কৃষ্ণনগরের হেরিটেজ ভবন গ্রেস কটেজে ২৭ এপ্রিল, ২০২৫ (রবিবার) অনুষ্ঠিত হলো ‘পরিবেশ মেলা ২০২৫’। কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য গ্রেস কটেজ হলো কৃষ্ণনগরের একটি ঐতিহ্যশালী ভবন। এই বাড়িতে ১৯২৬ থেকে ১৯২৮ সাল প্রায় আড়াই বছর নজরুল সপরিবার বসবাস করেছিলেন। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন কর্তৃক গ্রেস কটেজকে হেরিটেজ ভবনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গ্রেস কটেজে বসবাসকালে বিদ্রোহী কবি নজরুলের ব্যক্তি জীবন, রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও তাঁর সাহিত্য-জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নজরুল-প্রমিলার দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের জন্ম হয় গ্রেস কটেজে। এখানে বসবাসকালেই নজরুল লিখেছিলেন ‘দারিদ্র্য’, ‘খালেদ’ প্রভৃতি কবিতা। তাঁর ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসও এই বাড়িতেই রচিত। নজরুলের সৃষ্টি বাংলা গজল, যা বঙ্গ-সংগীতের অনবদ্য সম্পদ, তার জন্মভূমিও ছিল এই গ্রেস কটেজ। এহেন ঐতিহাসিক ভবনেই চতুর্থ বর্ষের পরিবেশ মেলার আয়োজন করা হয়েছিল।
কৃষ্ণনগরের গ্রেস কটেজে প্রথম পরিবেশ মেলা আয়োজিত হয়েছিল ২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি (রবিবার)। তারপর থেকে সেখানে প্রতিবছর পরিবেশ মেলা হয়। দ্বিতীয় বর্ষের পরিবেশ মেলা হয়েছিল ৩০ জুলাই, ২০২৩ (রবিবার)। তৃতীয় বর্ষের পরিবেশ মেলা হয়েছিল ২৩ মার্চ, ২০২৪ (শনিবার)। আর ২০২৫ সালে গ্রেস কটেজে আয়োজন করা হয়েছিল চতুর্থ বর্ষের পরিবেশ মেলার। ‘পরিবেশ মেলা ২০২৫’-এর আয়োজক সংস্থাগুলি ছিল গোবরডাঙা জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা সমিতি, নদিয়া পরিবেশ মঞ্চ ও সুজন-বাসর। সহযোগিতায় ছিল বিজ্ঞান অন্বেষক পত্রিকা (কাঁচরাপাড়া), রাখী পত্রিকা (বাদকুল্লা) ও কৃষ্ণনগর গবেষণা পরিষৎ। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিবেশ ও বিজ্ঞানকর্মীরা এদিন গ্রেস কটেজে এসেছিলেন পরিবেশ মেলায় অংশগ্রহণ করতে। সকাল সাড়ে দশটা থেকে নাম নথিভুক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে কয়েকজন শিক্ষার্থীও এসেছিল পরিবেশ মেলায় অংশগ্রহণ করতে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের দিদিমণি ও অভিভাবকেরাও এসেছিলেন।
গ্রেস কটেজ ভবনের সভাকক্ষে স্থাপিত কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের মধ্যে দিয়ে পরিবেশ মেলার সূচনা হয়। পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন বিজ্ঞানী সৈকতকুমার বসু ও বরিষ্ঠ বিজ্ঞান-প্রচারক দীপককুমার দাঁ। সভার সূচনায় সঞ্চালক দীপাঞ্জন দে নজরুল-স্মৃতিধন্য গ্রেস কটেজের ইতিহাস সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন। এরপর পরিবেশ মেলায় স্বাগতভাষণ রাখেন দীপককুমার দাঁ। তিনি পরিবেশ মেলা আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সাধারণ মানুষের ভূমিকার বিষয়টিও আলোচনা করেন। এছাড়া তিনি বিজ্ঞান ও পরিবেশকর্মীদের ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডগুলিকে সঠিকভাবে নথিবদ্ধকরণের প্রয়োজনীয়তার কথাও এদিন বলেন। বিজ্ঞানী সৈকতকুমার বসু সেই বক্তব্যের রেশ ধরে ঔপনিবেশিক শাসনকালের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন এবং ইংরেজদের স্থাপিত সার্ভেমূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ডকুমেন্টেশন পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরেন।
গোবরডাঙা জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা সমিতির মুখপত্র পরিবেশ পত্রিকা ‘জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা বার্তা’ (ত্রৈমাসিক)-র নতুন সংখ্যাটি এদিন গ্রেস কটেজে প্রকাশ পায়। পরিবেশ মেলায় আগত বিশেষ অতিথি বিজ্ঞানী সৈকতকুমার বসুর হাত দিয়ে পত্রিকাটির ষষ্ঠ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যার (এপ্রিল জুন, ২০২৫) আবরণ উন্মোচিত হয়, সঙ্গে ছিলেন গোবরডাঙা গবেষণা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা দীপককুমার দাঁ, বরিষ্ঠ বিজ্ঞানকর্মী সৌমেন বিশ্বাস, শান্তিপুর সায়েন্স ক্লাবের সভাপতি সুব্রত বিশ্বাস, ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার সম্পাদক প্রবীর বসু, এবং ‘জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা বার্তা’ পত্রিকার সম্পাদক দীপাঞ্জন দে। উল্লেখ্য, এদিন পরিবেশ মেলায় ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার নতুন সংখ্যাটি (বাইশ বর্ষ ২২, সংখ্যা ৩, মে-জুন, ২০২৫) প্রকাশ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণে নির্ধারিত সময়ে পত্রিকাটি না আসায় সেটি এদিন প্রকাশ পায়নি। যদিও ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’-এর নতুন সংখ্যার চূড়ান্ত প্রুফ-কপিটি সকল বিজ্ঞানকর্মীরা সম্মিলিতভাবে এদিন উন্মোচন করেন। উপস্থিত ছিলেন ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’-এর প্রকাশক তথা গণবিজ্ঞান আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক জয়দেব দে।
এরপর ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার সম্পাদক প্রবীর বসু তাঁর বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে বহুল প্রচারিত এই বিজ্ঞান পত্রিকার দীর্ঘ পথচলার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা এবং তাঁদের গণবিজ্ঞান আন্দোলনের অভিজ্ঞতার কথা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেন। ‘পাখিদের কথা’ (প্রকাশক: গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ) গ্রন্থের লেখক বিশ্বরঞ্জন গোস্বামী পরিবেশ মেলায় উপস্থিত ছিলেন এবং পাখিদের নিয়ে তাঁর গ্রন্থ রচনার বিরল অভিজ্ঞতার কথা বলেন। এবারের পরিবেশ মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘রাচেল কারসন স্মারক বক্তৃতা’। বিজ্ঞানকর্মী সুব্রত বিশ্বাস ছিলেন আলোচক। তাঁর প্রায় চল্লিশ মিনিটের বক্তব্যে রাচেল কারসনের জীবন, কর্ম, ভারতীয় পরিমণ্ডলে তাঁর গুরুত্ব ইত্যাদির সংক্ষিপ্ত ও সহজ বিবরণ সভাকক্ষে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা, শিক্ষার্থীরা মন দিয়ে উপভোগ করে।
চতুর্থ বর্ষের পরিবেশ মেলার আরেকটি আকর্ষণ ছিল হাতে-কলমে বিজ্ঞান প্রদর্শন। বরিষ্ঠ বিজ্ঞান-প্রচারক জয়দেব দে বিভিন্ন স্কুল থেকে আগত শিক্ষার্থীদের নিয়ে এদিন হাতে-কলমে বিজ্ঞান কর্মশালাটি পরিচালনা করেন। এই কর্মশালার মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীরা পদার্থবিদ্যা, রসায়নের একাধিক পরীক্ষা নিজেরা পর্যবেক্ষণ করতে পারে ও হাতে-কলমে সেগুলি করতে পেরে সহজে বিজ্ঞানের পাঠ অর্জন করে। পরিবেশ মেলায় আগত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিজ্ঞান-প্রচারক, অভিনব রসায়ন ল্যাবরেটরি প্রণেতা অসীম বসাকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। তিনি এদিন গ্রেস কটেজে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের সামনে গানে ছড়ায় ‘ঘরে ঘরে রসায়ন’-এর একক অভিনয় উপস্থাপন করেন। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বেশ উপভোগ্য হয় বিষয়টি। উল্লেখ্য, তিনি এদিন কৃষ্ণনগর গবেষণা পরিষৎ ও নদিয়া পরিবেশ মঞ্চকে একটি করে নিমের চারা তুলে দেন।
পরিবেশ মেলায় শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবেশ বিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রতি গ্রুপে তিনজন প্রতিযোগী ছিল। কৃষ্ণনগর এ.ভি. হাই স্কুলের দুটি দল, বাদকুল্লা ভুবন মোহিনী গার্লস স্কুলের একটি দল এবং কৃষ্ণনগর হাই স্কুলের একটি দল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। কুইজ-মাস্টার সৃঞ্জয় ঘোষের পরিচালনায় সমগ্র প্রক্রিয়াটি সুসম্পন্ন হয়। কুইজ প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন লেখক রতনকুমার নাথ। কুইজ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে কৃষ্ণনগর এ.ভি. হাই স্কুলের দেবজিৎ নন্দী, স্বস্তিক ভৌমিক ও বর্ষণ ঘোষ। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে কৃষ্ণনগর হাই স্কুলের আকাশ পাত্র, শৌণক দে ও নীলাদ্রি ব্যানার্জি। এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করে বাদকুল্লা ভুবনমোহিনী গার্লস স্কুলের অহনা বিশ্বাস, দিয়াশা হালদার ও মৈত্রী সিংহ। শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই কুইজ প্রতিযোগিতা আয়োজনে সক্রিয় ভূমিকা নেন পরিবেশকর্মী-শিক্ষিকা মমতা বিশ্বাস। দুপুরের আহার বিরতির পর কুইজ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করা হয়। বিজ্ঞান অন্বেষক প্রকাশন ও গোবরডাঙা গবেষণা পরিষদের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থাদি পুরস্কার হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
চতুর্থ বর্ষের পরিবেশ মেলায় নদিয়া পরিবেশ মঞ্চের বার্ষিক সম্মেলন ও বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠনের মতবিনিময় হওয়ার কথা থাকলেও এদিন সেটি সম্পূর্ণরূপে আয়োজন করা যায়নি। তবে নদিয়া সেঁজুতি প্রকৃতি বিদ্যাশ্রম, জলঙ্গি নদী সমাজ, কৃষ্ণনগর পরিবেশ বন্ধু, মুর্শিদাবাদ জেলা বিজ্ঞান পরিষদ, শান্তিপুর সায়েন্স ক্লাব, রানাঘাট নেচার ফার্স্ট, বাদকুল্লা বিজ্ঞান পরিষদ, নাস্তিক মঞ্চ, সারা ভারত বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি-র মতো বিজ্ঞান ও পরিবেশ সংগঠনের প্রতিনিধিরা সক্রিয়ভাবে পরিবেশ মেলায় অংশগ্রহণ করেন।
কৃষ্ণনগরের গ্রেস কটেজে ‘পরিবেশ মেলা ২০২৫’-এর আহ্বায়ক ছিলেন দীপককুমার দাঁ ও দীপাঞ্জন দে। চতুর্থ বর্ষের এই পরিবেশ মেলা সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা নেন রাখী পত্রিকার সভাপতি বিমল সরকার, সুজন-বাসরের সম্পাদক ইনাস উদ্দীন, বিজ্ঞান অন্বেষক পত্রিকার প্রকাশক জয়দেব দে। উল্লেখ্য, গ্রেস কটেজের দরদালানে এদিন পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিষয়ক পত্র-পত্রিকা, গ্রন্থাদির প্রদর্শনী এবং বিপণনের ব্যবস্থা ছিল। পরিবেশ সংগঠন ‘রানাঘাট নেচার ফার্স্ট’-এর পক্ষ থেকে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের ব্যাগ আনা হয়েছিল। বহু দূর-দূরান্ত থেকে আগত পরিবেশ ও বিজ্ঞানকর্মীদের সম্মিলিত সহযোগিতা ও সক্রিয়তায় চতুর্থ বর্ষের পরিবেশ মেলা সুসম্পন্ন হয়। ‘কৃষ্ণনগর পরিবেশ বন্ধু’-র সম্পাদক তরুণকুমার সাহার সমাপ্তি-ভাষণের মধ্যে দিয়ে পরিবেশ মেলার সমাপ্তি ঘোষণা হয়।
লেখক : সম্পাদক, পরিবেশ পত্রিকা ‘জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা বার্তা’ (ত্রৈমাসিক)।