এখন চারিদিকে শুধু কুম্ভ… আর মহাকুম্ভ!
এই বিষয় নিয়ে এখন বাজার-হাট গরম। নানা আলোচনা, চর্চা হয়েই চলেছে। সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘটে চলেছে একাধিক ঘটনা…দুর্ঘটনা!
সবাই প্রায় ছুটে চলেছে একই উদ্দেশ্যে — শুধু একটি বার পূর্ণকুম্ভে ডুব দেওয়া! দাতা গ্রহীতা সবাই একই সুরে গান গাইছে। তাল না মেলালেই সেই বিখ্যাত লাইন.. ‘পিছিয়ে পড়তে হবে!’ — কি জবাব দেব, ওপরে গিয়ে?
আমার এখন এই বয়সে এসে তীর্থস্থানে যাবার কথা শুনলেই অন্তরে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। কারণ একাধিক। সংসারের জাগতিক চচ্চড়ি তো আছেই, এছাড়া কেন জানি ওই সব আধ্যাত্মিক স্থানে গেলে আমার দুবলা হৃদয়ে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। ঘর-সংসারের কথা একপ্রকার ভুলেই যাই! একেই কি মায়ার খেলা বলে! জানিনা। তবে ঘরে ফিরে এসে মহামায়ার কাছে সব হিসেবই কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে দিতে হয়!
সত্যি করে বলতে কি, এবার কিন্তু আমি কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারলাম না। আমাদের এলাকারই বন্ধুসম জুনিয়র ছেলে এবং ফিল্ম এডিটর কোরককে বলেছিলাম, এই যাত্রায় যেতে রাজি কিনা! আমার মধ্যে বেচাল কিছু দেখলে, অন্তত সামাল দিয়ে দেবে!
যথারীতি কোরককে সঙ্গে নিয়ে গত সপ্তাহে ব্যাগপত্র সমেত কলকাতার চিনা বন্ধুদের সঙ্গে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়েই বসলাম। কপালে যা হয় দেখা যাবে। মহিলা পুরুষ মিলে মোট ১৩ জন মেম্বার।
প্রতি বছর কলকাতায় চিনা নববর্ষ পালন করার পরেই টেরিটি বাজারের কয়েকজন বন্ধুরা বৌদ্ধগয়ায় যায়। আমাকে প্রতিবারই যাবার জন্য বলে। নানা কারণে হয়ে আর ওঠে না। যদিও ওঁরা ফিরে এসে নানা গল্পগাছা করে আমায় প্ররোচিত করে চলে…। ইয়ং তো হেসে বলে ওঠে, ‘আরে হামারা সাথ একবার চলো না.. কৌই খরচা নেঁহী হোগা। ভিয়েতনামী গেস্ট হাউজ মেঁ রাহেগা…! খুব আচ্ছা জায়গা। থাকা খাওয়া সব ফ্রী!’
এত বার ধরে বলে যাচ্ছে, তাই এবার রাজিই হয়ে গেলাম। দু তিন দিনের তো ব্যাপার। কত আর না করা যায়!
যথারীতি পরের দিন ভোরের দিকেই গয়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। চায়ের গুমটিতে উপচে পড়া ভীড়। স্ট্যান্ডে দরদাম করে দুটি বড় সাইজের অটোরিকশায় সবাই মিলে চেপে বসি। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় রেশ বেশ ভালোই লাগছে। ট্রেনের ঝিমুনিটা উধাও হয়ে গেল। মাঝেমধ্যে গ্রামের ভেতর দিয়ে যাবার সময় সকালের আলোর ছটায় ক্ষেতের ভরা ফসল এবং প্রকৃতির নানা দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে যাচ্ছিলাম। গ্রামের মানুষজন রোজকার সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে। আমাদের অটোরিক্সা এগিয়ে চলে।
বিহার রাজ্যের গয়া জেলার একটি ছোট শহর এই বুদ্ধগয়া। অধুনা ফল্গু নদীর তীরে এবং গয়া রেল স্টেশন থেকে ১৫ কিলোমিটার এর মতো দূরে অবস্থিত। স্টেশন থেকে রিজার্ভ অটোরিকশায় ২৫০ টাকার মতো ভাড়া। ৮-৯ জন যেতে পারে। শেয়ারে ৩০ টাকার মতো দিতে হয়।
আমাদের গন্তব্য বুদ্ধগয়ার ভিয়েতনামের মন্দির তথা গেস্ট হাউজ।
যথারীতি ৩০-৩৫ মিনিট বাদে আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্য ভিয়েতনামী গেস্ট হাউসে গিয়ে উঠলাম। মালপত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকে বেশ অবাকই হলাম। এতোটা আশা করিনি — বিশাল এক গেস্ট হাউস। অসাধারণ তার ব্যবস্থা। তারা মার্কা হোটেলের মতো লাগছে। আমরা ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট-এর জন্য বেসমেন্টে থাকা ডাইনিং এলাকায় গেলাম। আরো অবাক — একসঙ্গে প্রায় ৫০০ লোক বসে খাবার ব্যবস্থা আছে। নানা দেশের লোকজন আসা যাওয়া করছে, কিন্তু উচ্চস্বরে কোন কথাবার্তা নেই। স্যুপ সমেত একাধিক ভিয়েতনামী পদ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। তেল মশলা ছাড়াও দারুণ স্বাদ। এই সমগ্র কর্মকাণ্ডটি প্রায় নিঃশব্দে পরিচালনা করছেন ভিয়েতনাম থেকে আসা দু-জন মুণ্ডিতমস্তক নান বা সন্ন্যাসিনী। এখানে সব কাজ হয় ঘড়ি ধরে।
সকাল ৬.৩০ টায় ব্রেকফাস্ট শুরু হয়ে যায়। তবে এখানে একটাই চাপ আমার কাছে, ডিনার শুরু বিকেল ৫টা থেকে। তবে রাত্রে যদি কারো খিদে পায় ডাইনিং হলে সব ব্যবস্থাই রাখা থাকে। ইচ্ছে মতো নিয়ে নিলেই হবে। এখানে টাকা পয়সার কোন বিষয় নেই। ইচ্ছে হলে কেউ যাবার সময় কিছু ডোনেশন দিতে পারে। সেটা ওঁনারা গ্রহণ করে থাকেন।
আমাদের প্রাথমিক কাজকর্ম মিটে গেলে মিনিট ৫-৭ দূরত্বে থাকা মূল মন্দিরের দিকে রওনা দিলাম। দু-পা যাবার পরেই প্রধান রাস্তায় উঠে গেলাম। রাস্তায় দু’ধারে নানা ধরনের স্টল সুসংগঠিত ভাবে দৃশ্যমান, বিক্রিবাটায় ব্যস্ত। বেশিরভাগ বিক্রেতারা দেখলাম তিব্বতি লোকজন। নানা ধরন ও বিষয়ের আকর্ষণীয় সব হ্যান্ডিক্রাফট বিক্রির জন্য রাখা আছে। কিছু ফুলের দোকানও দেখলাম। বিভিন্ন দেশের লামা ও তীর্থযাত্রীরা পরিচ্ছন্ন পোশাকে মঠের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। বেশ একটা শান্ত-সৌম্য ভাব গম্ভীর পরিবেশ। দু-একজন স্থানীয় হকারকে দেখলাম ডলার-পাউন্ড ভাঙ্গানোর খদ্দের খুঁজতে ব্যস্ত।
গেটের বাইরে মোবাইল, জুতো জমা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। কোন টাকা পয়সা লাগে না। তবে ক্যামেরা ভেতরে নিয়ে যাবার জন্য ১০০ টাকা দিতে হয়। এটা খুব ভালো লাগলো। যে কারণে ভেতরে মোবাইল নিয়ে ছবি শিকারীদের হামলে পড়ার দৃশ্য দেখলাম না। মন্দির সংলগ্ন প্রাঙ্গণের নানা জায়গায় সুশৃঙ্খলভাবে বসে প্রচুর মানুষ ধ্যানে মগ্ন। ক্যামেরা নিয়েও সেই ভাবে কাউকে দেখতে পেলাম না। তাহলে এখানে কি ফটোগ্রাফাররা খুব একটা আসা পছন্দ করেন না! আমি তো আবার কবে আসবো সেই নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছি।
বেশ কিছু শিষ্যকে দেখলাম ছোট্ট ছোট্ট মশারীর ভেতরে বসে ধ্যানস্ত হয়ে আছেন। এঁনারা নাকি দিন-রাত এখানেই বসে সাধনা করে থাকেন। কেউবা এক দু-মাসও এই ভাবে কাটিয়ে দিচ্ছেন। দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম।
এই বুদ্ধগয়া (Bodh Gaya) সারা পৃথিবীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে প্রধান মঠ বা মন্দিরের নাম — মহাবোধি মন্দির। তৃতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের বদান্যতায় এই সুউচ্চ মঠের নির্মাণ হয়েছিল। ২০০২ সালে বুদ্ধগয়ায় অবস্থিত এই মহাবোধি বিহারটিকে ইউনিস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী জায়গা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
গৌতম বুদ্ধ যে বোধিবৃক্ষের নিচে বসে ৪৯ দিন ধরে কঠোর তপস্যা করে বোধিলাভ করেছিলেন, সেই বোধিবৃক্ষটি এখনও বর্তমান। সেই বৃক্ষের নীচে নানা আচার, অনুষ্ঠান প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে। আমরা খুবই ভাগ্যবান যে এখনো এই বৃক্ষটিকে সমাজসেবীরা হজম করে ফেলেনি!
এই বুদ্ধগয়ার প্রধান মন্দির প্রাঙ্গণেও কোন পূজারী বা পান্ডাদের উৎপাত নেই। এক শান্ত সৌম্য পরিবেশে মন আপনা হতেই ভালো হয়ে যায়। জীবনের সব দেনা-পাওনা ভুলিয়ে দেয়।
সত্যি করে বলতে কি এ হেন পরিবেশ দেখলে ঘোর সংসারী মানুষজনও সব ছেড়ে-ছুঁড়ে দিতে পারেন!
আরো ভালো লাগলো, নিজেদের ধর্মের বাণী প্রচারের জন্য হনুমানের মতো নৃত্য করা বা তীব্রভাবে মাইক বাজিয়ে অন্যদের কানে ধর্মের বাণী ঢোকাবার চেষ্টা দেখা যাবে না।
একটি পয়সা খরচ না করেও যে কেউ ঘন্টার পর ঘন্টা এখানে সময় কাটিয়ে বিগ্রহ দর্শন করে চলে আসতে পারেন। অনেকটা আমাদের দক্ষিণেশ্বর বা বেলুড় মঠের মতো।
তবে খারাপ লাগে যখন শুনতে পাই তারাপীঠ নাকি বর্তমানে প্রমোটারবাবুদের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে।
সারা পৃথিবী থেকে নানা বর্ণের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এখানে এসে অসাধারণ সংযমের মাধ্যমে অশ্বত্থ গাছের নীচে বসে দিনের পর দিন ধ্যান করে থাকেন। সহযোগিতা করা ছাড়া, একে অপরকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত করেন না। এই প্রাঙ্গণ যেন সারা বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মিলনতীর্থ হয়ে উঠেছে। এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা প্রতি মুহূর্তে প্রত্যক্ষ করে চলেছি।
সত্যি, আমার এই চিনা বন্ধুরা জোর না করলে এখানে হয়তো আসাই হতো না। মূলত, সুইডেন, কানাডা, উত্তর কোরিয়া, চিন, জাপান, তাইওয়ান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভিয়েতনাম, তিব্বত ও লাদাখের লোকজনদের প্রচুর পরিমাণে দেখতে পেলাম।
বিহার রাজ্যের মধ্যে থেকেও বুদ্ধগয়ার এই এলাকাটিকে কিছুতেই যেন মেলানো যায় না। পৃথিবীর অন্য এক অজানা দেশের ছোট্ট অংশ বলে মনে হতো।
একদিন ভিয়েতনামের কয়েকজন কিশোরীর ছবি তুলেছিলাম।
ছবি তোলার পর একটি কিশোরী হেসে আমার হাতে পুজোর প্রসাদ এনে দিল। এরপর কিছু কথা বলে ছবি পাঠানোর জন্য চিরকুটে নিজের মেল আইডিটি সযত্নে লিখে দিল।
যথারীতি সেই ছোট্ট চিরকূট বাড়ি এসে আর কিছুতেই খুঁজে পেলাম না! এইভাবে নিজের দোষে কত কিছুই না হারিয়ে ফেলেছি এ জীবনে!
সেই নাতনীসম কিশোরীর গলার স্বরটি যেন এখনো শুনতে পাই…”send my photo…send my photo…!”
বিজয় চৌধুরী, ২১.০২.২৫