ষোলো
ইলেকট্রনিক টেকনলজি কিংবা বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির মধ্যে কমপিউটারই প্রথম জীবন্ত সংগীতে অনুপ্রবেশ শুরু করেছিল যান্ত্রিক মৃত সংগীত দিয়ে — এবং সেটা উনিশ শ সত্তরের দশক থেকেই। শুরুটা ছিল একান্তই কল্যাণকর। মূলত কমপিউটারই সংগীতের নিত্যসঙ্গী তানপুরা-তবলাকে স্বয়ংক্রিয় করে দিয়েছিল। প্রথমে এল ইলেকট্রনিক ‘সুরপেটি’ কিংবা ‘শ্রুতিবক্স’। সেটা রূপ নিল হালের স্কেল-বাঁধা বৈদ্যুতিন তানপুরার — যা সুইচ টিপলেই আপনা-আপনি বাজতে থাকে শিল্পীর কাক্সিক্ষত স্কেলে — ভ্রমশূন্য যাথাযথ্য বজায় রেখে।
পরপরই এল ইলেকট্রনিক তবলা — ‘লহরা’ এবং ‘তালমালা’র সাজে। দাদরা-কাহারবা-তেওড়া-রূপকড়া যে-কোনও নির্দেশিত তালে এবং নির্ধারিত লয়ে বাজতে থাকলো নির্ভুল যান্ত্রিক যাথার্থ্য নিশ্চিত করে। অভূতপূর্ব সুবিধে পেল শিল্পী তার রেয়াজে। এসবের সৃষ্টি হল প্রধানত ভারতের ব্যাঙ্গালোরে এবং বাংলাদেশে এল বেশির ভাগ কলকাতা হয়ে। অনেকখানি স্বয়ম্ভর হতে পারল সংগীতশিক্ষার্থী। এমনকি অতি মূল্যবান সহায়তা পেল সংগীতের রূপকারও। অত্যন্ত হ্যান্ডি এসব বৈদ্যুতিন বাদ্যযন্ত্র নানান কাজে আসে তাঁর, আসরে-মঞ্চে তো বটেই — এমনকি মুক্তাঙ্গনের অনুষ্ঠানেও, যেমন বনভোজনের।
কিন্তু রোমাঞ্চকর সেই প্রাথমিক পর্বে কেউ লক্ষ করল না যে কল্যাণের বানানো সেই ফোকরটি দিয়ে অকল্যাণ দেখল নানান ধরনের ফাঁক। সৃষ্ট মৌলিক ফাঁকটি ছিল — ভারতবর্ষীয় গুরুমুখী চারুশিল্প সংগীতের আবহমানকাল থেকে চলে আসা অবিকল্প ‘তালিম’-নির্ভর গুরু-শিষ্য পরম্পরার ‘ভার্টিক্যাল’ বা ‘পূর্বাপর’ ধারাটি আর নির্বিঘ্ন রইল না। তার পাশাপাশি সৃষ্ট হল অসংখ্য ‘হরাইজন্টাল’ বা ‘সমান্তরাল’ ধারা।
এদেশীয় সংগীতের আদ্যন্ত প্রবহমান একক ওই ‘উল্লম্ব’ ধারাটিতে ভেজাল মেশানোর উপাদানস্বরূপ এসব ‘পার্শ্বধারা’ জোগান দিল কারা? দিল বিশেষত কমপিউটার-আর-টেলিফোনের মিলনের ফলে জন্মানো ‘ইন্টার নেটওয়ার্ক’ ওরফে ইন্টারনেট। এর ফলে মুখ্যত যে-হুমকিটির সৃষ্টি হল, বরং ক্ষতিটির সূচনাই ঘটে গেল — সে হল সংগীত-নামক প্রধানত হৃদয়ের সম্পদটি হতে চলল প্রধানত মগজের ঐশ্বর্য। কারণ ইলেকট্রনিক ওয়ার্ল্ড বা বৈদ্যুতিন বিশ্বটি যতখানি মস্তিষ্কসর্বস্ব, ততখানি হৃদয়বর্জিতও। আজকের বিশ্বের হৃদয়ের বেদনার চেয়ে বেশি মস্তিষ্কের প্রেরণা দ্বারা শাসিত জেনারেশনগুলি আন্তর্জাতিক পরিভাষায় জেনারেশন X, Y, Z এবং A নামে পরিচিত। এই জনতাত্ত্বিক বর্গীকরণটি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক দেশটির নিজের প্রেক্ষাপটে উদ্ভাবিত এবং প্রবর্তিত হলেও, বিশ্বায়নের নেতা হিসেবে মার্কিন প্রভাবেই বর্গবিন্যাসটি আজ সমগ্র বিশ্বময় প্রচলিত।
সবশেষে জেনারেশন আলফা বা A (১০১০-)। এ প্রজন্মটির নামকরণের ধারাবদলকে অপরিহার্য বলতে হয়। কারণ XYZ-এর সঙ্গে ল্যাটিন বর্ণমালা শেষ হয়ে যাওয়াতে এবার গ্রিক অ্যালফেবেটের প্রথম অক্ষর Alpha-র A দিয়ে শুরু করাই তো সঙ্গত। গ্লোবাল জেনারেশন্স সম্পর্কে লিখিত ‘The ABC Of XYZ’-নামক গবেষণা গ্রন্থে গ্রন্থকার ম্যকক্রিন্ডল বলেছেন যে আসন্ন এই জেনারেশন অ ইতিহাসের সবচেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত প্রজন্ম হবে। তারা আগের সব জেনারেশনের চেয়ে স্কুলে যাবে আগে এবং পড়বে অনেক বেশি কাল যাবৎ। তারা হবে সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বস্তুগতভাবে সরবরাহকৃত জেনারেশন — বলেছেন রিসার্চ ডিরেক্টার ম্যকক্রিন্ডল। ‘গুগল কিড’-অভিহিত এই প্রজন্মকে গড়ে তোলা হবে প্রযুক্তি এবং ভোগবাদের জগতে। তবে এদের আগলে রাখতে হবে, যাতে এরা এদের আগের জেনারেশন জেডের মতো অমূল্য শৈশবটি সম্পূর্ণ হারিয়ে না-ফেলে।
জেনারেশন ওয়াই ও জেডের ভোগবাদী বৈশিষ্ট্য মনুষ্যপ্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবণতাকে ক্যাশ করে হৃৎপিণ্ডের সংগীত-শীর্ষক চারুশিল্পটিকে মাথামুণ্ডুর কারুশিল্পে নামিয়ে নিয়েছে। কারণ মাতৃস্তন্যস্বরূপ কমপিউটার-পণ্য পান করা জেনারেশনটি ঠিকই বুঝেছিল যে লাইভ মিউজিক থেকে ডেড মিউজিক সৃষ্টি সোজা ও সস্তা এবং সেজন্যেই বেশি মুনাফাদায়ী। যথা দশটা যন্ত্রসহ দশজন যন্ত্রী জোগাড় করে খাটানোর চেয়ে ইলেকট্রনিক কি-বোর্ড আর তার প্লেয়ারটিকে এনে দশভাগের একভাগ দামে একই পেটি থেকে বেহালা, সেতার, সরোদ, বাঁশি, ক্ল্যারিওনেট, অর্গ্যান, পিয়ানো, ম্যান্ডোলিন, সানাই, এমনকি তারসানাইয়ের বদলি হিসেবে সরোলিন ইত্যাদি যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র দিয়ে মুহূর্তে গান রান্না করে মিডিয়া মারফত সমগ্র বিশ্বকে খাইয়ে দেওয়া সোজাই তো। কথা শুধু এই যে সৃষ্ট ও পরিবেশিত এই সংগীতটি হবে মৃত ধ্বনির। তাই তার স্বাদও হবে মরা মাছের মতোই। হবেই তো। ইন্সট্যান্ট কফিতে কি পারকোলেটারের কফির স্বাদ প্রত্যাশিত?
সতেরো
এই প্রাণবান আর প্রাণহীন সংগীত সম্পর্কে আমার নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ছোট্ট একটি নজির দিচ্ছি। ইউনেস্কোর হেরিটেজ সংরক্ষণ প্রোগ্রামে ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতার পপ-সম্রাজ্ঞী ঊষা উত্থুপের স্টুডিয়ো ভাইব্রেশন্সে যন্ত্রসংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তি পণ্ডিত ভি. বালসারার সংগীত-আয়োজনে আমার কণ্ঠে রেকর্ডিং হচ্ছিল ‘ভ্যালু অ্যাডেড রিপ্রোডাকশন অফ লং লস্ট মেলডিজ’। আমি তখন ইলেকট্রনিক মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট সম্পর্কে বেশি কিছু জানতাম না।
একদিন, কিংবদন্তি বেহালা-বাদক পরিতোষ শীল তনয় সমীর শীল স্টুডিয়োতে পৌঁছাতে দেরি করাতে বালসারাদা কি-বোর্ড প্লেয়ার, সুবর্ণ যুগের অমর সুরকার দুর্গা সেন তনয় প্রশান্ত সেনকে বললেন — কী আর করা, প্রথম গানের বেহালার পিসটা তুমি কি-বোর্ডেই বাজিয়ে দাও। অপ্রত্যাশিত চান্সটি পেয়ে নবীন বাদক প্রশান্ত তার নতুন কেনা দামি যন্ত্রে চটপট সংশ্লিষ্ট ক্যাপসুলটি পুরে দিয়ে বেহালার আওয়াজ বের করতেই অ্যাকুস্টিক ভায়োলিন-হাতে দৌড়াতে দৌড়াতেই স্টুডিয়োতে ঢুকে পড়লেন প্রতীক্ষিত
বেহালাবাদক। সিনিয়র শিল্পী সমীর ইলেকট্রনিক ভায়োলিনের সিন্থেটিক ধ্বনি শুনে ক্ষেপে গিয়ে বালসারাসমীপে নালিশ পেশ করলেন :
‘বালসারাদা, আপনার সামনে প্রশান্ত তার কি-বোর্ডে সিন্থেটিক বেহালা বাজিয়ে আমার অর্গ্যানিক বেহালাকে অপমান করলো কী কারণে?’
‘তোমার দেরির কারণে।’
‘তাহলে সে-ই বাজাক এই গানে।’
‘বেশি গর্ব কোরো না সমীরদা। তোমার চেয়ে ভালো বাজিয়ে দেবে আমার লেটেস্ট যন্ত্র।’
চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে হেঁকে উঠলো টগবগে তরুণ প্রশান্ত। বাহাসটা বালসারাদা উপভোগই করছিলেন বোধ হল। তিনি বললেন :
‘দুজনেই বাজাও। যারটা বেশি ভালো লাগবে সেটাই ‘টেক’ করবো।’
প্রথমে প্রশান্ত প্রেলিউডটা পুরোই বাজালেন তাঁর সদ্য হংকং থেকে আনা রোল্যান্ডের লেটেস্ট কি-বোর্ডে। তারপরে সমীর তাঁর অতি পুরাতন সনাতন বেহালাটায় ছড়ের প্রথম টানটা দিতেই সমবেত যন্ত্রীদলের সকলেই যেন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আর প্রশান্ত? মাথাটা হেঁট করে বেচারা খামুশ খেয়ে বসে রইল। বালসারাদার মন্তব্যটা ছিল অ্যাকাডেমিক :
‘প্রশান্ত দুর্দান্তই বাজিয়েছে। আসলে ডেড মিউজিকের ফেইট এমনি ট্র্যাজিকই হয় — লাইভ মিউজিকের মুখোমুখি হলে।’
আমার পাদটীকাটি ছিল :
‘হৃদয়ের কাজ কেবল হৃদয়ই করতে পারে। মস্তিষ্কের কাজ করতে পারে ডস্-ও।’ (গুগল্ তখনও অনাগত)।
এটা ছিল ডিজিটাল বিপ্লবের গোড়ার কথা, বরং বিশ শতকের শেষ দশকের একেবারে সূচনালগ্নের কথাটাই — যখন প্রযুক্তি সবেমাত্র বাদ্যযন্ত্রের প্রাণবান যন্ত্রীপ্রণীত ধ্বনির বিকল্প হিসেবে সৃষ্টি করেছিল প্রাণহীন যন্ত্রপ্রণীত ধ্বনির — যেমন কি-বোর্ডসৃষ্ট বেহালা-বাঁশি-ম্যান্ডলিন-সানাই ইত্যাদির। আর ভয়েস-প্রোসেসর, কমপ্রেসর, ইকোয়ালাইজার, লিমিটার ইত্যাদি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ছিল হার্ডওয়্যারের অংশস্বরূপ এবং কাজ করত ব্যয়বহুল সাউন্ডরেকর্ডিং স্টুডিয়ো বা ধ্বনিধারণ কর্মশালার বিশাল মিক্সার-কনসোলের সঙ্গে কেব্ল মারফত যুক্ত হয়ে ম্যানুয়েল কন্ট্রোলে, মানে হস্তসাধিত নিয়ন্ত্রণে। তাই প্রযুক্তির এসব মহার্ঘ প্রসাদলাভের সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। ফলে টেকনলজির মূল্যবান উপহারের অপব্যবহারের আশঙ্কাও ছিল পরিমিত। [ক্রমশ]