বাড়িতে যখন বাবার সামনে বসে আমি বই পড়ি, অথবা ছবি আঁকি, অথবা তাঁর ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা মেরামত করি, আর বাবা কথা বলেন, প্রায়ই তখন আমার কানের ভেতর হিয়ারিং এইডের দুই জটিল মাথা গুঁজতে ভুলে যাই, তারা আমার কাঁধের দুই দিকে ঝুলে থাকে। কারণ বাবার প্রতিটি কথা আমি এমনিতেই বুঝতে পারি, একদম শুনতে না পেলেও। বাবার ঠোঁট নাড়া আর তাঁর মায়ায় ডোবানো চোখ দুটার গভীর বা তরল হওয়া, তাঁর ভ্রূর নাচানাচি অথবা থমকে যাওয়া দেখে বুঝতে পারি কখন তিনি বলছেন, ‘সুকান্তের ছাড়পত্র বইটা এক সময় তো ছিল, কে জানি নিয়ে গেছে, না হলে তোকে পড়তে দিতাম, ’ অথবা ‘ছেঁড়া পাঞ্জাবি এ জন্য পরি যে একদিন তোর মার চোখে পড়লে নতুন একটা কিনে দেবে।’ অথবা ‘বুড়িটা যদি…।’ বাবা ঠিক কোনখানে হঠাৎ থেমে যান, বুড়ি আপার কথা বলতে বলতে, আমি তা খুব বুঝি; আর এই থেমে যাওয়া যে একদিন, সাত বছর আগে, তার জন্য জগৎ সংসারটা থেমে যাওয়ার মতোই ছিল; বাতাসের দাপাদাপি, মেঘেদের ওড়াওড়ি অথবা বৃষ্টির ঝরে পড়াও হঠাৎ থেমে যাওয়ার মতোই ছিল, তা-ও আমি অনুভব করি। বুড়ি আপা আমার থেকে চার বছরের বড় ছিল, সে-ও জন্মেছিল মূক বধির হয়ে, সে-ও আমার মতো সারা দিনরাত ডুবে থাকত এক প্রতিকারহীন নিস্তব্ধতায়, যদিও আমি কানে যন্ত্র লাগিয়ে মানুষের কথা খুব হালকা কিছুটা শুনতে পেতাম। বুড়ি আপা তা-ও পারত না। বাবাই ছিলেন আমাদের নিস্তব্ধতায় একমাত্র শব্দময় উপস্থিতি। বুড়ি আপা নিউমোনিয়ায় ভুগে মারা গেলে, বাবা তাকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন সারা রাত। বাবা যতই স্তব্ধ বসে থাকুন এরপর অনেক দিন, বুড়ি আপার স্মৃতি বুকে নিয়ে, আমার মনে হয়েছিল সে মরার সময় অসুখী ছিল না। সে বাবার চোখ দেখতে দেখতে চোখের গভীরে রাখা তার জন্য সব ভালোবাসা শরীরে জড়িয়ে নিতে নিতে আরও বেশি ভাষাহীন আরেক জগতে চলে গিয়েছিল।
এরপর আমাকে চোখের আড়াল না করাটা বাবার জন্য একটা পণ হয়ে দাঁড়াল।
আমার মা ডাক্তার। জেলা শহরের হাসপাতালে মায়ের চাকরি। চাকরি বললে ভুল বলা হবে, হাসপাতালটা তাকে যেন অধিকার করে নিয়েছে, সারা দিনে আমার জন্য মায়ের অল্পখানি সময় বরাদ্দ, অল্প—অল্পখানি বাবার জন্য। বাকিটা হাসপাতালের জন্য। তাতে অবশ্য বাবার খেদ নেই। আমারও না। একটা কলেজে পড়ান বাবা, দিনে তিন ঘণ্টার মতো সেখানে কাটান। তারপর বাড়িতে।
বাবাকে অধিকার করে রেখেছি আমি। অথবা তাকে অধিকার করে রাখার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বাবাই।
একদিন আমাকে বললেন, ‘ইশারা ভাষা শিখবি?’
আমি বললাম, কে শেখাবে?
‘এক ওলন্দাজ-এনজিও শহরে অফিস খুলেছে। তারা শেখাবে। এক মোটাসোটা ওলন্দাজ, নাম ইয়ান, কোয়েকার ওট্স্ এর টিনে যে রকম ওলন্দাজ লোকের ছবি, সে শেখাবে।’
দুদিন পর ইয়ান আমার হাতে হাত মিলিয়ে বলল, ‘সুইট লেডি, কেমন আছ?’
আমি বললাম, ভালো। আপনি?
সে ইশারায় বলল, ভালো। আশ্চর্য, আমি সেটা বুঝলাম।
দুই
একদিন বাবা বললেন, ‘ইয়ান চাচ্ছে তুই তাদের ঢাকা অফিসে একটা চাকরি নে। খুব ভালো মাইনে। নিবি?’
আমি ইশারায় বললাম, আমার চাকরির দরকার নেই।
বাবার চোখ দুটিতে আলো নাচল। আমি খুশিতে ইশারা ভুলে হাত-পা নেড়ে বললাম, বাবা আমি এখান থেকে কোথাও যাব না।
বাবা বললেন, ‘এই তো আমার মেয়ের মতো কথা।’
কিন্তু বাদ সাধলেন মা। বাবাকে বললেন, ‘মেয়েকে স্বাবলম্বী হতে হবে। সারা জীবন একে তুমি আগলে রাখবে?’
কিছুদিন গেল, ওলন্দাজ ইয়ান ঢাকা ফিরে গেল। এবার সে যাবে বরিশাল। বাবাকে ফোন করে বলল, চাকরিটা রিফাতকে নতুন জীবন দেবে। কাজেই একদিন বাবার হাত ধরে ঢাকার বাসে উঠে বসতে হলো। ঘর থেকে বেরুবার আগে মা দীর্ঘ একটা আলিঙ্গনে আমাকে বাঁধলেন। আমি ভেবেছিলাম মার সঙ্গে কোনো কথা বলব না। কিন্তু মার চোখভর্তি বাষ্প। বুড়ি আপার চলে যাওয়ার পর আমি আর মার চোখ পড়িনি। সাহস হয়নি। আজ পড়লাম। মানুষের চোখের পানি যে এক মুহূর্তে গলায় নেমে গিয়ে সব কথা বন্ধ করে দিতে পারে, এ কথা ভেবে আমি অবাক হই।
ভেবেছিলাম মাকে বলব, আমি কি এতই বোঝা যে এভাবে নামিয়ে নিতে হবে? কিন্তু বলব যে, ভেতরটা তো বন্ধ। ইশারাও এলোমেলো। আমি শুধু বলতে পারলাম, মা…। বাবারই তো মেয়ে, কোনো কোনো সময় একটা জায়গায় এসে কেন জানি সব থেমে যায়। জগৎ সংসার, সব।
তিন
ওলন্দাজ ইয়ান আগে বলেনি, আমাকে একটা ইন্টারভিউ দিতে হবে, এবং ইন্টারভিউ নেবে এমন এক লোক, যে এখনো ত্রিশও পার হয়নি।
আমি বাবাকে বললাম, আমি বাড়ি যাব। ইন্টারভিউ দেব না।
ইন্টারভিউ যে নিচ্ছে তার চোখে চশমা। চশমার কাচ সামান্য বাদামি। তাতে তার চোখ পড়া মুশকিল। লোকটার নাকমুখ বেশ চোখা চোখা। টেলিভিশন নাটকে নামলে খারাপ করত না। মাথার চুলটা বেয়াড়া। মাঝে মাঝে সেখানে হাত চালায়। এই একটা জিনিস আমি সহ্য করতে পারি না। আরেকটা জিনিসও আমার অসহ্য লাগছে। লোকটার মুখে একটা বাঁকা হাসি। যেন ইন্টারভিউ নিয়ে আমাকে সে ধন্য করছে।
সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছেন?’
সে বলল, ‘আপনাকে খুব ভালো লাগছে দেখতে।’
আমি চমকে উঠলাম, বললাম, ব্যক্তিগত বিষয়ে কোনো প্রশ্ন নয়।
সে বলল, ‘তোমার চোখ দুটি খুব সুন্দর।’
আমি বললাম, কী যা তা বলছেন!
লোকটা বলল, ‘এ রকম এক জোড়া চোখের জন্য আমি বসে ছিলাম।’
আমি বললাম, আমি এখন উঠব। এই বলে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালাম। লোকটা আমার হাত ধরে বসাতে চাইল। আমি তার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
আমার চোখে জল দেখে বাবা অবাক হলেন। একটা বেঞ্চে আমাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’
আমি বললাম, চলো, বাড়ি যাই।
পরদিন আমাকে নিয়ে বাবা এসে হাজির হলেন ওলন্দাজ এনজিও অফিসে। লোকটার শার্টের কলার ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব কী প্রশ্ন?’
আমি একটা কাগজে লোকটার করা প্রশ্নগুলো লিখে আগের রাতে বাবাকে দেখিয়েছিলাম।
লোকটা প্রথমে ভড়কে গিয়েছিল। চোখ দুটিতে ভয় জমেছিল, হয়তো চাকরিটা হারাবার ভয়। কিন্তু কাগজটা দেখতে দেখতে লোকটা হেসে ফেলল। তারপর বাবাকে একটা কোনায় নিয়ে কী কী জানি বলল। বাবা আমার দিকে পেছন ফিরে ছিলেন। লোকটার কথা শুনে আমার দিকে ফিরে তাকালে আমি অবাক হয়ে দেখলাম, বাবার চোখে হাসি।
এই হাসিটা আমি পড়তে পারলাম না, হয়তো এই প্রথম বাবার হাসির কোনো মানে আমি করতে পারলাম না। বাবা কাছে এসে বললেন, ‘তোর চাকরিটা হয়েছে। তবে তিন মাস তোকে ইশারা ভাষাটা আরও ভালো করে শিখতে হবে। ওলন্দাজ ইয়ান তোকে যে ভাষা শিখিয়েছে, সেটা এই লোক শেখেনি, সে শিখেছে আমেরিকাতে। সে যে ভাষা বলে, তা ওলন্দাজদের গেবারেন্টাল বা ইশারা ভাষা থেকে কিছুটা আলাদা। সে জন্য তোদের কথাবার্তাটা গোলমেলে হয়ে গেছে। বুঝলি? তোকে এবার যে শেখাবে, তার নাম রেখা। এখন আমরা রেখার জন্য বসে থাকব। রেখা দোতলা থেকে নামবে।’
চার
ছ মাস পর আমি বাড়ি ফিরলে ঈদের মতো একটা উৎসব শুরু হয়ে গেল। দুপুরের খাবার পর বাবা আমাকে বললেন, ‘কেমন চলছে মা?’
‘রেখা কেমন শেখাল? ও তো মার্কিনদেরটা শেখায়, তাই না?’
আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিল যে লোকটা, তার নাম ইমরান।
আমার উত্তর শুনে বাবার চোখ হাসল। এই প্রথম বাবার চোখের দিকে তাকাতে আমার লজ্জা হলো। কেন?
বাবা বললেন, ‘তোর চোখে কি কিছু পড়েছে মা? হঠাৎ নামিয়ে নিলি যে?’
আমাকে বাঁচালেন মা। খেজুরের পায়েস রেঁধেছেন আমার জন্য, এই কদিন হাসপাতাল তাকে বাঁধতে পারবে না। বেঁধেছি আমি। ঢাকা গিয়ে আমাকে নিয়ে এসেছেন মা। কত দিন পর যে ছুটি নিলেন।
পায়েসের বাটি টেবিলে রেখে মা বললেন বাবাকে, ‘আমাদের রিফাত এখন কবিতা লিখছে, জানো?’
বাবা অবাক হলেন। আমার মাথায় বাজ পড়ল, আমি যে-খাতায় এটা সেটা লিখে রাখি, তার একটা পাতায় মার চোখ গেছে। খাতাটা হাতে ধরে আমি বাসে উঠেছিলাম। মা বাঁ হাতে ধরা সেই খাতার পাতাটা খুলে বললেন, ‘শোনো মেয়ে কী লিখেছে, কী দারুণ কবিতা।’ বাবা বললেন, ‘তাই বুঝি?’ মা পড়লেন, ‘তুমি বলেছিলে আমার চোখ দুটি খুব সুন্দর, তুমি কি জানো, তোমার চোখ দুটিও কত সুন্দর?’ মার গলা গভীর হলো। আমি ঠিকই বুঝলাম মা কোন পঙ্ক্তিগুলো পড়ছেন। তিনি আরও পড়লেন, ‘আমার হাতে তোমার হাত, আমার চোখে তোমার চোখ…তোমার চোখের ভাষা আমাকে ভাসিয়ে নেয়।’
বাবা হঠাৎ খাতাটা মার হাত থেকে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা কবিতা না, এটা ইশারা ভাষার জন্য একটা লেসন। এই জটিল কথাগুলো যে সুন্দরভাবে ইশারায় বলতে পারবে, এনজিওটা তাকে ওলন্দাজদের দেশে পাঠাবে। আরও ট্রেনিংয়ের জন্য। সঙ্গে ওই যেন কী নাম ছেলেটার, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ইমরান, সেও যাবে।’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাই না মা?’
বাবার চোখটা এত কোমল প্রসন্নতায় ভরা যে আমি যে উত্তর দেব, কীভাবে? আমার জানা সব ভাষা একটা জায়গায় এসে লেজেগোবরে হয়ে গেল। আমি অস্থির হাতে কান থেকে শোনার যন্ত্রের তারটা খুলে ফেলে বাবার পাঞ্জাবির একটা দিক তুলে তার নিচে মাথাটা সোজা ঢুকিয়ে দিলাম।
ছোটবেলায় যেমন করতাম, ভাষাটা হারিয়ে ফেললে।
প্রথম প্রকাশ, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