লোকসভা নির্বাচনের ফলফল নিয়ে যেদিন (৪ জুন) গোটা দেশের মানুষ ব্যস্ত ঠিক সেদিনই ভবিষ্যতের চিকিৎসকদের পরীক্ষার ফলাফল (ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট) সংক্ষেপে নিট-এর ফল প্রকাশ করে এনটিএ। দেখা গেল, এ বারের পরীক্ষায় মোট ৬৭ জন প্রথম হয়েছেন। অর্থাৎ, তাঁদের সকলের অল ইন্ডিয়া র্যাঙ্ক ১। যা এই পরীক্ষার ইতিহাসে প্রথম। ফলাফলে বিরাট ধাক্কা লাগে কারণ, গত দু’বছরের নিটের ফলাফলে প্রথম স্থান পেয়েছিলেন দুই থেকে তিন জন। সেখানে এই বারে একসঙ্গে ৬৭ জন। কেবলমাত্র প্রথম হওয়াই নয়, ৬৭ জনই ৭২০-র মধ্যে পেয়েছেন ৭২০। তার মানে প্রথম স্থানাধিকারী ৬৭ জনই একটি প্রশ্নের উত্তরও ভুল না করে ১০০ শতাংশ নম্বরই পেয়েছেন।
প্রসঙ্গত, জাতীয় টেস্টিং এজেন্সি বা এনটিএ প্রতি বছর দেশ জুড়ে যাদের ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা তাদের জন্য নিট পরীক্ষার আয়োজন করে। দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার পরই ছাত্রছাত্রীরা এই পরীক্ষায় বসার সুযোগ পান। ছাত্রছাত্রীরা এই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে দেশের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানগুলিতে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। গত ৫ মে দেশের ৫৭১টি শহরে নিট হয়েছিল। দেশের বাইরেও ১৪টি পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়। সারা দেশে ৭০০-র বেশি মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানে এক লক্ষের বেশি শূন্যপদ পূরণের লক্ষ্যে এই পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়ার আশায় ২৪ লক্ষ পরীক্ষার্থী নিট দিয়েছিল। তবে এবার পরীক্ষা শুরুর আগে থেকেই অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল যা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে ফল প্রকাশের পর। বহু জায়গায় পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা রাস্তায় নামেন, আদালতে একাধিক মামলা হয়। এমনকি পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার দাবিও ওঠে।
এবার নিট নিয়ে পরীক্ষার দু-দিন আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এমনকি প্রশ্নের ছবিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল। যদিও ন্যাশানাল টেস্টিং এজেন্সি ভাইরাল হওয়ার বিষয়টিকে অসম্ভব বললেও বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই ধরনের অন্তত তিনটে খবর প্রকাশিত হয়। তার থেকেও বড় কথা বিহারের ইকোনমিক অফেন্স ইউনিট পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক-সহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ ৫০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে এক একটি প্রশ্ন পত্র কেনাবেচা হয়েছে। নিট নিয়ে এবার বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘গ্রেস মার্কস’। যা দেওয়া হয়েছে ১,৫৬৩ জন পরীক্ষার্থীকে। কিন্তু কি কারণে ওই বাড়তি নম্বর দেওয়া হয়েছে এবং কত করে নাম্বার দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়টিও স্পষ্ট নয়।
আরও একটি অভিযোগ হল, পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি ও ছত্তিসগড়ের কিছু পরীক্ষার্থী হাইকোর্টে এক আবেদনে বলেন যে পরীক্ষা হলে বিভিন্ন কারণে তাদের সময় নষ্ট হয়েছে। কীভাবে সময় নষ্ট? তাদের ভুল প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছে। কেউ অভিযোগ করেছেন দেরিতে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে এনটিএ ২০১৮ সালের সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায়কে মাপকাঠি মেনে ওই পরীক্ষার্থীদের গ্রেস মার্কস দেয়। অন্যদিকে ফিজিক্সওয়ালা নামে এক শিক্ষা পোর্টালের অলখ পান্ডে আদালতে অভিযোগ করেছেন এই পরীক্ষার্থীদের গড়ে ৮০-১০০ নাম্বার গ্রেস দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সম্পূর্ণ মেধা তালিকাটাই বদলে গিয়েছে। তবে এনটিএ গ্রেস দেওয়ার কথা স্বীকার করলেও কত নাম্বার সে বিষয়ে মুখ খোলেনি।
এরপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, নিট কী পাশফেলের পরীক্ষা? তাহলে এই ধরনের কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় গ্রেস নম্বরের প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? স্বভাবতই বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে বিচারক জানিয়ে দিয়েছেন গ্রেস নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীদের ফের পরীক্ষা দিতে হবে। অথবা গ্রেস নম্বর বাদ দিয়ে তাদের আবার মেরিট লিস্ট প্রকাশ করতে হবে। আদালতের রায়ের পরও বলতে হবে ডাক্তারি কোর্সে ভর্তির সর্বভারতীয় অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা ও তার ফল প্রকাশের মধ্য দিয়ে যে দুর্নীতি হয়েছে তা এ যাবৎকালের পরীক্ষা কেলেঙ্কারির মধ্যে সর্ববৃহৎ। ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় দুর্নীতি দূর করার নাম করে ২০১৩ সালে অভিন্ন নিট পরীক্ষা চালু করা হয়। সে দিন রাজ্যে রাজ্যে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় দুর্নীতির অজুহাত দেখিয়েই এই পরীক্ষার কেন্দ্রীকরণ করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে তৈরি করা এনটিএ–র পরিচালনাতেই এই পরীক্ষা ব্যবস্থা চলছে।
শিক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতি এদেশে নতুন কথা নয়, বরং এটা আমাদের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। কারণ, আমরা মেডিকেল পরীক্ষা নিয়ে মধ্যপ্রদেশে ব্যাপক দুর্নীতি দেখেছি, উত্তরপ্রদেশ সাম্প্রতিক সময়ে চাকরি সংক্রান্ত পিএসসি পরীক্ষা দুর্নীতির কারণে বাতিল হয়েছে, বাংলায় স্কুল শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে স্কুল সার্ভিস কমিশনের সীমাহীন দুর্নীতি আজকে এই বাংলার শিক্ষাব্যবস্থাকে কতটা সংকটে ফেলেছে সেটাও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। সেই ধারাবাহিকতারই একটি অংশ হল ন্যাশানাল এলিজিবিলিটি কাম এনট্রান্স টেস্ট বা নিট-এর পরীক্ষা কেলেঙ্কারি। কেবল একটা পার্থক্য দেখা যাচ্ছে, এসএসসি পরীক্ষায় দুর্নীতি নিয়ে যে গণরোষ প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল, নিটের বেলায় তার সিকিভাগ এখনও দেখা যাচ্ছে না।