ছিন্নমূল মানুষের উৎকণ্ঠা আর আত্মপ্রত্যয় যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে, তখন ইতিহাস তৈরী হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মায়া ছেড়ে যখন মানুষগুলো কোনো রকমে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছেন, তার অনতি দূরে আরও একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন দক্ষিণ কলকাতার নেতাজীনগর কলোনিতে। ১৯৫১ সাল। দেশ ভাগের মর্ম বেদনা শরীর থেকে মোছেনি। এক রাতে কলোনির মানুষ গড়ে তুললেন একটা স্কুল বাড়ি। বাড়ি নয়, দরমার বেড়া আর টিনের চালে তৈরি হলো নেতাজী নগর বিদ্যামন্দির। অনেক স্বপ্নের বাস্তবায়ন। অনেক ঘাম আর ব্যাথার স্থানিক প্রতীক। আজ বহু বছর অতিক্রান্ত। সেদিনের সেই স্বপ্নের বুনিয়াদ বর্তমান প্রজন্মের কাছে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আজ। সচল। সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত নেতাজী নগর বিদ্যামন্দির।
অনেক কৃতি মানুষকে উপহার দিয়েছে এই শিক্ষা কেন্দ্র। এই বছর (২০২৫) ২রা জানুয়ারি ৭৫ বছরে পদার্পণ করবে। এতগুলো বসন্তে বহু ছাত্র দেশ ও বিদেশের মাটিতে নানাভাবে তাদের কৃতিত্বে প্রতিষ্ঠিত। বিদ্যামন্দিরের পরিচালন সমিতিতে বিভিন্ন থেকেছেন সুকুমার ব্যানার্জী, প্রশান্তকুমার শূর, জ্যোতিপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের মতো ব্যক্তিত্বরা। শক্তি ঠাকুর, সৌমেন বসুর মতো মানুষেরা এখানে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। বিদ্যামন্দিরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলোকিত করেছেন শিবরাম চক্রবর্তী, আশাপূর্ণা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়, নারায়ন সান্যাল, উষা গাঙ্গুলি প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। অতনু বিশ্বাস, কৌশল চন্দ, অমিতাভ রায় এর মতো ব্যক্তিরা এই বিদ্যামন্দিরের প্রাক্তন ছাত্র। বিদ্যামন্দিরের বহু কৃতী ছাত্র ছড়িয়ে আছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিবিধ ক্ষেত্রে, বিশ্বের নানা প্রান্তে। গত ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪, বিদ্যামন্দিরের প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হলো পুনর্মিলন উৎসব। এই পুনর্মিলন উৎসবের মাধ্যমে তাদের এক সুতোয় বাঁধার কাজ শুরু হলো।
আবেগ, নস্টালজিয়া আর ভালোবাসার স্মৃতি বারবার রোমন্থন হলো পুনর্মিলন উৎসবে। ‘৫৭ সালের মাধ্যমিক, ‘৬১ সালের মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি প্রমাণ করে দিয়েছে বিদ্যামন্দিরের প্রতি তার প্রাক্তন ছাত্রদের অপার ভালোবাসার কথা। অনুষ্ঠানের সূচনা করেন প্রাক্তনী কমিটির সভাপতি সব্যসাচী ব্যানার্জী। ঘটনাক্রমে তিনি বিদ্যামন্দিরের বর্তমান ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিও বটে। গোটা বছর ধরে প্রাণের বিদ্যামন্দিরের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা জানান তিনি। আমেরিকার থেকে ছুটে এসেছেন কেউ, মুম্বাই থেকে সরাসরি স্কুলে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন প্রাক্তনী এবং বিদ্যামন্দিরের বর্তমান শিক্ষক মানস গঙ্গোপাধ্যায়, দেবাঞ্জন দাস, তন্ময় সিনহা। প্রাক্তনীদের বক্তব্যে বারবার তাদের সময়ের নানান কথা উঠে এসেছে। একই সঙ্গে বর্তমান সময়ে পঠনপাঠন ও অন্যান্য বিষয়।
সরকারি বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের ভর্তির মাত্রাতিরিক্ত অনীহার ইদানিং কারণ আলোচনার মধ্যে উঠে এসেছে। যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। অনুষ্ঠানের মধ্যাহ্ন ভোজের পর উপস্থিত হন বিদ্যামন্দিরের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ড. দিলীপ মজুমদার। উপস্থিত প্রাক্তনীদের বৃহৎ শতাংশ ছাত্র তাঁর স্নেহচ্ছায়ায় বড়ো হয়েছেন একদা। তাঁর উপস্থিতি অন্য মাত্রা তৈরি করেছে। সংক্ষিপ্ত ভাষণে মূল্যবান পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, “আমাদের মতাদর্শের জায়গায় পার্থক্য থাকতেই পারে, মনের দিক থেকে যেন সেই পার্থক্য হাজির না হয়। মতান্তর থাকলে থাকুক, মনান্তর যেন না থাকে। তবেই প্রকৃত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।” সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রাক্তনী পল্লব কাঞ্জিলাল। গানে গল্পে আড্ডায় মুখরিত ছিল সারাদিন।
প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক দিলীপ মজুমদারের সংযোজন
সব্যসাচী, পল্লব, সুশান্তদের ডাক এড়াতে পারলাম না। পুনর্মিলন উৎসবে গেলাম। গিয়ে বুঝলাম, এই উৎসব একটা টাইম মেশিন। পাকা চুল, আধপাকা চুলের প্রাক্তন ছাত্রদের দেখতে দেখতে ধাঁ করে চলে গেলাম সুদূর অতীতে। দেখতে লাগলাম নিজেকে। তখন আমি তিরিশ-চল্লিশের ঘরে। কৈশোরের ঘরে ছাত্ররা। তারপর তাদের যৌবনের শ্যামল গৌরব এসেছে। তারপর তাদের এসেছে বার্ধক্য। তাদেরই একজন আমাকে বলল, ‘আপনি আশির ঘর ছুঁতে চললেন, এখনও দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন, হা হা করে হাসছেন, শরীরের চামড়া কুঁচকোয় নি, দাঁত পড়ে যায় নি, মনে শ্যাওলা পড়ে নি, ব্যাপারটা কি বলুন তো?’
রেসিপির কথা জানতে চাইছে তারা।
রেসিপিটা এমন কিছু দুর্লভ নয়। বয়সটা শরীরের বাড়ে। বাড়ুক। মনের বয়েসটা ঠিক রাখতে পারলে কেল্লা ফতে। কি করে ঠিক রাখব মনের বয়েস? মনে রেখো আমাদের ঠাকুরের কথা। ঠাকুর? আপনি তো তেমন আস্তিক নন, তাহলে ঠাকুরের কথা আসছে কেন? আরে, এ হল মানুষ — ঠাকুর। আমি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরের কথাই বলছি। প্রৌঢ় হবার পরেও যিনি ছিলেন সবুজ সংসদের গুরু। কি বলেছেন তিনি? বলেছেন : সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন সহজ হবি। সহজ হবি আর ভালোবাসবি। বিশেষ করে শিশুদের। বেশি বেশি করে মিশবি শিশুদের সঙ্গে। শিশুর সঙ্গে শিশু হলে সহজ হওয়া যাবে। পুর্নমিলন উৎসবে আমি দেবাঞ্জন আর সঞ্জয়ের গোমড়া মুখ দেখে সেই আগেকার মতো বকে উঠলাম : এমন রামগরুঢ়ের ছানার মতো বসে আছিস কেন? সমস্যা আছে? কার না থাকে সমস্যা? সেই ঠাকুরের কথা আওড়া : ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।
তা তো হল, খাদ্যাখাদ্য কি কিছুই নয়? কে বলল,. কিছুই নয়! আমি বাপু জীবনে মাত্র চার-পাঁচবার ফাস্ট ফুড খেয়েছি। আর তোরা? ঘরে গড়া রুটি খাবি না, মুড়ি খাবি না, শাক-পাতা খাবি না, তেতো খাবি না, কেবল চপ-কাটলেট-বিরিয়ানি–ফাস্ট ফুড ফাস্ট ফুড ফাস্ট ফুড। দেখ বাপু, প্রকৃতি আমাদের সবকিছু সাজিয়ে দিয়েছে, প্রতিটি ঋতুতে যেসব সবজি — যেসব ফল ফলে, শরীরে তার দরকার। মানিস এসব? প্রকৃতিকে টপকালে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবেই। নিচ্ছে।
তা বলে কি রোগ হবে না? নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু রোগের চিকিৎসার নামে যা চলছে তা তো মেডিকেল মাফিয়াদের খেলা। প্রথম কথা শরীরের সঙ্গে মনের গাঁটছড়া বাঁধা। সাইকোমনোরোলজি বলে একটা শাখার কথা শুনেছিস? সেখানে বলা হচ্ছে মনই সবচেয়ে বড়ো অ্যান্টি-সেপটিক, অ্যান্টিবায়োটিক। তার মানে মনই সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক। প্রকৃতি আরও প্রতিষেধক দিয়েছেন। এককোয়া রসুনের গুণ জানিস? রোজ কয়েকদানা গোলমরিচ চিবিয়ে খেয়ে দেখিস। ভাত খাবার পরে রোজ একটু হরতকি + আমলকি+ দারচিনি+ এলাচ+ লবঙ্গ + গোলমরিচ খেয়ে দেখিস তো? ভোর সকালে একটু ত্রিফলার জল।
না রে, এসব শুকনো উপদেশ নয়। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’ — আমি মানি। আমি নিজে এসব খাই। নিয়মিত। এই আমার রেসিপি।
আরও একটা কথা বলি। এই পুনর্মিলন উঃসবে এলি তোরা। তারপর ভুলে গেলি। আমার কিন্তু মনের খেলা চলতে শুরু করল। পুরানো ছাত্রদের দেখলাম, তাদের অতীতের কথা ভাবতে লাগলাম। কেমন ছিল তারা। কিছু স্মৃতি, কিছু আলাপ, কিছু প্রলাপ, কিছু কষ্ট, কিছু আনন্দ। এই হল মনের ব্যায়াম। এই ব্যায়াম না করলে মনে মরচে ধরে। ডিমনশিয়া চেপে ধরে।
অসাধারণ বর্ণনার মাধ্যমে সুন্দর স্মৃতিচারণা। আমি নিজেও উপস্থিত থেকে ঋদ্ধ হয়েছি। সংগীত পরিবেশন করে ধন্য হয়েছি।