ভারতে চোখের ক্যান্সারের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। যা উদ্বেগের। চিন্তিত বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, যে ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১0 হাজার নতুন চোখের ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়। এর মধ্যে, প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশর ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের এবং ৩০ থেকে ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের চোখের ক্যান্সার হয়। ভারতে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার শিশুর রেটিনোব্লাস্টোমায় চিকিৎসা করা হয়। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশের রোগীরা ভারতে আসেন চোখের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য। আজ অবধি, স্বনামধন্য চোখের ক্যান্সার ডাক্তাররা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রোগীদের জন্য ভারতে অরবিটাল টিউমার সার্জারি চিকিৎসা সফলভাবে সঞ্চালিত করেছেন।বেশিরভাগ ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীই প্রথমদিকে প্রাণঘাতী এই রোগের বিষয়ে টেরই পান না। যখন ক্যানসার কোষ ছড়িয়ে পড়তে থাকে, ঠিক তখনই নানা শারীরিক সমস্যার লক্ষণের কারণে পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়ে ক্যানসার।
আপনি কি জানেন? সমীক্ষায় দেখা গেছে , বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতি মিনিটে একটি শিশুর দু-চোখই অন্ধ হয়ে যায়। আবার এও দেখা গেছে বিশ্বের ১.৫ মিলিয়ন অন্ধ শিশুর মধ্যে ২০ হাজার ভারতীয় বলে অনুমান করা হচ্ছে। যেটা বিশেষজ্ঞদের কাছে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গত, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সেই সঙ্গে চোখের ক্যানসার। অনিয়মিত জীবনযাপন থেকে শুরু করে অ্যালকোহল, ধূমপান-সহ নানাবিধ কারণে চোখ, ফুসফুস, ব্রেস্ট সহ প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশিরভাগই। অনেকেই ক্যানসারের নাম শুনলেই ভয়ে গুটিয়ে পড়েন। আসলে এ রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা জরুরি। এই রোগ নিয়ে যত কম কথা বলবেন, ততই কিন্তু সবাই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চোখ সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্যানসার অসুখটি এখন বাড়ছে। আমাদের জীবনযাত্রার কিছু ভুলত্রুটি এই সমস্যা ডেকে আনছে। তাই প্রতিটি মানুষকে অবশ্যই এই রোগ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।যেহেতু ক্যানসার একবার ধরা পড়লে তার চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী হয়ে থাকে। তাই যত দ্রুত রোগটি শনাক্ত করা যাবে, ততই রোগীর সুস্থতা নিশ্চিত হবে। ক্যানসার শরীরে বাসা বাঁধলে বেশ কয়েকটি লক্ষণ শরীরে দেখা দেয়। যা সাধারণভাবে অনেকেই অবহেলা করেন। তাই শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে অবহেলা করবেন না। এর মাধ্যমেই কিন্তু আপনি প্রাথমিক পর্যায়েই ক্যানসার শনাক্ত করতে পারবেন। জেনে রাখা ভালো, শরীরে ক্যানসার বাসা বাঁধলে চোখেও এর প্রভাব পড়ে। এ কারণেই চোখে বেশ কয়েকটি লক্ষণ ফুটে ওঠে। লক্ষণগুলো কি কি? তা হল এক্ষেত্রে বহু মানুষের চোখের দৃষ্টি ঝপসা হয়ে যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ফুসফুসে টিউমার হলেও চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়। এমনকি চোখে ব্যথাসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ২০২০ সালের একটি গবেষণায় বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চোখের বেশ কিছু সমস্যা যেমন — চোখে কম দেখা, চোখে ঝাপসা দেখা, ব্যথা, চোখে কোনো স্পট ঘুরে বেড়ানো, চোখ ফুলে যাওয়া, চোখ জ্বালা করা ইত্যাদি দেখা দিলে কেউ অবহেলা করবেন না। কারণ চোখের এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ফুসফুসে ক্যানসার ও ব্রেস্ট ক্যানসার হলেও চোখে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে চোখ জ্বালা করা, চোখ থেকে ক্রমাগত জল পড়া, চোখ ঘোলাটে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি প্রোস্টেট ক্যানসারেও এই লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তাই চোখের কোনো সমস্যাকে অবহেলা করবেন না। উল্লেখ্য,ক্যানসার হলে চোখে সমস্যা দেখা দেওয়ার মূল কারণ হল অপরিবটাল মেটাস্টিটিস। এক্ষেত্রে ক্যানসার বেড়ে গেলে চোখের আশপাশেও প্রভাব ফেলে। তখন দেখা দেয় নানা সমস্যা। যদিও এসব ক্ষেত্রে ক্যানসার হয়তো চোখে ছড়ায় না, তবে এর লক্ষণ পৌঁছায়। সাধারণত স্তন, ফুসফুস ও প্রোস্টেট ক্যানসারের ক্ষেত্রে সমস্যা চোখে পৌঁছে যায়। তবে সবার ক্ষেত্রেই যে সবগুলো লক্ষণ প্রকাশ পাবে তা কিন্তু নয়।শরীরের অন্য স্থানের ক্যানসারও চোখে ছড়াতে পারে।
চোখের ক্যানসারের উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা হচ্ছে, সার্জারি, রেডিয়েশন ও লেজার থেরাপি। টিউমার ছোট হলে, দ্রুত বৃদ্ধি না পেলে ও চোখে সমস্যা সৃষ্টি না করলে চিকিৎসকেরা এটাকে ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে রাখবেন। এ টিউমার চতুর্দিকে ১০ মিলিমিটার বড় হলে অথবা ৩ মিলিমিটার লম্বা হলে চোখের অংশ বিশেষ ফেলে দিতে সার্জারির পরামর্শ দিতে পারেন। টিউমারটি কতটুকু অংশকে আক্রান্ত করেছে তার ওপর ভিত্তি করে সার্জারি নির্ভর করছে। চোখের ক্যানসার কোষকে ধ্বংস করতে চিকিৎসকেরা উচ্চ শক্তির বিকিরণও (একপ্রকার এক্স-রে) ব্যবহার করতে পারেন। সার্জারি সহকারে অথবা সার্জারি ছাড়াই রেডিয়েশন থেরাপি দেয়া যায়। কিন্তু এতে সুস্থ কোষও মারা যায় এবং চোখ শুষ্ক হয়ে পড়ে, চোখের পাতার লোম ঝরে যায় ও দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে। সবচেয়ে প্রচলিত লেজার চিকিৎসা হলো ট্রান্সপিউপিলারি থার্মোথেরাপি (টিটিটি)। এ থেরাপিতে ছোট টিউমারকে সংকুচিত করতে অবলোহিত আলোর বিকিরণ প্রয়োগ করা হয়। আই মেলানোমার চিকিৎসায় এ থেরাপি ব্যবহার করা হয়, কারণ কোষগুলো লেজারের আলোকশক্তি শোষণ করে। ইন্ট্রাঅকুলার লিম্ফোমাতে এ থেরাপি কার্যকর নয়। লেজার থেরাপিতে সার্জারি রেডিয়েশনের চেয়ে পাশ্বপ্রতিক্রিয়া কম।
আবার অনেক সময় দেখা যায় কনজাঙ্কটিভাল মেলানোমা। চোখের সাদা অংশের ওপর ও পাতার নিচে যে শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি বা পাতলা পর্দা থাকে তাকে কনজাঙ্কটিভা বলে। কনজাঙ্কটিভাল মেলানোমা হচ্ছে একটি বিরল ধরনের ক্যানসার যা কনজাঙ্কটিভাতে বিকশিত হয়। চোখের ওপর কালো দাগ দেখলে এটা কনজাঙ্কটিভার টিউমার হতে পারে। এ ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসা দ্রুত না করলে এটি লসিকাতন্ত্রের মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এছাড়া ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড ক্যানসার হতে পারে। অশ্রু উৎপাদনকারী গ্রন্থিতে সৃষ্ট টিউমারকে ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড ক্যানসার বলে। এটাও বিরল ধরনের ক্যানসার। ল্যাক্রিমাল গ্রন্থির অবস্থান হল প্রত্যেক চোখের উপরিস্থ পাতার নিচে। ৩০ বছরে পা রাখা মানুষের ক্যানসার বেশি হয়। এছাড়া শিশু বেড়ে ওঠার সাথে সাথে রেটিনোব্লাস্ট নামক কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায় ও টিউমার গঠন করে। কখনো কখনো শিশুর ফটোগ্রাফে এ ক্যানসারটি প্রথম ধরা পড়তে পারে, যেখানে চোখের একটি তারা অন্য তারা থেকে ভিন্ন দেখায়।
আর একটি হল ইন্ট্রাঅকুলার লিম্ফোমা: লসিকা গ্রন্থিগুলো বর্জ্য ও জীবাণু দূর করতে সাহায্য করে। শরীরের সবখানে লসিকাগ্রন্থি রয়েছে, এমনকি চোখেও। ইন্ট্রাঅকুলার লিম্ফোমা হচ্ছে একটি বিরল প্রকৃতির ক্যানসার, যা চোখের লসিকা গ্রন্থিতে ডেভেলপ করতে শুরু করে। ক্যানসারটি শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে, কারণ এর উপসর্গ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন ইউভিয়াল মেলানোমা: প্রাইমারি আই ক্যানসারের সবচেয়ে কমন ধরন হলো ইউভিয়াল মেলানোমা। চোখের ইউভিয়াতে কোষ থেকে টিউমার সৃষ্টি হলে তাকে ইউভিয়াল মেলানোমা বলে। ইউভিয়ার তিনটি অংশ, যথা — আইরিস বা চোখের রঙিন অংশ, সিলিয়ারি বডি (তরল তৈরি করে ও ফোকাসে সাহায্য করে) ও কোরয়েড লেয়ার (চোখে রক্ত সরবরাহ করে)। সাধারণত কোরয়েড লেয়ারে কোষের পরিবর্তন হতে থাকে এবং ক্যানসারে পরিণত হয়। তাছাড়াও উল্লেখযোগ্য হল রেটিনোব্লাস্টোমা: শিশুদের চোখের ক্যানসারের সবচেয়ে কমন ধরন হচ্ছে রেটিনোব্লাস্টোমা। বেশিরভাগ সময় পাঁচ বছরের পূর্বে এ ক্যানসার শনাক্ত হয়। সাধারণত শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় চোখের পেছনের অংশ রেটিনাতে এটি বিকশিত হতে শুরু করে। শিশু বেড়ে ওঠার সাথে সাথে চোখের ক্যানসারে যে লক্ষণটি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে তা হল, দৃষ্টিতে পরিবর্তন। এ ক্যানসারের রোগী ভালোভাবে দেখতে অসমর্থ হতে পারে অথবা চোখের সামনে আলোর ঝলকানি অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্পট/দাগ/রেখা/ ফুটকি/বিন্দু (ফ্লোটার্স) দেখা যেতে পারে। এক চোখে কালো দাগও ডেভেলপ হতে পারে অথবা আকার-আকৃতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। প্রসঙ্গত, চোখের ক্যানসারে সবসময় প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গ প্রকাশ পাবে এমনটা নাও হতে পারে। তাছাড়া অন্য সমস্যার কারণেও উপসর্গগুলো ডেভেলপ করতে পারে। চোখের ক্যানসারের ধরন চোখের সুস্থ কোষের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটলে এবং বিশৃঙ্খলভাবে খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেলে টিস্যুর একটি পিণ্ড গঠিত হয়। এটাকে বলে চোখের টিউমার। এ সমস্যা চোখের ভেতর হলে তাকে প্রাইমারি আই ক্যানসার বলে। শরীরের অন্য অংশ থেকে চোখে ক্যানসার ছড়ালে তাকে সেকেন্ডারি আই ক্যানসার বলে।
পরিশেষে এটা বলতেই হয়, চোখ গেল তো সব গেল। চোখের আলোয় থাকতে হলে যত্ন নিন। সতর্ক থাকুন। সামান্য চোখের সমস্যা হলে কাছাকাছি হাসপাতালে যান কিংবা চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। বিশেষ করে বাচ্চা থেকে স্কুল পড়ুয়াদের নজর দিন চোখের উপর।
ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী, চক্ষু বিশেষজ্ঞ, দৃষ্টিদীপ আই ইনস্টিটিউট, ডানকুনি, হুগলি, মোবাইল-৮০১৭৩০৯০৫৮
সাক্ষাৎকার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায়