সুখ বুঝি ছুঁয়ে যায় বাল্টিক সাগরের তীর বেয়ে বেয়ে!
মা বলেছিল,সব দুঃখ ঐ নীল জলে ভাসিয়ে আসবি।
আমি সুখ খুঁজে বেড়াই সিন্ধুচিলের ডানায়।
আমি আমাকে খুঁজি তরঙ্গায়িত সফেন স্রোতে।
সুখ মাপার কোনো যন্ত্র যদিও এখনো আবিষ্কার হয় নি। তবু কৌতুহল তো হয়, বাল্টিক সাগরের উপকূলে সবথেকে সুখী তকমাআঁটা দেশগুলো কেমন! একবার গিয়েই দেখি না!বান্ধবী পরমা যখন ডাক দিল, তখন আর না করতে পারিনি।
এবছরের প্রবল গরম, বাবার চলে যাওয়া, নানারকম সাংসারিক ঘাত প্রতিঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে স্ক্যান্ডিনেভিয়া যাবার নানারকম তোড়জোড় মনটাকে স্ট্রবেরী আইসক্রীমের মত খানিকক্ষণ ভিজিয়ে রাখত। ভাবতাম, এই তো ক’দিন! তারপরেই পৌঁছে যাব বরফগলা সেই ঠান্ডা ঠান্ডা, কুল কুল সুখীদেশে।
সেখানে পৌঁছনর আগে এই দেশগুলো নিয়ে একটুআধটু পড়াশোনার ইচ্ছে হচ্ছিল। বাবা এই ব্যাপারে আমার সিধুজ্যাঠা হয়ে উঠতে পারতেন। মাত্র একমাস আগে বাবাকে হারিয়ে এ আক্ষেপ আমার রয়েই গেল।
ভূগোল জানাচ্ছে উত্তর ইউরোপের একটি সাংস্কৃতিক অঞ্চল হল স্ক্যান্ডিনেভিয়া। সাধারণত, স্ক্যান্ডিনেভিয়া বলতে নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্ককে বোঝায়। তবে কখনো কখনো বৃহত্তরভাবে, এই তিনটি দেশের সঙ্গে ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জকেও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।
এই অঞ্চলের মানুষদের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত যথেষ্ট মিল রয়েছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়া (Scandinavia) শব্দটি আদি-জার্মান শব্দ স্ক্যাডিন-অওজো (Skaðin-awjō) থেকে এসেছে। ‘Skaðin’ অর্থাৎ বিপদ এবং ‘awjō’ অর্থাৎ দ্বীপ৷ অর্থাৎ স্ক্যান্ডিনেভিয়া শব্দটির আক্ষরিক অর্থ বিপজ্জনক দ্বীপ।
একটা সময় এই সব অঞ্চল সত্যিই বসবাসের অযোগ্য ছিল। তবে প্রবল ঠান্ডা, জলোচ্ছ্বাস, বনজঙ্গল আর জঙ্গলী জানোয়ারকে আয়ত্তে এনে মানুষই পারে অসাধ্য সাধন করতে। বিপজ্জনক দ্বীপকে একত্র করে পৃথিবীর সবথেকে সুখী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে।
আকাশপথে কোপেনহেগেনে নামতে নামতে সবথেকে আগে চোখে পড়ল বাল্টিক উপসাগরের উপকূলে সারি সারি উইন্ডমিল। গত শতকের সত্তরের দশক থেকে ডেনমার্কই নাকি প্রথম উত্তাল সমুদ্রের হাওয়াকে কাজে লাগাতে পেরেছে। তারাই এ ব্যাপারে এখনো সবচেয়ে এগিয়ে। ডেনিশ উইন্ড টারবাইন শিল্প বিশ্বের বৃহত্তম।
হোটেলে পৌঁছে লম্বা বিমান যাত্রার ক্লান্তি (কোলকাতা থেকে আবুধাবি, সেখান থেকে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন) কাটিয়ে শহরটাকে ছুঁতে বেরোলাম। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এ আমার প্রথম ইউরোপের মাটিতে পা রাখা। এর আগে ইউরোপকে চিনতে চেষ্টা করেছি ইতিহাসের পাতায়, সিনেমার পর্দায়, গল্পের বইয়ে, বিদেশী নাটকে।
যদিও আমার মনের মধ্যে এখনো সেই ছোটোবেলার রূপকথার ইউরোপ। সেখানে রাজত্ব করে বেড়ায় সান্তাক্লস, ঝিকিমিকি ডানাওলা পরী, সিন্ডারেলা, থাম্বেলিনা, লিটল রেড রাইডিং হুড, স্নো হোয়াইট, হ্যাপী প্রিন্সরা ।
সেই রূপকথার গল্পের লাল, চকলেট, হলুদ রঙের খেলনার মত বাড়িগুলো অবিকল তেমনি রয়েছে। তাতে চিমনি দেওয়া লাল টালির তিনকোনা ঢালু ছাদ। ছোটো ছোটো সাদা জানলা। কারো বাড়ির সামনে ছোট্ট পুকুর বা নদী। লম্বা লম্বা বার্চ, পাইন গাছের ছায়া পড়েছে তাতে। বাগানে ডেইজি আর লিউপাইন ফুল গাছের বেড়া। বাড়ির পেছনেই ঢালু পাহাড়। সেখানে একটু আধটু বরফের ছিটে। সবুজ ঘাসের কার্পেটে চরে বেড়াচ্ছে মোটাসোটা গোরুর পাল। লম্বা কেশরওলা ঘোড়া। পুকুরে ধবধবে হাঁসেদের সঙ্গে সাঁতরাচ্ছে এক আধটা আগলি ডাকলিং।
সোনালী চুল, গোলাপী ঠোঁট আর গাল, নীল চোখের রাজপুত্র আর রাজকন্যারাও কেউ হারিয়ে যায় নি। তবে তাদের পোশাক আর মনগুলো বদলে গেছে। তারা আর মাথায় কেউ লেসের টুপি পরেনা। গোলাপী গাউন, হাতায় -কলারে ঝালর দেওয়া জ্যাকেট, লাল প্যান্ট এখন মিউজিয়ামের শোকেসে। সাদাকালো টিশার্ট, বারমুডা অথবা জিন্স পরা ছেলেমেয়েদের চোখে আর রূপকথার কোনো যাদুকরী মায়া নেই। তারা অত্যন্ত ঝকঝকে, স্মার্ট। বাস্তবের কঠিন মাটিতে তাদের শক্তপোক্ত পদক্ষেপ ।
ডেনমার্কের রাস্তায় তাদের আর ঘোড়ায় চেপে ঘোরাঘুরির দরকার নেই। চারপেয়ের বদলে তাদের বাহন দুচাকার সাইকেল। সাইকেলের সামনের ঝুড়িব্যাগে নতুন বৌ, বুড়ো বর, চারটে বাচ্ছা, সবজিপাতি সব এঁটে যায়। ডেনমার্কের রাজবংশ নিভু নিভু প্রদীপের সলতের মত টিঁকে থাকলেও সাইকেলওলারাই হচ্ছে কোপেনহেগেনের Kings of the road.
প্রায় গোটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় প্রবলভাবে এখনো রয়ে গেছে ভাইকিংরা।
খেলনায়, বাসনপত্রে, টুপিতে, ফ্রীজ ম্যাগনেটে মোটা নাক, শিংওলা টুপিতে মজাদার মোটাসোটা জলদস্যু আর তার সঙ্গিনীরা বিদ্যমান। ফ্যাশনেবল মানুষের শরীর জুড়ে ট্যাটুতেও ঝাঁকড়া চুলের জলদস্যুরা বীরত্ব দেখায়। সম্ভবতঃ ওয়েব সিরিজের দৌলতে এখনো ভাইকিংদের রমরমা।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ইতিহাসের শুরুর দিকে প্রায় আড়াইশ বছর ধরে ভাইকিং জলদস্যুরা সাগরের জলে দাপাদাপি করেছে। অদম্য সাহস নিয়ে তারা পাড়ি দিয়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। ব্যবসা করেছে। জাহাজ বানানোয় পারদর্শী হয়েছে। মাছ ধরার নানা কলাকৌশল শিখেছে। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল তাদের৷ আশেপাশের সব উপকরণ সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা ছিল৷ নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলি কাজে লাগিয়ে তারা বাড়িঘর, জাহাজ, গাড়ি, দড়ি ইত্যাদি তৈরি করেছে। তারপর শেষমেশ দস্যিপনা কমিয়ে ডেনমার্কের রাজা হয়ে বসেছে। ইউরোপের ইতিহাস বলে প্রথম রাজতন্ত্র তাদেরই তৈরি করা।
রাজত্বের প্রথম দিকে অবশ্য তাদের বেশ নানারকম নাম ছিল। খ্রীস্টধর্ম প্রসারের পর রাজাদের একই নাম, ফ্রেডরিক।ফ্রেডরিক, ২, ৩, ৪ ইত্যাদি। এমনকি আমাদের শ্রীরামপুরকে ১৭৭৭ সালে ডেনিসরা যখন কব্জা করে চার্চ, ট্যাভার্ণ, কুঠি দিয়ে সাজাচ্ছিল, তখনো তার নাম দিল ফ্রেডরিকনগর।
একটা সময় পর্যন্ত ডেনমার্কের রাজার ছত্রছায়ায় ছিল নরওয়ে আর সুইডেন। এখন অবশ্য তারা ভাইভাই, ঠাঁইঠাঁই। ঝগড়াঝাঁটি নেই।
একটা ছোট্টো জেলেদের গ্রাম কিভাবে ধীরে ধীরে পৃথিবীর একটি বিখ্যাত বন্দর-শহর হয়ে গড়ে উঠল, কোপেনহেগেন তার অন্যতম উদাহরণ।
আমাদের কোপেনহেগেন সফরের গাইড ছিল ম্যাটে। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীর নাম ও তাই। সে দেশের পতাকার রঙের লালসাদা জামা পরে হাসিমুখে আমাদের জানাচ্ছিল পুরনো রাজপ্রাসাদ বদলে পার্লামেন্ট হাউস হয়ে গেছে। সেখানকার ঝুল বারান্দা থেকে প্রধানমন্ত্রী নতুন রাজার নাম ঘোষণা করেন। ঝুল বারান্দার নিচেই সাধারণ মানুষ দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্ণায় বসে।
আমরা অবাক হলাম গোটা পার্লামেন্টে কোনো পুলিশি পাহারা নেই! নতুন রাজপ্রাসাদে অবশ্য নিয়মমাফিক সান্ত্রীরা পাহারা দেয়। দুপুরে তাদের ডিউটি বদল হয়। মাথায় সাত আট কিলো ওজনের ভালুকের লোমের টুপি পরে তখন তারা কুচকাওয়াজ করে!
কোপেনহেগেন দেখার সবথেকে বড় উপায় কানাল ক্রুজ। গাইডের ধারাভাষ্যর সঙ্গে সঙ্গে নৌকা এগিয়ে চলে। আমরা মাথা নিচু করে একটা একটা ব্রিজের তলা পেরিয়ে যাই। নতুন পুরনো স্থাপত্য দেখি। একের পরে এক পাশ কাটিয়ে চলি লাইব্রেরী,অপেরা হাউস,চার্চ।কোনোটি ছুঁচলো গথিক স্টাইলের। কোনোটিতে ইউরোপের বারোক স্থাপত্যের কারুকাজ। রেনেসাঁস যুগের স্থাপত্য বা নিও ক্লাসিক্যাল শৈলীর সব ঐতিহাসিক নিদর্শন বড় যত্নে রাখা রাখা রয়েছে ।
সেই প্রভাবেই কিনা জানিনা, একুশ শতক থেকে ডেনিশ স্থাপত্য শিল্প খুব নাম করল। এখন তাদের বাড়িঘর বানানোর এই ব্যবসা সারা বিশ্বে রমরমিয়ে চলছে।
গোটা পৃথিবী থেকে নানাদেশের, নানাভাষার, নানা রঙের মানুষ গরমের ছুটি কাটাতে এখানে জড়ো হয়েছে। শীতকালের ভয়ঙ্কর ঠান্ডা, অন্ধকার দিনগুলো কাটিয়ে তারা লঙ সামার ডেজের আনন্দ চেটেপুটে নেয়। ঝকঝকে মিঠে রোদে শরীর সেঁকতে সেঁকতে ফুটপাতের ফুল সাজানো রেস্তোরাঁয় কফি বা বীয়ার খায়, গল্প করে। সুন্দরী নীল নয়না খাবার পরিবেশন করতে এসে আমাদের মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করল বীয়ারের দেশে বেড়াতে এসে শুধু জল খাবে? পরমা জানালো বিশ্ববিখ্যাত কার্লসবাগ বীয়ারের জন্মভূমি হচ্ছে ডেনমার্ক।
এত সুখী মানুষদের মাঝখানে ক্যানালের একপ্রান্তে পাথরের ওপর বসে থাকে সেই দুঃখী ছোট্ট জলকন্যা। ডাঙার সেই প্রিয়তম রাজপুত্রকে পাবার জন্যে সে তার সুন্দর রুপালী পাখনাটি অবধি বিসর্জন দিয়েছে। কোনোদিন আর সাঁতরে ফিরে যেতে পারবেনা তার বাবা মা’র কাছে। জল কেটে খেলতে পারবেনা মাছ আর সখিদের সঙ্গে। পৃথিবীর সবথেকে সুখীমানুষদের দেশে বিষণ্ণ মুখে অনন্তকাল প্রতীক্ষায় রয়ে গেছে হ্যানস ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের লিটল্ মারমেইড। [ক্রমশ]
সুন্দর শুরু।
খুবই সুন্দর লেখা। পরের পর্বের অপেক্ষায়।
খুবই সুন্দর লেখা। পরের পর্বের অপেক্ষায়।
এমন লেখা পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা বাড়িয়ে তোলে।
খুব প্রাঞ্জল বর্ণনা। সমৃদ্ধ হলাম নন্দিনী দি।
Khub bhalo laglo, onek informations notel kore nilam. Porer porbo khub taratari porte chai.
ভীষণ সুন্দর লিখছ,সাথে আছি
Khub bhalo laaglo….cholte thak
আমার সব সীরিয়াস পাঠককে অসংখ্য ধন্যবাদ আর আন্তরিক কৃতজ্ঞতা🙏🌹♥️
খুব ভালো লাগলো। যখনই জেনেছি তুমি গিয়েছো স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় তখন থেকেই এই ভ্রমণ কথার অপেক্ষায় ছিলাম। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে তোমারই সঙ্গে সঙ্গে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি চির দুঃখী মারমেডের দেশে…
ভীষণ সুন্দর। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম