রত্নগিরি
ললিতগিরি-উদয়গিরি বৌদ্ধক্ষেত্রদুটি লোকালয়ের বাইরে অবস্থিত। কিন্তু রত্নগিরির ঢিপির চারপাশে মানুষের বসবাস। এমনকি বৌদ্ধক্ষেত্রের পশ্চিমপাশে পাহাড়কে কেটে সমতল করে ও পুরনো ইট তুলে নিয়ে লোকজনেরা ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছিল। ফলে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সদ্ভাব ও বিশ্বাস অর্জন করতে হয়েছিল তাঁকে।
লোকেরা একটি ঢিপিকে বলতো ‘রানি পুখুরি’ — যদিও সেখানে কোনও পুকুরের অস্তিত্ব ছিলো না। এক রানি বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হয়ে এখানে ভিক্ষুণী হিসেবে জীবন কাটিয়েছিলেন, হয়তো তাঁরই স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওই ‘রানি পুখুরি’ শব্দের সঙ্গে।
খননকাজ একমাত্র বৃষ্টিবিহীন দিনগুলিতেই চলত। তিন বছরে চারটি সিজন-এ, মোটামুটি গ্রীষ্মকালে, খনন করার কাজ চলত। ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় প্রথম খননকাজ। প্রথম সিজন-এ, ঢিবির একটি বড় অংশ খোঁড়া হয়েছিল, বাকি অংশটি পরের সিজন-এ। দ্বিতীয় সিজন-এ রানী-পুখুরি ঢিবিতে খনন হয়েছিল। যার ফলে ২ টি বৌদ্ধমঠের বিস্তৃত ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়েছিল। তৃতীয় সিজন-এ আরও একটি বৌদ্ধমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। ১৯৬১ সালে চতুর্থ সিজন-এ শেষ ঢিবিতে একটি একক মঠ পাওয়া গেছে।
আর পাওয়া যায় ৩০০টি ছোট ছোট চৈত্য বা স্তূপ। পাওয়া যায় মঠের দেওয়াল ও প্রবেশপথের দরজা। খননের ফলে উঠে আসে বৌদ্ধধর্মের মহাযান ও বজ্রযান পর্বের অসংখ্য মূর্তি — বিভিন্ন শরীরী মুদ্রায় বসে থাকা বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব, লোকেশ্বর, বজ্রপাণি, জম্ভল, হরিতী, ভৃকুটি, অষ্টমহাভয়া তারা, প্রজ্ঞাপারমিতা, মঞ্জুশ্রী, অপরাজিতা।
রত্নগিরি বৌদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশের মুখে দেখলাম, সামনে স্থানীয় লোকজনের ঘরবাড়ি। একটি স্কুল চলছে, বহু ছাত্রছাত্রী টিফিন পিরিয়ডে বাইরে বেরিয়ে এসেছে ও আইসক্রিমের ঠ্যালাগাড়ির সামনে ভিড় করেছে। সেই স্কুলের সামনেই আমাদের গাড়িটা রাখা হলো।
প্রথমেই মন দিয়ে সামনের ফলক পড়লাম ও ছবি তুললাম। সেই বোর্ডে লেখা আছে —
রত্নগিরি মহাবিহারটি ‘আসিয়া’ পাহাড়শ্রেণীতে এবং ব্রাহ্মণী নদীর উপনদী কেলুয়া নদীর বাম তীরে অবস্থিত। রত্নগিরি বা “রত্নপাহাড়”-এর উপরে বৌদ্ধ ধ্বংসাবশেষ প্রথম ১৯০৫ সালে এম.এম. চক্রবর্তী লক্ষ্য করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের দেবলা মিত্র কর্তৃক খনন করা হয়, যার ফলে একটি মহাস্তূপ, দুটি মঠ, মন্দিরের গুচ্ছ, পূজা স্তূপ, ভাস্কর্য, স্থাপত্যের টুকরো এবং অন্যান্য পুরাকীর্তি সমন্বিত একটি দুর্দান্ত বৌদ্ধ স্থাপনা উন্মোচিত হয়। “শ্রী রত্নগিরি মহাবিহারীয় আর্য ভিক্ষু সংঘ” লিপির ভিত্তিতে স্থানটিকে রত্নগিরি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভৌমকরদের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থাৎ ৯ম-১০ম খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে এই স্থানটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ স্থাপনা ছিল। খননের সময় উদ্ধার হওয়া তাম্রশাসনের শিলালিপি থেকে জানা যায় যে এই কমপ্লেক্সের একটি মঠে কর্ণদেবের রানি কর্পূরশ্রী বাস করতেন। এই স্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির সময়কাল ৫ম শতাব্দী থেকে ১৩শ-১৪শ শতাব্দীর মধ্যে।
টিকিট কাটার পরে ঘূর্ণ্যমান গেট ঘুরিয়ে একে-একে প্রবেশ করলাম। সামনে একটি উচ্চ টিলা। চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে ধাপে ধাপে। কিন্তু পুরো টিলা সবুজ ঘাসের আস্তরণে ঢাকা। স্কুলের ড্রেস পরা একদঙ্গল ছাত্রী সেই ঘাসের উপরে বসে আছে। তাই দেখে, আমরা ওই সিঁড়ি বেয়ে না-উঠে, ঘাসের উপরে পা রেখে টিলায় চড়তে লাগলাম।
সবুজ ঢিপির উপরে উঠে আমি হতবাক, এ কীরকমের ধ্বংসাবশেষ? চারদিকে অবিনস্ত্য হয়ে পড়ে আছে ভাঙাচোরা মূর্তি ও ছোট ছোট মিনিয়েচার চৈত্য বা স্তূপ।
আমরা যাওয়ার ঠিক এক মাস আগে, ফের রত্নগিরিতে খননকার্য চালানো হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে দেবলা মিত্রের নেতৃত্বে যে খননকার্য চালানো হয়েছিল, সেটা হয়েছিল দুই-তৃতীয়াংশ জমিতে।
বাকি অংশটুকু ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ খুঁড়তে গিয়ে আবিষ্কৃত হয় বুদ্ধের তিনটি বড়সড়ো মস্তক।
সেকারণেই হয়তো একটা পাশ পুরোপুরি অবরুদ্ধ, সেখানে ছবি তোলা যাবে না — সেই মর্মে নোটিশ ঝোলানো আছে। কিন্তু আমি অন্যমনস্ক ভাবে সেইদিকে পা বাড়াতেই এক রক্ষী মুহূর্মুহূ বাঁশি বাজিয়ে আমাকে সতর্ক করতে লাগলো। ওদিকে যাওয়া নিষেধ।
একটি ভাঙা মঠের চারপাশের অনুচ্চ দেওয়াল ও তার গায়ে কিছু মূর্তি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে গিয়ে দেখি একটি প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, চারদিকে ইটের দেওয়াল ও পাথরের ভাস্কর্য। অদূরে আরও একটি স্থাপনা, কিন্তু সেখানে কোনও মূর্তি নেই।
হিউয়েনসাং কথিত ‘পুষ্পগিরি’ (Pu-sie-p’o-k’i-li) বৌদ্ধবিহার কোথায় ছিলো? কেউ কেউ বলেছেন, ললিতগিরি-উদয়গিরি জুড়ে যে বৌদ্ধচর্চার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, সেটাই পুষ্পগিরি। কিন্তু অন্য একদল পণ্ডিত মনে করেন, রত্নগিরি-ই পুষ্পগিরি। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় উড়িষ্যার শিল্প নিয়ে আলোচনা করেছিলেন এবং তিনি মনে করতেন, রত্নগিরিই হিউয়েনসাং কথিত ‘পুষ্পগিরি’। আবার একদল ইতিহাসবিদ বলেন, ললিতগিরি-উদয়গিরির অদূরে লাঙ্গুড়ি পাহাড়ে ছিলো পুষ্পগিরি। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করতেন, অন্ধ্রপ্রদেশের কুড়াপ্পা এলাকায় ছিলো পুষ্পগিরি!
দীর্ঘ সময় ধরে রত্নগিরি বিহার চালু থাকলেও, দেবলা মিত্র বলেছেন, তাঁরা লক্ষ্য করেছেন এক শতাব্দীর স্থাপত্যের ভগ্নস্তূপের উপরে অন্য শতাব্দীতে আবার স্থাপত্য গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন শতাব্দী জুড়ে তিল তিল করে গড়ে উঠেছিল রত্নগিরি, যখন উড়িষ্যার ভাগ্যাকাশে কত রাজা-মহারাজাদের পালাবদল হয়ে গেছে। [ক্রমশ]