দুর্গা নামটি বঙ্গদেশীয় শরৎকালীন দুর্গাপূজার সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছে বলেই প্রাথমিকভাবে আমাদের বলতে হচ্ছে যে, দুর্গাপূজার সময় আমরা যে মহিষাসুরমর্দিনীদেবীর পূজা করি, তিনি যতখানি দুর্গা, তার থেকে অনেক বেশি চণ্ডী বা চণ্ডিকা। মহামতি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ পাঠের আরম্ভে তাই ‘নম চণ্ডী’র গান অথবা ‘নমশ্চণ্ডিকায়ৈ’ মন্ত্র।
দুর্গ, মতান্তরে দুর্গম নামক একটি অসুরকে শক্তিরূপিণী দেবী বধ করেছিলেন, তিনিই দুর্গা নামে কথিত হন। মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা এবং দুর্গাসুর বা দুর্গমাসুরনাশিনী দুর্গা মূল শক্তিস্বরূপে এক এবং অভিন্না হলেও তাঁরা লীলাভেদে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। এঁদের দুজনের আবির্ভাবের কাল, অসুরবধের লীলাস্থল এবং তাঁদের কাজও আলাদা আলাদা।
মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার আবির্ভাবের সময় হলো স্বায়ম্ভুব বা প্রথম মন্বন্তর, লীলাস্থল হিমালয় পর্বত এবং তার সানুদেশ, আর তাঁর কাজ মহিষাসুর বধ। আর দুর্গমাসুরনাশিনী দুর্গার আবির্ভাব-কাল বৈবস্বত মনুর কাল অর্থাৎ সপ্তম মন্বন্তর, তাঁর লীলাস্থল বিন্ধ্য পর্বত, এবং তাঁর কাজ দুর্গমাসুর নিধন করা বা দুর্গাসুর বধ। শেষোক্ত দুর্গাসুরনাশিনী দুর্গার সঙ্গে শক্তিদেবীর অন্য রূপ শাকম্ভরী, শতাক্ষীর গভীর যোগ আছে। আর আমরা বঙ্গদেশে শরৎকালীন যে দুর্গাপূজা করি, সেটি আসলে মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডীর পূজা— যা খুব সরলভাবে দুর্গাপূজা বলেই বিখ্যাত হয়েছে। তবে এই বিখ্যাত হবার কাজটাও আজকে হয়নি। কেননা বঙ্গদেশে দুর্গাপূজার সময় মার্কণ্ডেয় পুরাণের সাতশো শ্লোকের যে অংশটা আমরা মার্কণ্ডেয় চণ্ডী বা ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’ নামে পাঠ করি, সেই চণ্ডী কিন্তু অনেক আগে থেকেই দুর্গা-সপ্তশতী নামে পরিচিত, যার অন্য নাম দেবীমাহাত্ম্য কিংবা সপ্তশতী চণ্ডী।
এই কথাগুলি এই কারণেই বলা যে, আসলে দুর্গা-নাম মহাশক্তির অন্য নামগুলির ওপরেও অধিক্ষিপ্ত হয়েছে, অথচ দুর্গা কিন্তু একভাবে সকলের চাইতে পৃথক। তবে দুর্গানামটি শক্তিরূপিণী দেবীর একটি সাধারণ নাম হিসেবে প্রচলিত হওয়ার রহস্যটা ওই দুর্গা নামের মধ্যেই নিহিত আছে। বস্তুত মানুষের মনের মধ্যে অহরহ বিপদ-মুক্তির যে প্রার্থনা থাকে, সেখানেই দুর্গা নামের জনপ্রিয়তা তৈরি হয়ে যায়। ‘দুর্গ’ শব্দের সাধারণ অর্থই হল সংকট, বিপদ। যে কোনওরকম বিপদ বা দুর্গ থেকে যিনি ত্রাণ করেন, তিনিই দুর্গা। এই ভয়, সংকট বিপন্নতা— যা দুর্গ শব্দের অর্থ— সেগুলি, তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতিতে কেমন ছিল, তার একটা বিবরণ দিয়ে ‘শব্দকল্পদ্রুম’ বলেছে— দুর্গ শব্দের অর্থ যেমন দৈত্য অর্থাৎ সেই দুর্গাসুর যেমন হতে পারে, তেমনই দুর্গ-শব্দের অর্থ মহাবিঘ্ন, দুর্গ মানে এই সংসারের মায়ার বাঁধন বা ভববন্ধন এবং দুর্গ মানে কুকর্ম—
