শুক্রবার | ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১১:৪৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (তৃতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় নানা পরিচয়ে গৌরী আইয়ুব : গোলাম মুরশিদ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় কেন বারবার মণিপুরে আগুন জ্বলে আর রক্ত ঝড়ে : তপন মল্লিক চৌধুরী শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (শেষ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (প্রথম পর্ব) : অভিজিৎ রায় শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (ষষ্ঠ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (শেষ পর্ব) : বিজয়া দেব শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (পঞ্চম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ? : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (চতুর্থ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার শতবর্ষে সঙ্গীতের ‘জাদুকর’ সলিল চৌধুরী : সন্দীপন বিশ্বাস সাজানো বাগান, প্রায় পঞ্চাশ : অমর মিত্র শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (তৃতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (একাদশ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার খাদ্যদ্রব্যের লাগামছাড়া দামে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের : তপন মল্লিক চৌধুরী মিয়ানমারের সীমান্ত ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্যোগ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (দ্বিতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (দশম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার বুদ্ধদেব গুহ-র ছোটগল্প ‘পহেলি পেয়ার’ ‘দক্ষিণী’ সংবর্ধনা জানাল সাইকেলদাদা ক্যানসারজয়ীকে : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (প্রথম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (নবম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘তোমার নাম’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (অষ্টম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘হাওয়া-বদল’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (সপ্তম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার প্রবোধিনী একাদশী ও হলদিয়ায় ইসকন মন্দির : রিঙ্কি সামন্ত সেনিয়া-মাইহার ঘরানার শুদ্ধতম প্রতিনিধি অন্নপূর্ণা খাঁ : আবদুশ শাকুর
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বঙ্গের শক্তি-পূজা : সুখেন্দু হীরা

সুখেন্দু হীরা / ১৪৬ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সৃষ্টির শুরুতে সভ্যতা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। এই মাতৃ প্রাধান্যের অর্থ এই নয় যে, পুরুষের চেয়ে নারী বলবান ছিল বা নারীর শৌর্য-বীর্য অধিক ছিল। এর কারণ ছিল সন্তান একমাত্র মাকেই চিনত, মা-ই ছিল তার একমাত্র আশ্রয় বা অবলম্বন। পারিবারিক বন্ধনের মূল যে প্রেম, স্নেহ প্রভৃতি হৃদয় বৃত্তির প্রকাশ সে একমাত্র মায়ের মধ্যে দেখতে পেত। তাই মা-ই ছিল পরিবারের কেন্দ্রে।

তখন মানুষ ‘মানব শিশু’র জন্ম রহস্য জানত না। কেমন করে নারীর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে একটি নতুন জীবন, তা সে বুঝতে পারত না। আদিম মানুষ মনে করত সন্তানের জন্ম দেওয়া রহস্যময়ী দৈবশক্তি বা দেবতার কাজ। তাঁরা বিশ্বাস করত নারীর মধ্যে সেই শক্তি বা দেবী আছেন। কারণ সে লক্ষ্য করেছিল সমস্ত স্ত্রীজাতীয় জীবরাই সন্তানের জন্ম দেয়। তাই সে মনে করত নারীর মধ্যে যে শক্তি বা দেবতা আছেন, তিনি হলেন মাতৃদেবতা। এজন্য বিশেষজ্ঞরা বলেন মানুষের আদি-দেবতা মাতৃদেবতা।

পৃথিবীর মাটিতে শস্য উৎপন্ন হয় অর্থাৎ মাটি ফল-ফলাদি, শস্য-ফসলাদি জন্ম দেয়। তাই পৃথিবীও নারী। সেই ফসল খেয়ে আমরা প্রাণ ধারণ করি তাই পৃথিবী বা মাটি আমাদের মা। তাই পৃথিবীও মাতৃদেবতা। এই ফসল আমাদের শক্তি দেয় তাই পৃথিবীও শক্তিদায়িনী। তাই কৃষি সভ্যতার সূচনা থেকেই পৃথিবী নারী দেবতা হিসেবে পূজিতা।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে মাতৃদেবতার প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পাতে। সিন্ধু সভ্যতার এই নিদর্শনে অনেক পোড়ামাটির নগ্ননারী মূর্তি পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন এগুলি মাতৃদেবতা।

