উদয়গিরি
এরপর ঢাকনাটি খোলা হলো এবং ব্রাহ্মণদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বলে প্রমাণিত হয়ে গেল, ভিতরে ছাই ছাড়া কিছুই নেই।
রাজা, প্রচণ্ড ক্রোধে বৌদ্ধদেরকে গণহত্যার আদেশ দিলেন।
তক্ষুণি ৩২ জন বৌদ্ধকে হত্যা করা হলো। বাকিরা প্রাণ হাতে করে পালিয়ে গেলেন। বীরসিংহ এখান থেকে পালিয়ে দণ্ডকারণ্যের বনে আশ্রয় নিলেন।
বেশ কিছুদিন পরে, পুরীতে প্রভু চৈতন্য আসছেন শুনে বীরসিংহ পুরীর দিকে রওনা হলেন। নৃসিংহ অবতারের পর, ভগবান আবার বুদ্ধের অবতার রূপে নিজেকে প্রকাশ করলেন। শ্রী চৈতন্য বুদ্ধের ‘মূর্ত প্রতীক’। বীরসিংহ এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং তৎক্ষণাৎ নিজেকে প্রভু চৈতন্যের চরণে নিক্ষেপ করেছিলেন।
বীরসিংহের বাঙালি অনুসারীরা মহানদীর তীরে বাঁকিতে পালিয়ে যান এবং মহাপর্বত পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন। তাঁদের বংশধররা তাঁদের পেশা হিসেবে বস্ত্র-বয়নকে বেছে নিয়েছিলেন — তারা এখন “সারকি” নামে পরিচিত — যা কেবল “শ্রাবক” শব্দের একটি প্রাকৃত রূপ। সারকিরা কটক জেলার বাঁকির কাছে রাগাদি, নুয়াপটনা এবং মণিবান্ধায় বাস করে।
বাঁকুড়া, বর্ধমান এবং বালাসোর জেলায়ও সারকিদের দেখা যায়, যেখানে তাঁরা এখন সম্পূর্ণরূপে হিন্দু ধর্মাবলম্বীতে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু উপরে উল্লিখিত তিনটি গ্রামে বসবাসকারী সারকিরা এখনও নিজেদের বৌদ্ধ বলেন। তাঁরা হিন্দু তাঁতি শ্রেণীর সঙ্গে মেশেন না এবং তাঁরা সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী। একই সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য নির্যাতন থেকে বাঁচতে তারা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এই বৌদ্ধ সারকিরা এখন সম্পূর্ণ ওড়িয়া। কিন্তু তাঁদের উপাধি, যেমন দত্ত, বর্ধন, চন্দ, দেব, নন্দী ইত্যাদি, স্পষ্টতই বাঙালি বংশোদ্ভূত। এইভাবে এই সারকিরা আমাদের সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দেয় যখন বীরসিংহের অনুগামী বৌদ্ধরা নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, যা উড়িষ্যা থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।
নিশ্চয়ই মনে পড়বে স্বামী বিবেকানন্দের সেই লেখাটি— “জগন্নাথ-মন্দির একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। আমরা ঐটিকে এবং অন্যান্য বৌদ্ধ মন্দিরকে হিন্দু মন্দির করিয়া লইয়াছি।” — স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (পঞ্চম খণ্ড)
উদয়গিরি এতটাই ছড়ানো যে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের দম বেরিয়ে যায় আর কি!!! ললিতগিরিতে দেখলাম এক বিশাল চেহারার বটগাছ, ঠিক তেমনই উদয়গিরিতেও প্রাচীন বটগাছ, ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে চারদিকে। তার নিচে সিমেন্টের বেঞ্চ। আমার সহযাত্রিণী আর হাঁটতে না পেরে বটের ছায়ায় বসে পড়লো। … আর আমি, একদিক থেকে ফিরে আবার অন্যদিকে ছুট লাগালাম।
মার্চের ৬ তারিখ, কিন্তু মধ্যদুপুরে ওড়িশার রোদ এত ভয়ঙ্কর যে মুখ-চোখ পুড়িয়ে ঝামা করে দেবে!!!
ললিতগিরিতে যেমন একটি মিউজিয়াম বানিয়ে সেখানে বেশ কিছু মূর্তি অন্তত সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এখানে সেটা নেই। তাহলে খননকার্যে পাওয়া মূর্তিগুলি গেল কোথায়?
তিনটি বৌদ্ধক্ষেত্র থেকে পাওয়া মূর্তিগুলি গত ১০০ বছর ধরেই বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। যেমন, ব্রিটিশ আমলে কলকাতা, পাটনা, এমনকি ফ্রান্সে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, ভুবনেশ্বর, কটক। আর চুরি করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে কতো, তার হিসেব নেই।
জাজপুরে ব্রিটিশ আমলে চন্দ্রশেখর ব্যানার্জি ও মনোমোহন চক্রবর্তীর মতো মানুষেরা এস-ডি-ও হয়ে এসেছেন বলেই এই বৌদ্ধ ক্ষেত্রগুলির কথা আজ আমরা জানতে পেরেছি।, কিন্তু সবাই তো তাঁদের মতো নয়। তাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পুরাতত্ত্ববিদ হারাণচন্দ্র চাকলাদার মহাশয় ১৯২৮ সালে জাজপুরে এস-ডি-ওর অফিসে দুটি বিশালাকার বুদ্ধমূর্তি সাজিয়ে রাখতে দেখেছেন।
এই ভাস্কর্য এবং সিলমোহরগুলি থেকে ধারণা করা হয় যে গুপ্ত যুগের পরবর্তী সময় পর্যন্ত (খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দী) এই স্থাপনার বাসিন্দারা হীনযান ও মহাযান বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ছিলেন এবং খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীর দিকে ওড়িশায় ভৌমকর রাজাদের আগমনের পরে বৌদ্ধধর্মের “বজ্রযান” রূপটি পরিণত হয়ে ওঠে। ভৌমকর রাজারা শৈব ছিলেন, কিন্তু তাঁরা বৌদ্ধদের প্রতি সদয় ছিলেন বলেই জানা যায়।
হীনযান ও মহাযান ধর্মের প্রচারের সময়, মূর্তির বাড়বাড়ন্ত বা সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম তেমন দেখা যায় না। কিন্তু “বজ্রযান” ধর্মের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বোধিসত্ত্ব, অবলোকিতেশ্বর, মৈত্রেয়, তারা, প্রজ্ঞাপারমিতা, অপরাজিতা, জাম্বল, মঞ্জুশ্রী প্রভৃতি মূর্তি আবির্ভূত হতে শুরু করে।
এমনকি ললিতগিরিতে আবিষ্কৃত প্রারম্ভিক যুগের ভক্তিমূলক স্তূপগুলিতে বৌদ্ধ দেবতাদের কুলুঙ্গির মধ্যে কোনও চিত্রাঙ্কন নেই। কিন্তু ৮ম শতাব্দীর পরে উদয়গিরি-রত্নগিরিতে নির্মিত হয়েছিল কারুকার্যখচিত স্তূপ, তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন বুদ্ধমূর্তি।
১৮৯০ সালের দিকে, লাণ্ডা পাহাড়ের কাছে একজন সাধু বাস করতেন। কেন্দ্রাপাড়ার জমিদার যখন ধ্বংসস্তূপ খুঁজে মূর্তিগুলি নিয়ে যান, তখন সাধুও নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুদ্ধিমান হয়ে ওঠেন। তিনি ধ্বংসস্তূপ থেকে বুদ্ধের একটি বিশাল উপবিষ্ট মূর্তি উত্তোলন করেন। বুদ্ধের ‘ভূমি-স্পর্শ’ মুদ্রায় বসে থাকা মূর্তি। সেই সাধু এরপর ঢিবির ধ্বংসাবশেষ থেকে অবলোকিতেশ্বর এবং তারা-র মূর্তিও বের করেন। তিনি একটি মন্দির নির্মাণ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে পাওয়া মূর্তিগুলি মন্দিরের বাইরের দেয়ালে গেঁথে দেন যাতে অপসারণ না করা যায়। বুদ্ধের মূর্তিকে গ্রামবাসীরা ‘মহাদেব’ বলে ডাকতে থাকে।
এই সবুজ মাঠের মধ্য দিয়েই হেঁটে যেতে হয় বৌদ্ধবিহারের ভগ্নস্তূপে।
সাধুর আরও বড় পরিকল্পনা ছিলো। দুর্ভাগ্যবশত সাধু তাঁর মন্দিরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে পারেননি। মৃত্যু এসে তাঁর কার্যকলাপকে স্থগিত করে দেয়। [ক্রমশ]