নদিয়ার করিমপুর থেকে প্রকাশিত ”দর্পণ…মুখের খোঁজে” সাহিত্য পত্রিকার সর্বশেষ প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা ‘হাট’। পত্রিকাটির সম্পাদক কবি, প্রাবন্ধিক তথা শিক্ষক দেবজ্যোতি কর্মকার। দাদা নিজে এসে সৌজন্য সংখ্যা তুলে দিলেন আমার হাতে। তারজন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। এটি ২০তম বর্ষ ও ৫০তম বিশেষ সংখ্যা। প্রকাশ ডিসেম্বর, ২০২২। প্রথমেই মন ভালো করা একটা প্রচ্ছদ, যাতে বাংলার চিরায়ত হাটুরে জীবনের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। প্রচ্ছদ শিল্পী বিশ্বভারতীর সুতনু চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদকীয়তে সম্পাদক লিখছেন —
“…পঞ্চাশতম প্রকাশের মাইল ফলক স্পর্শ করার এই সংখ্যার বিষয় ভাবনা ‘হাট’। হাট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেকটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি।
এ সংখ্যায় এমন কিছু বিষয় উঠে এলো যা শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, গবেষণার ক্ষেত্রেও নতুন দিশা দেখাবে।বাংলা সাহিত্যে ‘হাট’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে অসংখ্যবার।কবিতায়,গানে কিম্বা গল্প প্রবন্ধে ‘হাট’ প্রসঙ্গ এসেছে ঘুরে ফিরে।লিটল ম্যাগাজিনের একটি বৃহৎ আকারের সংখ্যাতেও হাট নিয়ে অসাধারণ কাজ হয়েছে।তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে আবারও ‘হাট’ নিয়ে সংখ্যা কেন?”
এর উত্তর সম্পাদক নিজেই দিয়েছেন সম্পাদকীয়র পরবর্তী স্তবকে —
“আসলে, আমরা অনুভব করেছি এখনও কিছু বাকি আছে। এর পরও বাকি থাকবে জানি। যে সব আলোচনা এখানে সংকলিত হল তা পূর্বে প্রায় হয়নি বললেই চলে। হাট নিয়ে যেমন তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ আছে, তেমনই কিছু কবিতায় ‘হাট’ উঠে এসেছে একটি বৃহৎ আকাশের মতো। অপরিসীম এই ভাবনার স্রোত চিরকালীন গানের সুরটি বেঁধে নিলাম আমরা হাটের পসরা, হাটের রূপান্তর নতুন করে ভাবিয়েছে আমাদের। এটাও একটা কারণ। হাটের ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে সে চিন্তাও হয়েছে বারবার। সব মিলিয়ে অনিবার্যতার হাটের ভিড়ে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যেই এ সংখ্যার ভাবনা।”
প্রথমেই রয়েছে ‘একজন হাটের কবি’-র সাক্ষাৎকার। আপনারা কখনও কি শুনেছেন হাটে কবিতা বিক্রির কথা? আমরা বই এর হাটের কথা জানি, গরুর হাটের কথা জানি, তাঁতের শাড়ির হাটের কথাও জানি, কিন্তু কবিতা? আজ্ঞে হ্যাঁ। হাটে কবিতাও বিক্রি হয়। এমনই এক হাটের কবির সন্ধান পেয়েছেন ‘দর্পণ…মুখের খোঁজে’ সাহিত্য পত্রিকা। তাঁর নাম সেখ আরেজুল্লা। তাঁর বাড়ি নদিয়ার করিমপুরের নিকটবর্তী জয়রামপুরে। তাঁর কাজ কবিতা ছেপে হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা। তাঁর কথাতেই উঠে আসে নস্টালজিক সেসব মুহূর্ত।
“হাটে আমার লেখা কবিতা ছেপে নিয়ে যাই। সবাই যেমন নানা পসরা নিয়ে হাটে বসেন, আমি কিন্তু কবিতা নিয়ে বসি। কবিতাই আমার পসরা। আর সঙ্গী একটা মাইক্রোফোন, বাক্স আর ব্যাটারি। ছাপানো কবিতা হাটের এক কোণে বসে পাঠ করি। তাতে অনেকেই এসে শোনেন। পয়সা দেন। আমি তাদের আমার ছাপানো কবিতা দিই। বিনামূল্যে আজও কাউকে কবিতা দিই নি। এভাবেই যা আয় হয় তাতেই যথেষ্ট মনে হয়েছে।” একসময় তিনি করিমপুর-সহ নাজিরপুর, বেতাই, জলঙ্গি, সুন্দলপুর প্রভৃতি হাটে আসতেন, ছাপা কবিতা বিক্রি করতে। কিন্তু আজ সমস্তটাই অতীত। তাঁর লেখা সব কবিতাই নাকও গীতিকবিতা। সুর করে কবিতা পাঠ করেন। সেই মোহেই সকলে হাটে এসে তাঁর কবিতা পড়া শোনেন মুগ্ধ হয়ে আর কবিতা কিনে নিয়ে যান ভালোবেসে। তাঁর কবিতা পড়া আমি শুনেছি ‘দর্পণের’ একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে। নজরুল ইসলাম কিম্বা জসীমউদ্দিনের কবিতা আমরা সকলেই পড়েছি। তাঁদের কবিতায় গীতিকাব্যের ঝংকার শুনে আমরা মোহিত হই। মনে পড়ে একবার পল্লিকবি জসীমউদ্দিনের “সোজন বাদিয়ার ঘাট” পড়তে পড়তে এত ভালো লেগে গেল যে একাসনে বসে পুরো কাব্যগ্রন্থটাই গোগ্রাসে গিলেছিলাম। আর আরেকবার সেখ আরেজুল্লার কবিতা পাঠ শুনে অবাক হলাম। তিনি বলছেন — “আসলে আমার সব কবিতাই গীতিকবিতা। আদতে আমি একজন গীতিকবি। অনেকেই বলেন, আমি নাকি এই মুহূর্তে বাংলার শেষ জীবিত গীতিকবি। জানি না এই তথ্য সত্য কিনা। তো সুর করে আমার লেখা কবিতাগুলো শুনিয়েই অর্থ রোজগার আমার।”
এ বিষয়টি সত্যিই অভিনব। তারপর এক এক করে হাট বিষয়ক প্রবন্ধের ডালি সাজিয়ে হাজির হয়েছেন রত্না রশিদ ব্যানার্জি, গৌর শংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যুৎ হালদার, তুষার কান্তি রায়, নরেশ মন্ডল, সুপ্রতিম কর্মকার, শ্রীপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায়, জনসন সন্দীপ থেকে শুরু করে একাধিক প্রাবন্ধিক।
হাট জনসংযোগ ও মানুষে মানুষে মিলনের একটা মাধ্যম। প্রত্যহ মানুষ একাকী। তার এই একাকিত্বের জীবনে সপ্তাহে একদিন বা দুদিন খুশির আবহ তৈরি করে হাট। চারপাশের দু-চার গ্রামের মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, গল্পগুজব হয়, চলে আমোদ-ফূর্তি। আর এই নির্মল আনন্দ এইসব খেটে-খুটে খাওয়া মানুষগুলো সকলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়। সেই সঙ্গে প্রাবন্ধিকদের লেখায় উঠে এসেছে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে হাটের প্রসঙ্গ। হাটের পসরা নিয়ে হাটুরিয়ারা হাটে আসে। তাদের কেনাবেচা,দর কষাকষি, হট্টগোল হাটের মাঝে মিলিয়ে যায়। তাদের জীবনযাত্রা, সুখ-দুঃখের কাহিনীও আমরা জানতে পারব এই সংখ্যাটি পাঠ করলেই। হৈমন্তী ভট্টাচার্য তাঁর ‘বিকিকিনির হাটঃ দ্রব্য যখন ব্যতিক্রমী’ প্রবন্ধে লিখছেন —
“হাট ক্রেতা বিক্রেতার মিলন ক্ষেত্র। তবে এ যেন চিরস্থায়ী বন্ধন নয়। ক্ষণিকের দেখাশোনা, পণ্যের আদান-প্রদান, হাসির বিনিময়। তারপর ভাঙা হাট। টিমটিম করে জ্বলা সন্ধ্যাতারা শূন্য মাঠের দিকে চেয়ে থাকে নীরবে। জীবননাট্য শেষে যেমন পড়ে থাকে না কিছুই, তেমনই শূন্যতা নিয়ে হু হু করে বয়ে চলে বাতাস” —
“বেচাকেনা সেরে বিকেলবেলায়
যে যাহার সবে ঘরে ফিরে যায়;
বকের পাখায় আলোক লুকায় ছাড়িয়ে পূবের মাঠ;
দূরে দূরে গ্রামে জ্বলে উঠে দ্বীপ…
আঁধারেতে থাকে হাট।”
—’হাট’, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।
তারপরেই আছে হাট বিষয়ক কবিতা — ‘কবিতার হাটে’। সুবোধ সরকার, শ্যামল কান্তি দাস, তন্ময় চক্রবর্তী, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভঙ্কর দাস, কনিষ্ক দেওঘরিয়া, মধুমিতা রায়, সুপর্ণা কর্মকার, প্রসাদ কুমার নন্দী-সহ একাধিক কবিরা কবিতার ডালি সাজিয়ে নিয়ে হাজির হয়েছেন।
তারপর রয়েছে ‘ছড়ার হাটে’। নবনীতা বসু হক, প্রাণনাথ শেঠ, স্বপন মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর দেবনাথ, অমৃতাভ দে, চিন্ময় মন্ডল, জীবানন্দ শীলের অসাধারণ কিছু ছড়া। গল্পের ডালি নিয়ে হাজির হয়েছেন শান্তনু দে, তপন তরফদার, সৌরভ হোসেন ও সুব্রত পাল। এছাড়াও ‘অন্যান্য কবিতা’-র পাতায় রয়েছে জয় গোস্বামীর মতো কবির কবিতা। তাছাড়া তুষার ভট্টাচার্য, রুদ্র শংকর, শ্যামশ্রী রায় কর্মকার, অদিতি বসু রায়, দেবাশীষ চন্দ, বিনয় কর্মকার, দীন মহম্মদ সেখ, গৌতম সাহা, সায়ন্তনী ভট্টাচার্য, রাসরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, মিজানুর রহমান, নীলাদ্রি শঙ্কর মুখোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কবিদের কবিতাও ছাপা হয়েছে পত্রিকাটির পাতায়।
সব শেষে রয়েছে ”একটি হাটের জন্মকথা : করিমপুর হাটঘর”-এর ইতিবৃত্ত। সবমিলিয়ে অসাধারণ একটা সংখ্যা। উঠতি গবেষকদের বিশেষভাবে কাজে দেবে এই সংখ্যা। যদি কোনো পাঠক সংগ্রহ করতে চান সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। পড়ে দেখুন অসাধারণ একটা সংখ্যা। মূল্য ছাড় দিয়ে ১০০ টাকা। আশা করি আপনার টাকা বিফলে যাবে না।
প্রসেনজিৎ দাস, বেতাই, নদিয়া।