শান্তির বয়স তখন কত আর। আঠারো উনিশ হবে। ও যে দেখতে এত সুন্দর, বোনদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী এর আগে লক্ষ করিনি। হাতে দুগাছি প্লাস্টিকের চুড়ি ছাড়া অলঙ্কারের কোথাও কিছু নেই। পরনে আটপৌরে একখানা শাড়ি। কিন্তু তাতে ওর রূপের অসামান্যতা ঢাকা পড়েনি। উজ্জ্বল রং, তীক্ষ্ণ নাক মুখ চোখ—আপনাদের গল্পের নায়িকা হবার জন্যে যা যা দরকার সবই আছে। কিন্তু এতদিন আমি যেন ভাল করে দেখিনি। হাসবেন না। সত্যিই দেখিনি। কেবল সমস্যার কথাটাই ভেবেছি। বোকার গুরুভারের কথা ভেবেই ক্লিষ্ট হয়েছি। কিন্তু ওর যে এত রূপ আছে তা দেখিনি। আজ একটি কৃতজ্ঞ তরুণীর মধ্যে নারীর রূপকে আমি প্রথম দেখলাম। কৃতজ্ঞতা যে এত মধুর তা যেন আমি জীবনে এই প্রথমে অনুভব করলাম। যে ভারকে অত গুরুতর মনে করেছিলাম তার গৌরব রইল, ভার যেন আর রইল না।
শ্ৰাদ্ধশান্তি চুকে গেল। মাইনের টাকার বেশির ভাগ আমি মতিবাবুর স্ত্রীর হাতে এনে ধরে দিলাম। তিনি একটু কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, সব দিলে তোমার চলবে কী করে। তোমারও তো মেস খরচা আছে। আমি বললাম, ‘সে একরকম চলে যাবে। সে জন্য ভাববেন না।’
তিনি বললেন, সে কী হয় বাবা। তুমি আমাদের জন্যে ভাববে, আমাদের জন্যে সব করবে, আর আমরা পোড়া ছাই একটু ভাবতেও পারব না। তুমি এখান থেকেই দুটো ডালভাত খেয়ে যাবে।’
শান্তি বলল, ‘খেয়েই দেখুন না, অতুলদা। কদিন থেকে আমরা বোনেরাই রান্নার ভার নিয়েছি। আপনার মেসের ঠাকুরের চেয়ে খুব খারাপ হবে না’।
আমি বললাম, ‘ঠাকুরের চেয়ে ঠাকুরানীরা চিরকালই ভাল রাঁধে। এত তরল স্বরে ওর সঙ্গে কোনদিন কথা বলিনি। এই প্রথম বললাম’।
শাস্তি হেসে বলল, ‘সে কথা স্বীকার করেন তা হলে?’
শুধু শান্তি নয়, ওদের চার বোনের মুখেই দেখলাম হাসি ফুটেছে। শান্তি, সুধা, তৃপ্তি, দীপ্তি।
বয়সে দেড় বছর থেকে দু-বছরের ব্যবধান। গড়নে প্রায় এক। কারিগরের একই ছাঁচে ঢালা মূর্তি। রঙটা ওরইমধ্যে কারও এক পোঁচ বেশি ফর্সা, কারও বা একটু শ্যামলা। চার মুখে সেই চারটি হাসির রেখা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এতদিন আমি ওদের শান্ত্বনা দিয়েছি, প্রবোধ দিয়েছি, আশ্বাস দিয়েছি, উপদেশ দিয়েছি, আজ দেখলাম সব চেয়ে বড় দান হল আনন্দদান। আমার কথায় যে ওরা হেসেছে এর চেয়ে বড় বিস্ময়কর যেন আর কিছু নেই। আমার একটি মাত্র কথায় যে চারটি হাসির ঝরনা ছুটে বেরোতে পারে তা দেখে সেদিন সত্যিই বড় অবাক লেগেছিল।
প্রথম মাসে আমি শুধু প্রতি রবিবারে আসতাম। ওদের সঙ্গে বসে খেতাম, গল্প করতাম, হাসতাম, হাসাতাম। দ্বিতীয় মাসে ওদের দাবি বাড়ল। তৃতীয় মাসে আমাকে মেস ছেড়ে দিয়ে ওদের দুখানা ঘরের একখানার বাসিন্দা হতে হল। শান্তির মা বললেন, ‘তুমি সব দিচ্ছ, ওদেরও কিছু দিতে দও। ওরা তোমাকে রেখে খাওয়াক, সেবা করুক, পরিচর্য করুক। তাহলে ওদের আর ভিখারির মতো নিতে হবে না। আমিও ভাবতে পারব — আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেই নিচ্ছি। তুমি আর আমাদের পর মনে কোরো না বাবা।’
এদিকে দুটো এস্টাব্লিশমেন্ট চালাতে গিয়ে আমি গলদগর্ম হয়ে উঠেছি। শুধু মাইনের টাকার কুলোর না। ব্যাঙ্কে যে সামান্য কিছু সঞ্চয় আছে তাতেও হাত পড়ে। আমি তাই শান্তিদের কথায় সম্মতি দিলাম।
মির্জাপুরের তিন তলায় একখানা ঘরে আমি একা থাকতাম। পূবের দক্ষিণের দুদিকের জানলাই খোলা ছিল। সেই তুলনায় বাদুড়বাগানের এই অপরিসর ছোট ঘর মোটেই বাসযোগ্য নয়। জানলা একটা আছে, তাও পশ্চিম দিকে। দিনের বেলায় ঘরখানা আধা অন্ধকার হয়ে থাকে।কিন্তু তা সত্ত্বেও সেদিনের সেই বাদুড়বাগান আমার কাছে পৃথিবীর সেরা ফুলবাগান হয়ে উঠল। চার বোনে কোমরে আঁচল জড়িয়ে ঘরখানা ঝেড়ে-পূছে পরিষ্কার করল। তক্তপোষ পাতল। বইয়ের র্যাকটি সাজিয়ে দিল। টিপয়ে রাখল একটা ফুলদানি।
সন্ধ্যার সময় সুইচ টিপে আলো জ্বালতে গিয়ে আমি একটা শক খেলাম। বিদ্যুতাঘাত। ছোট তিন বোন তো হেসেই অস্থির।
শান্তি হাসল না। একটু অপ্রতিভভাবে বলল, আপনাকে বলা হয়নি, সুইচটা খারাপ আছে।’ আমি পরদিনই মিস্ত্রি ডেকে সব ঠিক করে নিলাম। শুধু এ ঘরের নয়, ও ঘরেরও। বাড়িওয়ালার ভরসায় আর রইলাম না।
তারপর দুমাস যেতে না যেতেই কথা উঠল, আমি কে, আমার পরিচয় কী। পরিবারের বন্ধু কথাটা যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়। আমাদের সমাজ আত্মীয়তার বন্ধন ছাড়া আর কোনও বন্ধন মানে না।
শান্তির মা বলল, ‘বাবা, আমাকে সবাই ঠাট্টা করে। দোতলার ওরা তো দিনরাত ওই নিয়েই আছে।’
আমি সব বুঝতে পেরে বললাম, তাহলে আমি চলে যাই। মেসের সেই ঘরটা না পেলেও একটা সিট নিশ্চয়ই পাব।’
শান্তির মা বললনে, না, তা হয় না। তোমাকে আমরা ছাড়তে পারি না।’
আমি বললাম, ভাববেন না। দূরে গেলেও আমি আপনাদের কাছেই থাকব। যেটুকু করছি, সাধ্যমত তা করতে চেষ্টা করব।’
তিনি বললেন, তুমি আর কতদিন তা করবে। ভিখারির মতো আমরাই বা সারাজীবন তা কী করে নেব। যাতে অসঙ্কোচে নিতে পারি, যাতে কেউ আর কোনও কথা না বলতে পারে তুমি তার একটা উপায় করে দাও।’
এ উপায়ও আমাকেই করে দিতে হবে। আমি চুপ করে রইলাম। কিন্তু বুকের ভিতরটা আত চুপচাপ ছিল না। তা তোলপাড় করছিল।
আমি ভেবে দেখলাম শান্তির সঙ্গে আমার দূরত্বের ব্যবধান অনেক কমে গেছে, ও আমার বিছানার পাশে এসে বসে, হাসে গল্প করে। র্যাকের বাংলা বইগুলি টেনে টেনে নিয়ে পড়ে। আমার র্যাকে ওর পড়বার মতো বই বেশি ছিল না। ওর ফরমায়েশ মতো পাড়ার লাইব্রেরি থেকে আমি আপনাদের লেখা সব আধুনিক গল্প আর উপন্যাস জোগাড় করে এনে দিই।কিছু কিছু কিনেও আনি।
মাঝে মাঝে এমন কথা শান্তি বলে লঘুগুরুর ব্যবধান মানলে যা বলা যায় না ; এমন প্রসঙ্গ তোলে যা এতখানি বয়সের ব্যবধানে ওঠবার কথা নয়। এমনভাবে হাসে, এমনভাবে তাকায় যে আমার মনে হয় আপনাদের বর্ণিত পূর্বরাগের লক্ষণগুলির সঙ্গে একেবারে হুবহু মিলে যায়। অবশ্য আপনাদের বর্ণনার ওপরই শুধু আমি সেদিন নির্ভর করিনি। আমাদের নিজের যে বোধ-শক্তি আছে সেদিন সেও সেই কথা বলেছিল। সে বোধ ছিল বাসনারঞ্জিত।
তবু আমি বললাম, কিন্তু শান্তির মত—।’
শান্তির মা একটু হেসে বললেন, তার মত আগেই নিয়েছি। সেজন্য তুমি ভেবো না।’
অফিসে বেরোবার আগে শান্তির ফের দেখা পেলাম। অন্যদিনের মতো সেদিনও পানের খিলিটি হাতে দিতে এসেছে। আমি তাকে একা পেয়ে বললাম, ‘তোমার মার কথা শুনেছ? তোমার কী মত?’
শক্তি হেসে মুখ ফিরিয়ে নিল, ‘আমি কী জানি?
যদিও জানি মেয়েরা এসব কথা স্পষ্ট করে বলে না, ঠিক ওইরকমই ঘুরিযে বলে, ফিরিয়ে বলে, হাসিতে বলে, আভাসে বলে, তবু আমি ফের জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি সব ভেবে দেখেছ? তোমার মতটা শুনতে চাই।’
শান্তি তেমনি হেসে বলল, ‘আমি আবার কী ভাবব। এতক্ষণ মার কাছে থেকে শুনলেন তাতে বুঝি হল না?’
তাতেই হল। পাঁজিতে শুভদিন দেখে বিয়ে করে ফেললাম শান্তিকে। ঘটাপটা কিছুই করলাম না, ওদের তো এক পয়সাও ব্যয় করবার শক্তি নেই। যা করবার আমাকেই করতে হবে। ওদের আত্মীয়স্বজন বলতে তেমন কেউ ছিল না। তাদের কাউকেও নিমন্ত্রণ করতে দিলেন না আমার শাশুড়ি। তিনি বললেন, বিপদের দিনেই যখন কাউকে পেলাম না, এখন আমার কাউকে দরকার নেই।’
আমিও দু-একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া বিশেষ কাউকে বললাম না। তারা শান্তিকে দেখে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, সাবাস। তোমার সবুরে মেওয়া ফলেছে।’
তাড়াহুড়োতে আমি প্রথমে নতুন বাড়ি ঠিক কবতে পাবিনি। বাদুড়বাগানের ওই পুরনো বাসাতেই এক বছর ছিলাম। বাইরের দিক থেকে শান্তির বিশেষ কিছু বদলাল না। যা বাপের বাড়ি ছিল তা হঠাৎ স্বামীর ঘর হয়ে দাঁড়াল। শান্তির সিঁথিতে সিঁদুর উঠল, হাতে শাখা। শাড়িটা দামি হল, রঙটা প্রগাঢ়। কিছু গয়নাগাটিও করে দিলাম। অবশ্য একেবারে গা ভরে দিতে পারলাম না। ওর যে আরও তিন বোন আছে। তাদের গা যে একেবারে খালি। ওদেরও দুখানা একখানা করে গড়িয়ে দিলাম। তাতে আমার শাশুড়িরও আপত্তি, শ্যালিকাদেরও। সুধা বলল, বাঃ রে আমাদের কেন দিচ্ছেন। আমাদের তো আর বিয়ে করেননি।’
আমি বললাম, ভবিষ্যতে করতেও তো পারি। তা শুনে ওরা চাবজনেই খুব এক চোট হাসল।
তৃপ্তি বলল, যেটিকে বিয়ে করেছেন সেটিকে আগে সামলান। তারপর আমাদের দিকে চোখ দেবেন।’
আমি ওর বেণী ধরে কাছে টেনে এনে বললাম, তবে রে দু-নম্বর ফাউ—।’
ওদের প্রত্যেকেরই বাড়ন্ত গড়ন, ফুটন্ত যৌবন। বিয়ে ওদের একজনেরই হয়েছে। কিন্তু হাওয়া লেগেছে সবারই গায়ে, গায়ে হলুদের রঙ বসে গেছে সবার মনে। আমাদের মধ্যে যে ব্যবধান ছিল তা আমি তুলে দিলাম। এর জন্যে বেশি কিছু চেষ্টা করতে হল না। আমাদেব মধ্যে যে দাতা গ্রহীতার সম্পর্ক ছিল তা আগেই ঘুচে গেছে। শ্রদ্ধার ভয়ের কোনও দুস্তর ব্যবধানই আর নেই। বয়সের বোঝা নামিয়ে দিয়ে আমি ওদের সমস্তরে নেমে এসেছি। বড় সুখের এই অবতরণ।
মাইনের টাকাটা শাশুড়ির হাতে দিতে গেলে শাশুড়িও একটু রসিকতা করে বললেন, ‘এখন তো বাড়ির গিন্নি হল শান্তি। শান্তি হেসে বলে মা, তুমি যদি অমন কথায় কথায় খোঁচা দাও ভাল হবে না কিন্তু। বহুদিন পরে সংসারে যেন সুখের বান ডেকেছে৷
টাকা শান্তি নিজের কাছে রাখল না, হিসাবনিকাশ, সংসারের আর পাঁচটা ব্যবস্থা বন্দোবস্তের ভারও আমার শাশুড়ির হাতেই রইল। কিন্তু শান্তি মনে মনে জানল, সেই কত্রী। তার জন্যেই সব। যে ছিল দাতা শাস্তির জন্যেই আজ সে গ্রহীতা বনে গেছে। তার এই মনোভাব গোপন রইল না। চালচলনে ফুটে বেরোতে লাগল। নিজের যৌবন দিয়ে সে যে আর চারটি জীবনকে রক্ষা করেছে এ গর্ব তার যাবে কোথায়।
বাইরের দিক থেকে সংসারের আর কোনও পরিবর্তন হয়নি। শুধু বৃদ্ধ মতিলালের জায়গায় প্রৌঢ় অতুলচন্দ্র এসে বসেছে। কিন্তু ভিতরের যে পরিবর্তন হয়েছে তাকে প্রায় বৈপ্লবিক বলা চলে।
আমিও বদলাতে লাগলাম। এতদিন সমাজসেবা করেছি, তার সঙ্গে অর্থনীতির বিশেষ যোগ ছিল না। টাকাকড়ি যা হাতে আসত তা দীন দুর্গতদের জন্যে ব্যয় করতাম। স্কুল টিস্কুলও দুএকটা করেছি। কিন্তু এখন সব ছাড়িয়ে একটি পরিবারের জন্যে অর্থচিন্তাই আমার প্রবল হয়ে উঠল। এই অভিজ্ঞতা বিশেষ কোনও কাজে লাগল না। অফিসে যে মাইনে পাই তাতেও ওইটুকু স্বাচ্ছন্দ্য আনা সম্ভব নয়। তাতে বাদুড়বাগান থেকে নড়বার কথা ভাবতেও পারি না। অথচ নড়তেই হবে। শুধু শান্তির বোনদের জন্যেই নয়, ভবিষ্যতে ছেলেপূলেও তো হবে, তার জন্য তৈরি হওয়া চাই। বিয়ের পর বয়স আমি পাঁচজনের কাছে কমিয়ে বললেও তা তো আর সত্যি কমছে না। আর যৌবনে ধন উপার্জন করতে না পারলে যে হাল হয় তা তো আমি আমার শ্বশুরকে দেখে বুঝতে পেরেছি।
তাই আমি প্রথম দিকে গোটা দুই পার্ট টাইম কাজ নিলাম। তাতে রাত এগারোটা বারোটা হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে। চার বোনের কেউ ঘুমোয় না, কিন্তু সবাই ঝিমোয়। আমি রাগ করে বলি, ‘তোমরা খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লেই পারো৷’
শান্তি বলে, ‘বাজে বকো না। তাই কেউ পারে নাকি। আচ্ছা, দিন নেই, রাত নেই, ভূতের মতো এমন খাটছ কেন বলো তো?’
আমি গলা নামিয়ে বলি, ‘একটা পরীর জন্যে।’ আমার সেই নিচু গলার কথাও কী করে সুধাদের কানে যায়। সে ফস করে বলে বসে, তাই নাকি, অতুলদা? মাত্র একটা পরী? আপনার সঙ্গে তাহলে আমাদের কথা বন্ধ।
আমি তাড়াতাড়ি ভুল শুধরে নিয়ে বলি, শ্ৰীবিষ্ণু, শ্ৰীবিষ্ণু। একটি নয়—চারটি। উর্বশী, মেনকা, তিলোত্তমা, রম্ভা। আমার চারটি অঙ্গরী।’
আমি ওদের তিনজনকে পাড়ার স্কুলে ভর্তি করে দিলাম।
আমার শাশুড়ি বললেন, ‘স্কুলটিস্কুল আবার কেন। এখন দেখে শুনে বিয়ে থা দিয়ে দাও। একটি একটি করে পার করো। তোমার ঘাড়ের বোঝা নামুক।’
সুধাকে ডেকে বললাম, ‘তোমারও তাই ইচ্ছা নাকি?
সুধা হেসে বলল, ‘দোষ কী।’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, উহ,, আজকাল শুধু রূপসী হলেই হয় না। বিদুষী না হলে ভাল বর জোটা শক্ত।
আমার ইচ্ছা সত্যিই ওদের তিন বোনকে একটু দেখে শুনে বিয়ে দিই। ওরা পড়তে থাকুক। আর ইতিমধ্যে আমি তৈরি হই। পণ যৌতুকের টাকা জোগাড় করি।
শান্তি বলে, ‘নিজের শরীরের দিকে যে একেবারেই তাকাও না।’
আমি জবাব দিই, এতদিনে তাকাবার লোক পেয়েছি। নিজের দিকে তাকানো মানে নিজের আয়নার দিকে তাকানো। সে হল নিজের ছায়া। যখন নিজেকে ছেড়ে আর একজনের দিকে তাকাই তখনই ছায়ার বদলে কায়াকে পাই।’
শান্তি অত তত্ত্বকথা শুনতে চায় না। সে বসে বসে আমার পিঠের ঘামচি মারে,আর দু-একগাছি করে পাকাচুল তোলে।
একদিন বলল, আর তোলবার কিছু নেই। তুলতে গেলে কাচা ক’গাছিকেই তুলতে হয়। তার চেয়ে কলপ কিনে আনো।’
আমার বুকের মধ্যে কিসের একটা খোঁচা লাগে। একটু বাড়িয়ে বলছে শান্তি। আমার চুলগুলি পাকতে শুরু করলেও অত পাকেনি। অত বুড়ো হইনি আমি।
ওর চিত্তচাঞ্চল্যের কারণটা আমার অজানা নেই। দোতলার বাড়িওয়ালার মেয়ে মল্লিকা ওর সখী। তার সেদিন বিয়ে হয়ে গেল। বরের বয়স পঁচিশের নীচে। দেখতেও কার্তিকের মতো। গান বাজনাও জানে। কিন্তু কার্তিকের বদলে বুড়ো শিবকে তো শান্তি জেনে শুনেই বরণ করেছে। আমি চুলের জন্য কলপ কিনলাম না। ভাবলাম পারি যদি কীর্তির কলপ পরব।
তিনটে চাকরি করে আর পারি নে। তাতে খাটুনিই সার। সংসারের হাল যে কিছু ফিরেছে তা নয়। জীবিকা পাল্টাবার জন্যে আমি কিছুদিন আগে থেকেই চেষ্টা করছিলাম। সেই চেষ্টা এবার কাজে লাগল। আমার কয়েকজন জেলখাটা বন্ধু এখানে ওখানে বেগার খাটছিলেন। তাদের নিয়ে তাদের সাহায্যে শহরের বাইরে আমি ছোট একটা এগ্রিকালচারাল ফার্ম দাঁড় করালাম। পোলট্রি, ডেয়ারী আস্তে আস্তে সবই হল। ঘুরে ঘুরে শেয়ারও কম বিক্রি করলাম না। অফিস করলাম শহরেই। আর দোতলার চারখানা ঘর নিয়ে নিজেদের থাকবার ব্যবস্থা করে নিলাম। ঠিক চার বোনের জন্যে চারখানা ঘর দিতে পারলাম না। তবে ওদের শোবার বসবার পড়বার জায়গা আর বেড়াবার জন্যে ছাদের ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে গেল। ডেয়ারি ফার্ম খুলে বন্ধুবান্ধব এবং তাদের পুত্র ভ্রাতুষ্পপুত্ৰ ভাগ্নেদের দু-চারটে চাকরির ব্যবস্থাও আমরা করতে পারলাম। যারা একেবারে অনাত্মীয়, যোগ্যতা অনুযায়ী তারাও যে কাজকর্ম না পেলেন তা নয়। অনেক বেকার ছেলের বাপ-মায়ের আশীর্বাদ পেলাম। বহু পরিবার আমার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে রইল, যেমন একটি পবিবার হয়েছিল। কৃতিত্বটা আমার একার নয় তা আমি জানি। আমার বন্ধুদেরও যথেষ্ট অংশ আছে এতে। তবু তারা বলতে লাগলেন, ‘তোমার
জন্যেই এত বড় কাজটা আমাদের হয়েছে। নিজেকে কোনদিনই তেমন একটা কাজের লোক মনে করিনি। কিন্তু তারা বললেন, আমি না এগিয়ে এলে নাকি কিছু হত না। আমি জোর করে আমার সেই বন্ধুদের টেনে না তুললে তারা আমরণ অবসর শয্যাতেই পড়ে থাকতেন। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের ডেয়ারির কাজ ভালই চলতে লাগল। মুনাফাও মন্দ হল না।
গল্পের মতো শোনাচ্ছে না? আপনারা গল্পকাররাও সত্য ঘটনাকে ভয় করেন। কারণ সত্য হল গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর। কিন্তু সেই বিস্ময়কে আস্তে আস্তে সইয়ে আনাই তো আপনাদের কাজ। আপনার কাজ আপনিই করবেন। আমাব সে শক্তি নেই, সময়ও নেই।
সবাই বলতে শুরু করল তিন চার বছরের মধ্যে আমি অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়েছি। তা নাকি প্রায়ই আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো।
আমি স্ত্রীকে ডেকে হেসে বললাম, ‘সে প্রদীপ কোথায় জ্বলছে জানো? শান্তি মুখ ঘুরিয়ে বলল, হয়েছে। ওর মুখে যে জবাবটি প্রত্যাশা করেছিলাম তা পেলাম না। ওর মুখে প্রদীপের যে আলোটি নতুন শিখায় জ্বলে উঠবে ভেবেছিলাম তা জ্বলতে দেখলাম না।
কিন্তু তা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাববার কি হা-হুতাশ করবার আমার সময় ছিল না। তার একটু আগে প্রণব দত্ত অফিসের একটা জরুরি কাজ নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। বড় একটা কনট্রাক্ট হাতে প্রায় এসে পড়েছে। তাতে হাজার খানেক টাকা আসবে। আমি অফিস আর ফার্মের ব্যাপার নিয়েই তার সঙ্গে আলাপ করতে লাগলাম। স্ত্রীকে একটু দেখাতে চাই যে তার খুশি হওয়াটাই আমার একমাত্ৰ কাম্য নয়। পুরুষের আরও অনেক কাজ আছে, কীর্তির আলাদা ক্ষেত্র আছে। প্রণব দত্ত অফিসের সেক্রেটারি আর আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি,ইকনমিকসের এম.এ.। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ। স্বাস্থ্যবান সুদৰ্শন ছেলে। বুদ্ধিশুদ্ধি বেশ রাখে। আমি ওকে সুধার জন্য মনোনীত করে রেখেছি। আমার শাশুড়িরও তাই পছন্দ। তাই আমার সামান্য ইশারায় শুধু বাড়ির দোরগুলি নয়, জানলাগুলিও ওর জন্য খুলে গেছে। বাড়ির সব জায়গায় সবার কাছেই অবারিত। ওর ভূমিকাও অনেক। ও তিন বোনের কলেজের পড়াও দেখিয়ে দেয়। চার বোনেরই চিত্তবিনোদন করে। কখনও সিনেমায় নিয়ে যায়, কখনও লেকে, কখনও বোটানিক্যাল গার্ডেনে। শ্যালিকারা আর তার দিদি সবাই ওর সান্নিধ্যে সুখী। আমি মাঝেমাঝে যে তাতে একটু চমকে না উঠি, খোঁচা না খাই তা নয়। কিন্তু গৃহলক্ষ্মীকে আমি সব সময় চোখে চোখে রাখব তার সময় কই। এতদিনে বাণিজ্যলক্ষ্মীর সঙ্গেও আমার শুভদৃষ্টি হয়েছে। সে দৃষ্টির মাদকতা তো কম নয়।
সারা দিনরাত আমি ব্যস্ত থাকি। অনেক রাত্রে ফিরে এসে শান্তিকে ঠিক আগের মতো আর পাইনে। কখনও শুনি সে সিনেমা থেকে এখনও ফেরেনি। কখনও শুনি বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গেছে। তার এত বন্ধু আছে নাকি? অসম্ভব নয়। অবস্থা ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে।
যেদিন বাড়িতে থাকে সেদিনও মিলনটা নিষ্কণ্টক হয় না। কথায় কথায় কেন যে খিটিমিটি লেগে যায় বুঝে উঠতে পারিনে। বুঝতে পারিনে কার দোষ বেশি। নানা কারণে আমাব মেজাজও ভাল থাকে না। ব্যবসা চালাবার ঝামেলা অনেক। নানা রকম লোককে নিয়ে কারবার।
তাই মাঝে মাঝে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে যায, ‘তোমার কী। তুমি তো সেজেগুজে পটের বিবিটি হয়ে বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছ। একখানা হেলিকপ্টার কিনে দিলে উড়েও বেড়াতে পারো।
শান্তি বলে, ‘দেখো, দিতে হয় দাও, না দিতে হয় না দাও। আমি দিনরাত অত খোটা আর সইতে পারব না।’
ঝগড়া লাগে। প্রায় প্রতিরাত্রে ঝগড়া লাগে। কারণে অকারণে সামান্য কারণে। খিটিমিটি বাঁধে। কেন এমন হয় আমি ঠিক বুঝতে পারিনে।
ঝগড়াঝাটির পর ও যখন পাশ ফিরে ঘুমোয় আমি ওকে চেয়ে চেয়ে দেখি। আমার শান্তি, আমার সেই শান্তি ওর জন্যেই তো সব। ওর জন্যেই তো আমার এত বিভব প্রতিপত্তি, আমার এই নবযৌবন লাভ। যে যৌবনকে আমি শুধু ঘরের কাজে লাগাইনি, যে যৌবনকে দিয়ে আমি একটা প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলেছি, আরও দশজনের অন্নের সংস্থান করেছি। আমার আসল শক্তি যে কোথায়—তা তো আমি জানি, আমার আসল অন্নপূর্ণ যে কে তা তো আমার অজানা নেই,তবু কেন ওকে পাইনে। ওর জন্যে এত পেলাম, কিন্তু ওকে পেলাম না কেন।
একদিন আমি জোর করে ওর ঘুম ভাঙালাম, মান ভাঙালাম। জড়িয়ে ধরলাম বুকের মধ্যে। ও হঠাৎ বলে বসল, ছাড়ো ছাড়ো। আমার এক ডেন্টিস্ট বন্ধুর পরামর্শে সব দাঁত ফেলে দিয়ে দু-পাটি দাঁতই বাঁধিয়ে নিয়েছিলাম। দামি সেট। আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম। শান্তি বলল, তাছাড়া তোমার মুখে কিসের একটা গন্ধ। দাঁতগুলি পরে শুলেই পারো ‘
বললাম, আমি নতুন করে নেশাভাঙও করি নে, কিছুই করি নে। যা ছিলাম তাই আছি। যখন খেতে পেতে না তখন কিন্তু আর গন্ধটন্ধ কিছু ছিল না।’
শান্তি বলল, ‘ফের সেই খোটা?’ –
আমি বললাম, কেনইবা নয়? তুমি কি ভাব আমি কিছু বুঝতে পারি নে? আমি কিছুই টের পাই নে? আমার গায়ের বাতাসটুকু পর্যন্ত তোমার আর এখন পছন্দ হয় না। এমন অকৃতজ্ঞ নেমকহারাম আমি আর দুটি দেখিনি। একবার ভেবে দেখো তখন যদি না দেখতাম, কোথায় ভেসে যেতে।’
শান্তি বলল, ‘সেই ভেসে যাওয়াই ভাল ছিল। এর চেয়ে মরণ ভাল আমার।’
এমনি চলল রাতের পর রাত। মাঝে মাঝে থামে। তখন একেবারে কথা বন্ধ।
কিন্তু সেই অসহযোগও তো আমার কাম্য নয়।
কী যে আমি ওর কাছে চাই, আর কী যে পাই নে তা বুঝিযে বল শক্ত। সব সময়েই যে ঝগড়াঝাটি চলে তা নয়। শান্তি কোনও কোনদিন আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। হাসেও, কথাও বলে। কিন্তু আমার যেন মনে হয় আগে যা ছিল, আসলে এখন তার অভিনয় চলে। বাইরের দিক থেকে সম্পর্কটা ঠিকই আছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আবার যে পরিবর্তনটা ঘটেছে তার নামও বিপ্লব।
তারপর যা ঘটবার তা ঘটল। শান্তি মৃত্যু কামনা করলেও মরল না। মৃত্যুর ওপর দিয়ে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল প্রণবকে।
এই আশ্চর্যকাণ্ড কী করে ঘটল আমি তার বিস্তৃত বিবরণ দেব না। সেটা আমর পক্ষে রুচিকরও নয়, সুখকরও নয়। ওসব ব্যাপাব আপনি নিজেই অনুমান করে নিতে পারেন। ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে ফাঁকে ফাঁকে তিনটি নরনারীর মনোবিশ্লেষণ দিয়ে আপনি শ’ দেড়েক দুই পাতা দিব্যি পারবেন ভরে ফেলতে। বউ-পালানোর গল্প তো আপনি আর কম লেখেননি। পড়েছেন আরও বেশি। দেশে বিদেশে ও কাহিনীর তো আর অভাব নেই। কিন্তু দেখেছেন কখনও? আমিও পড়েছি, শুনেছি কিন্তু দেখিনি। স্ত্রী কারও সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পর স্বামীর দশা যে কী রকম হয় কোনদিন তা চক্ষুষ দেখা ছিল না। এবার দেখলাম।
স্বামী পালিয়ে গেলে কি সন্ন্যাসী হয়ে গেলে তার স্ত্রীর ওপর সহানুভূতি দেখাবার লোক পাওয়া যায়। কিন্তু পলাতকার স্বামীকেও পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয। বন্ধুদের কাছ থেকে আয়ীয়স্বজনের কাছ থেকে নিজের অধস্তন কর্মচারীদের কাছ থেকেও পালাতে হয়। তার আর মুখ দেখবার জো থাকেনা। কারও সহানুভূতি পর্যন্ত অসহ্য হয়। কারণ বন্ধুদের সমবেদনার তলায় যে চাপা বিদ্রূপ আর পরিহাস লুকিয়ে আছে তা কি আর তার টের পেতে বাকি থাকে। কুলের কালি দেখা যায় না, কিন্তু স্বামীর মুখের কালি সকলের চোখে পড়ে।
প্রথমে ভাবলাম সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কোথাও চলে যাই। না দাদা বউদির কাছে নয়, এ মুখ নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াতে পারব না। অন্য কোথাও গিযে কিছুদিন পালিয়ে থাকতে হবে।
কিন্তু বেরোবার জো রইল না।
আমার শাশুড়ি এসে আমাব সামনে কেঁদে পড়লেন, ‘বাবা, তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে পারবে না।’ তার সেই কান্নায় গলবার মতো মনের অবস্থা আমার নয়, তবু বিরক্তি চেপে শান্তভাবেই বললাম, আমি তো আর একেবারে চলে যাচ্ছি নে।’
তিনি বললেন, ‘না, বাবা তোমার কোথাও যাওয়া হবে না। এই অবস্থায় আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি না। যে মুখপুড়ি গেছে সে তার কপাল নিয়ে গেছে। তার সব পুড়ুক, সব ছারখার হয়ে যাক। তার কুষ্ঠ হোক, মহারোগ হোক তার। কিন্তু তোমার মনের যা গতিক ও’তে তোমাকে তো ছাডতে পারি না। তোমার জীবনের যে অনেক দাম।’
তার চোখের জল আমার কাছে নির্মল বলে মনে হল। মাতৃস্নেহেব স্বাদ পেলাম তার কথায়, ব্যবহারে। সেই মুহুর্তে ওইটুকু আশ্রয়ই বা আমার আধ কোথায় জুটত?
শুধু তিনিই নন, সুধারা তিন বোনে এসে আমাকে ঘিরে ধরল।
সুধা বলল, অতুলদা, আপনি যেতে পারবেন না। একজনের অকৃতজ্ঞতা, একজনের পাপের শাস্তি আপনি আমাদের সবার উপর চাপিয়ে দেবেন কেন?
ওরা তিনজন এখন কলেজে পড়ে। এখনও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হযনি। ওরা আমাকে শুধু সেই ভয়ই ধবে রাখতে চায়? সেই ভয়ে?
কিন্তু ওদেব দিদির কাছ থেকে অত বড় ঘা খেয়েও আমি ওদের অতখানি অবিশ্বাস করতে পারি না। আর তা না করে তৃপ্তিই পেলাম। সত্যিই তো এতদিন যে ওদের কাছ থেকেও তো কম শ্রদ্ধা প্রীতি পাইনি, কম সেবাশুশ্রুষা নিইনি।
আমি কোথাও গেলাম না। শুধু অফিস আর বাড়ি আলাদা করে দিলাম। নতুন একটা ফ্ল্যাটে এনে তুললাম ওদের।
অবিশ্বাসিনী স্ত্রীর মা আর বোনেরা আমার অন্নাশ্রিত হয়ে রইল। আমি থাকতে চাইলাম তাদের হৃদয়ের আশ্রয়ে।
আশ্চর্য শক্তির মুখের আদল ওদের সব কটির মুখে। একই রকমের গলা, একই রকমের উচ্চারণের ভঙ্গি। হাটন চলার ধরনও একই রকম। সেই একজনের প্রতিচ্ছায়া আমি ওদের প্রত্যেকের মধ্যে দেখতে পেলাম, যে আমাকে সব দিয়েছিল, আবার সবই কেড়ে নিয়েছে।
বন্ধুবান্ধব কেউ এসে শান্তির কথা জিজ্ঞাসা করলে তার মা আর বোনেরা সবাই বলে দেয় সে মরে গেছে। হঠাৎ হার্টফেল করে মরে গেছে। হৃদয়ের পরীক্ষায় সে ফেল করেছে না পাশ, করেছে কে জানে? বোধ হয় পাশই করেছে। ফেল করবার দুর্ভাগ্য একা আমার।
ওরা বলে সে মরে গেছে। কিন্তু স্মৃতি কি এত সহজে মরে জ্বালা কি অত অল্পে জুড়োয়?
আমার দগ্ধ ঘায়ে প্রলেপ দেওয়ার জন্যে ওদের কিন্তু চেষ্টার ক্রটি নেই।
ইলেকট্রিক ফ্যান আছে তালপাখার হাওয়ার আর দরকার হয় না। রাঁধুনী আছে, হাত পুড়িযে কাউকে রাঁধতে হয় না। কিন্তু খাওয়ার কাছে আমার শাশুড়ি এসে রোজ বসেন। শ্যালিকারা আমার ঘর আর টেবিল গুছিয়ে দেয়, ফুলদানি ফুলে ভরে রাখে। সন্ধ্যায় ফিরে এলে কাছে বসে গল্প করে।
সবাই আছে শুধু একজন নেই। সে মরে যায়নি, সরে গেছে।
দিদির নাম ওরা কেউ মুখে আনে না। সুধার রাগ সবচেয়ে বেশি। কারণ শান্তি তো শুধু আমাকে ঠকিয়ে যায়নি, ওকেও বঞ্চিত করে গেছে।
বছর ঘুরে এল। আমার শাশুড়ি সেদিন রাত্রে আমার ঘরে এসে বসলেন। আমার স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞাসা করলেন, কারবারের কথা জানতে চাইলেন।আরও কিছুক্ষণ ভূমিকার পর বললেন, ওদের তো একটি একটি করে এবার পার করা দরকার।’
আমি বললাম, আমারও তাই ইচ্ছা। সুধা বলে এম. এ. পাশ না করে ও বিয়ে করবে না। বোনদের কাছে বলেছে কোনদিনই করবে না। চিরকুমারী থেকে দিদির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে। সঙ্গে সঙ্গে তৃপ্তি আর দীপ্তিও নাকি সেই পণ করেছে। যত সব ছেলেমানুষি।
শাশুড়ি বললেন, ‘ছেলেমানুষি ছাড়া কী। কিন্তু এরই মধ্যে অনেকে অনেক কথা বলতে শুরু করেছে। এভাবে থাকলে ওদের তিনজনের নামেই বদনাম রটবে। কারোরই বিয়ে হবে না। তার চেয়ে তুমি বরং সুধাকে—।’
আমি ধমক দিয়ে বললাম, ছিঃ কী বলছেন আপনি। শাশুড়ি তখনকার মতো চুপ করে গেলেন।
শুয়ে শুয়ে অন্ধকারে আমি নিজের মনেই হাসলাম।
মৃতা স্ত্রীর বোনকে বিয়ে করার রেওয়াজ আছে।কিন্তু যে স্ত্রী ঘর ছেড়ে গেছে তার বোনকে নিয়ে ফের ঘর বাঁধবার সাধ থাকলেও সাহস আছে কার। একই দুর্বার রক্তের ধারা তো তারও শিরায়।
পরদিন সুধা কলেজে বেরোচ্ছিল, আমি ওকে ডেকে হেসে বললাম, আর শুনেছ নাকি তোমাব মায়ের কথা। তিনি তোমাকে তোমার দিদির আসন পাকাপাকিভাবে দখল করতে বলেছেন। তার আর ফিরে আসার লক্ষণ নেই।’
আমি কথাটা হেসেই বলেছিলাম। স্ত্রীর বোনের সঙ্গে এসব রসিকতা কে না করে? আগেও তো কত করেছি। সুধা কিন্তু হাসল না। সে যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। মুখখানা একেবারে শ্বেতপাথরের মূর্তির মুখ।
সুধা বলল, আপনি তাও পারেন।’
তারপর মুখ ফিরিয়ে জুতোর শব্দ তুলে চলে গেল।
কেন জানি না, আমার হাত দুটি আপনিই মুষ্টিবদ্ধ হল। বাঁধানো দুপাটি দাঁত আক্রমণ করল পবম্পরকে। আমি নিজের মনেই বললাম, ‘পারি বৈকি, আমি সব পারি। অবাধ্য একগুঁয়ে মেয়ে, ইচ্ছা করলে আমি না পারি কী? যে ঘা আমি খেযেছি তার চতুর্গুণ কি আমি ফিরিয়ে দিতে পারি না? কিন্তু খানিকক্ষণ বাদেই আমার কাণ্ডজ্ঞান ফিরে এল। ধিক্কার দিলাম নিজেকেই, ছিছিছি। গাডিতে করে ডেয়ারির কাজ দেখতে চলে গেলাম।
ফিরে এলাম অনেক রাত্রে। দেখি সুধা তখনও জেগে আছে। আমার জন্যেই নাকি জেগে আছে। আমা্র সঙ্গে গোপন কথা বলবে বলে।
সেই রাত্রে আমার ঘরে একা চলে এল সুধা। গম্ভীর। শান্ত মুখ।
মৃদুস্বরে বলল, অতুলদা, আপনি কি রাগ করেছেন?
আমি বললাম, না রাগ করব কেন।’
সুধা বলল, ‘আমি বড়ই দুর্ব্যবহার করেছি। দিদি যা করে গেছে সে অন্যায় তো কিছুতেই মুছবে না। এরপর আমরাও যদি—। ছিছিছি। আমাকে মাপ করুন, অতুলদা।
সুধা আমার পায়ের কাছে বসে পড়ল।
আমি বললাম, মাপ করবার কী আছে। তুমি তো কোনও দোষ করেনি, শুধু বুঝতে ভুল করেছ। আমি তোমাকে ঠাট্টা করেছিলাম, সুধা। সেটুকু করবার অধিকারও কি আমাব নেই?
বলে আমি ওর হাত ভুলে ধরতে গেলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে সে তার হাতখানাকে সরিয়ে নিল। যে সুধাকে আমি বেণী ধরে টেনেছি, গাল টিপে দিয়েছি, আজ সে আমার সামান্য স্নেহম্পর্শটুকু সহ্য করতে পারে না,আমি আজ এতই অস্পৃশ্য। এত বড় স্পর্ধা, এত দুঃসাহস ওর। আমি যদি ওকে এই মূহুর্তে বুকে তুলে নিই, ও কী করতে পারে।
কিন্তু আমি কিছুই করলাম না। শুধু এক মূহুর্ত সময় নিয়ে বললাম, আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম।’
সুধা বলল, কিন্তু মা যা বলেছেন, তাই হয়তো ঠিক। আপনি যদি তাই চান, আমার—আমার কোনও আপত্তি নেই।’
বলে মুখ নিচু করল সুধা। জানি না হাসল কি না। আমি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বললাম, ‘‘আমি কাউকে চাই না, তোমাদের কাউকে চাই না। চলে যাও এ ঘর থেকে।’
সুইচ অফ করে দিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। সুধার ব্যবহারের কথা ভেবে নিজের মনেই হাসলাম। আমাকে কী ভেবেছে ওরা?
আমি কি বক রাক্ষস যে ওরা একটির পর একটি পালা করে আত্মদান করবে? একবার তো এক ভীমের হাতে নিহত হয়েছি, আর কতবার নিহত হব?
তারপর দিন আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। আমাদের চালচলন কথাবার্তা শান্ত সংযত ঠিক আগের মতো।
ইতিমধ্যে আমি আরও কয়েকবার চলে যেতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘তোমরা তো আর নাৰালিকা নও। নিজেরাই বেশ থাকতে পারবে। আমি আলাদা জায়গায গিয়ে থাকি। খরচপত্রের জন্যে ভেবো না। তা যেমন আসছে তেমনি আসবে।’
সুধা বলল অতুলদা, আপনি একথা মুখে আনছেন কী করে আপনার চেয়ে আপনার টাকাটাই কি বড়। আপনি নিশ্চয়ই সেদিনের রাগ ভুলতে পারেননি।’
ওর চোখ দুটি ছলছল করে উঠেছিল।
ও-চোখ আমি আগেও দেখেছি। সেই জল। তারপর প্রচণ্ড জ্বালা।
সুধা এম.এ. পাশ করেছে। কিন্তু বিয়ে করেনি।
তৃপ্তি দীপ্তিও ইউনিভার্সিটিতে ঢুকল। সব খরচ আমিই চালাচ্ছি। তার বদলে ওদের সেবাশুশ্রুষা আর কৃতজ্ঞতাও পাচ্ছি।
সুধার মা তার সেই প্রস্তাব তুলে নেননি। সুধাও আরও দু-একবার বলেছে তার কোনও আপত্তি নেই।
আমি যদি চাই তা হলে পাই।
কিন্তু সে পাওয়ার মানে যে কী তা কি আমি আর জানি নে? আমি আর চাইব কোন ভরসায়? মুখেও বলি, নিজের মনেও বলি, চাই নে চাই নে চাই নে। এই জীবনের কাছ থেকে আমি আর কিছু চাই নে— আমার চাইতে নেই।
আমি দিনরাত কাজকর্মে ডুবে থাকি। বিশেষ করে শহরের বাইরেই আমার বেশি সময় কাটে। আমি সেখানেই শান্তি পাই। সেই কাঁচা ঘাস, সাদা দুধ আর সবুজ গাছপালার মাঝে। আমি মাঝে মাঝে দুচোখ মেলে দিয়ে বসে থাকি।
কিন্তু সেই চোখই যদি একমাত্র চোখ হত, তাহলে আর কোনও দুঃখ ছিল না। ওরা তিনজন সুধা তৃপ্তি দীপ্তিরাও কেউ থেমে নেই। তিন সমান্তরাল রেখায় তিনটি জীবনধারা ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে আমি সেদিকেও তাকাই। একজনের চলে যাওযার লজ্জাকে ওরা ভুলেছে, দুঃখকে মনে করে রাখেনি। নিজেদের কৃতিত্ব দিয়ে গৌরব আর গর্ব দিয়ে ওরাও যার যার নিজের স্বতন্ত্র পৃথিবীকে গড়ে নিচ্ছে। দিনের পর দিন ওদের গুণগ্রাহী বন্ধুদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। আমি এক একদিন চেয়ে চেয়ে দেখি। তারা আসে, যায়, হাসে, ঠাট্টা-তামাসা করে। কিন্তু আমি হঠাৎ ওদের মধ্যে গিয়ে পড়লেই ওরা যেন কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। সুর কেটে যায়, তাল ভঙ্গ হয়। আমি কি এতই অপয়া। আমাকে দেখলেই কি ওদের সব কথা মনে পড়ে? সব ব্যথা নতুন হয়? বন্ধুদের ফেলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে।
সুধা বলে, অতুলদা, আপনি কদিন ধরে বড় কাশছেন। একটা ওষুধ-টষুধ খান।
আমি বলি, ভয় পেয়ে না। সামান্য কাশি। টি বি, নয়।
সঙ্গে সঙ্গে সুধার হাসিমুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে য়ায়। আমি নিজেও বড় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি।
তৃপ্তি বলে, আপনার খাবারটা এখন এনে দিই, অতুলদা।
আমি ব্যস্ত হয়ে বলি, ‘না, না, এখন থাক।’
দীপ্তি বলে, অন্তত এক কাপ দুধ খেয়ে যান।
আমি বলি, ‘তোমরা খাও। গোয়ালা কি আর দুধ খায়?
ওরা স্তব্ধ হয়ে চুপ করে দাড়িয়ে থাকে। তিনটি তরুণীর মূর্তি। শ্বেত পাথর দিয়ে গড়া। তিনটি চঞ্চল ঝরনা হঠাৎ যেন এক প্রচণ্ড শাপে বরফের স্তুপ হয়ে গেছে।
আমি তো তা চাইনি। আমি চাই নে ওরা আমার চোখের দিকে চেয়ে ভয় পাক, আমি চাই নে আমার মুখের কথায় ওদের মুখের হাসি শুকিয়ে যাক।
আমি ওদের কাছে দুর্ভাগ্য আর দুঃস্বপ্নের প্রতীক হয়ে থাকতে চাই নে।
তবু ওরা আমার চোখে কী দেখে ওরাই জানে।