আঠারো
একুশ শতকের প্রথম দশকের সফ্টওয়্যার-বিস্ফোরণ ছুটি দিয়ে দিল শুধু সাউন্ড-রেকর্ডিস্টের রাজকীয় বিশাল মিক্সার-প্যানেলটিকেই নয়, মাস্টার-জাগলার কি-বোর্ডটিকেও। ধ্বনিধারণ-অলঙ্করণ-সংশোধন-ঘটিত যাবতীয় উপকরণই ঢুকে গেল পার্সনাল কমপিউটারে — ফুটপাতের শরবতের মতো সস্তা পাইরেটেড-সফটওয়্যারের বদৌলতে। এককথায় মিউজিশিয়ানদের বিদায় করে দিল টেকনিশিয়ানরা। অন্যকথায় মিউজিশিয়ানপাড়া হয়ে গেল টেকনিশিয়ানপাড়া। সাউন্ড-রেকর্ডিং স্টুডিয়ো বা পেশাদার ধ্বনিধারণের কর্মশালা হয়ে গেল অ্যামেচার সংগীতরন্ধনের পাকশালা, যা স্বভাবতই এখন ঘরে ঘরে বিরাজ করে। ফাস্টফুডের মতো ঘরে প্রোসেস করা মিউজিক-ট্র্যাক স্টুডিয়োতে পৌঁছালে এবং ভোকালিস্ট এসে ভয়েস যোগ করে দিলে গান বিপণন করা চলে।
যদি প্রশ্ন করেন গানটি কার কণ্ঠস্বরে বিপণিত হল? উত্তর হবে অর্ধেক মানবিক কণ্ঠে, অর্ধেক বৈদ্যুতিন স্বরে। কারণ অনেক ফিফটিপার্সেন্ট বেসুরো-বেতালা কণ্ঠশিল্পীর স্বরকেও প্রায় হান্ড্রেডপার্সেন্ট সুরে-তালে এনে দিচ্ছে স্টেইনবার্গ, সোনার, প্রোটুল্স প্রভৃতি ইলেকট্রনিক অটো-টিউনার। এসব যন্ত্র এমনকি শিল্পীবিশেষের কণ্ঠবিশেষের টিম্বারবিশেষের জন্য লাগসই মাইকটিও বাছাই করে দিচ্ছে ভয়েস-ক্যারেক্টার ফাইন্ডার-নামক ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সাহায্যে। মনুষ্যকণ্ঠকে কমপিউটার হুবহু ‘কোকিলকণ্ঠ’ করে দিচ্ছে বৈদ্যুতিন বংশীর সঙ্গে বেটে দিয়ে, বলতে পারেন, ভর্তা বানিয়ে। মানুষের কণ্ঠের বদলে কোকিলের কণ্ঠ কোনও শ্রোতা শুনতে চায় কিনা জানি না, আমি তো সইতেই পারি না। কারণ চিরকালই সংগীত-গুরুগণ একবাক্যে অকারণ বলে আসছেন না যে সংগীতবিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ যন্ত্রটির নাম — মনুষ্যকণ্ঠ।
বৈদ্যুতিন যন্ত্রের প্রশ্রয়ে বিপথগামী এমন একজন জননন্দিত কণ্ঠশিল্পীর কথা শুনি, যিনি এতই যন্ত্রাশ্রিত যে লাইভ পারফরমেন্স ভালো করতে পারেন না। আলামতটা কি ভালো? না, ভালো নয়। এমনকি ভালো ছিল না প্রথম জাগলারিটিও — গানের কলিটি একবার রেকর্ড করে, সেটিকে প্রয়োজনীয় স্থানগুলিতে কেবল পেইস্ট করে দেওয়া। কেননা কণ্ঠশিল্পীকে প্রতিটি অন্তরা থেকে তো বটেই, কখনও-সখনও
আভোগ-সঞ্চারী থেকে গানটির মুখে ফিরতে হলেও, তিনি একই আবেগানুভূতি কিংবা আকুলিবিকুলির প্রভাব বা অভিঘাত নিয়ে ফেরেন না। সুতরাং এক বিশেষ ব্যাকুলতার আবেগে কণ্ঠনিঃসৃত গানের কলিকে আরেক বিশেষ বিহ্বলতার আবেশে সেঁটে দিলে তা শ্রোতার মনে যথোপযুক্ত ভাব বা রূপটি ফুটিয়ে তুলবে কী করে, তাঁর প্রাণে দোলা দেবে কী করে?
তাহলে প্রযুক্তি কি অভিশাপ? না, প্রযুক্তি আশীর্বাদ। তবে তার ব্যবহারটা হতে হবে সুবিবেচিত। নির্ভেজাল শিল্পীকে মনে রাখতে হবে যে তাঁর প্রযুক্তিপুষ্টির প্রয়োজন পরিমিত। অপরিমিত প্রয়োজনটা থাকবে কেবল ভেজাল শিল্পীর। কারণ তাঁর বেসুরো গলাকে টেনে সুরে তোলা, বেতালা ছন্দকে টেনে ছন্দে ফেলা, এমনকি তালের লয়কেও টানা-হেঁচড়া করে জয় করার জন্য সকল রকম সফ্টওয়্যারই অপরিহার্য।
তিনি জানেন যে হার্ডডিস্কের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি তাঁর জন্য ব্লেসিং-আনলিমিটেড, যেহেতু তাঁর মতো অসিদ্ধ শিল্পীকে অর্ধসিদ্ধ শিল্পী বানিয়ে কিংবা — ‘কিলায়কে কাঁঠাল পাকিয়ে’ — বিপণনযোগ্য করে দিচ্ছে এসব সস্তা সফ্টডিস্কই। পূর্ণসিদ্ধির অভাব অনেকটা তো ঘটাচ্ছে ‘অ্যাকুস্টিক ট্রিটমেন্ট’বিহীন চারদেয়ালের ভেতরে হোম-মেইড মিউজিকট্র্যাকের নির্মিতি, এমনকি পরিস্থিতিবিশেষে তেমন নয়েজি পরিবেশে তড়িঘড়ি কণ্ঠধ্বনিধৃতিও।
বিপণনশীলতার এহেন উন্নতি ঘটছে সৃজনশীলতার ত্বরিত অবনতির বিনিময়ে। প্রযুক্তির অপব্যবহারে বাজারে একাকার হয়ে যাচ্ছে এক ডজন নির্ভেজাল শিল্পীর সঙ্গে এক শত ভেজাল শিল্পী। এমন ‘গুণীতান্ত্রিক’ একটি শিল্পের এমনি ‘গণতান্ত্রিক’ হয়ে যাওয়া কি ভালো? যে-প্রযুক্তির বলে হেমন্ত ‘মুখোপাধ্যায়’ হতে পারব না, সে-প্রযুক্তির ছলে হেমন্ত ‘যুগোপাধ্যায়’ হওয়ার দরকার আছে কি?
রচনাকাল ২০১১
সূত্র :
১। জাতক, ঈশানচন্দ্র ঘোষ অনূদিত, করুণা প্রকাশনী, ১৪০৮, কলকাতা।
২। বাঙ্গালীর রাগসঙ্গীত চর্চা, দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়, ফার্মা কেএলএম, ১৯৭৬, কলকাতা।
৩। সংগীতচিন্তা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী, ১৯০৭, কলকাতা।
৪। লোকসঙ্গীত জিজ্ঞাসা, সুকুমার রায়, ফার্মা কে এলএম, ১৯৮৩, কলকাতা।
৫। বাংলা সাহিত্যের একদিক/রচনা-সাহিত্য, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ১৯৯৩, কলকাতা।
৬। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, উৎপলা গোস্বামী, দীপায়ন, ১৯৯০, কলকাতা।
৭। ডা. সমীরকুমার গুপ্ত, মিলেমিশে, শারদীয় সংখ্যা, ১৪১৬, কলকাতা।
৮। বাংলা গানের বিবর্তন, করুণাময় গোস্বামী, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৩, ঢাকা।
সমাপ্ত