‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার ২২তম বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২৯ মার্চ, ২০২৫ (শনিবার) সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের অডিটরিয়ামে (১এ, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, কলেজ স্কোয়ার, কলকাতা ৭৩) এক সভার আয়োজন করা হয়েছিল। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিজ্ঞান ও পরিবেশকর্মীরা এদিন সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের অডিটরিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকজনও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিল। এদিনের সভায় ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার নতুন সংখ্যাটির (বর্ষ ২২, সংখ্যা ২, মার্চ-এপ্রিল ২০২৫) আবরণ উন্মোচিত হয়। নতুন সংখ্যাটিতে বিজ্ঞান, পরিবেশ বিষয়ক আঠেরোটি নিবন্ধ স্থান পেয়েছে। সেগুলি হলো— বিপন্ন উত্তরের বন্যপ্রাণ: শুভময় খান কর্মকার, পথের অধিকার— বন্যপ্রাণ ও প্রগতি: রামজীবন ভৌমিক, জলবায়ুর পরিবর্তন— সুন্দরবনের ফিশিং ক্যাট: শুভদীপ মুখোপাধ্যায় ও সৈকতকুমার বসু, সাধারণ অপেক্ষবাদের বিশেষ তাৎপর্য: বরুণকুমার দত্ত, মৌল’র নামকরণের উৎস: অসিত ঘোষ, সিরাম ব্যারাম: অসীম বসাক, চন্দ্রায়ণের নতুন পর্ব: কৌশিক রায়, সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ: রণজিৎ পাল, বিজ্ঞানমনস্ক মানবতাবাদী ধর্মের প্রসার: সিদ্ধার্থ জোয়ারদার, জীবিত পুত্রিকা: ভবানীপ্রসাদ সাহু, ম্যানগ্রোভ অরণ্য কি সুন্দরবনের রক্ষাকর্তা?: প্রবীর বসু, মুক্ত হোক নদী: সৌমেন বিশ্বাস, প্রজাপতি উদ্যান: জয়শ্রী দত্ত, আরল সাগর বিপর্যয়: তরুণ রায়চৌধুরী, ঝাড়ুগাছ : জয়শ্রী দত্ত, অংক ট্যালি মার্ক: সোমা সরকার, দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান: রিঙ্কু দাস, এবং মোটর ইঞ্জিন চালিত ভ্যান: দ্যুতি সরকার। সভায় আগত সকল ব্যক্তিবর্গকে নাম নথিভুক্তকরণের সময় বিজ্ঞান অন্বেষক পত্রিকার নতুন সংখ্যাটি দেওয়া হয়, সঙ্গে একটি প্যাড ও পেন দেওয়া হয়। কোনো রেজিস্ট্রেশন ফি ছিল না। বিজ্ঞান অন্বেষক প্রকাশনার চারটি নতুন বই এদিন প্রকাশ পায়। এছাড়া তিনজন বিশিষ্ট গুণীকে ‘বিজ্ঞান অন্বেষক স্মারক সম্মান ২০২৫’ প্রদান করা হয়। আর ছিল বিজ্ঞান বিষয়ক দুটি বিশেষ আলোচনা।
সভার শুরুতেই বিজ্ঞান অন্বেষক পত্রিকার পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক ও কলম দিয়ে এদিনের স্মারক-সম্মান প্রাপক, আলোচক ও বিশিষ্ট অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয়। সভা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন একনিষ্ঠ বিজ্ঞান-প্রচারক ও বিজ্ঞান অন্বেষক পত্রিকার প্রকাশক জয়দেব দে। বিজ্ঞান অন্বেষক প্রকাশনার যে চারটি বিজ্ঞানের বই এদিন প্রকাশিত হয়, সেগুলি হলো— মানসপ্রতিম দাসের লেখা ‘বিবর্তনের ভাবনা ও চালর্স ডারউইন’, বরুণকুমার দত্তের লেখা ‘আইনস্টাইন— এক ঝলকে’, প্রণবনাথ চক্রবর্তীর লেখা ‘তারার আলো চুরি!’ এবং সুমন প্রতিহারের লেখা ‘মৃত্যু: রহস্যের গোলক ধাঁধা’। মঞ্চে উপস্থিত বিশিষ্টজনেদের হাত দিয়ে বইগুলি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের লেখকেরাও সেই সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন এবং সংক্ষেপে তাঁদের বই সম্পর্কে দু-চার কথা বলেন। এরপর ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার নতুন সংখ্যাটি (বর্ষ ২২, সংখ্যা ২, মার্চ-এপ্রিল ২০২৫) প্রকাশ পায়। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন গোবরডাঙা গবেষণা পরিষদের কর্ণধার দীপককুমার দাঁ, বিশিষ্ট লেখক ও এদিনের অন্যতম আলোচক মানসপ্রতিম দাস, স্মারক-সন্মান প্রাপক ও লেখক প্রণবনাথ চক্রবর্তী, লেখক সুমন প্রতিহার, সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক অরুণাভ আদক, বিজ্ঞান অন্বেষক পত্রিকার সম্পাদক প্রবীর বসু ও সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যবৃন্দের মধ্যে ড. অমিতাভ চক্রবর্তী, ড. তপন দাস, ড. অনিন্দ্য দে ও ড. দীপাঞ্জন দে, এদিনের সভার সভাপতি অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ গাঙ্গুলী, বিজ্ঞানকর্মী সৌমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস এবং সভার পরিচালক জয়দেব দে।
যুক্তিবাদের বিকাশ ও বিজ্ঞানের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ডাক্তার ভবানীপ্রসাদ সাহু, দীপককুমার দাঁ এবং প্রণবনাথ চক্রবর্তী— এই তিনজন বিশিষ্ট গুণীকে এদিন ‘বিজ্ঞান অন্বেষক স্মারক সম্মান ২০২৫’ প্রদান করা হয়। প্রবীণ বিজ্ঞান লেখন দীপককুমার দাঁ-র হাতে স্মারক-সম্মান ও মানপত্রটি তুলে দেন বিশিষ্ট বিজ্ঞান প্রচারক অভিজিত বর্ধন ও ড. দীপাঞ্জন দে। কুসংস্কারবিরোধী ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রচারক ডাক্তার ভবানীপ্রাসাদ সাহুর হাতে স্মারক-সম্মান ও মানপত্র তুলে দেন বিজ্ঞান অন্বেষক প্রকাশনার প্রধান পরিচালক সুবিনয় পাল ও বারুইপুর গার্লস হাইস্কুলে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষিকা রিঙ্কু দাস। লেখক ও বিশিষ্ট প্রকৃতিপ্রেমী প্রণবনাথ চক্রবর্তীর হাতে স্মারক-সম্মান ও মানপত্র তুলে দেন বিজ্ঞান অন্বেষক পত্রিকার সম্পাদক প্রবীর বসু এবং উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ও অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ গাঙ্গুলী। এরপর স্মারক-সম্মান প্রাপক তিনজন সম্মাননীয় ব্যক্তিবর্গ তাঁদের কর্মময় জীবনের অভিজ্ঞতার কথা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে ‘বিজ্ঞান অন্বেষক স্মারক-সম্মান’ প্রদান করা হয়েছিল বিশিষ্ট প্রাণীবিজ্ঞানী অধ্যাপক সিদ্ধার্থনারায়ণ জোয়ারদার, বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় এবং বিশিষ্ট বিজ্ঞানকর্মী ও লেখক প্রকাশ দাস বিশ্বাসকে। এদিনের সভায় উপস্থিত ২০২৪-এর দুইজন স্মারক-সম্মান প্রাপক সিদ্ধার্থনারায়ণ জোয়ারদার ও প্রকাশ দাস বিশ্বাসের হাতে তাঁদের মানপত্রটি তুলে দেওয়া হয়। ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁদের হাতে স্মারক-সম্মান ও পুষ্পস্তবক তুলে দেন ড. দীপাঞ্জন দে ও সৌমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস।
এদিনের সভার প্রধান দুই আলোচক ছিলেন বিজ্ঞান-লেখক মানসপ্রতিম দাস ও বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে গবেষণারত সুকল্যাণ গাইন। তাঁদের আলোচনার বিষয় ছিল যথাক্রমে ‘বিবর্তনের ভাবনা ও চার্লস ডারউইন’ এবং ‘স্বাধীন ভারতে বিজ্ঞান সংগঠনের ইতিহাস ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা’। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে এই দুটি আলোচনা চলে, যা উপস্থিত সকলের মনোগ্রাহী হয়। দুজন বক্তা সভাকক্ষে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। আলোচনার শেষে উপস্থিত শ্রোতাদের প্রশ্নেরও উত্তর দেওয়া হয়। আর যাঁরা এদিন বক্তব্য রাখেন, তাঁদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা সমিতির ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান অশোককান্তি সান্যাল, বিজ্ঞান-লেখক জয়শ্রী দত্ত, সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক অরুণাভ আদক, বিজ্ঞান-লেখক সুমন প্রতিহার, প্রাণীবিজ্ঞানী অধ্যাপক সিদ্ধার্থনারায়ণ জোয়ারদার, ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার সম্পাদক প্রবীর বসু, কোচবিহার গোপালপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ড. তপন দাস প্রমুখের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, সেটি হলো এদিনের সভায় ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার মুদ্রক অর্থাৎ ‘রেজ ডট কম’ (৪৪/১এ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ০৯)-এর পক্ষ থেকে সুমন রায় ও জয়দেব ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। সভামঞ্চ থেকে তাঁদের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দেন প্রকাশক জয়দেব দে। সভার কার্যক্রম এখানেই শেষ হয়। এরপর সভাপতি অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ গাঙ্গুলী তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার ২২তম বর্ষ উদযাপন সকাল এগারোটা থেকে শুরু হয়, দুপুর আড়াইটে পর্যন্ত সভা চলে। দ্বিপ্রহর আহারের ব্যবস্থা ছিল। প্রায় দেড়শো জন এদিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভাকক্ষের বাইরে বারান্দায় বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক পত্র-পত্রিকা, গ্রন্থাদির স্টল ছিল। সভায় আগত ব্যক্তিবর্গ সেখান থেকে নিজেদের পছন্দমতো বিজ্ঞানের বই ক্রয় করেন। সব মিলিয়ে বলতে হয় যে, ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার পক্ষ থেকে এই আয়োজন ছিল এককথায় অনবদ্য। এহেন আয়োজন দেখে অনেকেই অভিভূত হন। সত্যিই, বিজ্ঞানের বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে এ যেন এক ঐতিহাসিক দিন। যেখানে একই সঙ্গে বিজ্ঞান অন্বেষক পত্রিকার নতুন সংখ্যা এবং বিজ্ঞানের চারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হলো। বিজ্ঞান অন্বেষক পত্রিকার বাইশে পদার্পণ নিশ্চয় সকলের স্মৃতিতে দীর্ঘস্থায়ী হবে।
লেখক: বিজ্ঞানকর্মী ও সম্পাদক, ‘জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা বার্তা’ পত্রিকা।