এর আগে শাসকদল ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তা নিয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েন দেখা গিয়েছিল। রাজ্য সংগীত হিসেবে তাঁরা নির্বাচন করেছিলেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’কে। তা নিয়েও বিতর্ক ছিল। এবার পয়লা বৈশাখ থেকে তাঁরা বাঙালিয়ানা ও বাঙালির অস্মিতা তুলে ধরার উপরে জোর দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্তর থেকে জেলা ও ব্লক স্তর পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, তার লোকজ সংস্কৃতিকে তাঁরা প্রচার করতে চান। বহিরাগত সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে চান জনমত।
বিরোধীরা এর পেছনে রাজনীতির গন্ধ পেয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য ২০২৬-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। বাঙালির আবেগকে আকর্ষণ করে ভোটের বাক্স ভরিয়ে তুলতে চান তাঁরা। এই অভিযোগকে একেবারে অমূলক বলতে পারি না। কারণ এখানকার সব কিছুর পেছনে থেকে যায় রাজনৈতিক অভিপ্রায়।
কিন্তু বাঙালিয়ানা বা বাঙালি অস্মিতার প্রচারটা যে জরুরি, মুক্তবুদ্ধির মানুষ সে কথা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। স্বীকার করবেন যে আজ বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি বিপন্নপ্রায়। বহিরাগত সংস্কৃতি যে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা একটু খোলা চোখে দেখলেই বোঝা যায়। ছটপুজো, গণেশপুজো, ধনতেরাস, গর্বাচভ এসবের প্রাবল্য বেড়েছে, ঘটা করে অস্ত্রহাতে নিয়ে পালিত হচ্ছে রামনবমী ; এখানকার কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসগুলিতে চাকুরির সূত্রে যাঁরা আসছেন তাঁদের ৯০ ভাগ অবাঙালি এবং তাঁরা শুধু হিন্দিতেই কথোপথন করেন।
চাপিয়ে দেওয়া যেমন হয়, তেমনি আমাদের প্রশাসক, শিক্ষিত মানুষ, গণমাধ্যমের অসচেতনতার ফলে বাংলা ভাষা ও বাঙালির ঐতিহ্য ক্রমশ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। যানবাহনের মাথার ওপরে, দোকানের সাইনবোর্ডে বাংলা লেখা চোখে পড়ে না। তরুণ শিক্ষার্থীর বাংলা না বলাটাকে প্রশ্রয় দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন অভিভাবকেরা। গণমাধ্যমে চর্চা হয় খিচুঢ়ি বাংলাভাষার। ভিন্ন প্রদেশবাসী যে সব মানুষ বাংলায় বাস করেন, তাঁদের বাংলা শেখা ও বাংলা বলার কোন বাধ্যবাধকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় না। এমন কি আমাদের অনৈক্যের সুযোগে তাঁরা বাংলা ও বাঙালিকে অপদস্ত করে বসেন। বড়বাজার প্রভৃতি অঞ্চলে সে অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে।
এ কথা ঠিক যে শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারের একটা নিবিড় যোগ আছে। একদা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালের সূত্রপাতে বাংলা-সহ প্রাচ্য ভাষা শেখার জন্য ইংরেজরা কলকাতায় যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ খুলেছিলেন তার পেছনে ছিল বাণিজ্যের তাগিদ। বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কারণেই জন্ম হয়েছে বাংলা গদ্যভাষার। কালক্রমে শিল্প-বাণিজ্যে নিদারুণ অধঃপতন হয়েছে বাঙালির। জীবিকার প্রয়োজনে শিক্ষিত বাঙালি ছেলেকে চলে যেতে হচ্ছে ভিন্ন প্রদেশে। শিল্প-বাণিজ্যে বাংলাকে উন্নত করার আন্দোলন করুন। রাজনৈতিক অভিসন্ধি বাদ দিয়ে সে আন্দোলন পরিচালিত হলে, নিশ্চয়ই তা সাফাল্য লাভ করবে।
কিন্তু একই সঙ্গে স্মরণ করুন বাঙালি জাতিসত্তাকে। স্মরণ করুন তার গৌরব ও ঐতিহ্যকে। জন্ম-মৃত্যু-শেষকৃত্য-বিবাহের আচারানুষ্ঠান-যৌন আচরণ-রক্ত ও আত্মীয় সম্পর্ক-খাদ্যাভ্যাস ও রন্ধনপ্রণালী-বংশগণনা-খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতি-লোককথা-লোকবিশ্বাস-সামাজিক সংস্কার-ধর্মীয় চিন্তাচেতনা-স্থাপত্য ও ভাস্কর্য এবং ভাষা নিয়ে তৈরি হয়েছে বাঙালি জাতিসত্তা। আমাদের এই শেকড়কে উপেক্ষা বা অস্বীকার করলে নিজেদেরকে ছিন্নমূল করা হবে। মনে রাখতে হবে বাঙালি তার দেহসৌষ্টবে ও সংস্কৃতিতে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভাজন রেখার আদর্শ মিশ্রিত রূপটি বহন করে চলেছে ; বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিশে আছে ককেশীয়, মোঙ্গলীয়, নিগ্রো, মেলানেশীয়, খমের, অস্ট্রলয়েড নরগোষ্ঠীর রক্ত। বাঙালির উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতার কারণ হিসেবে এই রক্ত সংমিশ্রণের কথা বলা যায়। মানব প্রজ্ঞার বিবিধ ক্ষেত্রে বাঙালির অতুলনীয় অবদান। সম্ভবত ভারতের অন্য কোন প্রদেশে এত মনীষীর আবির্ভাব ঘটে নি। এসবইতো বাঙালি অস্মিতার উপাদান উপকরণ। বাংলার নতুন প্রজন্মকে সেই ঐতিহ্য সম্বন্ধে সচেতন করার ক্রমাগত প্রচার দরকার।
রাজনৈতিক ছুৎমার্গ বিসর্জন দিয়ে বাংলার সমস্ত রাজনৈতিক কারবারী, বাঙালি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত মানুষ, শাসক ও বিরোধী সকলেই যদি এই প্রচারে আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করেন, তাহলেই কাজের কাজ হবে।
২০২৫ নববর্ষ বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত