প্রশান্তকুমার পাল তাঁর রবিজীবনী বইয়ের প্রথম খণ্ডে (আনন্দ পাবলিশার্স) জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নীলমণি ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র রামলোচন ঠাকুর সম্বন্ধে লিখেছেন —
‘কবিওয়ালা ও কালোয়াতদের আহ্বান করে বাড়িতে মজলিস বসানো ও আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করে শোনানো তাঁর অন্যতম ব্যসন ছিল।’
নীলমণি ঠাকুর ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পত্তন করেন। তিনি মারা যান ১৭৯১-এ। রামলোচনের জন্ম ১৭৫০এর কাছাকাছি সময়ে (সঠিক উল্লেখ নেই)। তিনি মারা যান ১৮০৭-এ। অর্থাৎ বৃদ্ধাবস্থায় নীলমণি ঠাকুর রামলোচনের দাপট দেখে গেছেন। তিনি যে কলকাতার অন্যতম রহিস ধনী হয়ে উঠেছিলেন নীলমণির পরামর্শ ছাড়া তা সম্ভব হত না। তাঁকে সদুপদেশ দিয়ে নীলমণি সঠিকপথে চালিত করতেন। কবিয়াল ও কালোয়াতদের সঙ্গে নীলমণির ভালোরকমই জানাশোনা ছিল। কারণ নীলমণি নিজেও সম্ভবত কবিগান করতেন। তাই জ্যেষ্ঠপুত্র রামলোচনকে কবিয়ালদের সন্ধান তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন।
‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ (আনন্দ পাবলিশার্স) বইয়ে চিত্রা দেব লিখেছেন, “ঝিমিয়ে পড়া সমাজের বুকে একটার পর একটা আঘাত হেনে যাঁরা তার জড়তা ঘোচাতে চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেরই স্থায়ী ঠিকানা ছিল জোড়াসাঁকো-ঠাকুরবাড়ি। পুরনো দিনের দু-চারটে পুঁথিপত্র, পাঁচালী, কবিগান আর বিকৃত বাবুকালচারের সংকীর্ণ খাতে শিল্পসাহিত্য যখন কোনও রকমে সেখানে টিঁকে আছে, সেই সময়কার কথা।”
সুতরাং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে কবিগানের সম্পর্কের কথা পড়ে ভূত দেখার মত যাঁরা চমকে উঠছেন, তাঁদের ভয়টা অমূলক। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পিউরিটান দম্ভে কোনওরকম আঘাত করা হচ্ছে না এসব লিখেটিকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই তাঁর বিভিন্ন লেখায় কবিগান ও কবির লড়াইয়ের উল্লেখ করেছেন।
‘সাহিত্যসমালোচনা’- শীর্ষক রচনায় কবিগুরু লিখেছেন কবির লড়াই শব্দবন্ধ। একটি বাক্যের শুরুতেই আছে কবির লড়াই। তারপর পাঁচালি, তর্জা।
“আমাদের সংস্কৃতিসাহিত্যেও এই বিকৃতি অনেক দেখা গিয়েছে। যখন সংস্কৃতসাহিত্যে সাধনার দৈন্য এসেছিল তখন কাব্যে তার পরিচয় ফুটে উঠেছে। বর্তমান কালের আরম্ভে কবির লড়াই, পাঁচালি, তর্জা প্রভৃতিতে সাহিত্যের যে-বিকার দেখা দিয়েছিল সেগুলিতে বীর্যবান জাতির প্রবল উন্নতির বা মহৎ আকাঙ্ক্ষার পরিচয় নেই। তার ভিতর অত্যন্ত পঙ্কিলতা আছে। সমাজের পথযাত্রার পাথেয় হচ্ছে উৎকর্ষের জন্যে আকাঙ্ক্ষা। জীবনের মধ্যে ব্যবহারে তার প্রকাশ খণ্ডিত হয়ে যায় বলেই মনে তার জন্যে যে-আকাঙ্ক্ষা আছে তাকে রত্নের মতো সাহিত্যের বহুমূল্য কৌটোর মধ্যে রেখে দিই— তাকে সংসারযাত্রায় ব্যক্ত সত্যের চেয়ে সম্পূর্ণতর করে উপলব্ধি করি। এই আকাঙ্ক্ষা যতক্ষণ মহৎ থাকে এবং এই আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ যতক্ষণ লোকের কাছে মূল্য পায়, ততক্ষণ সে জাতির মধ্যে যতই দোষ থাক, তার বিনাশ নেই। য়ুরোপীয় জাতির ভিতর যে-অস্বাস্থ্য রয়েছে তার প্রতিকারও তাদের মধ্যে আছে। যেখানে স্বাস্থ্যের প্রবলতা সেখানে রোগও আপাতত প্রবল হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু, তৎসত্ত্বেও মানুষ বাঁচে। দুর্বল শরীরে তার প্রকাশ হলে সে মরে।”
লোকসাহিত্যের অন্তর্গত ‘কবি-সংগীত’ প্রবন্ধে সরাসরি কবির লড়াই লেখেননি। লিখেছেন,’কবির দলের গান’। তিনি লিখেছেন —
“আমরা সাধারণ এবং সমগ্রভাবে কবির দলের গানের সমালোচনা করিয়াছি। স্থানে স্থানে সে-সকল গানের মধ্যে সৌন্দর্য এবং ভাবের উচ্চতাও আছে— কিন্তু মোটের উপর এই গানগুলির মধ্যে ক্ষণস্থায়িত্ব, রসের জলীয়তা, এবং কাব্যকলার প্রতি অবহেলাই লক্ষিত হয়— এবং সেরূপ হইবার প্রধান কারণ, এই গানগুলি ক্ষণিক উত্তেজনার জন্য উপস্থিতমতো রচিত।
তথাপি এই নষ্টপরমায়ু কবির-দলের গান আমাদের সাহিত্য এবং সমাজের ইতিহাসের একটি অঙ্গ,— এবং ইংরেজ-রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক।”
রবীন্দ্রনাথের ডাকে কবিয়াল গুমানী দেওয়ান তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে কবিগান শোনাতেন শান্তিনিকেতনে। কবিয়াল রমেশ শীলও ছিলেন কবির পরিচিত।
কবিগুরু নিজেই তাঁর লেখায় লিখেছেন, তিনি যদি দরিদ্রের ঘরে জন্মাতেন, তবে হয়ত কবিগানের দলে নাম লিখিয়ে তাঁকে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হত।
পঞ্চানন কুশারীর কবিয়ালের প্রেতটা যেন শেষ পর্যন্ত বিশ্বকবিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে।
আমাদের গবেষকরা এসব নিয়ে চিন্তা না করে বরং রবীন্দ্রসংগীতের সংখ্যা ও পূজাপর্ব-প্রকৃতিপর্বের বিভাজন নিয়ে মাথা ঘামিয়ে যান। কবিগুরুকে গজদন্তমিনারবাসী প্রতিভা হিসেবে লালনপালন করুন, তাঁর কবিয়ালি-সত্তা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করবেন না।