রবিবার | ৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ৮:২৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘সময়ের প্ল্যাকটফর্ম’ গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন জামিষষ্ঠী বা জাময়ষষ্ঠী থেকেই জামাইষষ্ঠী : অসিত দাস কার্বাইডে পাকানো আম দিয়ে জামাইষষ্ঠীতে জামাই খাতির নয়, হতে পারে ক্যান্সার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ভক্তের ভগবান যখন জামাই (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত কাশ্মীর নিয়ে বিজেপির নেহরুকে দোষারোপ ধোপে টেকেনা : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্র নাটকের দুই ট্র্যাজিক রাজা : শৌনক দত্ত কবির মৃত্যু : দিলীপ মজুমদার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের সপ্তসঙ্গিনী : স্বামী তেজসানন্দ মহারাজ দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক : সন্দীপন বিশ্বাস সিঁদুরে মেঘের গর্জন : অসিত দাস শতবর্ষে অন্য বিনোদিনী — তৃপ্তি মিত্র : শৌনক দত্ত আমার প্রথম অভিনয় দেখে সত্যেন বসুই বলেছিলেন— তোর হবে : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রজিৎ আমাকে ক্লান্ত করে কেবলই ক্লান্ত : তপন মল্লিক চৌধুরী মনোজ বসু-র ছোটগল্প ‘বাঁশের কেল্লা’ গ্রেস কটেজ বুলেটিন প্রকাশ : দীপাঞ্জন দে অথ ওয়াইন কথা : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসাবিভ্রাট : অসিত দাস বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম : আবু বকর সিদ্দিকি
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা—অসুখের ভিতরে ভাসমান স্বপ্নের নৌকা : অমৃতাভ দে

অমৃতাভ দে / ১০৫১ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০২৩

“সারাজীবন একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে আজ দেখি, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আমি প্রায় কিছু করিনি, শুধু কবিতা লেখা ছাড়া। “একথা যিনি বলতে পারেন তিনিই তো লিখবেন, “আমার ছিল জীবনের/আড়ালে একটা নদী, যা গাইত, চিরকালের বেঁচে থাকার/গান। আমি ভাবতাম,/আমার আছে হাজার হাজার সুখের দিন — ভাবতাম, আমি জন্মাইনি শুধু শুধুই মরে যাওয়ার জন্যে।…” (জীবন থেকে : এসো সুসংবাদ এসো)

কবি ভাস্কর চক্রবর্তী বাংলা কবিতার এক বিস্ময়। বাংলা কবিতাকে নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। সেটা স্বপ্ন থাকেনি, তিনি তা পূরণ করতে পেরেছেন। তা তাঁর কবিতায় বাস্তবায়িত। জ্যান্ত কবিতা লেখার দায়, নতুন কবিতা লেখার দায় তাঁর ছিল এবং সেটা অবলীলায় করে ফেলেছেন তিনি। বাংলা কবিতাকে শাসন করেছেন, তথাকথিত ছন্দ ছাড়া বাংলা কবিতাকে হাঁটতে শিখিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ‘সজ্জিত হয়ে উঠুক জীবন’। তাঁর কবিতার উঠোনে স্বপ্নের রেলগাড়ি এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাই বোধহয় কবি ভুলতে চান ‘রুক্ষতা আর আলপিন দিয়ে সাজানো সব কন্ঠস্বর’।

যে কবি জীবনকে ভালোবাসেন,যে কবি লেখেন ‘আমি দু-হাতে খুঁজে ফিরি আমার জীবন’,সেই কবি কেন ঘুমোতে চান বারে বারে? তিনি কেন শীতকালের জন্য অপেক্ষা করেন? তিন মাস ঘুমিয়ে থাকার কথা ভাবেন? কেন তিনি বাড়িশুদ্ধ লোকের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন? তাঁর তো চুরি হওয়ার কিছু নেই। কেন তিনি দৌড়ে যান? মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই নিঃশ্বাস ফেলেন? — আসলে তাঁর ভালোলাগে না — মাথা নিচু করে বসে থাকতে ইচ্ছা করে না। তাই সুপর্ণাকে তাঁর জিজ্ঞাসা, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকবো’। কবি তো লিখতে চেয়েছিলেন। লড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজেকে। আত্মার রঙিন ছবি তিনি দেখেছেন। পবিত্রতার কোনো বাতিক নেই তাঁর। তিনি জানেন ভালোবাসা ব্যাপারটা কী, প্রেমহীনতাটাই বা কী। ৫২ বছর বয়সে

পৌঁছে ‘কাহিল দুটো ফুসফুস নিয়ে অনপরাধ এখনো গড়িয়ে’ চলেন কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। ছ্যাতলা-পড়া সময়টাকে টোকা মারেন। বিশ্বাস করতে ভালোলাগে না কথাবার্তাহীন নিষ্ঠুরতা। মিথ্যের দাপট তাঁর সহ্য হয় না। তবু জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চান। ক্ষতি হতে দেখলেন, রক্ত বয়ে যেতে দেখলেন তবু ভালোবাসলেন জীবনকে। বেঁচে থাকাকে মূল্য দিলেন।’দীর্ঘশ্বাসের থেকেও লম্বা এই জীবনটাকে আমি শেষপর্যন্ত টিকিয়ে রাখি। এটা কি বেঁচে থাকা? নাকি টিকে থাকা?’ কিভাবে বাঁচবেন তিনি? বাঁচবেন কবিতা লিখে—

আরেক পাড়ায় গিয়ে ঘর বাঁধব এবার সুন্দরী

যে পাড়ায় শ্বাসকষ্ট নেই

আত্মার রঙিন ছবি ( তুমি আমার ঘুম )

কবি বাঁচেন। বার বার অসুস্থ হয়েছেন। মরে যাবার কথা ভাবেন। বিরক্তি, ক্রোধ, রাগ, ক্ষোভ ছিল মনে। বাঁচার অভিলাষ ছিল। মগ্নতা ছিল, স্বপ্নও ছিল। অনুভব ছিল, ভালোবাসাও ছিল। স্নেহ ছিল, মমতা ছিল, সুখও ছিল। শান্ত কোমল এক জীবন থাকেই। ধ্বংস থাকে, বিপন্নতা, বিষণ্ণতা, দুর্বলতাও থাকে। কবির হাতে অক্ষর থাকে — বেঁচে থাকার মন্ত্র থাকে।

আমি বাঁচি হামবড়াদের লজ্জা দেওয়ার জন্যে

টোকা দেওয়ার জন্যে

আমি বাঁচি কোনো রূপকথা কোন নাকী কান্নার জন্যে নয়

শুধু দু-একটা স্নেহ দু – একটা হাত

শুধু দু-একটা হাসির জন্য। (আমি বাঁচি)

স্নেহ জাতীয় কিছু একটা মাথায় ভিড় করে বলেই জীবনটাকে আরেকবার ফিরে পেতে চান। মুছে ফেলতে চান বিরক্তি, শব্দহীন এক হাসিতে মেতে ওঠেন। মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়েও বিবি-বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরতে চান, রাস্তার মধ্যে গান গেয়ে ওঠেন ফিসফিসিয়ে। সরল সাদাসিধে এক কবি হেঁটে যান ‘সরলরেখার খোঁজে’। পতনের কারণ কেন খুঁজবেন কবি!

তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলোর দিকে একটু ফেরা যাক। শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা (রচনা ১৯৬৫-৭১/প্রকাশ ১৯৭১), এসো সুংবাদ এসো (রচনা ১৯৭২-৭৮/প্রকাশ ১৯৮১), রাস্তার আবার (রচনা ১৯৭১-৮০/প্রকাশ ১৯৮৩), দেবতার সঙ্গে (রচনা ১৯৮২-৮৩/প্রকাশ ১৯৮৬), আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে (রচনা ১৯৮১-৮৭/প্রকাশ ১৯৮৯), স্বপ্ন দেখার মহড়া (রচনা ১৯৮৬-৯২/প্রকাশ ১৯৯৩), তুমি আমার ঘুম (রচনা ১৯৯২-৯৭/প্রকাশ ১৯৯৮), নীলরঙের গ্রহ (রচনা ১৯৬৬-৯৮/প্রকাশ ১৯৯৯), কী রকম আছো মানুষেরা (রচনা ১৯৯৭ ২০০৪/প্রকাশ ২০০৫), জিরাফের ভাষা (রচনা ১৯৯৭-২০০৪/প্রকাশ ২০০৫)।

ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার ভাষা আমাদের আবিষ্ট করে। ‘এসো সুসংবাদ এসো’ কাব্যের বেশিরভাগ কবিতা টানা গদ্যে লেখা। সাবলীল, প্রাণবন্ত এই শব্দজাল আমাদের একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যায়। যেন ডায়েরির পাতা পড়ছি। জীবনযাপনের কথাচিত্র রচিত হয়ে যায় বাক্যবিন্যাসে। ‘আলাপ’, ‘রাত্রিকালীন’, ‘দু-চার লাইন’, ‘স্মৃতি’, ‘নীল নক্ষত্রের রাত্রি’, ‘হাতুড়ি’, ‘আত্মকাহিনী’, ‘জীবন থেকে’ কিংবা ‘হারিয়ে যাবার গল্প’ পড়লে আমাদের কয়েক মিনিট স্তব্ধতায় কাটাতে হয়।

শোনো, ধুলোর মতো আমি মিশে গিয়েছিলাম মানুষের মধ্যে। একটুকরো ঘরে, রাস্তায়, নর্দমার ধারে বসে আমি কাটিয়েছিলাম জীবন — দেখেছিলাম চায়ের দোকানে দেবদূত …

(হারিয়ে যাওয়ার গল্প : এসো সুসংবাদ এসো)

অন্ধকার ছাতের উপর দাঁড়িয়ে কবি ফাঁকা জীবনের কথা ভাবেন। হারমোনিয়ামের উদ্দেশে লেখেন, ‘ওগো কাঠের বাক্সে ঢাকা হারমোনিয়াম, তুমি গান গাইতে থাকো আমাদের।’ কবি ছিলেন অনেকটা ঠিক ‘অন্যমনস্ক পুকুরের মতো। প্রত্যেক সন্ধেবেলা নিয়মিত বাজনা বেজে উঠত। তারপর একদিন চলতে শুরু করলেন তিনি — যে পথ দিয়ে কেউ কখনো চলতে চায় না কোনোদিন।

কবির পথচলা থামেনি। ‘রাস্তা থেকে চুপচাপ, হারিয়ে যান রাস্তায়। নতুন করে সবকিছু শুরুর কথা ভাবেন। ঘরটাকে পরিষ্কার করে তুলতে হবে, জানলায় পর্দা লাগাতে হবে, বিছানায় সাদা চাদর। তিরিশ বছরের ভুলভ্রান্তি, বোকামি, ঘুষোঘুষি চোখের জল, মদ্যপান কিংবা ছেলেমানুষিগুলোকে বিদায় জানাতে হবে। কেননা, তাঁর নতুন কবিতার ওপর জ্যোৎস্না এসে পড়ে— তাঁর জীবনে শুধু রাস্তা পড়ে আছে— ‘ধূ ধূ রাস্তা পড়ে আছে শুধু’। ‘রাস্তায় আবার’ কাব্যগ্রন্থে কবির পথচলা লিপিবদ্ধ হয়। ছিমছাম পা ফেলে কবি শুধুই হাঁটতে থাকেন। অথবা সময়ের থেকে কবিতাকে ছড়িয়ে দেন রাস্তায়। কবি ঝর্ণার মতো জীবন চান, চান স্বপ্নের মতো পৃথিবী। রাস্তাতেই দেখা পাওয়া যাবে তার দিনগুলো কাঠের রথে করে কবিকে নামিয়ে দিয়ে যায় রাস্তায়।

আমার জীবন আমি কার্পেটের মতো কলকাতায়

বিছিয়ে দিয়েছি

‘রাস্তায় আবার’ কাব্যগ্রন্থটির কবিতাগুলিকে ছুঁয়ে আছে কবির ‘অসুখ’। মনের জীবনের ক্লান্তি কবিকে ঘিরে ধরে। তাঁর রক্ত মাংস কেউ শুষে নিতে চায়। তার দুশ্চিন্তা আছে, বিষণ্ণতা আছে। খিদে, বুকে ব্যথা, নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা, ভয়, তাঁর নাটকের চরিত্র হয়ে ওঠে। বিছানা হয়ে ওঠে তার চিরকালীন বন্ধু। সমস্ত লেখালেখির ভেতর মৃত্যুর ছায়া তিনি দেখতে পান, দেখতে পান ডানা ভাসিয়ে এগিয়ে আসছে মরুভূমি, কিন্তু অন্যসব মানুষের মতো কবিও বলেন—

আজো, আমি

বেঁচে থাকতে চাই

 সন্তাপ (রাস্তায় আবার)

তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে কেউ। তাঁর ভালো লাগে যেই দেখি

একটি মেয়েকে ঘিরে চারপাঁচজন বসে আছে দূরের টেবিলে।

দূরের টেবিলে (রাস্তায় আবার) আসলে সব শেষ হয় না। ভালোবাসা থাকে, জীবনের ইচ্ছারা মরে যায় না। তাই কবিও ছুঁয়ে যান ‘ব্যর্থ এ জীবন’, জীবনকে প্রণাম জানান। বেঁচে থাকার জন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন বিছানায়।

‘দেবতার সঙ্গে’ যেন জীবনের মহাকাব্য। দেবতার সঙ্গে কীভাবে কথা বলেন কবি? কবি তাঁকে চিঠি লিখতে চান, সাদা পায়রা হয়ে পৃথিবীকে বাঁচাতে অনুরোধও করেন। কালবেলা দূর হোক, দেবতার গান ছড়িয়ে পড়ুক চারদিক। কবি তো গান গাইতে চান। দেবতাকে দেখতে চান ‘শহুরে রাজার গ্রামে জীবনকাহিনী’। দেবতাকে বলেন—

আমাকে এবার

আরো মানুষের কাছে যেতে দাও …

কিন্তু কবি জানেন ‘আকাশ অংশত মেঘলা’। শীতকাল, ভালোলাগে না, কতদিন আর চিত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবেন তিনি। বিষাক্ত জীবন গিলে কীভাবে কাটাবেন দিনগুলো। সন্ধেবেলায় শুয়ে শুয়ে মোমবাতির মৃত্যু দৃশ্য দেখেন কবি।

এই পোড়া

সময়ে শহরে

ডিঙি নৌকার মতো আমি শুধু

একটা বিপদ থেকে

অন্য আরো বিপদে ভেসেছি।

 কথাবার্তা (আকাশ অংশত মেঘলা)

কবি কি নিঃসঙ্গ, একাকী, বিষণ্ণ ব্যথিত আজও? তাই কি খোঁজেন রহস্যময় নীল আলো কিংবা দাঁত দিয়ে নখ খোঁটেন !

মনে হচ্ছে অনেকদিন পর মা আজ দেখতে এসেছেন

যখন শুকনো হাত আমি বুলিয়ে নিচ্ছি মুখে

যখন বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার ধ্বংসস্তূপে

শান্তভাবে বসে আছি আমি। — নাগপাশ (আকাশ অংশত মেঘলা)

‘আকাশ অংশত মেঘলা ‘কাব্যগ্রন্থেও জীবনের জলছবি নির্মাণ করেন কবি। রঙবেরঙের জামাকাপড়ের কথা ভুলে গিয়ে অর্থাভাব মৃত্যুর জন্য বিরক্ত না হয়ে শুধু সামান্য একটুকরো আলোর জন্যে ধ্যানে বসেছিলেন কবি। কিন্তু সেই ধ্যানও ভেঙে যায়। অশ্রহীন, ভবিষ্যৎহীন এক নীল মশারিতে কলের পুতুলের মতো, নিরুপায়’ ঢুকে পড়েন আবার। এপিটাফ লেখেন —

দুই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যিখানে, মৃত্যু, আমি তোমাকে জন্মাতে দেখেছি।

—এপিটাফ (আকাশ অংশত মেঘলা)

কবি মৃত্যুর কাছ থেকেই ভাষা পান, জীবনের কাছে পান রং। তাই শূন্যতার মধ্যে বাচ্চা মেয়ের হাসি মিশিয়ে দেন।

ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে মৃত্যু – প্রসঙ্গ। মৃত্যু নিয়ে বড় বেশি ভেবেছেন কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন। মৃত্যু প্রেতের মতো তাঁকে নিয়ে খেলেছে। অস্বাভাবিকতা কবির পেছনে থেকে দিন রাত কবিকে ঠেলেছে বলেই বোধহয় মৃত্যুকে বিপজ্জনক মনে হয়। কবি দেখেন—

আমার শবযাত্রা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছে

শ্মশানের দিকে আর আমি

তার পেছন পেছন হাঁটছি —জটা (স্বপ্ন দেখার মহড়া)

কবির স্বপ্ন ছিল মমতাময়ী রাতকে তিনি সুন্দরভাবে এঁকে রাখবেন। কিন্তু মৃত্যুদিন এসে যায়। মনে হয়—

এখানে হৃদয় বলে কিছু নেই

এখানে প্রণয় বলে কিছু নেই

আছে হুটোহুটি আর কামড়াকামড়ি

হুল – ফোটানোই আজ মনে হয় সেরা আহ্লাদ — সাত গলি থেকে (স্বপ্ন দেখার মহড়া)

‘স্বপ্ন দেখার মহড়া’য় মৃত্যুর কথা আছে। অবসাদের কথা আছে, বিষের কথা আছে— আছে স্বপ্নের কথাও। স্বপ্নের নৌকা নির্মাণ করেন কবি। পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন। ‘ভাসমান অন্ধকারে’ ‘কাল রাত্রি বেলার স্বপ্নে দু-একটা সাদা পালক ছিল। দু-একটা নীল পালক।’

তিনি বিষণ্ণতাকে বলতে পারেন—

বিষণ্ণতা, তুমি আজ আমাকে ঘিরো না— জেনো, আমি

এক ডজন মোমবাতি কিনে এনে

নতুন জীবন শুরু করে দেব আগামী সপ্তাহে … (প্রতিবহন)

কবিতার জন্য তিনি বসে থাকেন, স্বপ্ন বিস্তারের জন্য তিনি বসে থাকেন। তিনি কালের পুতুল নন, বাঘের মুখের মধ্যে বসে তিনি তিন খাতা চার খাতা কবিতা লিখতেও পারেন। তাঁর চোখ জুড়ে একটা চলা ভসে ওঠে। তিনি জানেন মগজটাকে স্বাধীন রাখতে হবে। গান গাইতে হবে। তিনি ‘কুসংস্কারের ভেলা’ নন কোনো। নারীবিদ্বেষীও নন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে চান তিনি।

আবার মানুষের পাশ থেকে মানুষের আড়ালে যাবার শব্দ তিনি শুনতে পান। শুনি, —

মহাকাশ যুগ

শুরু হয়ে গিয়েছে

নিরীহ কবিতা দিয়ে তৈরি এক

বর্মের ভেতরে

ছিলাম চুপচাপ

ছিলাম নিদ্রিত একা।

কিন্তু কবি দেখতে পান মানুষের ভালোবাসা মানুষের কাছেই পড়ে আছে। ছেলেবেলা থেকেই, জীবন ভাস্করকে যারপরনাই বিস্মিত করত। কবিতা তাঁর কাছে এসেছিল মুক্তির আশা নিয়ে। বিশাল কোনো মজাকে ধরতে চেয়েছিলেন কবিতায়, ধরতে চেয়েছিলেন বিশাল কোনো হাসির শব্দকে। ‘আমি কবিতাবাদী। সাধারণতাকে আমি ভালোবাসি। বাতিল অতিসাধারণ। সামান্য সব কথা, দৃশ্য, ফেলে আসা দিনরাতগুলো আমাকে টোকা দিয়ে যায়।’ গলাবাজিটা তার কাজ নয়, রাম হোক কি লক্ষ্মণই হোক অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি তা ধরবেনই। কবিতা তাঁর কাছে আলোয় ভর্তি একটা পাহাড়, যে আলো শুধুই হাজার মোমবাতি। মোমবাতিগুলো সব জ্বলছে, আর ছায়াটা আস্তে আস্তে ডানা ভাসিয়ে শূন্যে উড়ছে, আর ভেসে যাচ্ছে। কবিতা তার স্নায়ুকে সুস্থ রাখে। কবি বিশ্বাস করেন, মহাকাশে চলতে চলতেও মানুষ একদিন কবিতা পড়বে। কবিতাই তো পারে আমাদের বেঁচে থাকাটাকে সহজ করে দিতে। তাই হয়তো কবি বলতে পারেন — কোনো কিছুরই আমি পরোয়া করি না আর।

কবিতা লিখতে এসেছিলাম,

কবিতা লিখে চলে যাবো। — সুন্দরীকে


আপনার মতামত লিখুন :

3 responses to “ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা—অসুখের ভিতরে ভাসমান স্বপ্নের নৌকা : অমৃতাভ দে”

  1. রতন কুমার নাথ says:

    ভালো লাগলো। জানা গেল অনেক কিছু। আলোচককে ধন্যবাদ।

  2. Bidyut Biswas says:

    অসাধারণ! অনন্য! তোর লেখা যতগুলি প্রবন্ধ/নিবন্ধ পড়েছি, তার মধ্যে এটি চমৎকার। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা খুব কম পড়েছি আমি। তবে তোর লেখা পড়ার পরে আমি ওঁর সার্বিক লেখা পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছি।

  3. Amitava Biswas says:

    একটানা পড়ে ফেললাম। বেশ ভালো লাগলো। ‘কচি ছাগলের মতো রোদ নাচে ছাদের কার্নিশে..
    আমাদের স্বর্গ নেই স্যারিডন আছে.. সারাজীবন থেকে যেতে ইচ্ছে করে.. আমি বোধ সিগারেট যাওয়ার জন্য্ই বেঁচে আছি.. তোমাকে দুঃখিত করা আমার জীবনধর্ম নয় / চলে যেতে হয় বলে চলে যাচ্ছি, না হলেতো আরেকটু থাকতাম.. ‘ আমার প্রিয় কবির অসাধারণ সব পংক্তি।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন