শুক্রবার | ৩০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ৭:৫০
Logo
এই মুহূর্তে ::
দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক : সন্দীপন বিশ্বাস সিঁদুরে মেঘের গর্জন : অসিত দাস শতবর্ষে অন্য বিনোদিনী — তৃপ্তি মিত্র : শৌনক দত্ত আমার প্রথম অভিনয় দেখে সত্যেন বসুই বলেছিলেন— তোর হবে : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রজিৎ আমাকে ক্লান্ত করে কেবলই ক্লান্ত : তপন মল্লিক চৌধুরী মনোজ বসু-র ছোটগল্প ‘বাঁশের কেল্লা’ গ্রেস কটেজ বুলেটিন প্রকাশ : দীপাঞ্জন দে অথ ওয়াইন কথা : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসাবিভ্রাট : অসিত দাস বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম : আবু বকর সিদ্দিকি পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের অনবদ্য সৃষ্টি ‘কবর’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি : মনোজিৎকুমার দাস কঠোর শাস্তি হতে চলেছে নেহা সিং রাঠোরের : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন : শান্তা দেবী বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা : ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সিন্ধু সভ্যতার ভূখণ্ড মেলুহা-র সঙ্গে বাণিজ্যে মাগান দেশ : অসিত দাস তদন্তমূলক সাংবাদিকতা — প্রধান বিচারপতির কাছে খোলা চিঠি : দিলীপ মজুমদার হেমন্তকুমার সরকার ও নজরুল-স্মৃতিধন্য মদনমোহন কুটির : ড. দীপাঞ্জন দে রামমোহন — পুবের সূর্য পশ্চিমে অস্তাচলে গেলেও শেষ জীবনে পিছু ছাড়েনি বিতর্ক : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় মাওবাদী দমন না আদিবাসীদের জমি জঙ্গল কর্পোরেট হস্তান্তর : তপন মল্লিক চৌধুরী জৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে শ্রী অপরা একাদশী মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত পর্যটন মানচিত্রে রামমোহনের জন্মভূমিতে উন্নয়ন না হওয়ায় জনমানসে ক্ষোভ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সংগীতে রবীন্দ্রনাথ : সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর গোয়ার সংস্কৃতিতে সুপারি ও কুলাগার কৃষিব্যবস্থা : অসিত দাস পুলওয়ামা থেকে পহেলগাঁও, চিয়ার লিডার এবং ফানুসের শব : দিলীপ মজুমদার ক্যের-সাংরী কথা : নন্দিনী অধিকারী সুপারি তথা গুবাক থেকেই এসেছে গোয়ার নাম : অসিত দাস রোনাল্ড রসের কাছে জব্দ ম্যালেরিয়া : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে, কমবে অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় উনিশের উত্তরাধিকার : শ্যামলী কর কেট উইন্সলেটের অভিনয় দক্ষতা ও চ্যালেঞ্জিং ভূমিকার ৩টি চলচ্চিত্র : কল্পনা পান্ডে
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

এবং ইন্দ্রজিৎ আমাকে ক্লান্ত করে কেবলই ক্লান্ত : তপন মল্লিক চৌধুরী

তপন মল্লিক চৌধুরী / ৯২ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ২৮ মে, ২০২৫

বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকটি আমি পড়েছি কেবল, কোনো অভিনয় দেখিনি। একাধিকবার পাঠের পর আবছা ও স্পষ্টভাবে একই রকম মনে হওয়াটাই পরবর্তী পাঠের প্রতিক্রিয়ায় ঘুরে ফিরে এসেছে, কিন্তু কেন এমন মনে হওয়া বা প্রতিক্রিয়া? জানিনা। অনেকটা ইন্দ্রজিতের মতো করেই বলতে হয়, “জানি না। আমি অনেক ভেবেছি। অনেক যুক্তি তর্ক বিচার মনে মনে করেছি। সব কিছুর উত্তর- জানি না। কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। যুক্তি তর্ক আর ভাল লাগে না। কিছু করতেও পারছি না। শুধু ক্লান্ত লাগছে। ঘুমোতে ইচ্ছে করছে”। প্রথম পাঠে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ অ্যাবসার্ড নাটক বলেই মনে হয়েছিল। যদিও নাটককার নিজে ‘এবং ইন্দ্রজিত’কে পুরোপুরি অ্যাবসার্ড নাটক বলতে নারাজ অবশ্য তিনি সেই বিচারভার পাঠক বা দর্শকদের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নিয়ে আলোচনায় অ্যাবসার্ড প্রসঙ্গের উত্থাপন অনেকেই করেছেন। অবচেতন স্তরে হলেও আমার পাঠের মধ্যে সেইসব আলোচনার রেশ পড়েছে অথবা পড়েনি- সেও সঠিক জানিনা। তার চেয়ে বরং দেখা যেতে পারে ক্যামু তাঁর The Myth of Sisyphus-এ অ্যাবসার্ড নাটকের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে কী বলছেন, — “In a Universe that a suddenly deprived of illusions and of light, man feels a stranger. He is an irremediable exile…. This divorce between man and his life, the actor and his sething, truly constitutes the feeling of absurdity”. ক্যামু অ্যাবসার্ড নাটক প্রসঙ্গে এবং নাটকের অ্যাবসার্ডিটি ব্যাখ্যায় যে বক্তব্যকে সামনে আনেন তা মোটামুটিভাবে এই — “সুসংহত নিয়মবদ্ধ নাটক, যাকে পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘well made play’ অ্যাবসার্ড নাটক তার বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় আধুনিক নাট্যচর্চার একটি ফসল”। যার বিষয়বস্তু, আঙ্গিক, মঞরীতি, অভিনয় এবং আর যা যা কিছু তার সবকটিতেই এই নাটক সম্পূর্ণ আলাদাভাবে অবস্থান করছে, এই নাটকের চলন এক ধরনের দুর্বধিগম্যতা ও অতীন্দ্রীতার পথে, এর কারণ, এই নাটক যুদ্ধোত্তর জীবনদর্শন ও জিজ্ঞাসার এক দুঃসাহসিক অভিজ্ঞান। এই নাটকে প্রচলিত নাটকের মতো কোনো সুনির্মিত বৃত্তবন্ধন নেই, নাটকের চরিত্রচিত্রনও বিবর্তনধর্মী নয়, নাটকের চরিত্রেরা কথা বলেন হেঁয়ালিময় দুর্বোধ্য ভাষায় এবং তাদের আচরণও অনেকে সময়েই অসঙ্গত, সেই আসঙ্গতি যান্ত্রিক জীবন ও মৃত্যুর অনুভূতিজাত। সঙ্গতীহীন জীবন নিঃসঙ্গ, শুন্যতাময়, নিস্ক্রিয়, হতোদ্যম, বৃন্তচ্যুত তবু যেন মনে হয় কোনো এক আত্মানুসন্ধানের পথেই চলা।

আসলে আধুনিক নাটকের যে বিশিষ্টতাটি একসময় “অ্যাবসার্ড নাটক” হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে, তার পিছনে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের অস্থিরতা ও নৈরাজ্য। যুদ্ধ শেষ হলেও যুদ্ধভীতি, বিষাদ, হতাশায় মানুষের মনজুড়ে থাকা শূন্যতা, মানবিকতার বিপর্যয়ে, মূল্যবোধের অবক্ষয়ে মানুষের মনে ক্রমেই জমে ওঠা অবিশ্বাস, ওই বিপর্যস্ত ও বিদ্ধস্ত সময়ের ফসল হিসেবেই নাটকের মধ্যে অবধারিত ভাবে এসেছিল অ্যাবসার্ডিটি। ঠিক যেভাবে জেমস জয়েস, কামু, কাফকার রচনার মধ্যে অর্থহীন দুঃখময় জীবনবোধ স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে যেতে থাকে তারই আর এক রূপ ফুটে ওঠে স্যামুয়েল বেকেট, ইউজিন আয়ানেস্কো, জাঁ জেনে প্রমুখের নাট্য রচনায়। চারদিকের ধ্বংসযজ্ঞে মানবতা পদদলিত, বেঁচে থাকাই যখন এক বেদনাদায়ক, ক্লান্তিকর, গ্লানিময় অভিজ্ঞতা আর অস্তিত্ব যখন হয়ে উঠছে এক ভীষণ অর্থহীন বিষয়, হাজারো নৈরাশ্যের মধ্যে একটা কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় মানুষের অন্তহীন পথচলা, বিনিদ্র অপেক্ষা, তারই প্রেক্ষাপটে নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের অ্যাবসার্ডধর্মী নাটক ওয়েটিং ফর গডো। আয়োনেস্কোর নাটকে অ্যাবসার্ডিটি এসে পড়ার নেপথ্যে ক্রিয়াশীল কারণও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তরকালে গণমানুষের ক্ষয়িষ্ণু অনুভূতি। মোটকথা যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত পরিবেশ অ্যাবসার্ড আবহ সৃষ্টিতেই সহায়ক হয়ে উঠেছিল।

আমাদের আলোচ্য বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিত’ নাট্যপাঠকালে যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত পরিবেশের অ্যাবসার্ড আবহ সেভাবে ক্রিয়াশীল না হলেও দেশভাগ উত্তর পশ্চিম বাংলা, যেখানে উদ্বাস্তু সমস্যা, খাদ্য সংকট, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব- ১৯৬৩ তে, যখন চীন-ভারত যুদ্ধ চলছে, বেখাপ্পা পরিস্থিতিতে পড়েছে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি, দোটানায় চীন পন্থী কমিউনিষ্ট পার্টি, ফলে পার্টির নীতি ও আদর্শগত দিক নিয়ে দ্বন্দ্ব; ফলশ্রুতিতে পার্টির ভাঙ্ন। এদের কোনো একটা দলে জড়িয়ে গিয়েছিলেন নাটককার নিজেও। তাঁর নাটকটিতে কিছুটা হলেও ফুটে ওঠে দ্বিধা-দোলাচলতার চিহ্ন। “হাসবার ক্ষমতা চলে যাচ্ছে আমার। …আজগুবি সৃষ্টিছাড়া হয়ে উঠছে আমার লেখা। আর সবচেয়ে মারাত্মক- এতো রূপক এতো আড়াল স্বত্তেও সত্যিই মানুষগুলো বড় বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে”। এর ওপর চূড়ান্ত বেকারি, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও নৈরাজ্য এবং নৈতিক বিপর্যয়ে তৈরি হয় এক শূন্যতার জগৎ। এই সময়-জীবনের পটভূমি স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায় বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এ। নিটোল বৃত্তধর্মী নাট্যনির্মাণের পথ ছেড়ে তিনি তুলে ধরলেন যুবসমাজের ব্যাপক নৈরাশ্য ও আত্মপীড়নের সমস্যা। লেখক বা সুত্রধর যিনি পাঠক বা দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন নানা জ্ঞাতব্য তথ্য, তেমনি নাটককার পরিবেশন করেন জনজীবনের নানা সমস্যা সম্বলিত এক ভিন্ন ধর্মাবলম্বী নাটক। আর সেই নাট্য রচনার সূত্রেই তিনি দর্শকাসন থেকে তুলে আনেন অমল-বিমল-কমল এবং সতন্ত্র নামের ইন্দ্রজিৎকে।

অমল, বিমল, কমল, ইন্দ্রজিৎরাই মূলত নাটকটির প্রধান চরিত্র। আর খানিকটা বিশ্লেষকের ভূমিকায় একজন লেখক যিনি লিখতে চান। কিন্তু তার ভাষ্যমতে সমস্যাটা দাঁড়ায় যে তিনি কলকাতা শহরের কত শ্রেণী পেশার মানুষ তার কতজনকেই বা চেনেন জানেন। আর তাদেরকে কাছে থেকে যখন জানেনই না তখন তাদের নিয়ে কিবা লিখবেন তিনি। নাটকের প্রথম দিকে যেটি দেখা যায় যে অমল, বিমল, কমল, ইন্দ্রজিৎরা কলেজের ছাত্র। তাদের আড্ডায় মাঝে মাঝে এই লেখককেও পাওয়া যায়। আড্ডার বিষয় বস্তু কখনো ক্রিকেট, কখনো সিনেমা, রাজনীতিকে বানার্ড শর নাটকে মেশানো ঠিক হয়েছিল কিনা অথবা মেশানো হলেও তাতে নাটকটির সাহিত্য মূল্য আদৌ কমে যায় কিনা কিংবা ভূগোলের বাইরে কোনো পৃথিবী আছে কিনা আর থাকলেও সেখানে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে ইন্দ্রজিৎ কেন চলে যেতে চায় এতসব কিছুই। কিছু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কলেজ গন্ডীর ছেলেদের আগ্রহের ধনুক থেকে তীর যেদিকে ছুটবে আরকি। তবে লেখক এখানে অমল-কমল-বিমলদের দেখান সমাজের আর দশটা মানুষের মতো করে যারা কিনা সমাজের সঙ্গে আপোষ করে রোজ বেঁচে থাকে, কিন্তু ইন্দ্রজিৎকে তিনি সম্পূর্ণ আলাদা একটা রূপ দেন। ইন্দ্রজিৎ সমাজ বা ব্যবস্থার সঙ্গে আপোষ করতে চায়না, চলতি সমাজ ব্যবস্থাকে সে ঘৃণা করে। অবশ্য দিন শেষে সেগুলির সঙ্গেই সে সহবাস করে বা করতে বাধ্য হয়। নাটকটির বিশেষত্ত্বই ফুটে ওঠে ইন্দ্রজিৎ চরিত্রটির চরিত্রায়নের মধ্যে থেকেই।

নাটকে ইন্দ্রজিতের প্রমিকা হিসেবে পাওয়া যায় একটি মেয়েকে যার নাম কবি রেখেছিলেন মানষী। মূলত মানষীর সঙ্গে কথোপকথনেই ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাট্য রচনার উদ্দেশ্যটি একটি স্পষ্ট রূপরেখায় ধরা পড়ে। সে একটি সাধারন আটপৌরে চিন্তা ধারার মেয়ে-পরিবারের শৃংখল, সমাজের মেনে নেওয়া, না মেনে নেওয়া ইত্যাদি অনেক কিছু খেয়াল করে চলতে হয় তাকে। এই ব্যাপারটাতেই ইন্দ্রজিতের রাগ। ইন্দ্রজিতের ভাষায়ঃ “বহু নিয়ম মেনেছি…লেখাপড়া করার নিয়ম-মেনেছি, পরীক্ষা দেবার নিয়ম মেনেছি, চাকরী করবার নিয়ম মানব। কিন্তু নিয়মটাকে মানা উচিৎ একথাটাও কি মানতে হবে ? নিয়ম না মেনে নিয়মের দড়িটাকে ঘৃণা করব, যে দড়ি দিয়ে আষ্টে পিষ্টে বাধা আছি সেই দড়িটাকে পূজো করে কি লাভ”? আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ফুটে আসে ইন্দ্রজিতের একটি কথার সূত্র ধরে। “যেই নিয়মে সাত বছরের একটি ছেলেকে জুতো পালিশ করতে হয় আর এক বছরের একটি ছেলেকে কোলে রাখতে হয় সেই নিয়মটিকে যে আমি মানতে পারিনা”। ইন্দ্রজিৎ সমাজ ও সমাজের পরিবর্তন চাইতো। অন্য কথায় সেটাকে বোধহয় বিপ্লব ও বলা চলে। এদিক থেকে তিনি চরিত্রটির মধ্যে সম্ভবত কিছুটা সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তুলেছেন। সম্ভবত চরিত্রটি বাদল বাবুর নিজের জীবনেরই ফটোগ্রাফ।

নাটকটির শেষে অমল, কমল, বিমল দের সঙ্গে ইন্দ্রজিতের পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়। তাদের সবার সাঙ্গেই কবি চরিত্রটির শেষবারের কথোপকথন হয়। তাদের সবাই ব্যাস্ত সংসার, স্ত্রী, চাকরির বদলি, ছেলের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি, কিংবা ইন্সুরেন্স পলিসির বিজ্ঞাপন নিয়ে। তবে ব্যাতিক্রম পাওয়া যায় ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে, মানষীকে সে ভালোবাসলেও কোন একটা দোটানার কারনে তাকে বিয়ে করতে পারেনি। ইন্দ্রজিৎ আমাদের সমাজের প্রতিবাদী চরিত্রের মুখোচ্ছবি যারা জীবনকে নিয়ে আলাদা চিন্তা করবার ক্ষমতা রাখে, জীবনটাকে আলাদা খুব নিজস্বতায় চালিত করবার ক্ষমতা রাখে। সমাজ ও ঘুনেধরা নিয়মগুলির সঙ্গে চিরচারিত সহবাসকে এরা প্রচন্ড ঘেন্না করে। আমাদের আজকের সমাজেও অমল, কমল, বিমলদের মত গতানুগতিকতার বাইরে অনেক ইন্দ্রজিৎকে পাওয়া যায় যারা জীবনের একটা মোড়ে এসে অনেক গুলি হিসেব মেলাতে পারেনা। যুগে যুগে ইন্দ্রজিৎরা এসেছে পৃথিবীতে, ভবিষ্যতেও আসবে। সমাজটাকে পরিবর্তনের সপ্ন নিয়ে, মানুষগুলিকে সপ্ন দেখাতে… আর এমন হাজার ইন্দ্রজিতের জীবনের বলি নিয়ে আমাদের সমাজটা রোজ বেড়ে উঠছে।

খুব আশ্চর্যের বিষয় বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’নাটকটির সঙ্গে মহেশ এলকুঞ্চওয়ারের ‘গার্বো’নাটকটির অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। একথা মহেশ নিজেই বলেছেন। এ বিষয়ে মহেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনটা কী করে ঘটল, বলা মুশকিল। তবে জানা যায়, মহেশ ‘গার্বো’ লিখেছিলেন ১৯৭০ সালে আর ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’১৯৬৫-তে ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নাটকটির ইংরেজি করেছিলেন গিরিশ কারনাড এবং সেই অনুবাদটিও প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। ফলে, ‘গার্বো’রচনাকালে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এর কোনও অনুষঙ্গ মহেশের ভাবনায় আসা একরকম ভাবে অসম্ভব ব্যাপার। তাছাড়া, মহেশের কথানুযায়ী তিনি তখনো বাদল সরকারের কোনো নাটকই ১৯৭৩ সালে ‘গার্বো’ মঞ্চস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত পড়ে উঠতে পারেননি। তাহলে দুটি নাটকের আশ্চর্য মিল হল কীভাবে। বাদল সরকার এবং মহেশ এলকুঞ্চওয়ার দেশের দুই প্রান্তের মানুষ। একজন পূর্ব প্রান্তের অন্যজন পশ্চিমের। তাঁদের ভাষা ভিন্ন, নাটক দেখা বা নাট্য-ভাবনার পরিসরও একেবারেই আলাদা। অথচ, দুটি নাটকের মিল অনস্বীকার্য।

বাদল সরকার কিন্তু নাটক লিখবেন বলেই এই নাটকটি লেখেননি, এ নাটকের বীজ ছিল নাট্যকারের প্রথম প্রবাসজীবনে লেখা কবিতা ও ডায়েরিতে। নাটককার নিজেই লিখেছেন, ‘কোনও রকম নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না করেই লিখে চললাম। যেন একটা কবিতা থেকে পরের কবিতায় পৌঁছনো, মাঝখানটা সংলাপ দিয়ে ভরা।…থিয়েটার করি তখন, কিন্তু এটা মঞ্চস্থ করার কথা ভাবিনি, কারণ এটাকে নাটক বলে ধরিনি, এ যেন নিজস্ব ডায়েরি’। বাদল সরকারের কাছ থেকে নিয়ে ‘বহুরূপী’তে প্রকাশের জন্য শম্ভু মিত্রকে দিয়েছিলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। নাট্যকারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ এই নাট্য-সমালোচক বলেন, “নাটকটা শম্ভু মিত্র মঞ্চস্থ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। পরে শৌভনিক করেছিল। এবং তা বহু বছর ধরে চলেছিল, জনপ্রিয়ও হযয়েছিল। কিন্তু এমন দু’একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ বাদ দিলে বাংলার মূলস্রোতের থিয়েটারমহল বাদল সরকারকে বরাবরই ভেন্ন করে রেখেছে। বাদল সরকার একজন চিন্তাশীল স্রস্টা বলেই তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার দিক থেকে মনোনিবেশ হারাননি। যেমন, তার নাটকের লেখকের কাছে লেখার মতো উপাদান নেই, এবং পরিবর্তে নাটকের দর্শকদের দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি তাদের সম্পর্কে লেখার চেষ্টা করেন, কিন্তু সেখানেও হতাশ হন। যে কারণে প্রায়শই ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে ফেলেন। অবশেষে তিনি অনুপ্রেরণা পান মানসীর মধ্যে। লেখকের মতো, মানসী তার নিজস্ব চরিত্রায়নের চরিত্র নয়, একটি উপস্থাপনা। এটি এমন একটি সত্তাকে বোঝায় যা যৌথ চেতনার নির্দেশক হিসাবে কাজ করে। উভয় প্রধান চরিত্র এবং তাদের পরিচয়ের ধারণা প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, বিশেষ করে লেখক ইন্দ্রজিৎ। নাটকে তিনি একাধিকবার তার পছন্দের নাম পরিবর্তন করেন এবং ঘন ঘন তার পরিচয় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তার ব্যক্তিত্ব তিনটি নামের মধ্যে বিভক্ত, অমল, কমল এবং বিমল। এই তিনজন প্রত্যেকেই সমাজে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে এবং সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় হাসির জন্য অভিনয় করা হয়। ইন্দ্রজিৎ, লেখক হিসাবে তার ব্যক্তিত্বে, প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু অবশেষে তিনি নিশ্চিত হন যে সমাজের থাবা থেকে মুক্তি নেই। তবু ইন্দ্রজিৎ বিশ্ব অন্বেষণের অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেন। তিনি লন্ডনে ভ্রমণ করেন, কিন্তু সেই পৃথিবীকে তার রেখে যাওয়া জীবনের মতোই অতৃপ্ত মনে করেন। তিনি শীঘ্রই নিজের আত্মহত্যার কথা ভাবছেন কিন্তু সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি এতেও অক্ষম। তবে নাটকটি কোনো রকম উপসংহারে না গিয়েই শেষ হয়, কারণ ইন্দ্রজিৎ উপলব্ধি করেন যে অতীত এবং বর্তমান এক দড়ির দুটি প্রান্ত। নাটকটি শেষ পর্যন্ত জীবনের অসারতা এবং সমাজে আমরা সকলে যে ভূমিকা পালন করি তা নিয়ে। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাট্যপাঠের শেষ কথায় নাটকেরই একটি সংলাপ বলতে হয়- “আমরাও অভিশপ্ত সিসিফাসের প্রেতাত্মা। আমরাও জানি এ পাথর পড়ে যাবে।যখন ঠেলে ঠেলে তুলছি তখনই জানি এ থেলার কোনো মানে নেই। পাহাড়ের চূড়োর কোনো মানে নেই”।

পেজফোরনিউজ ২০২৪ পুজা সংখ্যায় প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন