শনিবার | ১২ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ভোর ৫:৪২
Logo
এই মুহূর্তে ::
হনুমান জয়ন্তীতে নিবেদন করুন ভগবানের প্রিয় নৈবেদ্য : রিঙ্কি সামন্ত গল্প লেখার গল্প : হাসান আজিজুল হক ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (শেষ পর্ব) : জমিল সৈয়দ চড়কপূজা কি আসলে ছিল চণ্ডকপূজা : অসিত দাস অরুণাচলের আপাতিনি : নন্দিনী অধিকারী ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (সপ্তম পর্ব) : জমিল সৈয়দ শাহরিয়ার কবিরকে মুক্তি দিন : লুৎফর রহমান রিটন ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (ষষ্ঠ পর্ব) : জমিল সৈয়দ ওয়াকফ সংশোধনী আইন এই সরকারের চরম মুসলিম বিরোধী পদক্ষেপ : তপন মল্লিক চৌধুরী ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (পঞ্চম পর্ব) : জমিল সৈয়দ যশোধরা — এক উপেক্ষিতা নারীর বিবর্তন আখ্যান : সসীমকুমার বাড়ৈ কলকাতার কাঁচাভেড়া-খেকো ফকির ও গড়ের মাঠ : অসিত দাস ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (চতুর্থ পর্ব) : জমিল সৈয়দ রামনবমী পালন এবং হুগলী চুঁচুড়ার শ্রীরামমন্দির : রিঙ্কি সামন্ত ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (তৃতীয় পর্ব) : জমিল সৈয়দ মিয়ানমারে ভূমিকম্প — প্রতিবেশী দেশের জনগণের পাশে বাংলাদেশ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (দ্বিতীয় পর্ব) : জমিল সৈয়দ হুমায়ুন-এক স্মৃতি-এক আলাপ : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী সনজীদা যার সন্তান : শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (প্রথম পর্ব) : জমিল সৈয়দ অবসর ঠেকাতেই মোদী হেডগেওয়ার ভবনে নতজানু : তপন মল্লিক চৌধুরী লিটল ম্যাগাজিনের আসরে শশাঙ্কশেখর অধিকারী : দিলীপ মজুমদার রাঁধুনীর বিস্ময় উন্মোচন — উপকারীতার জগৎ-সহ বাঙালির সম্পূর্ণ মশলা : রিঙ্কি সামন্ত রামনবমীর দোল : অসিত দাস মহারাষ্ট্রে নববর্ষের সূচনা ‘গুড়ি পড়বা’ : রিঙ্কি সামন্ত আরামবাগে ঘরের মেয়ে দুর্গাকে আরাধনার মধ্য দিয়ে দিঘীর মেলায় সম্প্রীতির মেলবন্ধন : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার ২২তম বর্ষ উদযাপন : ড. দীপাঞ্জন দে হিন্দিতে টালা মানে ‘অর্ধেক’, কলকাতার টালা ছিল আধাশহর : অসিত দাস আত্মশুদ্ধির একটি বিশেষ দিন চৈত্র অমাবস্যা : রিঙ্কি সামন্ত চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয় : ড. দীপাঞ্জন দে
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ অন্নপূর্ণা পূজা ও বাসন্তী পূজার আন্তরিক শুভেচ্ছা শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘সুখ-অসুখের ঘরে’

দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায় / ৩৫৮ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ৩ আগস্ট, ২০২২

সুনয়নী রাস্তার দিকে চেয়ে বসে আছেন। তাঁদের গ্রিল ঘেরা বারান্দা থেকে রাস্তাটা চোখে পড়ে। অটো কী সুমো, যাই যাক না, সুনয়নীর চোখে পড়বেই। কিন্তু আজ এখনও পর্যন্ত কোনও গাড়ি চোখে পড়েনি তাঁর। দু’একটা ছিটেফোঁটা রিকশা চোখে পড়েছে। সুনয়নীর মনে হল, ওরা আসবে কীসে! রিকশা চড়ে কি টিভি চ্যানেলের দলবল আসে?

সে যে ভাবে আসুক, কখন আসবে সেটাই হল প্রশ্ন। দীপু ওদের টাইম জিজ্ঞেস করেছিল। ওরা বলেছে কখন যাব তা বলতে পারছি না, যে কোনও সময় যেতে পারি। সুনয়নী তাই সকালবেলাতে উঠে রেডি হয়ে গিয়েছেন। যদিও তাঁর একটু-আধটু লজ্জা লাগছে। ভয়ও পাচ্ছেন, তিনি ঠিকঠাক পারবেন তো।

একটু দূরে মৃগাঙ্ক আয়েশ করে কাগজ পড়ছেন। উনিই ইচ্ছে করে তাঁকে ভয় দেখিয়েছেন। বলেছেন, সু, এই বেলা একটু পড়াশুনো করে নাও।

ওমা, কেন?

তোমাকে প্রশ্ন ধরতে পারে।

সুনয়নী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন। ওর গম্ভীর মুখের দিকে একপলক চেয়েছিলেন তিনি। মৃগাঙ্ক খুব সূক্ষ্ম রসিকতা করতে পারেন। সে রকম রসিকতা করছেন কি না, কে জানে? তিনি বলেছিলেন, ধুর, তুমি ভয় দেখাচ্ছ!

ভয় দেখাব কেন? সে দিন দেখলে না জিজ্ঞেস করল সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবির নাম কী? মৃগাঙ্ক বলেছিলেন।

হ্যাঁ, এ রকমই সব প্রশ্ন করে বটে, সুনয়নীর তা মনে পড়েছিল। দু’একটি অনুষ্ঠানে তাই দেখেছেন সুনয়নী। এক একটা প্রশ্ন কী সহজ, চট করে উত্তর মনে ভেসে আসে। সিনেমার প্রশ্ন হলে তো কথাই নেই, তিনি বলতে পারবেন সারাজীবন অনেক সিনেমা দেখেছেন তিনি। কিন্তু যদি অন্য রকম প্রশ্ন করে ওরা? ভাবতে সুনয়নীর ধুকপুকুনি বেড়ে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, শোনো, দীপুকে বলে ওদের আসতে বারণ করে দাও!

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সে কী কেন?

না বাপু আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। কী বলতে কী বলব।

ধুর, কী আর বলবে তুমি। মৃগাঙ্ক তাঁর কথা উড়িয়ে গিয়ে চোখ নাচিয়ে বলেছিলেন, তোমার রাঙাদির কাছে ফোন করে বরং টিপস নাও।

আবার ঠাট্টা। সুনয়নী মৃদু হেসেছিলেন। রাঙাদিকে একদম সহ্য করতে পারেন না মৃগাঙ্ক। রাঙাদি ফুরসত পেলেই ডায়লগ ঝাড়ে। মুখে শুধু ছেলেমেয়েদের কথা। বুবাই-বুকুন দু’জনেই জুয়েল। বুবাই ইঞ্জিনিয়ার, বুকুনও একটা বড় পোস্টে চাকরি করে। তা ও রকম ছেলেমেয়ে হলে তো মায়ের বলতে সাধ হবেই। তার ছেলে দীপুও ভাল চাকরি করে। সুনয়নী কি তা ভেবে সুখ পান না? মৃগাঙ্ককে বললে তিনি তর্ক জুড়বেন, বলবেন, আসল কথাটা তো ভুলেও বলবেন না রাঙাদি। বুবাইয়ের বউয়ের সঙ্গে যে এক ফোঁটা বনে না, সেটা জানতে কারও বাকি আছে? দেখো না, তোমায় কেমন তাতিয়ে যায়!

মৃগাঙ্কর অভিযোগ মিথ্যে নয়। রাঙাদি কখনও যদি আসেন, তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুনয়নীকে এমন প্রশ্ন করেন যে, তিনি বিব্রত বোধ করেন। রাঙাদি বলেন, হ্যাঁ রে, দীপুর বউ ম্যাক্সি পরে, তুই কিছু বলিস না?

ওমা, কেন কী বলব?

বাড়ির বউ ম্যাক্সি পরবে কেন? ছিঃ!

তোমার মেয়েও তো পরে দিদি। সুনয়নীর মুখে এসে গিয়েছিল কথাটা, কিন্তু তিনি তা বলেননি। রাঙাদি এর পর টুকটুক করে আরও অসংখ্য প্রশ্ন করবে। ওর মূল উদ্দেশ্য সুনয়নী জানেন। রাঙাদি তৃপ্ত হবেন তিনি যদি বউমার নামে নিন্দামন্দ করেন। কিন্তু তিনি বলবেন কী? আজ পর্যন্ত বউমার কোনও দোষ দেখতে পাননি সুনয়নী। অবন্তিকা ভারী ভাল মেয়ে, যেমন কাজের, তেমনই সবার উপর ওর সমান নজর।

এ জন্যই সুনয়নী চাপা অস্বস্তিতে রয়েছেন, যে কাজটা কোনও দিন করেননি, আজ তাই তিনি করবেন। মৃগাঙ্ককে তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ গো, বউমার নামে তো কিছু বলতে হবে। কী যে বলি?

মৃগাঙ্ক বলেছিলেন, কেন? বলবে বউমা খুব বাজে রাঁধে। রান্নায় নুন দিতে ভুলে যায়।

না বাপু, মিথ্যে কথা বলা আমার পোষাবে না।

বউমাকে না হয় জিজ্ঞেস করো কী বলবে। মৃগাঙ্ক বলেছিলেন।

ছিঃ, বউমাকে কি তা জিজ্ঞেস করা যায়? সুনয়নী মাথা নাড়িয়েছিলেন।

এখন টেনশন আরও বাড়ছে সুনয়নীর। মৃগাঙ্ক জানেন না ওর টেবিল থেকে গত কাল একটা কুইজের বই জোগাড় করেছেন। চোখ বোলাতে দোষ কী? বই উল্টেপাল্টে মাথায় আরও ঝিঁঝি ধরে গিয়েছে। এ সব খটোমটো প্রশ্ন কি ধরবে তাকে? বউমা তো এ দিক দিয়ে খুব চৌকশ, সে দিব্যি টকাটক উত্তর দেবে। সুনয়নী বিমনা হয়ে ভাবলেন।

ঘর থেকে দৌড়তে দৌড়তে গুড্ডু বেরিয়ে এল। সে মৃগাঙ্কর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সুনয়নী নাতিকে দেখে কাছে সরে এলেন, তার পর জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, তুই পড়তে বসিসনি।

আজ তো ছুটি আমার।

ছুটি? কেন? তোর মা কী করছে?

মা ঘরে পড়ছে।

পড়ছে? পড়ছে কেন?

আহা জানি না যেন। আজ তো তোমার আর মায়ের পরীক্ষা।

মৃগাঙ্ক কাগজটা এক পাশে মুড়ে রাখলেন, তার পর মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন তা, দাদুভাই, পরীক্ষার রেজাল্ট কী হবে?

জানি না। গুড্ডু মাথা নাড়িয়ে বলল।

তোমার কী ইচ্ছে?

গুড্ডু চোরাচোখে সুনয়নীকে দেখল। তার পর ফিসফিস স্বরে বলল, মা জিতবে।

সে কী দাদুভাই, ঠাম্মা হেরে যাবে?

বারে! ঠাম্মা তো রুপোর মেডেল দেবে বলেনি। মা বলেছে। গুড্ডু বলল।

ওর কথা শুনে মৃগাঙ্ক জোরে হেসে উঠলেন। সুনয়নী হাসতে চেষ্টা করলেন কিন্তু হাসি ফুটল না। ক্ষণিকের জন্য রুপোর মেডেল মাথায় ঘুরে গেল। টিভিতে তিনি দেখেছেন বিজয়ীর গলায় রুপোর মেডেল পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটুকু মেডেলে তার লোভ নেই, কিন্তু সবার সামনে গলায় মেডেল পরাবার আনন্দ কি কম? সুনয়নী ভাবেন।

দু’দিন আগে মজার ছলে মৃগাঙ্কর কথা মনে পড়ল তার। মৃগাঙ্ক বলেছিলেন, দীপু নাকি বউমাকে জেতানোর খুব চেষ্টা করছে। গত কাল নাকি সুরভি, চাঁদু, পলাশদের বাড়ি ঘুরে এসেছে।

সুনয়নী বলেছেন, ধুস!

এখন অল্প হলেও বুক ধড়ফড় করল সুনয়নীর। টিভি চ্যানেলের লোকেরা প্রথমে যাবে প্রতিবেশীদের বাড়ি। ওদের কাছ থেকে জানবে শাশুড়ি ও বউমা কে কেমন? দীপু গিয়ে যদি সত্যিই ওদের ম্যানেজ করে থাকে? সুনয়নী ভাবলেন তা। বিশ্বাস করা ভীষণ কঠিন। তবু ক্ষীণ সন্দেহ জাগে তাঁর মনে। গত দু’দিন দীপুর মুখটা খুব চাপচাপ লাগছে। কী যেন লুকিয়ে যাচ্ছে তাঁকে। উতলা হলেন সুনয়নী, মুখে অভিমানের ছায়া ঘনাল। ঠিক সে সময় তাঁর সুরভির কথা মনে পড়তে সুনয়নীর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

ক’দিন আগে সুরভি তাঁর কাছে এসে বলেছিল, মাসিমা, শাবল আছে তোমাদের? বাবা বাগান কোপাবে বলে চাইছে।

সুনয়নী খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। সুরভিরা মাঝেমধ্যেই এটা সেটা চায়, কিন্তু তাঁরা চাইলে হাত উপুড় করে না। শাবল থাকলেও চেপে গিয়ে সুনয়নী বলেছিলেন, ছিল তো রে, হারিয়ে গিয়েছে।

কাজটা খুব ভুল হয়ে গিয়েছে। সুনয়নী ঠোঁট কামড়ে ভাবেন। টিভি চ্যানেল সুরভিদের কাছে গেলে তিনি শূন্য পাবেন। এখন কি কোনও উপায় আছে? তিনি ভাবেন। গুড্ডু চলে যেতে তিনি আড়ষ্ট গলায় মৃগাঙ্ককে ডাকেন।

মৃগাঙ্ক তাঁর দিকে উৎসুক চোখে তাকান।

সুনয়নী চার পাশ সতর্ক চোখে তাকিয়ে নিচু স্বরে সমস্যা উগরে দিয়ে বললেন, আমি কি এক বার সুরভিদের বাড়ি যাব?

মৃগাঙ্ক জিজ্ঞেস করলেন, যাবে? মানে?

না মানে, ওদের যদি

শাবল-টাবল লাগে। কথা খুঁজে না পেয়ে সুনয়নী বললেন।

তার মানে তুমি ঘুষ দিতে চাও? অ্যাঁ! মৃগাঙ্ক সজোরে হাসতে শুরু করলেন।

আঃ! হাসছ কেন? চুপ করো।

মৃগাঙ্ক তবু হাসি থামাতে পারলেন না। সুনয়নী বিরক্ত হয়ে ওর কাছ থেকে সরে এলেন। ধুস! মানুষটাকে কোনও কাজে পাওয়া যায় না। তখনই তার অন্য একটা উপায় মনে হল। এখনও চ্যা নেলের লোক আসেনি, এর মধ্যে রাঙাদির সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়? যা ভাবা তাই কাজ, সুনয়নী ঘরে ঢুকলেন।

দুই

রাঙাদির খুরে খুরে প্রণাম। ক’মিনিটেই তাঁকে চাঙ্গা করে দিলেন তিনি। বললেন, এমা! তুই আগে বলিসনি কেন? আমি তো শাশুড়ি-বউয়ের প্রোগ্রামটা রোজ দেখি। আগে বললে তোকে আমি শিখিয়ে-পড়িয়ে দিতাম।

সুনয়নী বলেন, আমি যে কী বলি?

শোন, মাথা ঠান্ডা রাখ। সু, আমি খেয়াল করে দেখেছি, ছেলেগুলো সবাই বউকে সাপোর্ট করে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো। দীপুও তাই করছে।

সে তো করবেই। কিন্তু ঘাবড়ালে চলবে না। আদিখ্যেতা করে তুই আবার বউয়ের গুণগান করিস না। প্রশংসা করলেই হারবি।

হ্যাঁ, তাই তো।

সুতরাং তোকে বউমার খুব নিন্দা করতে হবে। যে যত বেশি নিন্দা করবে তার তত নম্বর।

সুনয়নী ধৈর্য হারিয়ে বলেন, ওটাই তো মুশকিল দিদি। কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।

কীসের মুশকিল? মাথা ঠান্ডা রাখ, দেখবি তোর বউমার অনেক দোষ আছে। রাঙাদি বললেন, তার পর জিজ্ঞেস করলেন, টিভি চ্যানেল কখন আসবে?

আসার তো কথা এখুনি।

এখনও তো আসেনি। ততক্ষণ তুই বউমার উপর নজর চালা, সকাল থেকে ভাব বউমা কী কী কাজ করেছে বা করেনি, তা হলেই দোষ পেয়ে যাবি।

অন্ধকারে আলো দেখতে পেয়েছেন সুনয়নী। রাঙাদির কথা মতো তিনি ভাবতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে অনেকগুলি পয়েন্ট জমে গিয়েছে তাঁর।

এক নম্বর, বউমা সাতটার পরে ঘুম থেকে উঠেছে। তার মানে বলা যেতে পারে বউমা লেট-রাইজার। অন্য দিনের কথা তিনি চেপে যাবেন।

দুই নম্বর, ডাইনিং টেবিলে এঁটো কাপ পড়ে আছে। বউমা অগোছালো তার প্রমাণ। অন্য দিনের কথা ভুলেও ভাববেন না তিনি।

তিন নম্বর, ঘর বন্ধ করে বসে থাকে। সেটা যে শুধু আজকের দিনের জন্য, তা বলবেন না সুনয়নী।

চার নম্বর, ছেলের পড়াশোনার দিকে নজর রাখে না বউমা। সেটাও আজকের সিদ্ধান্ত।

সুনয়নী আরও খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন। একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললেন তিনি। নিজের ওপর ভরসা জাগছে। মনে হচ্ছে তার পারফরম্যান্স খারাপ হবে না। রাঙাদির পুরো নম্বর মুখস্থ। পাঁচ নম্বর প্রতিবেশী, পাঁচ নম্বর ছেলে। দশ নম্বর কুইজ আর ঘটিবাটি খেলা। বাকি তিরিশ নম্বর নিজের হাতে। অল্প সময়ের মধ্যে নিন্দা করতে হবে। যত নিন্দা তত নম্বর। রাঙাদি বলেছেন, তুই তেড়েফুঁড়ে নিন্দা করলে পঁচিশ নম্বর পেয়ে যাবি। বাকিটা থেকে দশ। সব মিলিয়ে পঁয়ত্রিশ। ব্যস, রুপোর মেডেল তোর গলায়।

বউমা যদি আমার চেয়ে বেশি পায়। সংশয় মাখা স্বরে সুনয়নী জিজ্ঞেস করেছেন।

না রে, তোর বউমা আর যা-ই হোক ভীষণ লাজুক। ও তোর নামে নিন্দা করবেই না। রাঙাদি বলেছিলেন।

বারান্দায় এখন বউমাকে দেখলেন সুনয়নী। ঝলমলে পোশাকে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। খুব সুন্দর দেখতে লাগছে ওকে। কিছু একটা বলতে গিয়েও সুনয়নী চুপ করে গেলেন। তিনি খেয়াল করলেন বউমা তাকে লক্ষই করছে না। অন্য দিন সাজগোজ করলে বউমা তাকে দেখিয়ে যায়।

সুনয়নী আরও একটা পয়েন্ট পেলেন। এটা বলা যাবে বউমার ভদ্রতা জ্ঞান নেই। ঠোঁটে হাসি ফুটল সুনয়নীর।

তিন

সন্ধেবেলায় ঘরে চুপচাপ বসে রইলেন সুনয়নী। মৃগাঙ্ক এক মনে ক্রিকেট দেখছেন। তাকে এক বার জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী গো, দেখবে নাকি।

সুনয়নী বলেছেন, না।

আসলে তাঁর এখন কিছুই ভাল লাগছে না। আজ যে কাণ্ড হল তার পর তিনি কোন মুখে টিভি দেখবেন। রিলেটিভরা খবর পেয়ে খুব হাসাহাসি করছে। রাঙাদি ঠিক হুল ফুটিয়ে বলেছে, অ! টিভি চ্যানেল আসেনি? ওরা তো সব বেছেবুছে যায়। তাই বোধ

হয় আসেনি।

শোনার পর সুনয়নীর মুখ নিমেষে কালো হয়ে গিয়েছিল। কেউ বিশ্বাস করছে না তাদের বাড়িতে টিভি চ্যানেল আসবার কথা ছিল।

দীপু যখন জানাল, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তিনি বলেছিলেন, অ্যাঁ, বলিস কী?

হ্যাঁ, মা ওরা ফোন করে বলল, আসতে পারছি না। কবে আসবে তাও

ঠিক নেই।

যাহ!

মৃগাঙ্ককে খেয়াল করলেন সুনয়নী। কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। শুধু এক বার হালকা স্বরে বলেছেন, আসেনি ভালই হয়েছে, সু! নইলে তোমার ও বউমার মধ্যে ঝগড়া লেগে যেত।

সুনয়নী অস্বীকার করতে চেয়েছেন তা। ওর কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন ধুস, ওটা তো খেলা!

খেলা না যুদ্ধ?

সুনয়নী জবাব দেননি। সকালবেলার অধ্যায়টা এখন অতীত। আবার আগের মতোই ভাবছেন তিনি। এই তো একটু আগেই তিনি বউমার সঙ্গে গল্পগুজব করলেন। মৃগাঙ্ককে প্রকাশ্যে না বললেও মনে মনে ওর কথা তিনি সমর্থন করেছেন। তারও মনে হয়েছে টিভি চ্যানেল না এসে ভালই হয়েছে। তাকে বউমা সম্পর্কে আর নিন্দা করতে হচ্ছে না।

যা তিনি সারাদিন ভেবেছেন বউমা শুনলে কান লাল হয়ে যেত। ভেবে সুনয়নীর নিজের উপর ধিক্কার জাগল। উফ, খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছেন তিনি। এ যাত্রায় গুরুদেব তাকে রক্ষা করেছেন। গুরুদেবকে স্মরণ করে প্রণাম ঠুকলেন সুনয়নী।

ঠাম্মা?

গুড্ডু দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুনয়নী স্নেহমাখা স্বরে ডাকলেন, আয় দাদু।

না যাব না।

ওমা! আসবি না কেন?

তুমি আমার মাকে মারো কেন?

আমি? সুনয়নী অবাক, কিছুটা অপ্রস্তুত। এমা! তোর মাকে আমি মারব কেন?

সে আমি কী জানি? মা তো মাসিকে ফোন করে বলছিল।

ফোন করে?

হ্যাঁ। মা বলছিল তুমি খুব কুঁড়ে, মাকে খুব খাটাও। আরও কী সব বলতে যাচ্ছিল গুড্ডু তার আগেই বউমা হাজির হল। ছেলের মুখ চেপে সে বলল, এই কী সব বলছিস তুই?

বারে! তুমিই তো মাসিকে বলছিল যে টিভিতে এ সব বলব।

এক মারব থাপ্পড়। চুপ। বলে বউমা সুনয়নীর দিকে তাকায়, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। ও বানাচ্ছে মা!

কে বানিয়েছিল তা পলকে বুঝে যান সুনয়নী। বোনের কাছ থেকে বউমা টিপস নিয়েছিল। টিভিতে সে উজাড় করে বলত। ভেবে শিউরে ওঠেন সুনয়নী। তিনি ভুলে যান রাঙাদির সঙ্গে তার গল্পগুজবের কথা। এই প্রথম তিনি বউমার সত্যি সত্যি দোষ দেখতে পান।

সুনয়নী বাঁকা স্বরে বলেন, বাচ্চারা এ সব বানাতে পারে না বউমা!

১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ রবিবার ২৭ মে ২০১২


আপনার মতামত লিখুন :

One response to “দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘সুখ-অসুখের ঘরে’”

  1. mahua meel says:

    পড়লাম।ভালো লাগলো।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন