সাম্প্রদায়িক শক্তি ইতিহাসের বিকৃতি ঘটায়। যেমন আরএসএস-বিজেপি ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস বিকৃত করে চলেছে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস এবং কাশ্মীর নিয়ে ভুল ও মিথ্যা তথ্য প্রচার করে চলেছে। সম্প্রতি তারা নেহরুর তীব্র সমালোচনা এবং কাশ্মীর নিয়ে প্যাটেল ও নেহেরুর মধ্যে সংঘর্ষের কথা প্রচার করছে। তাদের অভিযোগ, বল্লভভাই প্যাটেল যদি কাশ্মীর সমস্যা সমাধান করতেন, তাহলে কাশ্মীর সমস্যা হয়ে থাকতো না। তাদের এও অভিযোগ, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান ছিল নেহরুর চূড়ান্ত ভুল সিদ্ধান্ত, যার ফলে বহু সমস্যা দানা বেধেছিল। কিন্তু এই তথ্য বা অভিযোগের আদৌ কি কোনো বাস্তবতা আছে, নাকি কাশ্মীর নিয়ে নেহরু এবং প্যাটেলকে পরস্পরবিরোধী উপস্থাপন করে ঐতিহাসিক তথ্যের চূড়ান্ত অপব্যবহার করাটাই মূল লক্ষ্য? নেহরু অবমাননার কারণ তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদী হলেও দৃঢ়ভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ছিলেন।
আরএসএস-বিজেপিরা যে বলছে ব্রিটিশ কমান্ডারদের চাপে নতি স্বীকার করতে নেহরু যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছিলেন কিন্তু এই তথ্য কেবল ভুল নয়, বিকৃত। সেই সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন যুদ্ধবিরতির পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং বিষয়টি জাতিসংঘে নিয়ে গিয়েছিলেন। তৎকালীন ভারতীয় নেতৃত্ব যে যুদ্ধ দেখেছিলেন তাতে অসংখ্য বেসামরিক প্রাণহানি এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য সম্পদের অভাব ঘটেছিল। এরপরও সময়সীমা বাড়ানোর পরিণতি(?) ১৯৪৮ সালের ৪ জুন, সর্দার বল্লবভাই প্যাটেল গোপালস্বামী আয়াঙ্গারকে একটি চিঠিতে লেখেন, “সামরিক অবস্থান খুব বেশি ভালো নয়, এবং আমি ভয় পাচ্ছি যে আমাদের সামরিক সম্পদের চরম সংকট রয়েছে”। Sardar Vallabhbhai Patel’s correspondence from 1945-1950, edited by Durga Das, published by Navajivan Publishing House Ahmedabad. কিন্তু মোদী-শাহদের মিথ্যা সাহসিকতা এতটাই যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা না করা হলে সমগ্র জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অংশ হত! মোদী-শাহরা জাতিসংঘে যাওয়াকে ঐতিহাসিক ভুল বলে প্রচার করছেন, সে বিষয়ে আবার সর্দার প্যাটেলের চিঠি পড়া যায়। ১৯৫০ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী সর্দার প্যাটেল নেহেরুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “… জাতিসংঘ সংস্থার সদস্য হিসেবে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের উন্মুক্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি ফোরাম আহ্বান করার পর, বিরোধ নিষ্পত্তির পথে সেই ফোরামের মাধ্যমে বিষয়গুলি সমাধানের জন্য ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই”। অতএব যারা বলছেন, প্যাটেল যুদ্ধবিরতির ডাক দিতেন না, নেহরু একাই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিলেন তারা নেহরু এবং প্যাটেলের অবস্থানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিকতা তৈরির চেষ্টা করছেন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে।
মোদী-শাহরা কি জানেন নেহরু এবং শেখ আবদুল্লাহের জন্যই কাশ্মীর ভারতে যোগ দেয়। মহারাজা হরি সিং তখনও ভারতের সঙ্গে একীভূত হতে চাননি। তাঁর না চাওয়াকে প্রজা পরিষদ সমর্থন করেছিল। রাজমোহন গান্ধীর “প্যাটেল আ লাইফ” বইতে জুনাগড়ের বাহাউদ্দিন কলেজে প্যাটেলের দেওয়া একটি বক্তৃতা উদ্ধৃত করেছেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন, “তারা হায়দ্রাবাদে রাজি হলে আমরা কাশ্মীরের সঙ্গে একীভূত হব”। উপজাতীয় মিলিশিয়ারা শ্রীনগরের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে যোগদানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। যখন হরি সিং স্বাধীন কাশ্মীরের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং প্যাটেল হায়দ্রাবাদকে ভারতের সঙ্গে নেওয়ার কথা বলছিলেন, তখন শেখ আবদুল্লাহই কাশ্মীরের ভারতে যোগদানের পক্ষে ছিলেন। তবে তাঁর বিবেচনা ধর্মের নয় ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের উপর ছিল। তিনি ভূমি সংস্কারে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু তা পাকিস্তানে অসম্ভব বলে মনে করেছিলেন, তাঁর আস্থা ছিল গান্ধী এবং নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে।
রাজমোহন গান্ধী তাঁর “প্যাটেল আ লাইফ”-এ লিখেছেন, “কাশ্মীর সম্পর্কে বল্লভভাইয়ের উদাসীনতা ছিল এবং তা ছিল ১৯৪৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু তারপরেই সেই মনোভাব বদলে যায়। তিনি ভারতের প্রথম প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলদেব সিংকে একটি চিঠিতে লেখেন, “যদি কাশ্মীর অন্য রাজ্যে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তিনি মেনে নেবেন।(পৃ. ৪৩৯। গান্ধী এও লিখেছেন, প্যাটেলের মনোভাব সেই দিনই বদলে যায়, যখন তিনি শুনতে পান যে পাকিস্তান জুনাগড়ের যোগদানের আবেদন গ্রহণ করেছে তখন তিনি বলেন, “যদি মুহম্মদ আলী জিন্নাহ একজন মুসলিম শাসকের (জুনাগড়) সঙ্গে হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য দখল করতে পারেন, তাহলে সর্দার কেন একজন হিন্দু শাসকের (কাশ্মীর) সঙ্গে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে আগ্রহী হবেন না? সেই দিন থেকে জুনাগড় এবং কাশ্মীর, তাঁর যুগপত উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে।” প্রশ্ন, প্যাটেল কাশ্মীর না ভারতের জন্য হায়দ্রাবাদ চেয়েছিলেন? “প্যাটেল: আ লাইফ” বইতে রাজমোহন গান্ধী লিখেছেন যে, স্বাধীনতার অনেক আগে প্যাটেল শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় এবং পরে স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল লুই মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলির সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। প্যাটেল মাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন যে তিনি যদি স্বাধীনতা দিবসে ৫৬৫টি কর রাজ্যের পুরো আপেলের ঝুড়ি নিয়ে আসেন তাহলে তিনি খুশি হবেন। তবে, ৫৬০টি আপেল দিলেই চলবে। ভাইসরয় একথা শুনে অবাক হয়েছিলেন। রাজমোহন গান্ধী লিখেছেন, “সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার মধ্যেও বল্লভভাই প্যাটেল তাঁর বস্তা থেকে হারিয়ে যাওয়া তিনটি আপেল- হায়দ্রাবাদ, কাশ্মীর এবং জুনাগড়কে ভোলেননি।”
রাজমোহন গান্ধী লিখেছেন, “বল্লভভাই নিশ্চিত ছিলেন না যে তিনি কাশ্মীরের আপেল চান কিনা।” তবে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও, র্যাডক্লিফের পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলা ভাগ করার ফলে ভারত জম্মুতে প্রবেশের জন্য একটি রাস্তা পেয়েছিল। “কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি অর্জনের জন্য কোনও পদক্ষেপ না নেওয়া এমনকি এর সঙ্গে একটি অচল চুক্তি সম্পাদন করতে অস্বীকৃতি জানানো সত্ত্বেও, প্যাটেল নিজেই এই রাস্তাটির উন্নতির অনুমোদন দিয়েছিলেন। মাউন্টব্যাটেনের প্রতি জিন্নাহর মন্তব্য, লাহোর, ১ নভেম্বর, ১৯৪৭, সরদার প্যাটেল শতবার্ষিকী খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৭৪-এ লেখা হয়েছে, “জিন্নাহ যদি হায়দ্রাবাদ এবং জুনাগড়কে ভারতে যেতে দিতেন, তাহলে প্যাটেল কাশ্মীরকে পাকিস্তানে যেতে দিতেন, কিন্তু জিন্নাহ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন”। প্যাটেল কাশ্মীর নিয়ে ভারতের অনেক পদক্ষেপে অসন্তুষ্ট ছিলেন, যার মধ্যে ছিল গণভোটের প্রস্তাব, জাতিসংঘের কাছে আবেদন, যুদ্ধবিরতি, এবং মহারাজার অপসারণ। অন্যদিকে প্যাটেল পেপারস: দ্বারকানাথ কাচরুর চিঠির উপর ১৯৪৭ সালের ৮ অক্টোবর, নেহরুকে লেখেন, “…আমি মনে করি না যে কাশ্মীরের জন্য যা করা সম্ভব ছিল তা আমি অসম্পূর্ণ রেখেছি; কাশ্মীর সম্পর্কিত নীতিগত বিষয়ে আপনার এবং আমার মধ্যে কোনও পার্থক্য সম্পর্কে আমি অবগত নই। তবুও এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে নীচের স্তরের লোকেরা মনে করে যে আমাদের মধ্যে একটি ফাঁক রয়েছে। এটি আমার কাছেও বেদনাদায়ক”।