দুর্গো দৈত্যে মহাবিঘ্নে ভববন্ধে কুকর্মণি।
মহাবিঘ্ন এবং ভববন্ধন থেকে মুক্তি পাবার জন্য দুর্গাকেই তো চিহ্নিত করা হয়েছে মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর মধ্যেই। এখানে দেবস্তবে বলা হয়েছে— তুমি দুর্গা, এই দুস্তর (দুর্গ) ভবসাগর পার হবার নৌকা হলে তুমি—
দুর্গাসি দুর্গভবসাগর-নৌরসঙ্গা
এই শ্লোকের পরে পরেই দেবতারা আবার বলছেন— হে দুর্গা, তোমাকে স্মরণ করা মাত্রই তুমি সমস্ত প্রাণীর ভয়ভীতি হরণ করে থাকো—
দুর্গে স্মৃতা হরসি ভীতিমশেষজন্তোঃ
এই শ্লোকের ‘দুর্গে’ শব্দটিকে সম্বোধন পদ হিসেবে না ধরে দুর্গ শব্দের সাধারণ অর্থ করলে মানে দাঁড়াবে— বিপদে-আপদে তোমার নাম স্মরণ করলেই তুমি সমস্ত প্রাণীর বিপদের ভয় দূর করে দাও।
দুর্গ শব্দের অর্থ মহাবিঘ্ন ধরে নিয়েই শব্দকল্পদ্রুম দুটি-তিনটি শ্লোক উদ্ধার করে বলেছে— দুর্গ শব্দের অর্থ মহাবিঘ্ন, সংসার-বন্ধন, কুকর্ম, শোক, দুঃখ, নরক, পরলোকে যমদণ্ডের ভয়, পুনর্জন্মের ভীতি, মহাভয়, অতিরোগ ইত্যাদি। আর এই মহাভয়াত্মক দুর্গ শব্দটির সঙ্গে ‘আ’ বর্ণটি ব্যবহৃত হয় হন্তা বা ‘নাশ করা’ অর্থে অর্থাৎ দুর্গ বা মহাভয়-বিঘ্নকে যিনি নাশ করেন, হত্যা করেন, তিনিই দুর্গা—
দুর্গে দৈত্যে মহাবিঘ্নে ভববন্ধে কুকর্মণি।
অন্য আর একটি পরম্পরাপ্রাপ্ত শ্লোকে দুর্গা শব্দের বর্ণবিভাগ করে শব্দকল্পদ্রুম জানিয়েছে— দুর্গা শব্দে ‘দ’ বর্ণটি ব্যবহার করা হয়েছে, যেহেতু তিনি দৈত্য নাশ করেন, উ-কার ব্যবহৃত হয়েছে বিঘ্ন নাশ করেন বলে, আর এখানে রেফ বা র-বর্ণের অর্থ তিনি রোগ নাশ করেন, আর ‘গ’ বর্ণের অর্থ তিনি পাপ নাশ করেন— এই সম্পূর্ণ দুর্গ-পদটির সঙ্গে আ-কার ব্যবহার করার অর্থ হলো— তিনি ভয়, শত্রু, সব কিছু নাশ করেন, কেননা আকার বর্ণটাই নাশবাচক—
দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মতঃ।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়-শত্রুঘ্নবচন আকারঃ পরিকীর্তিতঃ।।
অবশেষে দুর্গা শব্দের সবচেয়ে সাধারণ অর্থ এটাই যে, দুর্গা সব প্রকারের দুর্গতি নাশ করেন—
দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা।
