ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে নানা স্থানে সরস্বতীর উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে। কৃষ্ণের মুখ থেকে এক কন্যার আবির্ভাব হয়েছিল, তিনি শুক্লবর্ণা, শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপা, বীণা-পুস্তকধারিণী, শ্রুতি ও শাস্ত্রের জননী, কবিদের ইষ্ট-দেবতা। ইনিই ‘শান্তরূপা সরস্বতী’। এই পুরাণেই অন্যত্র বলা হয়েছে ইনি আবির্ভূতা হয়ে কৃষ্ণকেই কামনা করেন। সর্বজ্ঞক কৃষ্ণ তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, রাধাই আমার প্রাণাধিষ্ঠাত্রী দেবী, অতএব তুমি বৈকুষ্ঠে যাও, সুন্দর সর্বগুণযুক্ত বৈকুণ্ঠপতি বিষ্ণুকে ভজনা কর। এতেই তোমার মঙ্গল হবে — ‘তব ভদ্রং ভবিষ্যতি’। এই বলে তিনি সরস্বতী পূজার তিথি, পূজাবিধি, ধ্যান-কবচ নিরূপণ করে দিলেন। কৃষ্ণের নির্দেশে সরস্বতী হলেন বিষ্ণুপত্নী।
বিষ্ণুর আবও দুই স্ত্রী — লক্ষ্মী ও গঙ্গা। একদিন গঙ্গা সকামা হয়ে বিষ্ণুর মুখের দিকে তাকালেন। বিষ্ণুও বিনিময়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে হাস্য করলেন। লক্ষ্মী ব্যাপারটি সহ্য করলেন, কিন্তু সরস্বতী ক্রোধাবিষ্টা হয়ে রক্তলোচনে বিষ্ণুকে তিরস্কার করলেন, নিজেকে গতি প্রেমবঞ্চিতা দুর্ভাগা বলে ধিক্কার দিলেন। হরি সরস্বতীর রোষ দেখে বহিঃসভায় প্রস্থান করলেন। ইত্যবসরে তুমুল কলহ শুরু হল। সরস্বতী গঙ্গার কেশাকর্ষণ করতে উদ্যতা হলে লক্ষ্মী বাধা দিলেন। সরস্বতী ক্রুদ্ধা হয়ে লক্ষ্মীকে অভিশাপ দিলেন, মর্ত্যে তুমি বৃক্ষরূপা হবে। এতে গঙ্গা কুপিতা হয়ে সরস্বতীকে শাপ দিলেন, তুমিও অধোগামিনী হয়ে পৃথিবীতে সরিৎরূপে অবস্থান করবে। সরস্বতীও গঙ্গাকে শাপ দেন, তুমিও মর্ত্যে গিয়ে নদীরূপে পাপীদের পাপভার বহন করবে। এর ভিতর বিষ্ণু ফিরে এলেন। তিনজনের পরস্পরের অভিশাপের কথা শুনে ক্ষুণ্ণ হলেন এবং কিরূপে তাঁরা পৃথিবীতে অবস্থান করবেন, তার বিধান দিলেন। সরস্বতীকে তিনি বললেন, তার বিধান দিলেন। সরস্বতীকে তিনি বললেন, সপত্নী-কলহের ফলভোগ কর। হে ভারতি, তুমি নদীরূপ ধারণ করে অংশরূপে ভারতে গিয়ে ব্রহ্মসদনে ব্রহ্মার কামিনী হও — ‘স্বয়ঞ্চ ব্রহ্মসদনে ব্রহ্মণঃ কামিনী ভব।’ সরস্বতীরূপা ভারতী ভারতী ভারতবর্ষে ব্রহ্মাপ্রিয়া ব্রাহ্মী। তিনিই বাণী, বাগধিষ্ঠাত্রী দেবী। দেবী ভাগবতেও একি কাহিনি বিবৃত হয়েছে।
মৎস্য পুরাণের মতে, ব্রহ্মা সৃষ্টি কামনায় তপোনিরত অবস্থায় নিজদেহকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন — এক অর্ধ স্ত্রী, এক অর্ধ পুরুষ। স্ত্রী অংশ শতরূপা নামে বিখ্যাত হলেন। এই শতরূপা সাবিত্রী, গায়ত্রী, সরস্বতী ও ব্রহ্মাণী নামেও খ্যাত। শতরূপা রূপবতী। ব্রহ্মা তাঁর রূপ দেখে অভিভূত হলেন, মুখে বলতে লাগলেন, ‘আহোরূপমহোরূপম্’ — আহা কি রূপ, কি রূপ! তিনি কামনায় জর্জরিত হলেন। কন্যা তাঁকে প্রণাম করে প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন। তাঁকে দেখার জন্য ব্রহ্মা চতুর্মুখ হলেন। কন্যা ঊর্ধ্বদিকে বিচরণ করতে লাগলেন। ব্রহ্মারও ঊর্ধ্বদিকে আর এক মুখ হল। ব্রহ্মা হলেন পঞ্চমুখ। ব্রহ্মার ঊর্ধ্বমুখ জটাজালে আচ্ছন্ন। শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মা এই কন্যার পাণিগ্রহণ করলেন। তাঁদের যে পুত্র হয়, তিনি স্বায়ম্ভুব মনু।
ব্রহ্ম-সরস্বতী-ঘটিত ব্যাপারটি অসামাজিক। মৎস্যপুরাণ এর ব্যাখায় বলেছেন, দেবতাদের কর্ম মানবমনে বিচার্য নয়। ব্রহ্মা ও সরস্বতী অভিন্ন। যেখানে ব্রহ্মা, সেইখানেই সরস্বতী — যেখানে সরস্বতী, সেইখানেই ব্রহ্মা। ছায়া যেমন সূর্যকে ত্যাগ করে না, দেবী গায়ত্রীও তেমনই ব্রহ্মার পার্শ্ব ত্যাগ করেন না। ব্রহ্মা বেদরাশি বলে কীর্তিত, দেবী সাবিত্রী বেদে অধিষ্ঠিতা — ‘বেদরাশিঃ স্মৃতো ব্রহ্মা সাবিত্রী তদধিষ্ঠিতা।’ মৎস্যপুরাণ অনুসারে সাবিত্রী, গায়ত্রী, সরস্বতী এক
শতরূপা চ সা খ্যাতা সাবিত্রী চ নিগদ্যতে।
সরস্বত্যথ গায়ত্রী ব্রহ্মাণী চ পরন্তপ।। (মৎস্য ৩)
পদ্মপুরাণে সাবিত্রী, গায়ত্রী ও সরস্বতীকে পৃথকরূপে দেখানো হয়েছে। ব্রহ্মা পুষ্করের পূণ্যতীর্থে যজ্ঞ করবেন বলে স্থির করলেন। পুষ্করতীর্থের প্রাণ সরস্বতীর পুণ্য প্রবাহ। ইনি ব্রহ্মার হৃদয় থেকে উৎপন্না শ্বেতবসনধরা, শ্বেতচন্দনেচর্চিতা। ব্রহ্মার নির্দেশেই তিনি পুষ্করে, সংগুপ্তা থেকেও পঞ্চধারায় প্রবাহিতা — সুপ্রভা, কাঞ্চনা, প্রাচী, নন্দা ও বিশালা। সরস্বতী এখানে অতি পবিত্রা — ‘পূতাৎ পূততমা’। পুষ্করে সরস্বতী সাধকবর্গের সিদ্ধিদাত্রী। তাপস মষ্কণক এইখানেই শাকরসে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। সরিদ্বরা সরস্বতী পুষ্করে স্বর্গসোপান স্বরূপিণী।
পদ্মপুরাণে (সৃষ্টিখণ্ড) বলা হয়েছে — এই সরস্বতী তীরেই ব্রহ্মা যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। তাঁর ধর্মপত্মী দেবী সাবিত্রী। সহধর্মিনী নিয়েই যজ্ঞে ব্রতী হতে হয়। ব্রহ্মা সাবিত্রীকে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দিলেন। সাবিত্রী দেবী তখন অন্য কাজে ব্যস্ত। তাছাড়া তাঁর সহচরী অন্যান্য দেবপত্নীরা তখনও এসে উপস্থিত হননি। এদিকে যজ্ঞের কাল বয়ে যায়। ইন্দ্র তখন অন্য স্ত্রীর সন্ধানে বের হলেন। পথেই পেলেন অনিন্দ্যসুন্দরী এক কন্যা। নাম তাঁর গায়ত্রী। সাবিত্রীর পরিবর্তে গায়ত্রীই ব্রহ্মাপত্নীরূপে যজ্ঞে দীক্ষিতা হয়ে ব্রহ্মার বাম পাশে বসলেন। এমন সময় দেবপত্নীদের সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন সাবিত্রী। সাবিত্রী ক্রদ্ধা হয়ে দেবতাদের অভিশাপ দিয়ে চলে গেলেন পুষ্করসন্নিহিত এমন একটি পর্বতে, যেখানে ব্রহ্ম-যজ্ঞের ধ্বনি প্রবেশ না করে। বিষ্ণু তাঁকে শান্ত করার জন্য স্তব করলেন। তাতে প্রকাশ পেল যে, সাবিত্রী হলেন সর্বব্যাপিকা, তিনিই বিভিন্ন নামে বিভিন্ন তীর্থের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। দেবী সাবিত্রী বিষ্ণুর স্তবে তুষ্টা হলেন বটে, কিন্তু যাজ্ঞস্থলে ফিরে এলেন না। গায়ত্রীকে নিয়েই ব্রহ্মা যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন। গায়ত্রী দেবী নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি অষ্টাক্ষরা। আমিই জগৎ ব্যাপ্ত করে রয়েছি। আমিই সর্বপদশোভিতা বেদমাতা। আমার জপেই সর্ব সিদ্ধি।
তিনি অভিশপ্ত দেবতাদেরও বর দিলেন। রুদ্র শিব তখন বেদমাতা গায়ত্রীকে প্রণিপাত করে স্তূতি করলেন —
নমোহস্তু তে বেদ মাতরষ্টাক্ষর বিশোধিতে।
গায়ত্রী দুর্গতরণী বাণী সপ্তবিধাতথা !!
গায়ত্রীই সকল অক্ষর, নিখিল গাথা, অখিল শাস্ত্র। তিনিই ব্রহ্মাণী, সর্বদেবতার জননী। সরস্বতী, গায়ত্রী, সাবিত্রী সকলেই ব্রহ্মণী ‘ব্রহ্মণঃ প্রিয়াঃ’। প্রজাপতি ব্রহ্মার হৃদয়ে সরস্বতী। বামে গায়ত্রী, দক্ষিণে সাবিত্রী। মৎস্যপুরাণ মতে তাঁরা এক।
নামভেদে যাই হক, দেবী সরস্বতী পূরাণেই বিগ্রহবতী। শুধু বিগ্রহবতী নন, পুরাণে তিনি বিচিত্র লীলাময়ী। সরস্বতী পূজার ব্যাপক প্রচারও পূরাণ থেকে। কৃষ্ণই তাকে প্রথম পূজা করে তাঁর পূজাবিধি প্রচার করেন। তিনি ‘সরস্বতীং শুক্লর্বণাং সস্মিতাং সুমনোহরাম্’ ধ্যানটিও নিরূপণ করে দেন। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে এ ধ্যান রয়েছে। অগ্নিপুরাণেও ‘ধ্যায়েৎ কুন্দেন্দুসন্নিভাং’ বলে একটি ধ্যান আছে। সরস্বতীর ধ্যান স্তব ও প্রণামমন্ত্রে পুরাণ পরিপূর্ণ। সব চেয়ে বিশিষ্ট মুনিসপ্তম যাজ্ঞবল্ক্যের প্রণাম মন্ত্রটি। গুরুশাপে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে তিনি এই মন্ত্রে সরস্বতীর বন্দনা করে স্মৃতি ফিরে পেয়েছিলেন —
স্মৃতিশক্তির্জ্ঞানশক্তি বুদ্ধিশক্তিস্বরূপিণী।
প্রতিভা কল্পনা শক্তি র্যা চ
তস্যৈ নমো নমঃ ।।
দেবী সরস্বতীর অতি প্রচলিত ধ্যান ‘তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ মন্ত্রপদটি। তাঁর আরও অনেক ধ্যান-মন্ত্র আছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সরস্বতীর প্রচলিত কোন ধ্যানই পুরাণ থেকে সংগৃহীত নয়। সব ধ্যানই তন্ত্র থেকে সঙ্কলিত। পুরাণে সরস্বতীর নানা কাহিনি, নানা লীলা বর্ণিত হলেও, পুরাণের চেয়ে তন্ত্রেই তাঁর অধিক প্রতিষ্ঠা। তন্ত্রে সরস্বতীর নদীরূপের উল্লেখ নেই, তিনি দেবতা। তন্ত্রের তত্ত্ব এবং সাধন-পদ্ধতির সঙ্গে যেন দেবী সরস্বতীর অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। বাগ্বীজ, বাগ্বীজ মন্ত্র সাধন-তন্ত্রের বিশিষ্ট সাধন। তন্ত্রমতে বাক্ (স্পন্দ) হল সৃষ্টির মূলীভুত তত্ত্ব ও পরমা শক্তি। এই তত্ত্বই নাদ, বিন্দু ও বীজ। বাক্-ই শব্দব্রহ্ম। এই শব্দ থেকেই স্থূল সৃষ্টির প্রকাশ। বাকের নানা রূপ — সূক্ষ্মতম, সূক্ষ্ম, মধ্যম ও স্থূল। তাদের পারিভাষিক নাম — পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা ও বৈখরী। বৈখরী হল মানুষের কণ্ঠোচ্চারিত ধ্বনি। এই ধ্বনির প্রতীক অক্ষর ও বর্ণ। তন্ত্রমতে বাগদেবী ‘বর্ণেশ্বরী’, তিনি অ থেকে ক্ষ পর্যন্ত পঞ্চাশটি মাতৃকা বর্ণে বিভূষিতা, তাঁর হাতেও বর্ণময়ী অক্ষমালা (অ-ক্ষ পঞ্চাশটি বর্ণের জপমালা), তিনি নাদ-বিন্দুময়ীঃ। তন্ত্রে বর্ণের বড় গুরুত্ব। বর্ণই সৃষ্টির মূল। বর্ণই সৃষ্টিব্যাপী। সরস্বতীর দেহ ‘পঞ্চাশৎ লিপিভিবিভক্ত’, তিনিই ‘লিপিতরু’, তিনি ‘বর্ণতনু’। তন্ত্রেরবীজ ও ধ্যান এই লিপিতরুর ফুল ও ফল। তান্ত্রিকদের সাধন হল ‘বর্ণবীজ’। বাগ্বীজ হল ‘ঐং’ (দ্রষ্টব্য, শারদাতিলক, ষষ্ঠ পটল)।
মনে হয়, সরস্বতী হলেন প্রাগার্য দেবী। মাতৃতান্ত্রিক তন্ত্রে একদিন ইনিই ছিলেন বাগ্রূপা পরমা শক্তি। আদিমতম এই ধারারই প্রবাহ এসে মিশেছে বাক্ ও ঊর্মিরূপা বৈদিক সরস্বতীর মধ্যে। পুরাণও তার স্মৃতি বহন করছে বিভিন্ন পৌরাণিক স্তবাবলীতে। অগ্নি পুরাণে তিনি ‘পঞ্চাশৎবর্ণমালা’। বামন পুরাণে তিনি ‘পঞ্চাশৎবর্ণমালা’। বামন পুরাণে ঋষি মার্কণ্ডেয়ের ত্ববেও প্রকট হয়েছেন তান্ত্রীক নাদময়ী বর্ণতনু সরস্বতী —
হে দেবি, স্থাবর ও জঙ্গম যাতে প্রতিষ্ঠিত; তুমি সেই ওঙ্কার সংস্থান মাতাত্রয়। তুমি অক্ষরূপা পরম ব্রহ্ম, তুমিই ক্ষররূপা জগৎ। দারুতে বহ্নির ন্যায়, মাটিতে গন্ধের ন্যায় তোমাতেই অনস্যূত হয়ে আছে সৃষ্টি। হে দেবি, তিন মাত্রাই তোমার রূপ। হ্রস্ব ও দীর্ঘমাত্রা বোধগম্য। যে অর্ধমাত্রা অব্যক্ত, অবোধ্য, অচিন্ত্য — জিহ্বা ওষ্ঠ ও তালু দিয়ে যাকে উচ্চারণ করা যায় না, যার বিনাশ নেই, ক্ষয় নেই, পরিণাম নেই — সে অর্ধমাত্রাও তুমি। (বামন পুরাণ, ৩২ অধ্যায়)।