একটি দুর্গাপূজা যে কীভাবে অর্থনীতি ও সামাজিক বিন্যাসের পরিবর্তন ঘটাতে পারে, তা বেহালার সখেরবাজার থেকেই বোঝা যায়।
বর্তমানে বেহালা সখের বাজার ঠিক কীসের বাজার জানি না। তবে এটা জানা থাকা দরকার যে শুধু বেহালা-বড়িশাতেই নয়, সখের বাজার নামে জায়গা আছে উত্তরপাড়ার ভদ্রকালীতে, বজবজের কাছে বাওয়ালিতে আর আড়িয়াদহে। অনেকে বলেন বড়িশা সাবর্ণচৌধুরীদের সখসাধের জিনিস পাওয়া যেত এই বাজারে। তাই নাম হয়েছে সখের বাজার। শোনা যায়, তারিণীচরণ রায়চৌধুরীর আমলে এই বাজারের প্রতিষ্ঠা। তবে কলকাতার যে আঠেরোটি বাজারের উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৬৮-র কোম্পানি-রেকর্ডে, তাতে সখের বাজারের নাম নেই। তার পরে কোনও একসময় এর সৃষ্টি হয়।
আসল ঘটনা হল, সখের বাজার আদতে ছিল চিনির বাজার। চিনিকে আগে বলা হত সক্কর। ১৭৭৯-১৭৮১তে বজবজের কাছে আছিপুরে প্রথম চিনিকল তৈরি করেন চীনা ব্যবসায়ী টং আছিউ। তাঁকে বার্ষিক মাত্র ৪৫ টাকা খাজনার বিনিময়ে ৬৫০ বিঘা জমি পাট্টা দেন বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস। আখচাষ করার জন্যে ও চিনিকলে কাজ করার জন্যে স্বদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক আনিয়েছিলেন টং আছিউ।
কিন্তু টংয়ের মৃত্যুর পর বন্ধ হয়ে যায় চিনিকল। যাই হোক কাছেই বাওয়ালির সখের বাজার তথা সক্করবাজারে এই চিনি বাজারজাত হত। সক্করবাজার অপভ্রংশের ফলে সক্কেরবাজার তথা সকেরবাজার বা সখেরবাজার হয়ে যায়। এখান থেকে বাখরাহাট-রায়পুর হয়ে কিছু চিনি চলে আসত বেহালা সখেরবাজারে। রাজা নবকৃ্ষ্ণ দেবের বাগানবাড়ি ছিল সোদপুরের সুখচরে। বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। সুখচরে দেশীয় পদ্ধতিতে লালচিনি তৈরি হত। এর সুনাম ছিল উত্তরভারতের কাশী ও বাটাভিয়ায়। ক্রমে ক্রমে সুখচর নবকৃষ্ণ দেবের জমিদারিতে পরিণত হল। পরবর্তীকালে রাধাকান্ত দেব এখান থেকেই বৃন্দাবন যান। নবকৃষ্ণ দেব বেহালা থেকে ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত যে ডায়মন্ডহারবার রোড তৈরি করান, তার সঙ্গে চিনি রপ্তানির সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। চিনিকলের সাদা চিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিলেতে রপ্তানি করত আঠেরো শতকের শেষভাগে। কেননা সে যুগে বিলেতের সাহেবমেমরা চিনিতে আসক্ত ছিল। কিউবা বা ল্যাটিন আমেরিকার ক্রীতদাসকৃত চিনি তারা খেতে চাইত না। তাই নজর পড়েছিল ভারতের চিনির দিকে। উমিচাঁদ ও আর্মেনিয়ান খোজা ওয়াজিদ ছিলেন তৎকালের বড় সুগার-মার্চেন্ট।
বেহালার সখেরবাজার-এ এখনও চিনির চিহ্ন আছে কিনা বলতে পারব না। উত্তরপাড়ার ভদ্রকালীর সখেরবাজারে চিনির পুরনো গুদামের ধ্বংসাবশেষ আছে বলে শুনেছি, তবে দেখিনি নিজের চোখে। লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী (মজুমদার) বড়িশার সাবর্ণরায়চৌধুরীদের দুর্গাপূজার সূচনা করেন ১৬১০-এ। এই পূজায় ল্যাটা বা শোল মাছের ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। মুখে কাপড় বেঁধে ভোগ রান্না করেন বাড়ির সদ্যস্নাতা সিক্তবসনা মহিলারা। বাটাচিনির নৈবেদ্য দেওয়া হয় কি? সাবর্ণচৌধুরীদের প্রতিষ্ঠিত পুকুরেই দেবীর বিসর্জন সারা হয়। দশমীর দিন বাড়িতে তৈরি বোঁদে দিয়ে দশমী সারা হয় তিন-চারশো বছর ধরে। বোঁদে তৈরিতে লাগে চিনির রস। এই পূজার কারণেই যে কাছাকাছি চিনির বাজার গজিয়ে ওঠেনি, তা কে বলতে পারে? বেহালা সখেরবাজারের সঙ্গে কি তাহলে পরতে পরতে জড়িয়ে আছ সাবর্ণচৌধুরীদের দুর্গাপূজা?