“যদি তুমি ১০ বছর ধরে অনুশীলন করো, তাহলে নিজে তৃপ্তি পেতে শুরু করবে, ২০ বছর পর তুমি একজন শিল্পী হতে পারো এবং শ্রোতাদের খুশি করতে পারো, ৩০ বছর পর তুমি তোমার গুরুকেও খুশি করতে পারো, কিন্তু সত্যিকারের শিল্পী হওয়ার আগে তোমাকে আরও অনেক বছর অনুশীলন করতে হবে — তারপর তুমি ঈশ্বরকেও খুশি করতে পারো।” সঙ্গীতের প্রতি দর্শন বোধের এমন কথা সেই শিল্পী বলতে পারেন যিনি ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কঠিন অনুশীলন করে আসছেন। তিনি হলেন সঙ্গীত জগতের প্রবাদপুরুষ আলী আকবর খাঁ।
ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের চর্চায় আজ সরোদের যে স্থান, তা পুরোপুরি আলি আকবরের অবদান। শুধু সরোদেই নয়, তিনি অসম্ভব ভালো অন্যান্য যন্ত্র বাজাতেন দক্ষ বাজনদারদের মত। খান সাহেব পাশ্চাত্য বিশ্বে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন — একজন শিল্পী এবং একজন শিক্ষক উভয় হিসেবেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকার জন্য তিনি বাঙালি জাতির কাছে বিশেষভাবে সম্মানিত।
উচ্চাঙ্গ সংগীতের পীঠস্থান এই বাংলা। আজকের দিনে স্মৃতিচারণ ও সংগীতের পালিত হচ্ছে তাঁর ১০৩ তম জন্ম শতবার্ষিকী। তাঁকে নিয়ে আজকের লেখা।
আলি আকবরের পরিশীলিত সঙ্গীতজ্ঞতার মধ্যে নিহিত ছিলো — তাঁর পিতা এবং গুরু, কিংবদন্তি বাবা আলাউদ্দিন খানের নির্দেশনায় কঠোর এবং অত্যন্ত কঠোর অনুশীলন। আলী আকবর খান (১৪ এপ্রিল ১৯২২ — ১৯ জুন ২০০৯) বর্তমান বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুর গ্রামে সঙ্গীতজ্ঞ ও শিক্ষক আলাউদ্দিন খান এবং মদিনা বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের পরপরই, খানের পরিবার মাইহারে (বর্তমান ভারতের মধ্যপ্রদেশে) চলে আসেন, কারণ যেখানে তাঁর বাবা ছিলেন রাজকীয় রাজ্যের মহারাজার প্রধান দরবারী সঙ্গীতজ্ঞ।
ছোটবেলা থেকেই খান তার পিতৃদেবের কাছ থেকে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি কণ্ঠস্বর রচনার প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন, কিন্তু অবশেষে তিনি সরোদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। বাবার কাছ থেকে সংগীতের তালিম নেওয়ার সময় কড়া শাসনের দিনে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত রেওয়াজ করতে হতো আকবরকে। বছরের পর বছর এই ভাবেই চলেছে। কারো সঙ্গে কথা বলা নিষেধ, বাবার সঙ্গেই খেতে বসতে হতো তাওবা তিন মিনিটের জন্য। এমনকি তিন মিনিট সময় পেরিয়ে গেলে অসমাপ্ত অবস্থায় খাওয়া ফেলে উঠে যেতে হতো। কখনো কখনো মা জানলা দিয়ে খাইয়ে দিতেন আদরের ছেলেকে।
আকবরের পিতৃদেব এক অন্য টেকনিকে তাঁকে বাজানো শিখিয়েছিলেন। প্রথমে সংগীত শেখান। আরোহণ অবরোহণ দিয়ে গানের তাল শেখাতে লাগলেন। তিনি বলতেন আরোহণ অবরোহণ যত রপ্ত হবে, ততই সরোদের অলিগলি চেনা সহজ হবে। আকবর তাঁর চাচা আফতাবউদ্দিন খানের কাছ থেকে তবলা এবং পাখওয়াজ বাজানোও শিখেছিলেন, যার জন্য তিনি শিবপুরে যেতেন। এই সময়কালে তাঁর বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞের সঙ্গে সাক্ষাৎকার হয়, যেমন সরোদবাদক তিমির বরণ এবং বাঁশিবাদক পান্নালাল ঘোষ…– যারা তার বাবার শিষ্য ছিলেন।
মাইহারে সবাই আকবরের পিতৃদেব আলাউদ্দিনকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। আসলে তিনি যে খুব সাধারণ মানুষ ছিলেন না। আলাউদ্দিন খান সারা বিশ্বে সেতার, সানাই ও রাগসংগীতের গুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মূলত সরোদই তার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাহন হলেও সাক্সোফোন, বেহালা, ট্রাম্পেট-সহ আরো অনেক বাদ্যযন্ত্রে তাঁর যোগ্যতা ছিল অপরিসীম। মাইহার ঘরানার জন্মদাতা ছিলেন খানসাহেব। আলাউদ্দিন খান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার মানুষ হলেও বহু চেষ্টার পর তিনি পৌঁছান রামপুর দরবারের রাজ-সঙ্গীতজ্ঞ মিয়াঁ ওয়াজ়ির খানের কাছে। তিনিই তরুণ আলাউদ্দিনকে তালিম দেন। মিয়াঁ ওয়াজির খান ছিলেন তানসেনের জামাই নওবত খানের বংশধর। বাবা আলাউদ্দিন রামপুর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মাইহারের রাজার দরবারে নিযুক্ত হন এবং রাগসঙ্গীতের প্রেক্ষাপটে খান সাহেবের বিশেষ বাদনশৈলী ‘মাইহার ঘরানা’র পত্তন করেন।
আলাউদ্দিন ছিলেন একজন গান্ধীবাদী লোক। তিনি দেশের প্রচুর বিপ্লবীকে সেই সময় মাইহারে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
আলাউদ্দিনের কন্যা ছিলেন রোশানারা খান। যিনি সুরবাহারের একজন দক্ষ বাদক। আচার্য আলাউদ্দীন খান সাহেবের কাছে রবিশঙ্কর (যাঁকে তিনি বাবা বলে ডাকতেন) শিক্ষা নিতে আসেন। প্রাক্তন মাইহার এস্টেটের মহারাজা ব্রিজনাথ সিং রোশানারাকে ‘অন্নপূর্ণা’ নাম দিয়েছিলেন এবং এই নামেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। একুশ বছর বয়েসে রবিশঙ্করের সঙ্গে অন্নপূর্ণার বিবাহ হয়। এই বিয়েতে তাদের একটি পুত্র সন্তান শুভেন্দ্র শঙ্করের জন্ম হয়। কিন্তু এই বিয়ে বিচ্ছেদে শেষ হয়।
দীর্ঘকাল প্রশিক্ষণ লাভের পর ১৩৩৬ সালে ১৩ বছর বয়সে এলাহাবাদে সর্বপ্রথম এক সঙ্গীত সম্মেলনে আলি আকবর প্রথম সঙ্গীত পরিবেশনা করেন। তিন বছর পর, ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে, এক সম্মেলনে পন্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে প্রথম সরোদে সঙ্গত করেন; এটি ছিল দুই বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীর প্রথম যুগলবন্দী। ১৯৩৮ সালে আকবর অল ইন্ডিয়া রেডিও (এআইআর), বোম্বেতে তার প্রথম সংগীত পরিবেশন করেন (উস্তাদ আল্লারাখা তবলায় সঙ্গত করেন) এবং ১৯৪০ সালের জানুয়ারি থেকে তিনি লখনউতে এআইআর এ প্রতি মাসে যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করা শুরু করেন ।
১৯৪৪ সালে, রবিশঙ্কর এবং আলি আকবর উভয়েই সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাদের পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করার জন্য মাইহার ছেড়ে যান; রবিশঙ্কর বোম্বে চলে যান, যখন খান এআইআরে লখনউয়ের সর্বকনিষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হন এবং রেডিও অর্কেস্ট্রার জন্য একক পরিবেশনা এবং সুরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৩ সালে তার বাবার সুপারিশে খানকে যোধপুরের মহারাজা হনবন্ত সিংয়ের সভাসদ সঙ্গীতজ্ঞ নিযুক্ত করা হয়। সেখানে তিনি সঙ্গীত পরিবেশনের পাশাপাশি সঙ্গীত শিক্ষা ও রচনাও করতেন এবং মহারাজা এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যে তাঁকে ‘ওস্তাদ’ উপাধিতে ভূষিত করেন ।
আসলে যোধপুরের মহারাজা ছিলেন আকবরের সরোদের একনিষ্ঠ ভক্ত। এই যোধপুরেই আকবরকে একটি ভালো বাড়িও দেওয়া হয়। যে বাড়িটা যোধপুর প্যালেসের কাছেই ছিল। যোধপুরের মহারাজা ছিলেন ভারতীয় সংগীতের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। আলী আকবরের বাজানোর সময় ছিল রাত গভীরে। মহারাজা সারা রাত বাজনা শুনতেন — প্রতিদিন রাত বারোটা থেকে ছটা পর্যন্ত। এমনও হয়েছে মহারাজা বাজনা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছেন কিন্তু আকবর একমনে সারারাত বাজিয়ে গেছেন। এমনই ছিল তাঁর সঙ্গীতের প্রতি নিষ্ঠা ও আনুগত্য। যোধপুরে থাকার সময় আকবরের দুই পুত্র এবং একমাত্র মেয়ে আমিনা জন্মায়। আকবর তিনবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর কমপক্ষে ১১টি সন্তান ছিল, যার মধ্যে সরোদ বাদক আশিষ খান , আলম খান এবং মানিক খান বিখ্যাত।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সাথে সাথে দেশীয় রাজ্যগুলি ভেঙে পড়ে এবং ১৯৫২ সালে মহারাজা হনবন্ত সিং বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান, তখন আলি আকবর কলকাতায় চলে আসেন।
কলকাতায় এসে প্রথমে কবীর রোডে, তারপর গড়িয়াহাট মোড়ে হিন্দুস্তান মার্টে তিনি চলে আসেন। আকবরের স্ত্রীর নাম ছিল জুবেইদা। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ ছায়াসঙ্গী। কলকাতায় আসার পর জুবেইদার ইচ্ছা হল তার দুই পুত্র প্রাণেশ এবং অমরেশ প্রথাগত স্কুলে পড়বেন, তাই সাউথ পয়েন্ট স্কুলে ভর্তি করা হলো। আমিনা কিছুদিন কলকাতার কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন। কলকাতা আসার পর আকবরের জীবন অনেকটাই পরিবর্তন হয়। আকবর সেই সময় কলকাতায় আকাশবাণী গ্রেড শিল্পী হলেন। এরপর কিছুদিন নানা কাজ করতে আরম্ভ করলেন।
আত্মীয়তার সূত্রে রবিশঙ্করের পরিবারের সঙ্গে আলী আকবরের পরিবারে যাতায়াত ভালই ছিল। রবিশঙ্করে সেই সময় আলমোড়ার ভারতীয় কালচারাল কেন্দ্র নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন। ওই সময়টা রবিশঙ্কর ও আকবর নানা কাজে কলকাতা মুম্বাই দিল্লি করে বেড়াতেন। কলকাতা বরাবরই সংস্কৃতির শহর। সেই সময় কলকাতায় তানসেন সংগীত সম্মেলন খুব বড় করে হতো। এখানে একটা ঘটনা বলি।
ইন্দিরা সিনেমা হলে একবার এক বিশাল সংগীত সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে খান সাহেবের তিনপ্রজন্ম নিয়ে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো — পন্ডিত আলাউদ্দিন খান, উস্তাদ আলী আকবর খান এবং তার সুযোগ্য পুত্র আশিস খান। এই সংগীত সম্মেলনে এতটাই লোক হয়েছিল যে ওই সময় ওই রকম ভিড় অন্যকোন অনুষ্ঠানে কলকাতা কোনদিন দেখিনি। অনুষ্ঠান চলাকালীন স্টেজের মধ্যেও বহু লোক উঠে পড়েছিল, প্রবল ভিড়ের চাপে স্টেজ ভেঙ্গে পরে। অবশ্য স্টেজ ভাঙার সময় আলী আকবর এবং বাবা আলাউদ্দিন খানের কোন হুশ ছিল না, এতটাই আত্মনিমগ্ন হয়ে তারা বাজাচ্ছিলেন। প্রবল হইহট্টগোলের মধ্যে আশিস খানের কিছুক্ষনের জন্য মনসংযোগ নষ্ট হয়। তিনি বাজানো বন্ধ করে দেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যুগ পুরুষ, অসামান্য শিল্পী ও চড়া মেজাজের জন্য সর্বজনবিদিত আলাউদ্দিন খান এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে অত লোকজনের মাঝখানে নাতিকে এক চড় মারেন। কলকাতার বহু লোকেরই এই ঘটনাটির কথা আজও মনে আছে। [ক্রমশ]
দারুন লেখা