সময় এগিয়ে নিয়ে চলে সভ্যতাকে। সভ্য মানুষের পিছুটান তবু রয়ে যায় তার স্মৃতির পাতায়, ইতিহাস আর পুরাণ কথায়।
কোপেনহেগেন শহরের বুকে তাই নতুন করে সগৌরবে বিরাজ করেন পৌরাণিক দেবী জেফিয়ন। বিখ্যাত কার্লসবাগ বীয়ার কোম্পানি তার পঞ্চাশ বছরের পূর্তিতে জেফিয়নের মূর্তিকে শহরের বুকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার প্রাচীন নর্স পুরাণে শক্তির প্রতিমূর্তি। কৃষি এবং উর্বরতার প্রতীক। চারটি ষাঁড়কে একত্রে যুতে তিনি জমিতে লাঙল চালান। এই শক্তিময়ী দেবীকে ঘিরে অসংখ্য কল্পকাহিনী -কবিতা। তিনিই এখন শহরের অন্যতম পর্যটনপার্কের অধিষ্ঠাত্রী। স্পেনের ছেলে অরল্যান্ডো সেই দেবীর দয়ায় সেখানে আইসক্রীম বিক্রি করে দুটো পয়সা রোজগার করে।
তার কাছে আইসক্রিম খেয়ে বিদায় নিয়ে আমরা জাহাজে চড়ি। এবার আমাদের ভাসার পালা বাল্টিক সাগরের জলে। জাহাজের ডেকে সমুদ্রবিলাসী ভাইকিংদের মত দুরন্ত উত্তাল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যেতে যেতে আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি ছোটো ছোটো দ্বীপ।
মনে পড়ছে শীর্ষেন্দু সেনের একটি কবিতা, —
“আমার পায়ের পাতায় বাল্টিক সাগরের জল পৃথিবীর মানচিত্র ধুয়ে দেয়।
ধোয়া মানচিত্রে আমি তেরঙা দেশ খুঁজি। ভাইকিংদের গভীর জলে আমি কাগজের নৌকা ভাসাই।
বাল্টিক সাগরের পাশে আমাকে হারানোর দেশ খুঁজি।
বাল্টিক সাগরের পাশে আমি আমার দেশ খুঁজি।”
সাগরের বুকের মাঝে কোনো কোনো দ্বীপ যেন এক একটি সবুজ পান্না। গাছ পশুপাখি ছাড়া সেখানে মানুষের পা পড়েনা। নীল জলঘেরা কোনো কোনো স্থল ভূমিতে গড়ে উঠেছে বয়স্ক দম্পতিদের অবসর জীবনের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। মোটা টাকার ট্যাক্সের বিনিময়ে তারা সুখ কিনেছে। সরকার তাদের স্বাচ্ছন্দ্য-আরাম-চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁদের বাঁচার কোনো প্রয়োজন নেই।
অজানা দেশের এইসব নতুন তথ্যে ভরে উঠছে অভিজ্ঞতার ঝুলি। নিশীথ সূর্যের দেশের আলো নিয়ে আমরা যখন জাহাজের কেবিনে ঘুমোতে গেলাম, ঘড়িতে তখন দেখাচ্ছে মাঝ রাত। ভারতীয় সময় থেকে প্রায় সাড়ে তিনঘন্টা পেছিয়ে আছে।
জল কেটে এগিয়ে যেতে যেতে পরের দিন অপেক্ষা করছিল নতুন এক দেশ নরওয়ে। উত্তর ইউরোপের এই দ্বীপময় দেশটি আমাদের ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ করেছে। উজ্জ্বল নীল আকাশ, বনের সবুজ, রঙিন ফুল, দিগন্তবিস্তৃত চারণভুমি, বার্লি-ওট-গমের ক্ষেতে সাজানো নরওয়ের কান্ট্রি সাইডের ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবু মন বলছিল আরো দেখি।
রাজধানী অসলোতে মধ্যযুগের এ্যকেরশাস চার্চে গিয়ে শোনা গেল হিটলারের নাৎসি বাহিনীর এই চার্চকে কব্জা করে নেওয়ার গল্প। মিউজিয়ামে সাজানো আছে ভাইকিং জাহাজের হাওয়া মোরগ, অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাসন-কোসন। এসব তাদের দুর্জয় সাহসের পরিচয়। অসলোর প্রাণ কেন্দ্রে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেবার বিশাল প্রাসাদ। মনে পড়ল মাদার টেরিজার কথা গাইডের সঙ্গে অসলো শহরকে চিনতে চিনতে আমরা শুনেছি নরওয়ের সিংহভাগ অধিকার করে রয়েছে জলভূমি। স্থলভাগের তুলনায় তা প্রায় ছ’গুণ বেশি। এই সুন্দর দেশটি পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার। সামুদ্রিক খাবার দাবার থেকেও এদের প্রচুর অর্থ উপার্জন। সমুদ্রের দুরন্ত স্রোতকেও এরা কব্জা করে ইলেক্ট্রিসিটি তৈরি করে ব্যবহার করছে প্রচুর পরিমাণে।
অসলোর রাস্তায় ব্যাটারি চালিত সেগওয়ের ছড়াছড়ি। ছিপছিপে মানুষ দু-চাকার এই বাহনে দাঁড়িয়ে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে অন্যত্র।
সাম্প্রতিক এক সিনেমায় নরওয়ে সরকারকে নির্দয় বলে মনে হলেও সে দেশে শান্তি বিরাজমান। পুলিশরা তাই নিরস্ত্র। তাদের লাঠিসোঁটা, বন্দুক নেবার প্রয়োজন পড়ে না। অপরাধের সংখ্যা নেহাতই সেখানে কম।
সোনালী রোদে তাই নির্ভয়ে সবাই ছুটির মেজাজে। ছোটোদের স্কুলের দরজায় তালা। গাড়ির মাথায় স্কি করার সাজ সরঞ্জামের সুন্দর বাক্স নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়েছে মানুষ। স্কি করা এদের অন্যতম শখ।
ভাইকিংদের রক্ত রয়ে গেছে এদের শরীরে তাই নরওয়ের সংস্কৃতিতে ছোটো থেকেই শরীর গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। ফুটবল, স্কি, আইস হকি, স্কেটিং এদের প্রিয় খেলাধুলো।
আমরা অবাক হয়ে দেখেছি কারো কারো গাড়ির পেছনে বাঁধা রয়েছে নৌকা। ছুটির দিনে নদীতে, খালবিলে, সমুদ্রে সপরিবারে এরা নৌকা ভাসায়। মাছ ধরে। হয়তো বা গান গায়,
“ভেসে যায় আদরের নৌকা
ভেসে যায় সোহাগের সাম্পান
সিগারেট টুকরোরা মুখচোরা,
শিখছে স্নান
নুড়ি ঘেরা বালির স্তুপ
জোনাকিরূপ বুকে নিয়ে চুপ।”
এই চুপকথার গল্প রয়েছে অসলোর স্কাল্পচার পার্কে। প্রায় নতুন এই পার্কটিতে বিশাল আকারের অসাধারণ সব ভাস্কর্য। ব্রোঞ্জ, গ্রানাইট, কাস্ট আয়রনে তৈরি মূর্তিতে মানব জীবনের জন্ম থেকে মৃত্যুর সব ভঙ্গিমা। সেই পার্কে পিয়ানো অ্যাকোর্ডিয়ান বাজিয়ে ভিক্ষে করে এক প্রৌঢ়। কেন জানি না হঠাৎ আমার নিজের দেশের ইলোরা, কোণার্ক, মহাবলীপুরম, খাজুরাহো, হাম্পির কথা ভেবে ভারি মন খারাপ হয়। কি অবিস্মরণীয় ঐতিহ্যের অধিকারী হয়েও আমরা তার কতটুকু মর্যাদা রাখতে পারি! অথচ এদের সবটুকুই সৌন্দর্য আর পরিচ্ছন্নতার মোড়কে সাজানো।
তবে নরওয়ের অসাধারণ প্রকৃতি সব মনখারাপ কাটানোর ওষুধ!
রেল যাত্রার ফাঁকে ফাঁকে দেখি বরফগলা ঝর্না নদী হয়ে বইছে। জল জমে হ্রদ তৈরি হয়েছে।পাহাড়, রঙিন বাড়ি, ফুলের বাগান নিয়ে এক একটি দৃশ্য যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি।
একটি জলপ্রপাতের সামনে হঠাৎ আমাদের ট্রেন থেমে গেল। দৌড়ে দৌড়ে নেমে সেখানে দেখলাম জলস্রোতের ছন্দে পাহাড়ে-জঙ্গলে ধ্বনিত হচ্ছে লোকসঙ্গীত। দূরে লালজামাপরা একটি মেয়ে কোন আড়াল থেকে বনদেবীর মত নাচতে নাচতে খানিক সামনে এল। আবার বনের মধ্যে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম।
রেলের পথ ছেড়ে আবার জলপথ। হিমবাহ গলা জল পাহাড়ের খাত কেটে তৈরি করেছে ফিয়র্জড্। গ্রীষ্মে সেই বরফগলা জলে জাহাজ চলে। প্রায় সারা পৃথিবীর লোক এই অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যের আনন্দ নেয়। পাহাড়ের ধাপে ছোটো ছোটো গ্রাম। চীজ তৈরির খ্যাতিতে একটি গ্রামের নাম ‘চীজ ভিলেজ’। আমরা শুনতে পাচ্ছি হাজার বছরের পুরনো চ্যাপেলে ঘন্টা বাজছে। চার্চের লাগোয়া সমাধিস্থলের এক একটি কবরে কারা যেন সদ্য ফোটা ফুল সাজিয়ে রেখেছে। সব মিলিয়ে মনের মধ্যে এক রঙিন ছবির অ্যালবাম হয়ে রয়ে যায় এই ফিয়র্জড্ যাত্রা।
কেক-কুকিজের মিষ্টি সুঘ্রাণ, গরম কফি, মেঘলা দিন, স্বর্গীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য ঈশ্বরের আশীর্বাদের মত আমাদের সব্বাইকে ছুঁয়ে যায় সেই দিনটায়। (ক্রমশ)
খুব সুন্দর বর্ণনা।
ভালোবাসা জেনো