শব্দকল্পদ্রুমে দুর্গা শব্দটার প্রধান অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে বর্ণ ভেঙে প্রত্যয় যুক্ত করে। সমস্ত প্রকার দুর্গতি নাশের এই অর্থ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে উল্লিখিত হয়েছে। আরও লক্ষণীয়, মহাভারতে অজ্ঞাতবাসের জন্য বিরাট নগরে প্রবেশ করার আগে সমস্ত বিপদ থেকে মুক্তি পাবার জন্য পাণ্ডবরা যে শক্তি-দেবতার স্তুতি করলেন— তিনি কিন্তু দুর্গা— অগমন্মনসা দেবীং দুর্গাং ত্রিভুবনেশ্বরীম্। যুধিষ্ঠির-কৃত এই দুর্গাস্তুতির মধ্যে দেবীর সমস্ত রূপেরই বর্ণনা আছে প্রায়। এই বর্ণনার ক্রমে যখন দুর্গার নামটি এসেছে, তখন যুধিষ্ঠির বলেছেন— তুমি সমস্ত বিপদ-আপদ-ভয় থেকে ত্রাণ করো বলেই তোমাকে লোকে দুর্গা বলে। যারা অরণ্য-কান্তারের মধ্যে পথ হারিয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, যারা মহাসমুদ্রে মগ্ন হয় (সংসার-সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে), দস্যুরা যাঁদের বন্দি করেছে— তাদের সকলের গতি তুমি। এমন সংকটাপন্ন অবস্থাতেও যদি তোমাকে কেউ স্মরণ করে, তারা কিন্তু আর বিপন্ন হয় না—
দুর্গাত্তারয়সে দুর্গে তস্মাদ্ দুর্গা স্মৃতা জনৈঃ।
দুর্গ বা বিপদ থেকে ত্রাণ করেন বলেই তাঁর নাম দুর্গা— মহাভারতের এই কথাটার প্রতিধ্বনি আছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এবং মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে। ব্রহ্মবৈবর্তে তিনি ‘দুর্গে দুর্গতিনাশিনী’। দুর্গানাম স্মরণ করলেই তিনি দুর্গতি থেকে ত্রাণ করেন—
নারায়ণি মহাভাগে দুর্গে দুর্গতিনাশিনি।
আর দুর্গাসপ্তশতী চণ্ডীতে স্তুতি করে বলা হচ্ছে— হে দেবী! তুমি আমাদের সকল ভয় থেকে পরিত্রাণ করো, তাই দেবী দুর্গা হে! তোমাকেই প্রণাম করছি—
ভয়েভ্যস্ত্রাহি নো দেবি দুর্গে নমো’স্তুতে।
দুর্গার এই রক্ষাদায়িনী, ত্রাণকারিণী ভূমিকা থেকেই সেকালে রাজারা শত্রুর পক্ষে অভেদ্য যে দুর্গগুলি তৈরি করতেন, সেই দুর্গের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা হিসেবে দুর্গার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতেন। ফলত একটি অভেদ্য, দুরধিগম্য দুর্গ যেভাবে রাজাকে সুরক্ষা দেয়, সেই দুর্গের ভাবনা থেকেই দুর্গার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করেন। দেবী পুরাণে দেবী দুর্গাকেই দুর্গের রক্ষাকর্ত্রী দুর্গেশ্বরী বলে সম্বোধন করা হয়েছে এবং রাজা-রাজড়াদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, দুর্গগুলিতে তাঁরা যেন মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার মূর্তি স্থাপন করেন— কেননা দুর্গের মধ্যে অবস্থিত হয়েই তিনি পরাক্রম দেখান—
ত্বং হি দুর্গে মহাবীর্যে দুর্গে দুর্গপরাক্রমে।
দেবীভাগবত পুরাণে দুর্গ শব্দটি ব্যবহার না করে বহুদুর্গসমন্বিত কাশী নগরীর উল্লেখ করে বলা হয়েছে— দেবী দুর্গা যেন নগরে স্থিত হয়ে নগরকে রক্ষা করেন। কাশীর রাজা সুবাহু দুর্গার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে বলছেন— আপনি সেই পরমা শক্তি। আপনি দুর্গা দেবী নামে বিখ্যাত হয়ে সব সময় এ বারাণসী নগরীতে অবস্থান করবেন এবং চিরকাল রক্ষা করবেন এই বারাণসী নগরীকে—
নগরে’ত্রত্বয়া মাতঃ স্থাতব্যং মম সর্বদা।
দুর্গাদেবীতি নাম্না বৈ ত্বং শক্তিরিহ সংস্থিতা।।
দেবীভাগবত পুরাণের এই শ্লোকটিতে যে নগরী শব্দটি বলা হলো, এই নগরী, নগর, পুরী আসলে দুর্গেরই নামান্তর। এটা বোঝা যাবে সপ্তাঙ্গ রাষ্ট্রের সাতটি অঙ্গের মধ্যে অন্যতম অঙ্গ দুর্গকে অনেকেই ‘পুর’ বলে অভিহিত করেছেন। স্বয়ং মনুই বলেছেন পুর। কিন্তু দুর্গ তৈরি করার সঙ্গে নগর-নির্মাণের একটা বড়ো সম্বন্ধ আছে বলেই কৌটিল্য দুর্গ নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গেই নগর নির্মাণের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। ফলে দেবীভাগবতে দেবী দুর্গাকে বারাণসী নগরীর রক্ষাকর্ত্রী বা পালিকা হিসেবে দেখতে চাইছেন রাজা, সেটা আসলে বারাণসীর দুর্গপালিকার কথা।
যে বারাণসী নগরীতে নগরপালিকা হিসেবে দুর্গার কথা বলা হলো, বারাণসী বা কাশীর সুরক্ষা নিয়ে স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে স্বয়ং মহাদেব তাঁর পরিচর নন্দীকে আদেশ দিয়ে বলছেন— কাশী নগরী রক্ষার জন্য প্রতিটি দুর্গে দুর্গামূর্তি স্থাপন করো—
প্রতিদুর্গং দুর্গারূপাঃ পরিতঃ পরিবাময়।
প্রভু মহাদেবের আদেশ পেয়ে নন্দীও প্রতিটি দুর্গে দুর্গামূর্তি স্থাপন করেছেন—
আহূয় সর্বতো দুর্গাঃ প্রতিদুর্গং ন্যবেশয়ৎ।
রাজা-রাজড়াদের দুর্গের মধ্যে দুর্গামূর্তি প্রতিষ্ঠা করার এই পৌরাণিক নির্দেশ কিন্তু এমন একটা ইঙ্গিত দেয় যে, দুর্গরক্ষিণী দেবী হিসেবেই দুর্গার প্রথম রূপকল্পনা হয়েছিল।
দুর্গা নামের আর একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ উৎস হল—মহাশক্তিরূপিণী দেবী দুর্গম বা দুর্গ নামে এক অসুরকে বধ করেছিলেন বলেই তাঁর নাম হয়েছে দুর্গা। দেবীভাগবত পুরাণ এবং স্কন্দ পুরাণের কাশী খণ্ডে এই দুর্গ বা দুর্গমাসুর বধের কাহিনি বিবৃত হয়েছে— যদিও স্কন্দপুরাণের কাহিনিতে দুর্গাসুরের সঙ্গে মার্কণ্ডেয় পুরাণের শুম্ভ-নিশুম্ভ দৈত্যের ব্যবহারিক মিল পাওয়া যায় কিছু; আর দেবীভাগবতের কাহিনিতে দুর্গার সঙ্গে শতাক্ষী এবং শাকম্ভরী দেবীর একটা পর্যায়ক্রমিক একাত্মতা তৈরি হয়।
দেবীভাগবত পুরাণে দুর্গম বা দুর্গ দৈত্যের বধ অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় এবং তা দুর্গতিনাশের একটি ক্রমিক পর্যায় হিসেবে এসেছে বলে অসুরবধের চাইতেও এখানে দুর্গার দুর্গতিনাশিনী ভূমিকা বড়ো হয়ে ওঠে। এখানে রুরুদৈত্যের ছেলে দুর্গম দৈত্য মনে মনে এটা আগে বুঝে নিলেন যে, দেবতারা আসলে বেদের ওপর বেঁচে আছেন। ব্রাহ্মণরা বেদবিহিত যজ্ঞকর্মাদি করে দেবতাদের বল-শক্তি বাড়িয়ে দেন। ব্রাহ্মণরা যজ্ঞে ঘি ঢালেন, সেই ঘি খেয়ে দেবতারা পুষ্ট হন এবং তাঁরা অসুরদের বিনাশ করেন। কিন্তু এই সমস্ত প্রক্রিয়ার উপাদান এবং উৎস যেহেতু বেদ, অতএব বেদকেই যদি অবলুপ্ত করে দেওয়া যায় তাহলেই দেবতাদের বিনাশ ঘটবে— এই ভাবনা নিয়ে দুর্গম দৈত্য ব্রহ্মার তপস্যা আরম্ভ করলেন। তপস্তুষ্ট ব্রহ্মা বর দিতে চাইলে দুর্গম সকাতরে বললেন— এই তিন ভুবনে দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের কাছে যে বেদমন্ত্র আছে, সেগুলি আওমস্ত আমার কাছে থাকবে আর আপনি আমাকে এমন শক্তি দিন, যাতে আমি দেবতাদের পরাজিত করতে পারি—
ত্রিষু লোকেষু যে মন্ত্রা ব্রাহ্মণেষু সুরেষ্বপি।।
বিদ্যন্তে তে তু সন্নিধ্যং মম সন্তু মহেশ্বর।
বলঞ্চ দেহি যেন স্যাদ্দেবানাঞ্চ পরাজয়ঃ।।
ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে ‘তথাস্তু’ বলে চলে গেলেন বটে, কিন্তু সেই থেকে ব্রাহ্মণেরা বেদমন্ত্রে বিস্মৃত হলেন। স্নানাচিহ্ন, যজ্ঞ-জপ, শ্রাদ্ধ-হোম— সব বন্ধ হয়ে গেল। দেবতারা আর যজ্ঞে আহূত হন না, তাঁদের অন্ন-পান বন্ধ হয়ে গেল, শরীর হয়ে উঠল নিস্তেজ। এই অবস্থায় দুর্গম দৈত্য স্বর্গ অধিকার করে নিলেন। দুর্গমাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোনও শারীরিক ক্ষমতাই তাঁদের রইল না। দেবতারা স্বর্গ থেকে পালালেন। নিরুপায় হয়ে তাঁরা আশ্রয় নিলেন হিমালয় পর্বতের গিরিগুহায় এবং অবশেষে পর্বতসানুতে বসে জগদম্বিকা শিবার ধ্যানে মগ্ন হলেন।
এদিকে এই পৃথিবীও বিপন্ন হয়ে উঠল। শতবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টিতে পৃথিবীর নদ-নদী, জলাশয় এমনকী কুয়ো পর্যন্ত শুকিয়ে গেল। অবস্থা দেখে শান্তচিত্ত ব্রাহ্মণরাও তপস্যা আরম্ভ করলেন শিবা-ভবানীর। দেবতা-ব্রাহ্মণদের স্তব এবং করুণ তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেবী শক্তি এক অদ্ভুতরূপে তাঁদের সামনে আবির্ভূত হলেন। দেখা গেল— তাঁর অনত্ত চক্ষু, নীল পদ্মের পাপড়ির মতো টানা টানা শত শত আঁখিপাতে জল নিয়ে তিনি দেখা দিলেন—
অনন্তাক্ষিময়ং রূপং দর্শয়ামাস পার্বতী।
নীলাঞ্জনসমপ্রখ্যং নীলপদ্মায়তেক্ষণম্।।
তিনি চতুর্ভুজা মূর্তিতে ডান দিকের অধোহস্তে অনেকগুলি বাণ মুষ্টি পাকিয়ে ধরে আছেন, আর ডাইনে ওপরের হাতে পদ্ম। বাম দিকে ওপরের হাতে পুষ্প-পল্লব, ফল-মূল-শাক, আর বাম দিকের নীচের হাতটিতে ধনুক। এই অদ্ভুতরূপে সবার সামনে আসার পর তাঁর অনন্তসংখ্যক চক্ষু দিয়ে বৃষ্টির ধারার মতো জল গড়াতে শুরু করল। তাতে পৃথিবীর সর্বস্থানে নয় দিন ধরে নিরন্তর বহুল বৃষ্টিপাত হল। নদ-নদী-কূপ-তড়াগ ভরে উঠল জলে। দেবতারা, মানুষেরা যে যেখানে আত্মগোপন করেছিল সবাই বেরিয়ে এসে দেবীর স্তব করতে করতে বললেন— আপনি যখন আমাদের এই অনাবৃষ্টির ভয় নিবারণ করার জন্য নিজশরীরে শত শত অক্ষি (চক্ষু) ধারণ করেছেন, তাই আপনি শতাক্ষী নামে বিখ্যাত হবেন—
অস্মচ্ছান্ত্যর্থমতুলং লোচনানাং সহস্রকম্।
ত্বয়া যতো ধৃতং দেবি শতাক্ষী ত্বং ততো ভব।।
দেবতারা-ব্রাহ্মণেরা এবার মহাদেবীর স্তব করতে করতেই তাঁকে বললেন— আমরা খাবারদাবার পাইনি এতকাল, তাই ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর, আমাদের ভালো করে স্তব করার শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। হে অম্বিকে, হে মহেশানী! আপনি নিজগুণে কৃপা করে বেদের উদ্ধার সাধন করুন। দেবতা-ব্রাহ্মণদের মুখে এত করুণ আর্তি শুনে মহেশানী অম্বিকা তাঁর নিজের হাতে ধরে থাকা ফলমূল এবং শাক অর্থাৎ শক্তিদায়ী নানাপ্রকারের উদ্ভিদ দেবতা এবং মানুষদের দান করলেন। যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে নতুন শস্য-শাকের উৎপত্তি না হলো, ততদিন সেই দেবী সমস্ত মানুষকে আহারের উপযোগী নানা রস-সমৃদ্ধ খাদ্য এবং পৃথিবীর সমস্ত পশুদের ঘাসপাতার জোগান দিলেন তিনি। এই শাকান্ন দানের ফলেই মহেশানীর নতুন আর একটি নাম হল শাকম্ভরী—
নানাবিধানি চান্নানি পশুভোজ্যানি যানি চ।
কাম্যানন্তরসৈর্যুক্তান্যানবীনোদ্ভবং দদৌ।
শাকম্ভরীতি নামাপি তদ্দিনাং সমভূন্নৃপ।।
এইভাবে বৃষ্টি এবং পুষ্টিদায়ক খাদ্যলাভের পর দেবতা-মানুষ সকলের মধ্যে যখন আনন্দ-কোলাহল তৈরি হলো, তখন দূতের মুখে সব খবর পেলেন দুর্গমাসুর। দেবতাদের ওপর এবং ব্রাহ্মণদের ওপর শরবর্ষণ করতে আরম্ভ করলো। দেবী শতাক্ষী এই অবস্থায় চতুর্দিকে একটি তেজোময় বলয় তৈরি করে দেবতা ও ব্রাহ্মণদের প্রাথমিক সুরক্ষা প্রদান করলেন। তাঁর শরীর থেকে বেরিয়ে এলেন বহুতর শক্তিমূর্তি— কালী, তারা, মাতঙ্গী, মোহিনী, ছিন্নমস্তা এবং দশমহাবিদ্যা-সহ আরও অনেক শক্তিমূর্তি। দুর্গমাসুর এবং তাঁর সৈন্যবাহিনী দশ দিন ধরে যুদ্ধ করলেন মহাশক্তির বিভিন্ন রূপের সঙ্গে। দুর্গমাসুরের সৈন্যক্ষয় হয়ে গেল দশ দিনের মধ্যেই। এবার দুর্গমাসুর এলেন যুদ্ধ করতে, অন্যদিকে উপস্থিত হলেন মহাদেবী স্বয়ং। ভীষণ যুদ্ধ হলো দেবী এবং দৈত্যের। অবশেষে মারা গেলেন দুর্গম দৈত্য। ব্রহ্মাদি সমস্ত দেবতারা দেবী অম্বিকার স্তব করলেন। পরমতুষ্টা দেবী দেবতাদের কল্যাণ কামনা করে বললেন— দুর্গমাসুরকে আমি হত্যা করেছি বলে আজ থেকে আমার নাম হলো দুর্গা। এই দুর্গা নাম এবং শতাক্ষীর নাম যে গ্রহণ করবে, সে সমস্ত সাংসারিক মায়া জয় করতে পারবে—
দুর্গমাসুরহন্ত্রীত্বাদ্ দুর্গেতি মম নাম যঃ।
গৃহ্নাতি য শতাক্ষীতি মায়াং ভিত্ত্বা ব্রজত্যসৌ।।
শতাক্ষী, শাকম্ভরী, দুর্গা— এই তিনটি স্বরূপই ভগবতী মহাশক্তির কার্যভেদে তিনটি নাম; স্বরূপত তাঁদের মধ্যে কোনও ভেদ নেই বলেই দেবীভাগবতের টীকাদার শৈব নীলকণ্ঠ লিখেছেন— এখানে শতাক্ষী, শাকম্ভরী এবং দুর্গা— দেবতাদের যেহেতু এই তিন রূপে তিনি জলদান, অন্নদান এবং দৈত্যবধের উপকার সাধন করেছিলেন, তাই তিনটি হলো মহাদেবীর কর্মভেদ মাত্র এবং কর্মভেদের জন্যই তাঁর নামেও ভেদ হয়েছে, কিন্তু এগুলি তাঁর অবতার-ভেদ নয়।
দেবীভাগবতের টীকাদার শৈব নীলকণ্ঠের কণ্ঠলগ্ন হয়েই আমরা দুর্গানামের বহুল ব্যবহার এবং জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে একটা সিদ্ধান্ত শোনাতে চাই। খেয়াল করে দেখুন, নীলকণ্ঠ দুর্গার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন শতাক্ষী-শাকম্ভরীর পরিণতি হিসেবে, আরও লৌকিক এবং জড়দৃষ্টিতে জলদান, অন্নদানের পর সেই অন্নপানে বাধা সৃষ্টিকারী অসুরনাশের পরিণতিতে। এর অর্থ মানুষের যত দুর্গতি হয় জলাভাবে খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, যে দুর্গতি হয় অনাহারে, অর্ধাহারে অথবা যে দুর্গতি তৈরি করে জাতবৈরী শত্রুরা, সেই দুর্গতি শতাক্ষীর করুণাঘন নয়নাশ্রুবৃষ্টিধারায় সিঞ্চিত করে, নতুন শস্য না ওঠা পর্যন্ত ফল-মূল-শাকম্ভরীর ক্ষুধার অন্ন দান করে— আনবীনোদ্ভবং দদৌ— অবশেষে অন্নপানের বাধাসৃষ্টিকারী দুর্গতির মূর্ত স্বরূপ দুর্গাসুরকে বধ করে দেবী হলেন দুর্গা— দুর্গা দুর্গতিনাশিনী।
আমরা এখানেই যেন বুঝতে পারছি যে, দুর্গ বা দুর্গম কোনও অসুর বা দৈত্য নন, আমাদের জীবনধারণের যত দুর্গতি— যে দুর্গতি আমরা রোধ করতে পারি না, আমাদের কাছে যেটা দুর্গম, অসাধ্য, সেই দুর্গতিই আসলে দুর্গাসুর অথবা দুর্গম দৈত্য এবং সেই দুর্গতি নিঃশেষে যিনি দূর করে দেন, তিনিই দুর্গা। লক্ষণীয়, এই দুর্গাসুরের মধ্যেই মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর শুম্ভ-নিশুম্ভ-কাহিনীর রসাভাস আছে, আবার এই দুর্গার মধ্যেই মহিষাসুর-নিধন কালে হস্তী থেকে মহিষ, মহিষ থেকে পুনরায় অসুরের যোদ্ধা বেশের আরোপন ঘটেছে। এই দুর্গার মধ্যেই মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডিকার মতোই অন্যান্য শক্তিদেবতার উৎসারণ ভূমি। ফলত দুর্গতিনাশিনী দুর্গাই পরবর্তীকালে অন্যান্য শক্তিদেবতার, বিশেষত শরৎকালীন মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডীরও নামান্তর হয়ে উঠেছেন।