হিন্দুশাস্ত্রে অমাবস্যা তিথি বিশেষ ধর্মীয় তাৎপর্য বহন করে। চলতি বছরে (২০২৫ সালে) যে কয়টি অমাবস্যা তিথি রয়েছে, তারমধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তিথি হল চৈত্র অমাবস্যা। এই চৈত্র মাসের অমাবস্যা তিথিকে ‘দর্শন অমাবস্যা’ও বলা হয়। এই অমাবস্যা সম্পন্ন হলেই শুরু হয়ে যাবে চৈত্র নবরাত্রি।
অমাবস্যায় পবিত্র যে কোন নদীতে স্নান করা শুভ। এই দিনে, পূর্বপুরুষের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেকেই পিতৃতর্পণ এবং স্নান ও দান করে থাকেন। বিশ্বাস করা হয় যে পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ পেতে অমাবস্যার পূজা করা গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসে চৈত্র মাসের অমাবস্যা তিথি নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, এখানে জেনে নিন ২৮ না ২৯ মার্চ চৈত্র অমাবস্যা কখন পালিত হবে এবং স্নান ও দান করার জন্য কোন সময়টি শুভ।
পঞ্জিকা অনুসারে, চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথি ২৮ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ মিনিটে শুরু হবে এবং এই তিথি পরের দিন অর্থাৎ ২৯ মার্চ বিকেল ৪টে ২৭ মিনিটে শেষ হবে। এমন পরিস্থিতিতে ২৯ মার্চ শনিবার অমাবস্যা পালিত হবে। যেহেতু এটি শনিবার পড়ে তাই একে শনিশ্চরি অমাবস্যা বা শনি অমাবস্যাও বলা হয়।
চৈত্র অমাবস্যায় স্নান ও দানের শুভ সময় ২৯ মার্চ শনিবার পড়ছে। সেদিন ভোর ৪ টা ৪২ মিনিটে থেকে ভোর ৫ টা ২৯ মিনিট পর্যন্ত রয়েছে স্নান ও দানের শুভ সময়। এরপর অভিজিৎ মুহুর্ত হবে দুপুর ১২ টা ১৯ মিনিট থেকে দুপুর ১টা ০৮ মিনিট পর্যন্ত। এছাড়া সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত স্নান করা যায়। চৈত্র অমাবস্যায় স্নানের পাশাপাশি পিতৃশ্রাদ্ধ বা পূর্ব পুরুষদের প্রতি বিশেষ পুজো নিবেদন করা যেতে পারে।
এই বিশেষ তিথির অমাবস্যায় অনেকেই বাড়িতে প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকেন। এই দিনে পিতৃদেবকে প্রসন্ন করতে বাড়ির মূল দরজায় প্রদীপ রাখা হয়ে থাকে। মনে করা হয়, মূল দরজার সামনে প্রদীপ রাখলে মালক্ষ্মী সন্তুষ্ট হন এবং বাড়ির দক্ষিণে প্রদীপ রাখলে পিতৃপুরুষ সন্তুষ্ট হন। অমাবস্যায় শনিদেবের পূজা করা যায়। শনি ঢাইয়া এবং শনির সাড়ে সতী থেকে মুক্তি পেতে সন্ধ্যায় শনিদেবের মন্দিরে সরিষার তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে অনেকেই পুজো করে থাকেন।
শনি অমাবস্যায় পিতৃদোষ শান্তি মন্ত্র :
তর্পণ করার সময় ওম পিতৃভ্যঃ স্বধায়িভ্যঃ স্বাহা মন্ত্রটি ১১ বা ২১ বার জপ করুন।
এই তিথিতে শনির প্রকোপ থেকে মুক্তি পেতে বজরংবলীর পুজো করুন। শনি অমাবস্যায় হনুমান চালিসা, বজরংবাণ, সুন্দর কাণ্ড পাঠ করতে পারেন। আবার এ দিন অশ্বত্থ গাছের তলায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করলে ও শনি মন্ত্র জপ করলে শনির উগ্র প্রভাব শান্ত করা যায়।
এই তিথিতে ওম শং শনৈশ্চরায় মন্ত্রটি অবশ্যই জপ করবেন। এ ছাড়াও ছায়াদান করতে পারেন। এর ফলে শনি দোষ দূর হয়।
এই বিশেষ তিথিতে দান করলে, বিশেষ করে দুঃস্থদের দান করলে বা ব্রাহ্মণদের দান করলে তা শুভ ফল দিতে পারে বলে মনে করা হয়। এ ছাড়াও জীবজন্তু ও পক্ষীকেও খাওয়ার খাওয়ানোর প্রথা রয়েছে। এর ফলে পিতৃ দোষ দূর হয়। উল্লেখ্য শনি কর্মের দেবতা। এই তিথিতে শ্রদ্ধা-ভক্তি সহ দান-পুণ্য ও পিতৃ পুজো করালে শনি দোষ শান্ত হয়।
এমন দিনে, কলহ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন শাস্ত্রজ্ঞরা। চৈত্র অমাবস্যার দিন কোনও নতুন কাজ শুরু করতে বারণ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অমাবস্যা তিথিতে আত্ম-আত্মনিরীক্ষণ, উপাসনা এবং আপনার অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করার উপর মনোনিবেশ করুন। ১০৮ বার গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করে দিন শুরু করুন। এরপর, সূর্য ও তুলসীকে জল অর্পণ করুন, একটি গরুকে খাওয়ান এবং শিব লিঙ্গে পবিত্র জল ঢালুন। একটি অশ্বত্থ গাছের নীচে তুলসী পাতা রাখতে পারেন এবং দই, দুধ এবং ফুলের মতো বিভিন্ন জিনিস অর্পণ করতে পারেন।
শনিবার চৈত্র অমাবস্যায় খণ্ডগ্রাস সূর্যগ্রহণ হবে। যদিও ভারতবর্ষ থেকে এই গ্রহণ দেখা যাবে না। আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ, এবং রাশিয়ার উত্তর অঞ্চল থেকে এই গ্রহণ দেখতে পাওয়া যাবে।
যাঁরা আমাবস্যা তিথি পালন করবেন সেদিন তারা ফুলকপি, বাঁধাকপি, বিট, গাজর, মাশরুম, মুসুরডাল, সজনেডাঁটা খাবেন না৷ এই তিথিতে গ্রহণ করতে পারেন পটল, ঝিঙে, মিষ্টি কুমড়ো, চালকুমড়ো, করলা, কাঁচকলা, ঢেঁড়শ, চিচিঙ্গা, কচুজাতীয় সবজি,ওল, মানের মতো সবজি ৷আপনার পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে ঘরে তৈরি পুরি, সবজি এবং ক্ষীরের মতো খাবার অর্পণ করুন এবং পরে এগুলি প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করুন। আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্য মৌন ব্রত পালন করার কথা বিবেচনা করুন।
অমাবস্যা মানে অমাবস্যা তিথি। সংস্কৃত ভাষায়, এর অনুবাদ নিম্নরূপ: “অ” অর্থ “উপস্থিত নয়” বা “অনুপস্থিত”, সংস্কৃত ভাষায় “ম” হল চাঁদের আরেকটি শব্দ, এবং “বাস্য”/”বাস” এর অর্থ “পরিহিত” বা “বাস করা”। সব মিলিয়ে, আমরা “অমাবস্যা” শব্দটি পাই , যার মোটামুটি অর্থ যেদিন আকাশে কোন চাঁদ বাস করেনা।
সংস্কৃতে ‘দর্শন’ শব্দের অর্থ ‘দেখা’’। এই তিথিকে দর্শন অমাবস্যা বলার পিছনে বিশ্বাস হল, এই দিনে আত্মদর্শন এবং আত্মশুদ্ধির একটি বিশেষ যোগ তৈরি হয়। আত্মার গভীরে তাকানোর, নিজের দোষ সংশোধন করার এবং নতুন করে শুরু করার জন্য এই দিনটিকে সর্বোত্তম বলে মনে করা হয়।
পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, এই দিনে দেবতারা বিশেষভাবে খুশি হন এবং ব্যক্তিকে তার পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ প্রদান করেন। যারা এই দিনে উপবাস করেন এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে পূজা করেন, তারা সুখ, সমৃদ্ধি এবং শান্তি পান।
জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে, অমাবস্যা হল চন্দ্রের অন্তর্ধানের দিন। এর ফলে মানসিক চাপ, নেতিবাচক শক্তি এবং অশুভ শক্তির প্রভাব বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে দর্শন অমাবস্যায় উপবাস এবং সাধনা মনকে শক্তিশালী করে এবং নেতিবাচকতা দূর করে।
প্রতি মাসে পড়া অমাবস্যা তিথি কেবল আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি পূর্বপুরুষদের শান্তি, দান এবং আত্মশুদ্ধির জন্যও একটি চমৎকার সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হয়। এরকম একটি বিশেষ অমাবস্যা হল চৈত্র অমাবস্যা; এই দিনে গঙ্গায় স্নান, শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান এবং ঈশ্বরের উপাসনা কেবল সাধকদের পুণ্যই দেয় না, বরং জীবনে ইতিবাচক শক্তিও নিয়ে আসে।
তথ্যঋণ: হিন্দুস্থান টাইমস, জাগরণ ও অন্যান্য।