…বাগচীবাবুর সঙ্গে আলাপ হবার কিছু পরেই বলে ওঠেন আমাকে — “আপনি তো শুনলাম ছবিও তোলেন? তাহলে এবারই চলে আসুন না! আমাদের গ্রামের বাড়ির পুজো দেখতে। আশা করি ভালোই লাগবে আপনার। আমি নিজেও থাকি প্রতিবছর, পুজোর দু’চারদিন আগেই চলে যাই। পরের দিকে বাড়ির অন্য লোকজনরা কলকাতা থেকে যায়।”
পেশায় উকিল, এই অমায়িক বাগচীবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ১৩-১৪ বছর আগে। একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার অফিসে। আমি বেশ কিছুদিন কর্মরত ছিলাম ঐ সংস্থায়। এই অফিসের কোর্ট কাছারির বিষয়গুলো এই ভদ্রলোকই দেখাশোনা করে থাকতেন। লোকজন ওঁকে বাগচীবাবু বলেই ডেকে থাকেন।
পুলিশ, উকিল-মোক্তার — এই সব লোকজনদের বিষয়ে মনে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও গ্রামের বাড়ির পুজো দেখার লোভ’টা আর সামলাতে পারলাম না। ভাবলাম, ভালো না লাগলে কোন ঢপ দিয়ে না হয় সে দিনই চলে আসবো।
মাস দুয়েক বাদে, সাতপাঁচ না ভেবে আমিও রওনা দিলাম। বাগচী বাবুর গ্রামের বাড়ির পুজো দেখবার উদ্দেশ্যে — ষষ্ঠীর দিন ভোর বেলায়।
ট্রেনে কৃষ্ণনগর তারপর বাস, সাইকেল ভ্যানে করে নদীয়া জেলার করিমপুরের নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম। প্রথমে দর্শনে অবাক হওয়ার ঘোর কাটতেই অনেক সময় চলে গেল। এতো দেখি এক বিশাল জমিদারি। ঠিক জায়গায় এসেছি তো? মনে হলো জলসাঘর সিনেমার লোকেশানে এসে পড়েছি। কিছুটা রেগেই ভ্যানওয়ালা ছেলেটিকেই বলি, যাও তুমিই ভেতরে গিয়ে বাড়ির কাউকে ডেকে নিয়ে আসো! কোন ভুলভাল জায়গায় নিয়ে এসে ভিড়িয়ে দিল আবার, কে জানে!
খানিক বাদেই একটা বিশাল দরজার ভেতর দিয়ে, সাদামাটা লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে সত্তর ছুঁতে যাওয়া বাগচীবাবু হাসিমুখে বেড়িয়ে এলেন। — ‘তাহলে আপনি এলেন শেষে! আশা করি খারাপ লাগবেনা আপনার।’
আমি কথা বলবো কী, ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক সেদিক শুধু মোহিত হয়ে দেখে যাচ্ছি। এরকম তো কথা ছিল না!
আমার ঘোর কাটতেই বেশ কিছু সময় লেগে গেল। কিছু পরে এক ধরনের খারাপ লাগাও শুরু হয়ে গেল। এই বাড়ির যেন বাংলার আরো পাঁচটা জমিদার বাড়ির মতোই করুণ — এক সময়ে পূর্বপুরুষদের গৌরবময় ঐতিহ্য আজ ক্রমশ যেন বিলুপ্তির পথে! প্রতিটি ইটের গায়ে যেন সেই বিখ্যাত সিনেমা জলসাঘর-এর চিত্রনাট্যই খোদাই করা আছে।
প্রায় দু’শো বছরেরও বেশি পুরনো এই জমিদার বাড়ি। এই অঞ্চলের স্কুল, মন্দির, হরিসভা, খেলার মাঠ, দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরির জন্য এই জমিদার বাড়ির অবদান অনস্বীকার্য। — গ্রামের লোকজনদের কথাবার্তায় যা বুঝতে পারি।
আমার থাকবার ও শোওয়ার জন্য জায়গা হলো দোতলায় এক বিশাল কড়ি বরগা’র ঘরে, অসাধারণ কারুকাজ করা এক পালঙ্কে।
শিয়ালদহ লাইনের ট্রেনে চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে ও গঞ্জের ভীড় বাসে ঠোক্কর খেতে খেতে যখন আসছিলাম — কল্পনাও করতে পারিনি, রাতে এমন এক জমিদার বাড়িতে আমার রাত কাটানোর সৌভাগ্য হবে!
আমার মনে হল দু’দিনের জন্য হলেও দৈন্যতা ঘুচে গিয়ে চৌধুরী পদবী সার্থকতা লাভ করল!
বিকেলের দিকে বাগচীবাবু আমাকে গ্রাম ঘোরাতে নিয়ে গেলেন। গ্রামের লোকজন দেখলাম এই বাগচীবাবুকে দেখে এখনো সমীহ-সম্মান করে চলেছেন। পাশেই ওঁনাদের আরেক শরিকের জমিদারি দেখাতে নিয়ে গেলেন। সেও দেখবার মতোই। যা নতুন বাড়ি নামে পরিচিত এই গ্রামে। তা সেও প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। যেখানে নতুনত্বের বিন্দুমাত্র নামগন্ধ নেই! এক সময়ের রাজকীয় জৌলুস বিলীন হয়ে আজ কাঠামোটাই শুধু পড়ে আছে!
এখানে এসে পুজো দেখবার চেয়ে এই গ্রাম ও জমিদার বাড়ির আনাচেকানাচে ঘোরাঘুরি করতেই আমি বেশি উৎসুক ছিলাম। সেই স্বাধীনতাটাও বাগচীবাবু আমাকে দিয়েছিলেন। শুধু সাবধান করেছিলেন, ‘সাপখোপ আছে এখানে, একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন!’
আর ওঁনার আতিথেয়তায় কোন রকমের ফাঁক রয়ে যাচ্ছে কীনা প্রতি মুহূর্তে উনি সেইদিকে তীক্ষ্ম নজর রাখতেন। মনে হতো দীর্ঘদিনের পরিচিত কোন অবিভাবক!
বাপ ঠাকুর’দার এক সময়ের গরিমা নিয়ে কোন রকমের পাঁচালি ওঁর মুখ থেকে শুনতে পাইনি এক মূহুর্তের জন্যও — এটা আমার খুব ভালো লেগেছিল।
আমি মনের আনন্দে এই বাড়ির বিভিন্ন মহল্লায় চষে বেড়াতাম। মনে হতো যেন কোন পরিত্যক্ত মিউজিয়ামের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছি। কত কী সব নিদারুণ অবহেলায় পড়ে আছে। একটা পিয়ানোকেও দেখলাম ওই স্তুপের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। — দেখে মনটা ভারী হয়ে যেত। তবে একটা জিনিস দেখে খুব ভালো লাগলো। একটা সময়ে এই বাড়িতে যে পড়াশোনার ভালই চল ছিল, তা দেরাজ ও কাঠের আলমারিতে ঠাসা পুঁথি ও প্রাচীন বইপত্তর দেখে বুঝতে পারা গেল। তবে কালের প্রবাহে ও অযত্নে সবই প্রায় নষ্ট হয়ে যাবার পথে।
ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাগচীবাবুকেও বেশ চিন্তিত
দেখলাম। নাকে এক টিপ নস্যি দিয়ে বলে ওঠেন — “জানেন, যতো দিন যাচ্ছে আমাদের লোকবলও কমে আসছে। সবাই প্রায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, দেশে-বিদেশে,
নানা জায়গায়। জানিনা, এই পুজো আর কতদিন টানতে পারা যাবে!” একথা বলে একটা দীর্ঘশ্বাসও ফেললেন যেন।
অষ্টমীর দিন সকাল। গ্রামের লোকজনও এই বাড়ির ঠাকুরদালানে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য আর পুজো দেখবার জন্য জড়ো হতে শুরু করেছে। আর কলকাতা থেকে এই বাড়ির আত্মীয়স্বজনরা এখানে পৌঁছে যাবার আগেই আমি বাগচীবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
মাস খানের বাদে বাগচীবাবুকে আমার তোলা কিছু ছবি দিয়েছিলাম। সেই ছবি দেখে ওঁনার স্বজনদেরও খুব ভালো লেগেছিল — পরে একদিন জানিয়ে ছিলেন সেকথা।
সময় বয়ে চলে…!
পুজো আসে পুজো যায়। আমিও সেই কর্মস্থল, অনেক দিন হলো ছেড়ে দিয়েছি। শুনেছি, বাগচীবাবুও সেখানে আর যান না। আমার সঙ্গেও আর যোগাযোগ নেই!
স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে হটাৎই মনে পড়ল — এই বাগচীবাবুর সঙ্গে আমার বাবা’র দুয়েকটি জায়গায় বেশ মিল ছিল। আমার বাবাও নস্যি নিতেন এবং ওই বাগচীবাবুর মতোই ফর্সা ও ছোটখাটো শীর্ণ চেহারার মানুষ ছিলেন আমার বাবা।
আর, এই দিন পাঁচেক আগেই আমার বাবা চলে গেলেন ‘না ফেরার দেশে!’
বাবার পারলৌকিক কাজের জন্য ছবি বাছাই করছিলাম। হটাৎই একটা সিডি থেকে করিমপুরের এই ছবিগুলো বেরিয়ে এলো! চোখের সামনে যেন একটা অদৃশ্য চলচ্চিত্রের কিছু মূহুর্ত ভেসে উঠলো— যা প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিলাম!
আজকের এই বিষণ্ণতার দিনে, বাগচীবাবুর এই ছবিগুলো দেখে কেন জানিনা ওঁর কথাও খুব মনে পড়ছে…!
কোথায়, কেমন আছেন বাগচীবাবু — কে জানে!
সেই সময়ে তোলা বাগচীবাবু এবং ওঁনার সেই জমিদার বাড়ির কিছু ছবি এখানে রাখলাম।
পুজো সবার ভালোভাবে কাটুক এই প্রার্থনাই করি।
১০-১০-২০২১