজর জেনারেল/ব্রিগেডিয়ার), মেজর এ টি এম হায়দার (পরে লেঃ কর্ণেল), মেজর এম এ জলিল ও মেজর আবু তাহের (পরে লেঃ কর্ণেল)।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে চে বিষয়ক আলোচনা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অফিসার ব্যাচের (প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স) প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হয়েছিল ভারত-ভূটান সীমান্তের কাছে ‘‘মূর্তি’’ (জলপাইগুড়ি জেলা) নামক স্থানে। মূর্তিতে প্রশিক্ষণরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের ক্যাডেটদের কাছে চে গুয়েভারার ‘‘গেরিলা যুদ্ধ’’ বইটি খুব জনপ্রিয় ছিল। ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণের কোনো প্রেসি,প্যামপ্লেট ছিল না। এই ব্যাচের ক্যাডেট এ কাইউম খান (পরে মেজর) এর ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখা বইটি হয়ে ওঠে তাদের অন্যতম পড়ার বই।

মেজর এ কাইয়ুম খান মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার উপর তাঁর আলোচিত গ্রন্থ ‘‘বিটার সুইট ভিকটোরি; এ ফ্রিডম ফাইটার্স টেল’’ এ এই বিষয়ে লেখেন ‘‘মূর্তির জন্য ট্রেনে ওঠার আগে আমি ও কায়সার (সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কায়সার হামিদুল হক, কবি ও অধ্যাপক) শিয়ালদহ ষ্টেশনের বই বিক্রেতাদের থেকে কয়েকটি পেপার ব্যাক বই ক্রয় করি। এর মধ্যে একটি হলো চে গুয়েভারার ‘‘গেরিলা ওয়ারফেয়ার’’ যা পরে আমাদের অনেক ক্যাডেট বন্ধু পড়েছিল। অন্যগুলো হলো, এরিক সেগালের ‘‘লাভ স্টোরি’’ ও বরিস প্যাষ্টারনেকের ‘‘ডক্টর জিভাগো’’। সন্ধ্যার পর ক্যাম্পে (রাত্রিকালীন প্রশিক্ষণ না থাকলে) আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা, গল্প করতাম। আমাদের একটি প্রিয় বিষয় ছিলো, চে গুয়েভারার চিন্তাভাবনা ধারণাগুলোকে মুক্তিবাহিনীর রণকৌশল ও অপারেশনে কিভাবে অন্তভূক্ত করা যায়”।

১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর তারিখে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভের পর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এ কাইয়ুম খান (পরে মেজর) এর পোষ্টিং হয় ৭ নং সেক্টরের সাব সেক্টর ৩ এ। সেখানে সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (পরে বীরশ্রেষ্ঠ)। এই নিবেদিত প্রাণ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মেজর এ কাইয়ুম লিখেন ‘‘জাহাঙ্গীর ছিলেন প্রকৃতিগতভাবে একজন গেরিলা। তিনি মাও সেতুং ও চে গুয়েভারা পড়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে গেরিলারা হলো মানব-সমুদ্রে মাছের মতো”।

চে গুয়েভারার জন্ম দিনে একজন মুক্তিযোদ্ধা- জেনারেলের অতল শ্রদ্ধা

ভারতের ‘‘মূর্তিতে’’ কমিশনপ্রাপ্ত প্রথম ব্যাচের একজন পেশাদার ও চৌকষ অফিসার ছিলেন মেজর জেনারেল জামিল ডি আহ্সান, বীর প্রতীক। চে গুয়েভারার জন্মদিন উপলক্ষে ২০২৩ সালের ১৫ জুন ফেসবুকে চে বিষয়ক আবেগঘণ একটি পোষ্ট দিয়েছিলেন জেনারেল জামিল।

‘‘গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন

Ernestro Raphael Guevera de la Serna

আমি চে কে দেখিনি।

অবিনাশী এক সংশপ্তক।

আন্তর্জাতিক বিষয়ে বরাবর আগ্রহ থাকায় ষাটের দশকে ছাত্রাবস্থায় তৎকালিন বিশ্বরাজনীতির গতিধারা আকৃষ্ট করতো, বিশেষ করে লাতিন-আফ্রো-এশিয় বামধারার সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম, আন্দোলন এবং এর নেতৃত্বে। সেই সূত্রে জেনেছিলাম ক্যাস্ট্রো আর চে’কে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা খোলশ ছেড়ে অক্টোবরে অফিসার হয়ে ৩ নম্বর সেক্টরে ১১ ইষ্ট বেংগলে যোগ দেই। সিলেটের চুনারুঘাট এলাকায় চা বাগানে যুদ্ধরত অবস্থায় আমার পোস্টিং হলো ২ নম্বর সেক্টরে ৪ ইস্ট বেংগলে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যোগ দিতে হবে। চলে আসলাম ৩ নম্বর সেক্টর হেঃ কোঃ এ, উত্তর ত্রিপুরার হেজামারায়। টিলার উপরে জংগলে বাঁশের তরজা আর শনের তৈরী ছোট বড় ব্যারাকে অফিস, সৈনিক ব্যারাক, অফিসার মেস ইত্যাদি।

দুপুরে মধ্যাহ্নারের পরে মেসে বাঁশের তরজার মাচা-চৌকিতে বিশ্রাম নিতে এসে টেবিলে পেলাম একটা মোটা বই। বাংলায় লেখা কিউবার বিপ্লবের উপর প্রায় ৪২০ পৃষ্টার বই ‘আর্নেষ্টো গুয়েভারা, বলিভিয়ার বিপ্লব’’। আমার প্রিয় বিষয়, প্রিয় ব্যক্তিত্ব, আর মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাভাবিক আকর্ষণ। বিছানায় শুয়ে পড়া শুরু করলাম। মাঝে নৈশাহার করে আবার বই হাতে বিছানায়। ক্রমে রাত গভীর হতে থাকলো। বাইরে একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকা নিকষ কালো রাত, থেকে থেকে নিয়মিত লয়ে রাতজাগা পাখীর ডাক, আশেপাশে ব্যারাকে সৈনিকদের মৃদুমন্দ আলাপচরিতা আর দূরে মাঝে মাঝে শিয়াল ডাকে। এসবের সাথে হারিকেনের হালকা আলোয় গোগ্রাসে পড়ে ভোর বেলা বইটা শেষ করলাম। ঘুম না হওয়ায় চোখ দু’টো জ্বালা করছিল।

সকাল সকাল নাস্তা করে রওনা দিতে হবে হেঃ কোঃ ২ নম্বর সেক্টর, মেলাঘরে। লম্বা পথ। ক্যাষ্ট্রো এবং চে’কে আর গভীরভাবে কাছে পেলাম যেন। গভীর শ্রদ্ধায় একটা আবেগের মধ্যে ছিলাম। যুদ্ধদিনে প্রবলভাবে অনুপ্রানিত করলো। মনে হলো কত চেনা, পৃথিবীর দুই প্রান্তে আমরা সংশপ্তক।

যুদ্ধ শেষে দিনে দিনে আরও জেনেছি তাঁদেরকে, শ্রদ্বাবনতচিত্তে।

দেখা হবার সুযোগ ছিলোনা, হয়নি… আর কখনও হবেও না।

লাল সালাম… জনমানুষের বিপ্লবী বিশ্বনেতা।

মাত্র ৩৯ বয়সে অবিনাশী সংশপ্তক’’।

চে এর সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জামিলের। তবে ২০০৬ সালে অদ্ভূত এক ঘটনা ঘটে সূদুর লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে। জেনারেল জামিল তখন লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। এই সময় লিবিয়ায় সফরতর ভেনেজুয়েলার আলোচিত বামপন্থী বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট হুগো স্যাভেজ এর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সেই মুহূর্তে চে এর কথা ভাবছিলেন অ্যাম্বাসেডর জামিল…। উল্লেখ্য প্রেসিডেন্ট শ্যাভেজ ছিলেন সাইমন বলিভার ও চে গুয়েভারার ‘বিখ্যাত’ ভাব-শিষ্য।

সেক্টর কমান্ডারের ব্যাগে চে এর বই পুস্তক

১৮। বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট ওবায়দুর রহমান মোস্তফা ছিলেন ৯ নং সেক্টর সদরদপ্তরের একজন স্টাফ অফিসার। তাঁর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। এই দূধর্ষ সেক্টর কমান্ডারের ব্যাগে সবসময় থাকতো চে গুয়েভারাসহ গেরিলা যুদ্ধের উপর বিশ্বের বিভিন্ন গেরিলা কমান্ডারদের লেখা বিদেশে মুদ্রিত মোটা মোটা বই। এ বিষয়ে, এডভোকেট ওবায়দুর রহমান তাঁর গ্রন্থে লেখেন- ‘‘বইগুলো আমি ও মেজর জলিল যখন কলিকাতায় ৮ নং থিয়েটার রোডে তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের হেড কোয়ার্টারে যেতাম তখন ফেরার পথে বিভিন্ন বুক স্টল থেকে মেজর জলিল এগুলো কিনেছিলেন” (মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টর ও আমার যুদ্ধযাত্রা) ।

ত্রিপুরার মেলাঘরে আরেক চে গুয়েভারা…

মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপ্লবী চে এর গেরিলা রণকৌশল ছিল অনুকরণীয় ও অনুপ্রেরণাময়। একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, অনেক তরুন মুক্তিযোদ্ধার কাছে সামরিক বাহিনীর কিছু কর্মকর্তাকে ‘‘চে গুয়েভারা’’ মনে হতো। এদের একজন হলেন মেজর এটিএম হায়দার। ২ নং সেক্টরের অপারেশনাল অফিসার (পরে সেক্টর কমান্ডার) মেজর হায়দার মেলাঘর ক্যাম্পে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মেজর হায়দার স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের (এসএসজি) বিশেষ কমান্ডো ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ঠান্ডা মেজাজের এই দুধর্ষ কমান্ডো ছিলেন গেরিলা গড়ার অসাধারণ এক কারিগর। উল্লেখ্য, এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন লেঃ কর্ণেল খালেদ মোশাররফ।

২ নং সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ও কৃষি বিজ্ঞানী ডঃ জহিরুল ইসলাম “মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়” (২০১৩) নামে একটি চমৎকার বই লেখেন। এ বইতে লেখক জহিরুল ইসলাম তাঁর প্রশিক্ষক মেজর হায়দারকে ‘‘চে গুয়েভারা’’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এই বইতে এ বিষয়ে লেখেন “তিনি (মেজর হায়দার) ছিলেন আমাদের চে গুয়েভারা (বিপ্লবী)। আমাদের চে গুয়েভারা মার্ক্সিষ্ট বিপ্লবী ও বামপন্থী ছিলেন না, ছিলেন না কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু দেশের প্রতি, গণমানুষের প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম দরদ। এককথায় তিনি ছিলেন একজন মানবদরদী, মানবতাবাদী ও মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ। এসব গুণের কারণে কেউ কেউ তাঁকে বামপন্থী বলে সন্দেহ করতেন”।

গেরিলা যুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনায় খালেদ-হায়দার ছিলেন অপূর্ব সংমিশ্রণ। বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১ নং সেক্টরে আর ২ নং সেক্টর তা প্রাণবন্ত করে রেখেছিল। উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি গোষ্ঠি, ২ নং সেক্টরকে “বাম বা রেড সেক্টর’’ বলে প্রচারণা চালিয়েছিল।

দুঃসাহসিক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন জালাল (বিচ্চু জালাল) মেলাঘরে বিশেষ কমান্ডো প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তিনি লিখেন (মেজর হায়দার) ‘‘প্রশিক্ষণ দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বিপ্লবী ও মহান রাজনৈতিক নেতাদের সাহস ও ত্যাগের কথা বলতেন। ক্ষুদিরাম, মাষ্টার দা সূর্যসেন, মাও সে-তুং, লেনিন, চে গুয়েভারা, ফিদেল কাষ্ট্রো, আংকেল হো, বঙ্গবন্ধুর উদাহরণ দিতেন। হায়দার ভাইয়ের তাঁবুতে তাঁর বিছানার পাশে বিপ্লবী চে গুয়েভারার বই “ডাক দিয়ে যাই”সহ বেশ কিছু বিপ্লবী বই ছিল, যদিও তাঁর কোনো অবসর ছিল না। তিনি খুব কম সময় পেতেন ঘুমের জন্য, তবুও ঘুমের আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি কিছুক্ষণ বই পড়তেন (মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্তক বিদায়)।

ঢাকায় সাড়া জাগানো ‘‘ক্র্যাক প্লাটুনের’’ সদস্য ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী। তিনিও ২ নং সেক্টরের মেলাঘরে মেজর হায়দারের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেই প্রশিক্ষণকালীণ সময় নিয়ে ফতেহ আলী চৌধুরী লেখেন- “মেজর হায়দার মাও সে-তুংয়ের গেরিলাযুদ্ধের রণনীতি ও চে গুয়েভারার বক্স এমবুশ ইত্যাদি রেফার করতেন প্রশিক্ষণের সময়”। (টু ইউ স্যার, উইথ লাভ, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৯)।

… তবুও প্রাসঙ্গিক বিপ্লবী চে

চে গুয়েভারার প্রভাব নিয়ে ভারতের লেখক অসিত রায় লিখেছেন — “একুশ শতকের গোড়ায় পৃথিবীর সর্বত্র কমিউনিজমের মশাল প্রায় নির্বাপিত, প্রশমিত, নুতন মানুষ গড়ায় ব্যর্থ- কিন্তু আর্নেস্তো চে গুয়েভারার বিদ্রোহের জ্বলন্ত প্রতীক এবং বিপ্লবীর সম্মোহনী উদ্দীপনা এমনও দীপ্যমান” (আজকের চে)। মৃত্যুর ৫৭ বছর পরও চে সর্বব্যাপী রয়ে গেছেন। চে-র জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে মধ্যবিত্ত তরুন-তরুনীদের মধ্যে বেড়ে চলেছে।

বিশ শতকের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে চে ছাপিয়ে যেতে পেরেছেন তার কারন; অসততা, দূর্নীর্তি, প্রতারণা, কাজ ও কর্মের দুস্তর ফারাক-এসবের মধ্যে চে ছিলেন, অবিনাশী উজ্জল। ক্ষমতা, সম্পদ ও অধিকার তাঁর হাতের মুঠোয় ছিল কিউবায়। কিন্তু চে একজন বৌদ্ধ সন্নাসীর মতো সমস্ত জাগতিক প্রাপ্য ও স্বাচ্ছন্দ্যকে অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আন্তর্জাতিক তাড়নায় নিজের সুখী জীবনকে ছুড়ে ফেলে কষ্ট, দুর্ভোগ ও মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন।

সেভাবে কমিউনিজম, সমাজতন্ত্র কোন দেশেই নেই। হয়তো আর আসবেও না। তবুও প্রাসঙ্গিক চে। লেবাননের হিজবুল্লাহ গেরিলারা চে-এর ছবি আকা টি শার্ট পরে বৈরুতে মিছিল করে। গাজায় ইসরায়েলি গনহত্যার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে মিছিল করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা-তাদের অনেকের আইকন চে। ঢাকায় চে নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। দেশে দেশে বৈষম্য, অন্যায়, আধিপত্য, দূর্নীতি, দুঃশাসন, শোষন, লুন্ঠন চলছে…। এসবের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আইকন এখনও চে গুয়েভারা। অভিবাদন কমাদান্তে, মেজর চে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, এনডিসি (অবঃ) গবেষক, বাংলাদেশ, bayezidsarwar792@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন