এগারো
ইতিমধ্যে কলকাতাকে কেন্দ্র করে লোকসংগীত, মার্গসংগীত, হিন্দুস্তানি সংগীত, পাশ্চাত্য সংগীত ইত্যাদির বহুবিচিত্র বর্ণচ্ছটায় বাংলা গানের জগতে বর্ণাঢ্য এক বৈচিত্র্যময় পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। এই প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্ররূপে স্বীকৃত হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি এবং এই পর্বেই সেই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব। ভাব ও ভাবনায় তাঁর গান বিকশিত হয় এই পরিমণ্ডলেই। রবীন্দ্রনাথ লালিত হয়েছিলেন বৃহত্তর ভারতবর্ষীয় সংগীতের ঐতিহ্যে। তাই উপমহাদেশীয় গানের সকল ধারাই তাঁর গানের পারাবারে এসে মিশেছিল। তা ছাড়াও পাশ্চাত্য সংগীতের বহু সুরও রবীন্দ্রসংগীতকে বিশেষভাবে সুসজ্জিত করেছে।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানকে জাতে তুলে নেননি, তাঁর হাতে বাংলা গান রূপ পেয়েছে একটি নতুন জাতির। জাতিটিকে আধুনিক গান নামেই অভিহিত করতে হয়। বাংলার তথা ভারতবর্ষের সকল সংগীতের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে তিনি এক নতুন শৈলীর প্রবর্তন করেছেন। স্রষ্টাসুলভ সাহসের সঙ্গে নবাবিষ্কৃত স্বকীয় রীতিতে আস্থা রেখে উপমহাদেশের অমর সংগীতের সুপরিণত ধারাকে ভিন্ন খাতে পরিচালনা করে নিয়ে গিয়েছিলেন বিস্ময়কর শক্তিধর এই মহান কম্পোজার। তাঁর উদ্ভাবিত নতুন শৈলীর সংগীত কালে কালে ‘রবিবাবুর গান’, ‘রবীন্দ্রসংগীত’ এবং সর্বশেষ ‘রবীন্দ্রনাথের গান’ বলে পরিচিত। এ ধারায় সুদূরের কোনও ভাবীকালে হয়তো তাঁর বর্ষার গান ‘ঠাকুর কি মল্লার’, ঊষার গান ‘ঠাকুর কি টোরি’, গোধূলির গান ‘ঠাকুর কি পূরবী’ প্রভৃতি নামেই অভিহিত হবে।
রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক আরও চারজন সংগীতজ্ঞ আধুনিক বাংলা গানকে কথায়, সুরে, তালে, ছন্দে, বিষয়বৈচিত্র্যে উদ্ভাসিত করেছেন — দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০), অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) ও কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৮-১৯৭৬)। এঁরা একাধারে গীতিকার এবং সুরকার, কিন্তু কেউই কারুর সঙ্গে তুলনীয় নন। গানের প্রকাশভঙ্গি, আঙ্গিক, বিষয়বস্তু, সুরারোপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এঁরা সকলেই মৌলিকত্ব দেখিয়েছেন এবং নিজ নিজ স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন প্রত্যেকেই। আধুনিক গানের বৈশিষ্ট্য এঁদের গানে সার্থক রূপ পেয়েছে।
এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে পিছনের সহায়তার গুরুত্ব যথেষ্ট — সে সত্য এঁদের সৃজনেও সুপ্রমাণিত। বাংলা গানের ঐতিহ্য এই ঐতিহাসিক সত্যকে প্রয়োজনে ভবিষ্যতেও বারবারই প্রমাণ করবে। সারবান গানের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সে গানের দায়িত্ব সুখে-দুখে, হরষে-বিষাদে, স্বজনে-বিজনে, অন্তরে-বাহিরে সকল সময়ে মানুষকে সঙ্গ দেওয়া, তার রুচিকে শুদ্ধ করা, মনকে নির্মল করা, চেতনাকে উন্নত করা। এ দায়িত্ব সর্বাংশে পালন করেছে বলেই পঞ্চপ্রধান, পঞ্চভাস্কর, পঞ্চপ্রদীপ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রেমার্দ্র অভিধায় অভিহিত বাংলা গানের এই চিরন্তন রচয়িতাদের সৃজিত গান কালোত্তীর্ণ হয়ে একালেও গীত হচ্ছে এবং মনে হয় সর্বকালেই গীত হবে।
বারো
বর্ণিত ধারাবাহিকতাতেই বাংলা গান দেবাঙ্গন থেকে বেরিয়ে জনাঙ্গনের সর্বকোণে ছড়িয়ে পড়েছে। পুরোহিতের মন্দির, সম্রাটের দরবার, জমিদারের জলসাঘর, জনপদের প্রেক্ষাগার ইত্যাদি মাতিয়ে, খোল-নলচে পাল্টে, শহরাঞ্চলে, গ্রামেগঞ্জে — মাজমা, সম্মেলন, সেমিনার, প্রতিযোগিতা, শিক্ষাসূচি প্রভৃতির মাধ্যমে বাংলা গানের প্রেক্ষাপট নিরবচ্ছিন্ন গতিতে সজ্জিত ও প্রসারিত হয়ে চলেছে।
এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সমকালীন সম্প্রচার-মাধ্যমগুলির। পরবর্তীকালীন অপরিসীম ক্ষমতাধর গণসম্প্রচার মাধ্যমসমূহ যথা রেডিয়ো, গ্রামোফোন, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং অসংখ্য পত্রপত্রিকা বাংলা গানের প্রসারকে ব্যাপকতম রূপ দান করল। ফলে সর্বস্তরের মানুষের মনে আধুনিক বাংলা গান অনায়াসে জায়গা করে নিল এবং প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল আপন মহিমায়। তাই আজ নির্দ্বিধায় বলা যায় — বাংলা গানই হল বাংলার প্রাণ।
রবীন্দ্র-নজরুলের পর একাধারে বহু কথাকার, সুরকার ও রূপকারের সুসমন্বিত প্রয়াসে ঐশ্বর্যময় আবহসংগীত সহযোগে পরিবেশনগুণে বাংলা গান আজকের এই সুবিপুল সাফল্যটি অর্জন করেছে। সাফল্যের মূলে ছিল শুধু কথা আর সুরই নয়, তাতে আরেকটা মাত্রা যোজন করেছিল অভূতপূর্ব যন্ত্রানুষঙ্গও। গানে উৎকর্ষসাধনের ক্ষেত্রে যন্ত্রীদের অবদান বিকল্পবিহীন। তাঁরা কাজ করেন নেপথ্যে। কিন্তু তাঁদের কাজের প্রসাদগুণেই গান আজ সকল ধরনের মঞ্চ থেকেই সীমার বাঁধন ছাড়িয়ে অসীমের অজানায় পাড়ি জমাতে পারে।
‘সাত ভাই চম্পা’ (লতা মুঙ্গেশকর), ‘এ শুধু গানের দিন’, ‘মধু মালতী ডাকে আয়’, ‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’ (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়), ‘যা যারে যা পাখি’ (শ্যামল মিত্র), ‘তুমি সুন্দর যদি নাহি হও’ (তালাত মাহমুদ), ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্র“বতারা’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়), ‘এলো বরষা যে সহসা’ (ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য), ‘কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায় (মান্না দে) ইত্যাদি গানের প্রেলিউড-ইন্টারলিউড কি কোনওদিন ভোলার? এই সময়কার গানের কথা, সুর, কাব্যময়তা, যন্ত্রানুষঙ্গ — সব মিলিয়ে এ যেন এক ঐন্দ্রজালিক মেলবন্ধন, এক অলৌকিক ককটেল। ফলত এসব গান হতে পেরেছে সকল প্রজন্মের, অন্যকথায় চিরায়ত।
বাংলা গানের অভূতপূর্ব সমৃদ্ধির এই পর্বে একপাল সমমানের কথাকার, সুরকার ও রূপকারের চাঁদের হাট থেকে যদৃচ্ছচয়িত কয়েকজনের নামোল্লেখ করছি শুধু এটুকু বোঝাতে যে আলোচনাটা কল্পজগতের নয়, বাস্তবজগতেরই। গীতিকার : অজয় ভট্টাচার্য (১৯০৬-১৯৪৩), সুবোধ পুরকায়স্থ (১৯০৭-১৯৮৪), প্রণব রায় (১৯০৮-১৯৭৫), শৈলেন রায় (১৯১০-১৯৬৩), মোহিনী চৌধুরী (১৯২০-১৯৮৭) প্রমুখ। সুরকার : লালচাঁদ বড়াল (১৮৭০-১৭০৭), তুলসী লাহিড়ী (১৮৯৭-১৯৫৯), ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় (১৯০৯-১৯৭৭), রাইচাঁদ বড়াল (১৯০৩-১৯৮১), হিমাংশুকুমার দত্ত সুরসাগর (১৯০৮-১৯৪৪), অনুপম ঘটক (১৯১১-১৯৫৬), কমল দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৭৩) প্রমুখ। রূপকার : কৃষ্ণচন্দ্র দে (১৮৯৩-১৯৬২), ইন্দুবালা (১৮৯৮-১৯৮৪), আঙ্গুরবালা (১৯০০-১৯৮৪), জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী (১৯০২-১৯৪৭), কুন্দনলাল সায়গল (১৯০৪-১৯৪৭), কমলা ঝরিয়া (১৯০৬-১৯৭৯), শচীন দেববর্মন (১৯০৬-১৯৭৫) প্রমুখ। আর একটি নাম দাবি রাখে স্বতন্ত্রস্বরূপ উল্লেখের। তিনি উনিশ শো বিশ-ত্রিশ দশকের শিল্পীকুলের শিরোভূষণ— যুগপৎ গীতিকার ও সুরকার কাজী নজরুল ইসলাম। এঁর এক স্বাতন্ত্র্য তো এই যে, পঞ্চপ্রধানের মধ্যে একমাত্র নজরুলই ছিলেন বর্ণিত শিল্পীগণের মধ্যমণিস্বরূপ সহশিল্পী।
যুগ, সমাজ, ব্যক্তিরুচি চিরকালই সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। এই সময়কার বাংলা গানে রোমান্টিকতার খরস্রোতেও যুগের প্রভাব ও সমাজের চাহিদাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। চল্লিশের দশকে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, স্বাধীনতা-আন্দোলন, জাতিগত দাঙ্গা ইত্যাদি মিলে দেশজুড়ে যে বিশৃঙ্খলা — তার প্রভাব গানেও অবিস্মরণীয়ভাবেই পড়েছে। যাঁদের গান এই সময়ে জনমানসে প্রবল সাড়া জাগিয়েছিল তাঁদের কয়েকজন : জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, বিনয় রায় প্রমুখ। জ্যোতিরিন্দ্রের ‘নবজীবনের গান’ এক বিশেষ কালে সৃষ্ট চিরকালীন শিল্প এবং সময়ের ঐতিহাসিক দলিল। ১৩৫০ সালের মন্বন্তর গোটা বাংলাদেশে, বিশেষ করে কলকাতায়, যে করাল ছায়া বিস্তার করেছিল তা-ই বর্ণিত ও অঙ্কিত হয়েছিল এই গায়ক-কবির গানে এক অসামান্য দক্ষতায়।
এছাড়াও ১৯৪৭ সালের গণহৃদয়বিদারক দেশভাগের চিরস্মরণীয় স্মারক ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর ’পরে রাগ কর/তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ কর’ (কথা — অন্নদাশঙ্কর রায়, সুর — সলিল চৌধুরী), ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি/জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।’ (কথা-সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুর — সলিল চৌধুরী), ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে/কত প্রাণ হল বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে।’ (কথা — মোহিনী চৌধুরী, সুর ও কণ্ঠ — কৃষ্ণচন্দ্র দে), ‘স্বপন যদি মধুর এমন’ (কথা — জলধর চট্টোপাধ্যায়, সুর ও কণ্ঠ — কৃষ্ণচন্দ্র দে) প্রভৃতি ভিন্নস্বাদের আধুনিক বাংলা গান বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল এবং কালের স্মারক হিসেবে শ্রোতাপ্রিয় থাকবে বহুকাল।
চল্লিশ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত তিনটি দশক আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাসে একটা হীরকোজ্জ্বল অধ্যায়। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ অধ্যায়টি রচিত। অনেক সংগীতপিপাসু মানুষের সধৈর্য প্রস্তুতি, গভীর চিন্তাভাবনা ও অপরিসীম গবেষণার ফসল এই পর্যায়ের বাংলা গান। অনেক সময় একটি গানের নির্মিতিতেই লেগে যেত মাসকে মাস সময়। নির্বাচিত রূপকারকে কথাকার তাঁর রচিত গীতিটি কয়েকদিন বারবার উচ্চারণ ও আবৃত্তির মাধ্যমে স্বরের বাঞ্ছিত উচ্চাবচতা নির্ধারণ করে দিতেন। তারপর সুরকার কয়েকদিন তাঁর সুর গুনগুন করিয়ে রূপকারের মনের খাঁজে খাঁজে বসিয়ে দিতেন।
তারপর শুরু হত গানটি গাওয়ানোর পূর্ণাঙ্গ মহড়া। বর্ণিত প্রক্রিয়াটি জুড়েই চলত সর্ববিষয়ে সংস্কার—সংযোজন-বিয়োজন, সংশোধন-পরিমার্জন, এমনকি প্রয়োজনে পরিবর্তনও। এত সব যত্নের অন্তেই একটিমাত্র ‘টেক’-এ শ্রোতা পেত ‘নাই বা ঘুমালে প্রিয়’, ‘তুমি আজ কত দূরে’র মতো চিরকালীন গান। কারণ দুই টেকে দুনো খরচ বহন করতে রাজি হত না রেকর্ড কোম্পানি। এখনকার মতো অংশ অংশ রেকর্ড করার ভার্সেটাইল ফ্যাসিলিটি তখন ছিল না।
এই অমরত্বের পেছনে রয়েছে আরেক দূর্নিরীক্ষ্য অনির্বচনীয়ের জোগান। উপমহাদেশীয় সব ধরনের সংগীতের পুঞ্জীভূত প্রসাদগুণ থাকত এসব চিরন্তন বাংলা গানের দেহে লীন হয়ে — যেমন কোথাও সাঁওতাল পরগনার ঝুমুর, কোথাও উত্তরপ্রদেশের লোকলোর, কোথাও বিহার অঞ্চলের লাউনি, ইত্যাদি। এমনকি পাশ্চাত্য সুরের ভাবধারাও সুন্দর এবং সুচারুরূপেই দেশীকরণের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হত এতে। সব মিলিয়ে এ এক অপূর্ব রন্ধন ও বিরল আস্বাদন সংগীতের।
যে সমস্ত বিরল প্রতিভাধর গীতিকার, সুরকার এবং রূপকারের সুসমন্বয়ে বাংলা গানের এই ঐশ্বর্যমণ্ডিত অধ্যায় রচিত হয়েছিল — তাঁদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি, যাঁরা ফোকাসে এসেছিলেন পূর্ববর্ণিতদের পরে। গীতিকারের তালিকার কয়েকজন হলেন — শ্যামল গুপ্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৩-১৯৯৯), গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার (১৯২৪-১৯৮৬), সুনীলবরণ প্রমুখ। সুরকারদের কয়েকজন শৈলেশ দত্তগুপ্ত (১৯০৫-১৯৬০), পঙ্কজ মল্লিক (১৯০৫-১৯৭৮), হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৯), নচিকেতা ঘোষ (১৯২৪-১৯৭৬), অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনল চট্টোপাধ্যায়, রবীন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। গীতিকার-সুরকার বলতে সুধীন দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী (১৯২২-১৯৯৫), প্রবীর মজুমদার প্রমুখ। রূপকারদের কয়েকজন সন্তোষ সেনগুপ্ত, বেচু দত্ত, রবীন মজুমদার (১৯১৮-১৯৮৩), হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৯), মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় (১৯২৯-১৯৯২), শ্যামল মিত্র (১৯২৯-১৯৮৭), সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, লতা মুঙ্গেশকর, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, নির্মলা মিশ্র, আরতি মুখোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, আশা ভোঁসলে প্রমুখ।
কথা ও সুরের বৈচিত্র্যে, নব নব মৌলিক সৃষ্টির সমাহারে, নিপুণ নিখুঁত উপস্থাপনায় এই সময়কার বহু বহু গান জনপ্রিয়তার শীর্ষে উন্নীত হয়েছিল এবং এখনও শীর্ষেই রয়েছে। বিরল প্রতিভার অধিকারী এই সব শিল্পী ছিলেন যাঁর যাঁর ক্ষেত্রে আত্মস্থ, ধ্যানমগ্ন। উপলব্ধির সমুদ্রের এসব ডুবুরি ততক্ষণই নিমজ্জিত থাকতেন, যতক্ষণ না তাঁদের সন্ধিত মুক্তোটি খুঁজে পেতেন।
চল্লিশের দশক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত তিনটি দশক ধরে এত উচ্চমানের এত বেশিসংখ্যক সংগীতগুণী কমবেশি একই সময়ে নানা ধরনের অজস্র গানে সর্বস্তরের অগণিত শ্রোতার মনেপ্রাণে যে সুখ, তৃপ্তি, আনন্দ ইত্যাদি নানা ভাবাবেগের সঞ্চার করেছেন, সে উপহার অদূর তো নয়ই, সুদূর ভবিষ্যতেও বাংলা গানের শ্রোতা আর পাবেন বলে মনে হয় না। কারণ বিবিধ। তার মধ্যে নগ্ন অনুকরণের মাধ্যমে বাংলা গানকে মলিন এবং কলুষিত করার প্রবণতা, অবক্ষয়ী ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রভাব, শিল্পীদের জীবিকাতাড়িত মানসিকতা, সর্বগ্রাসী ব্যবসাদারি হামলা এবং সস্তায় বাজার মাত করার ধান্দার কথা বলতেই হয়।
এর পর থেকে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সত্তরের দশকের শেষার্ধ থেকেই যেন সমকালীন বাংলা গান ক্রমশ পথহারা হয়ে উঠল। আস্তে আস্তে সংগীতরসিকদের মনে আধুনিক গান সম্পর্কে একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে লাগল। পরিলক্ষিত হতে থাকল কেমন যেন চমকহারা একটা ম্রিয়মাণ ভাব। আশির দশকে তো সমকালীন বাংলা গান প্রায় অবলুপ্তির মুখে বলেই ধারণা করেছেন সকলে। এই ধারণা অমূলক ছিল না। কারণ, যে-কোনও শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে মৌলিকত্বই প্রধান কথা। এই পর্বে যার অভাবে বাংলা গান ধুঁকছিল।
ফলে ঐতিহ্যবাহী বাংলা গানের জয়যাত্রার গতি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। কেন এমন হল — তা ভাবার অবকাশ ও প্রয়োজন দুই-ই ছিল। গান তার অন্তর্নিহিত মৌলিক গুণাবলী ও নান্দনিক আবেদন নিয়ে মানুষের মনে নাড়া দেয়, আবেগ ও রসের সঞ্চার করে — যার রেশ মানুষের মন ও প্রাণকে আবিষ্ট করে রাখে সুদীর্ঘ কাল। আশির দশকে বাংলা গানের ক্ষেত্রে এসব কথার যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায় না। [ক্রমশ]