ভারতের প্রথম ধর্মসাহিত্য বেদ। তাতে পৃথিবী মাতৃ দেবীরূপে বর্ণিত। এছাড়া অনেক নারী দেবতার উল্লেখ আছে বেদে। বেদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ঋকবেদ। ঋকবেদে অদিতি ও দিতি উল্লেখ আছে। অদিতি অখণ্ড বা সীমাহীন বিশ্ব এবং দিতি খণ্ড অর্থাৎ সীমাযুক্ত বিশ্ব। অথর্ববেদের তৈত্তিরীয় সংহিতায় অদিতিকে পৃথিবীর সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে। ঐতরের ব্রাহ্মণে পৃথিবীকে ‘শ্রী’ বলা হয়েছে। পরবর্তীকালের কতগুলি উপনিষদের মধ্যে পৃথিবীকে শস্য ও সম্পদের দেবী ‘শ্রী’ বা ‘লক্ষ্মী’র সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে।

বাজসেনেয় সংহিতায় ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে রুদ্র-ভগিনী অম্বিকার উল্লেখ পাই। তৈত্তিরীয় অরণ্যকে আবার অম্বিকাকে রুদ্র পত্নী বলা হয়েছে। কাঠক-সংহিতায় অম্বিকাকে শরৎ বলা হয়েছে। বলা হয় এই শরৎ রূপিণী অম্বিকার পূজা হল শারদীয়া পূজা।

এ প্রসঙ্গে ঋকবেদে রাত্রিসূক্তে বর্ণিত রাত্রি দেবীর নাম গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মের ব্যাখ্যাকারগণ বলেন, বেদের রাত্রি দেবী পরবর্তীকালে পুরাণে কালীদেবীতে পরিণত হয়েছেন।

পুরাণে নারী দেবতার অভাব নেই। ঋকবেদের অদিতি ও দিতি পুরাণের কালে যথাক্রমে দেবতাদের ও দৈত্যদের মাতা। ‘শ্রী’ পুরাণে লক্ষ্মী, তিনি শস্য ও সম্পদের দেবী। রুদ্র পত্নী বা ভগ্নি অম্বিকা পুরাণে মহাদেবের পত্নী দেবী দুর্গা।

পুরাণে যতই একাধিক দেবীর উল্লেখ থাকুক না কেন পুরাণের মধ্যে একটা বার্তা পরিষ্কার — এনারা বহু নন, স্থান-কাল-পাত্র অনুসারে আকৃতি ও প্রকৃতিতে পৃথক পৃথক বহু রূপ হলেও এনারা মূলত এক। সকলেই সনাতনী মহাদেবী থেকেই সকল দেবী প্রসৃতা।

যেমন বেদে সরস্বতী মূলত নদী, পরে নদী অধিষ্ঠাত্রী দেবী, আরও পরে জ্ঞান চর্চার দেবী। পুরাণে সরস্বতী বাগদেবী এবং প্রধানত ব্রহ্মার পত্নী; কোথাও কোথাও বিষ্ণুপত্নী। এক সময় সরস্বতী দেবী দেবগনকে এড়ানোর জন্য সিংহরূপ ধারণ করেন। এজন্য তিনি সিংহবাহনা। সিংহবাহনা সরস্বতী মূর্তি অনেক পাওয়া গিয়েছে। তাই কেউ কেউ মনে করেন সরস্বতীর সিংহ বাহন থেকে পরবর্তীকালে মহাদেবী সিংহবাহনা হয়েছিল।

পুরাণ মতে সিংহবাহিনী দুর্গা আদ্যাশক্তি মহামায়া। তন্ত্রসাধকেরা আদ্যাশক্তিকে দশমহাবিদ্যা বলে উপাসনা করেন। মহাবিদ্যাগুলি হলেন কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। অর্থাৎ কালী হলেন দশমহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা। ইনিও মহাদেবের স্ত্রী।  উপপুরাণ গুলিতে কালী ও পার্বতী অভিন্না। অর্থাৎ দূর্গা ও কালী উভয়ই শক্তির রূপ।

শক্তি শব্দের আক্ষরিক অর্থ বল, পরাক্রম, সামর্থ্য, ক্ষমতা ইত্যাদি। আবার স্ত্রী দেবতাদের শক্তি বলা হয়। তাই স্ত্রী দেবতার পূজাকে বলা হয় শক্তি পূজা। আদিম মানুষ প্রকৃতির শক্তিকে ভয় পেত ও শ্রদ্ধা করত। তখন মানুষ প্রকৃতির পূজা করত। তাই সেই অর্থে প্রকৃতি পূজাও শক্তি পূজা। কিন্তু সাধারণভাবে শক্তি পূজা বলতে নারী দেবতা বা মাতৃ দেবতার পূজাকে বুঝি। প্রচলিত অর্থে আদ্যাশক্তি মহামায়ার পূজাকে শক্তিপূজা বলা হয়। এজন্য দুর্গা ও কালীপূজাকে জনসাধারণ শক্তিপূজা বলেন।

স্ত্রীদেবতাদের শক্তি বলার পিছনে সর্বজন বিদিত পৌরাণিক আখ্যান আছে। ব্রহ্মাসহ অন্যান্য দেবতাদের নিজ নিজ শক্তি আছে। প্রয়োজন মত এরা দেব তেজ থেকে উদ্ভুত হয়ে নিজ নিজ দেবগনকে সাহায্য করেন। মহিষাসুর বধের সময় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকে নির্গত সমবেত তেজ রাশি থেকে দুর্গা আবির্ভূত হন। আবার শুম্ভ-নিশুম্ভের সঙ্গে কৌষিকী ও কালীর যুদ্ধের সময় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শংকর ও কার্তিকের শরীর থেকে পৃথক পৃথক শক্তিগণ আবির্ভূত হয়ে যুদ্ধ করেন।

বেদ আর্যদের সৃষ্টি। বিশেষজ্ঞরা বলেন আর্যরা আসার আগে অনার্য ভারতে একাধিক লৌকিক দেবীর অস্তিত্ব ছিল। সেই সব লৌকিক দেবীদের নিজেদের অধিকারে নেওয়ার প্রচেষ্টা আর্যরা বরাবর করে গেছেন। তাঁরা এই সব লৌকিক দেব-দেবীর ওপর বৈদিক বা পৌরাণিক দেবত্ব আরোপ করেছেন। বলেছেন লৌকিক দেবীরা আসলে মহাদেবীর অংশ। বর্তমানে অনার্য বংশোদ্ভূত জনজাতি সমাজ বহুলাংশে এই তত্ত্ব মেনেও নিয়েছেন।

‘বহুর মধ্যে এক’-এই তত্ত্বে যতই মহানতা বা উদারতা থাক না কেন, এর পেছনে আর্যদের বা পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্যবাদের একটি অভিসন্ধি কাজ করেছে। তা হল লৌকিক দেবতাদের স্থলে নিজেদের দেবতাদের স্থান দেওয়া। ভালো দিক হিসেবে বলা যেতে পারে, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ভারতীয় উপমহাদেশে ৫১ পীঠের কথা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন ৫১টি সতী পীঠের দেবী মূলত লৌকিক দেবী। ‘দক্ষযজ্ঞ ও সতীর দেহত্যাগ’ এই পৌরাণিক আখ্যার মাধ্যমে সেই লৌকিক দেবীদের পৌরাণিক দেবী পদে উন্নীত করা হয়েছে। এই উন্নয়নের প্রচেষ্টা এখনও বর্তমান। গ্রাম বাংলায় ঘুরলে দেখা যায় বেশিরভাগ লৌকিক দেব-দেবীর পূজার ভার ব্রাহ্মণদের হাতে চলে এসেছে। লৌকিকদেবীকে মহামায়া বা দুর্গার রূপ বলে প্রচারিত। কিছু দিন আগে পর্যন্ত এইসব দেব-দেবীর পূজার ভার ছিল স্থানীয় অনার্য শ্রেণীর বাসিন্দাদের হাতে।

সনাতনী ভারতে পাঁচ রকম ধর্মমত প্রচারিত ছিল। গণেশের উপাসকরা ছিলেন গাণপত্য, সূর্যের উপাসকরা ছিলেন সৌর, বিষ্ণুর উপাসকরা ছিলেন বৈষ্ণব, শিবের উপাসকরা ছিল শৈব এবং শক্তির উপাসকরা ছিল শাক্ত। পরবর্তী কালে বৃহৎ হিন্দু জাতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই পঞ্চমত বা পঞ্চশাখাকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা হয়। অষ্টম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য একসঙ্গে পঞ্চদেবতার পূজা চালু করেন। আজও হিন্দু ধর্মে কোনও পূজা বা শুভকার্যের আগে গণেশ পূজা করা হয়।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর পূর্ব ভারতে স্বাধীন গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যার অধিপতি ছিলেন শশাঙ্ক (রাজত্বকাল ৫৯৩-৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ)। শশাঙ্ককে বলা যায় বৃহৎ বঙ্গের প্রথম ঐতিহাসিক রাজা। তিনি ছিলেন শৈব। পাল রাজারা (৭৫০-১১৭৪ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন বৌদ্ধ। আর সেন রাজত্বকালে (১০৭০–১২০১ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় বৈষ্ণবধর্ম পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। তুর্কি আক্রমণের (১২০১ খ্রিস্টাব্দ) পর দুশো বছর বাংলায় কোনও সাহিত্যচর্চার নিদর্শন নেই। তাই ধর্মীয় সাধনার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। তারপর আবার বাংলার মুসলিম শাসকদের অনুপ্রেরণার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ–১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ) আবির্ভাব বঙ্গে বৈষ্ণবধর্মের ভরা গাঙে জোয়ার আনে। বলা হয় চৈতন্য প্রভাবেই বাংলায় সৃষ্টি হয় কীর্তন। চৈতন্য পরবর্তীকালে নানা জমিদার, ভূস্বামী এবং স্থানীয় রাজারা বৈষ্ণবধর্মের অনুরাগী হয়ে বৈষ্ণবপদাবলী ও কীর্তনের প্রচার, প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।

ষোড়শ শতাব্দী থেকে বাংলায় মঙ্গলকাব্য বিস্তার লাভ করেছিল। মঙ্গলকাব্যের মাধ্যমে বাংলার লৌকিক দেবীরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। কিছু পৌরাণিক দেবী বাংলার ঘরের মেয়ে হয়ে উঠেছিলেন। তবুও মঙ্গলকাব্যের শাক্ত দেবীরা বাংলায় সর্বজন প্রিয় হননি। কারণ মঙ্গলকাব্যের দেবীরা ছিলেন প্রতিষ্ঠালোভী, ঈর্ষাকাতর, কোপন স্বভাবের। ভক্তের কাছ থেকে পূজা আদায়ের জন্য ভক্তকে বিপদে ফেলেছেন (মনসামঙ্গল), সামান্য শাঁখার জন্য স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করেছেন (শিবায়ন)। অবৈধ কামনা পরিপূর্ণ করার জন্য উপর থেকে ভক্তকে সিঁদকাঠি ফেলে দিয়েছেন (বিদ্যাসুন্দর/কালিকামঙ্গল)। বলা হয় মঙ্গলকাব্যের দেবীদের আদর্শ ছিল অনুন্নত।

শক্তি-পূজা বাঙালির মধ্যে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়েছিল খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতক থেকে। এর অন্যতম কারণ হিসাবে বলা যায় মুসলিম শাসনে ধর্মমতের ওপর আঘাত। আর শাক্তসংগীত বা শাক্তপদাবলীর আবির্ভাব হল অষ্টাদশ শতাব্দীতে।

এই সময় কিছু রাজন্য বর্গের আনুকুল্য পেয়েছিল শাক্ত ধর্মমত। যেমন মোগল রাজত্বকালে বাংলার বারো ভুঁইঞাদের মধ্যে কেদার রায়, চাঁদ রায়, প্রতাপাদিত্য ছিলেন শক্তির উপাসক। কিন্তু অনেক রাজ-রাজারা শক্তি সাধনার নামে পঞ্চ-মকার তত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। পঞ্চ-মকার তত্ত্ব বলতে মদ, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন-এর সাহায্যে সাধনা। সেটা জনসাধারণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।

এর আগেই বঙ্গে কালীপূজার প্রচলন ছিল। আমরা আজ যে কালী প্রতিমা দেখি তা প্রকাশ করেছিলেন নবদ্বীপের বিখ্যাত শাক্তসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের সমসাময়িক। তার আগে মায়ের কোনও মূর্তি ছিল না। তখন ঘটে কালীপূজা হত।

সেন রাজত্বকালে ছিলেন শাক্তসাধক ব্রহ্মানন্দ, পূর্ণানন্দ স্বামী, মেহারের সর্বানন্দ ঠাকুর । তাঁরা রচনা করেছেন- শাক্তানন্দ, তরঙ্গিনী, শ্রীতত্ত্ব চিন্তামণি ইত্যাদি বিখ্যাত বিখ্যাত তান্ত্রিক গ্রন্থ। আগমবাগীশ রচনা করেছিলেন বিখ্যাত তান্ত্রিক গ্রন্থ তন্ত্রসার। কিন্তু এই সব গুলি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত। এই জন্য সেগুলি জনসাধারণের মধ্যে খুব বেশি জনপ্রিয় হয়নি।

মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব (১৬১৮–১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ) -এর মৃত্যুর পর সারা ভারতবর্ষের রাষ্ট্রতন্ত্রে সার্বিক ক্ষয় হয়। সুদৃঢ় কেন্দ্রীয় শাসনের অভাবে আঞ্চলিক রাজারা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। বাংলায় হাঙ্গামা করে বর্গীরা। তারপর মগ, ফিরিঙ্গি, পর্তুগিজ ও হার্মাদ জলদস্যুদের অত্যাচার, সবশেষে ইংরাজ বণিকদের রাজদণ্ড গ্রহণ। অষ্টাদশ শতাব্দীর এই অস্থির সময়গুলিতে বাঙালির নিরিবিলি, শান্ত পারিবারিক ও সমাজ জীবনে বিরাট আঘাত লাগে।

রাষ্ট্রীয় এই অব্যবস্থার যুগে অত্যাচার ও অবিচার থেকে রক্ষা পেতে বাঙালি একটি বরাভয়দায়ী আশ্রয় খুঁজছিল। যেখানে প্রেম আছে, কিন্তু ব্যভিচার নেই, ভক্তি আছে, কিন্তু দুর্বলতা নেই। সেই ধর্ম আধ্যাত্মিক আরাম দেবে, আবার সেই সঙ্গে সঙ্গে লড়াই করার শক্তি যোগাবে।

তখন জনসাধারণ শক্তি-পূজার শরণ নিল। শক্তি-সাধকেরা উপলব্ধি করলেন মাতৃপূজা করতে হবে ভক্তি দিয়ে। বিশেজ্ঞরা বলেন এই ভক্তি দিয়ে পূজা হল বৈষ্ণব প্রভাব। সেটা অস্বাভাবিক নয়, কারণ দীর্ঘ ৬০০ বছর বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব ছিল বঙ্গদেশে।

শাক্তসাধকরা রচনা করলেন মানুষের সহজবোধ্য শাক্তসংগীত। এই শাক্তসংগীত শাক্তধর্ম প্রসারে বিরাট ভূমিকা নিয়ে ছিল। এই সাধকগণ শৈব, গাণপত্য, শাক্ত, সৌর ও বৈষ্ণব ভক্তদের একত্ব করলেন। তাঁদের গানে সমন্বয়ের বাণী ঘোষিত হল। এছাড়া শাক্তসংগীতে গৃহত্যাগের কোনও কথা নেই। শাক্তসাধকেরা প্রায় সকলেই গৃহী ছিলেন। পলায়নের মনোবৃত্তিতে নয়, দুঃখকে জয় করার জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। এর জন্য সাধককে আত্মস্থ হতে হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, বামাক্ষ্যাপা ও ঋষি অরবিন্দ প্রভৃতি শাক্ত সাধকেরা বাংলায় শাক্তধর্মকে এক বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন।

বঙ্গে প্রধান দুই শক্তি-পূজা হল শারদীয়া দুর্গাপুজা ও কালীপূজা। বঙ্গে শারদোৎসবের যে মাতামাতি, তার পিছনে আছে কবি কৃত্তিবাসের অবদান। তিনি প্রায় ৫০০ বছর আগে বাংলায় যে রামায়ণ লিখেছিলেন বা অনুবাদ করেছিলেন, তাতে শরৎকালে অকালবোধনের কথা লিখেছিলেন। বঙ্গদেশে বসন্তকালে দুর্গাপুজো প্রচলিত ছিল বা আছে। যা এখন বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত।

অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে কলকাতা ও কলকাতার চারপাশে তথাকথিত পশ্চিমবঙ্গে শারদীয়া দুর্গাপূজা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একটা কারণ অবশ্যই সেই অস্থির সময়ে বাঙালি বরাভয়দাত্রী আদ্যাশক্তি মহামায়া চরণে আশ্রয় নিয়েছিল। তাছাড়া তৎকালীন বেশীর ভাগ রাজা বা জমিদার চৈতন্য প্রভাবের ফলে ছিলেন বৈষ্ণবধর্মাবলম্বী। আর প্রজারা প্রধানত ছিলেন শাক্ত। প্রজানুরঞ্জনের জন্য তাঁরা দুর্গাপূজা করতেন।

শুধু প্রজানুরঞ্জন নয় দেশীয় জমিদার, কলকাতার বাবুরা ইংরেজদের মনোরঞ্জনের জন্য দুর্গাপূজা করতেন। তাতে থাকত খানাপিনা, নাচ-গান, অঢেল ফুর্তির ব্যবস্থা। ব্রিটিশরাজ তুষ্টির জন্য ধনাঢ্য ব্যক্তিরা যেমন দুর্গাপূজাকে বেছে নিয়েছিলেন তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য সর্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন। মূলত দেবী দুর্গাকে মাথায় রেখেই বিপ্লবীরা দেশমাতা বা ভারতমাতা কল্পনা করেছিলেন।

যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এখন রাজবাড়ির প্রাঙ্গণ ও বনেদি পরিবারের দুর্গাদালান থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গাপূজা আজ সর্বজনীন। যদিও প্রথম বারোয়ারি পূজা হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে (১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে) হুগলির গুপ্তিপাড়ায়। আজ প্রধান প্রধান দুর্গাপূজা সবই বারোয়ারি বা সর্বজনীন। তা সত্ত্বেও আজ পারিবারিক দূর্গা পূজার সংখ্যা কম নয়। বারোয়ারী পূজার নবতম সংযোজন শহর ও শহরতলীতে ছোট বড় আবাসনে দুর্গাপূজা।

বাংলায় দেখা যায় শরৎকাল থেকে প্রধান প্রধান দেবী পূজা শুরু, বসন্তকালে শেষ। প্রথমে দুর্গাপূজা, তারপরে লক্ষ্মী, তারপর কালী, জগদ্ধাত্রী, সরস্বতী, বাসন্তী পূজা এবং শেষে অন্নপূর্ণা পূজা।

এছাড়া আছে আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত গ্রাম বাংলার বিভিন্ন গ্রামে মনসা পূজা। তবে মনসা পূজার জনপ্রিয় দিন শ্রাবণ সংক্রান্তি। দশহরা তিথিতেও মনসা পূজা হতে দেখা যায়। আবার দশহরা ও মকর সংক্রান্তিতে হয় গঙ্গাপূজা। শীতলা ও চণ্ডী লৌকিক দেবী হিসাবে গ্রাম বাংলায় বিভিন্ন সময় পূজা হয়। তবে গ্রীষ্মকালে এই দুই পূজা হতে বেশি দেখা যায়। কারণ গরমে পানীয় জলের অভাবে রোগের প্রাদুর্ভাব ও মহামারী বাড়ত, তাই মানুষ রোগ-ভোগ থেকে বাঁচতে এই সময় পূজার জন্য বেছে নিয়েছিল। এই কারণে গরমকালে (ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস) রক্ষাকালী পূজা হতে দেখা যায়। শাস্ত্রে  মহামারী প্রতিরোধে কালী পূজার নিদান দেওয়া হয়েছে। সেটাই রক্ষাকালী পূজা বলে খ্যাত।

রক্ষাকালী পূজার মতন ফাল্গুন থেকে জৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত প্রতি শনিবার হাওড়া ও মেদিনীপুর (পূর্ব ও পশ্চিম) জেলায় কোনও না কোনও গ্রামে হয় কালী পূজা। পূজা ও মেলা পুরোটা রাত্রিকালীন। সূর্যাস্তের পর বানানো হয় কালী প্রতিমা। তারপর পূজা এবং সূর্যোদয়ের আগে বিসর্জন। এই পূজা গুলি অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেরা করে থাকেন। সারাদিন তাদের কায়িক পরিশ্রম করতে হয়, রাতের বিশ্রামের সময়টা বেছে নিয়েছেন দেবীর আরাধনার জন্য।

পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যা দিক থেকে সবচেয়ে অধিক হয় কালী পূজা। সারা বছর ধরে কালী পূজা হতে দেখা যায়। প্রাধান্য থাকে শনি, মঙ্গলবার ও অমাবস্যাতে। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কার্তিক অমাবস্যায় শ্যামা পূজা। এছাড়া জ্যৈষ্ঠ মাসে অমাবস্যায় হয় ফলহারিনী কালীপূজা, মাঘ মাসে কৃষ্ণ চতুর্দশীতে হয় রটন্তী কালীপূজা।

সারা বাংলা জুড়ে মকর সংক্রান্তি ও পয়লা মাঘ বেশিরভাগ লৌকিক দেবীর পূজা হয়। অতীতে পয়লা মাঘে বছর শুরু হত। তাই বছরের শুরুতে বা শেষে জনসাধারণ তাদের আরাধ্য লৌকিক দেবতার আরাধনা করতেন। সেই প্রথা এখনও বহমান।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাঝেও পশ্চিমবঙ্গে শক্তি-পূজা ভীষণ জনপ্রিয়। সমাজের নারীর অবস্থান যাই হোক না কেন, মাতৃ-পূজা বা শক্তি-পূজার কোনও খামতি নেই। তা তিনি লৌকিক দেবীই হন বা পৌরাণিক দেবীই হন।

তথ্যঋণ :

১. শাস্ত্রমূলক ভারতীয় শক্তিসাধনা (প্রথম খন্ড): উপেন্দ্রকুমার দাস — রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার।

২. ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য: শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত — সাহিত্য সংসদ।

৩. শাক্তপদাবলী ও শক্তিসাধনা: শ্রীজাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী — ডি.এম. লাইব্রেরি।

৪. বৃহৎবঙ্গ (প্রথম খণ্ড): দীনেশচন্দ্র সেন — দে’জ পাবলিশিং।

৫. পৌরাণিক অভিধান : সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত — এম.সি. সরকার এন্ড সন্স প্রা: লি:

৬. বাঙ্গালা ভাষার অভিধান: শ্রী জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস সংকলিত ও সম্পাদিত-দি ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস

৭. ক্ষেত্র সমীক্ষা

পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন