বুধবার | ১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৮:৪৫
Logo
এই মুহূর্তে ::
বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (দশম পর্ব) : আবদুশ শাকুর রামলোচন ঠাকুর ও তৎকালীন বঙ্গসংস্কৃতি : অসিত দাস দধি সংক্রান্তি ব্রত : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (নবম পর্ব) : আবদুশ শাকুর সপ্তাহে একদিন উপবাস করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো : অনুপম পাল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র ভাষা : ড. হান্স্ হার্ডার সবগুলো গল্পেই বিজয়ার নিজস্ব সিগনেচার স্টাইলের ছাপ রয়েছে : ড. শ্যামলী কর ভাওয়াল কচুর কচকচানি : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (অষ্টম পর্ব) : আবদুশ শাকুর রামলোচন ঠাকুরের উইল ও দ্বারকানাথের ধনপ্রাপ্তি : অসিত দাস বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (সপ্তম পর্ব) : আবদুশ শাকুর যে শিক্ষকের অভাবে ‘বিবেক’ জাগ্রত হয় না : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভিয়েতনামের গল্প (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (ষষ্ঠ পর্ব) : আবদুশ শাকুর দিল্লি বিধানসভা ভোটেই নিশ্চিত হচ্ছে বিজেপি বিরোধি জোটের ভাঙন : তপন মল্লিক চৌধুরী দ্বারকানাথ ঠাকুরের গানের চর্চা : অসিত দাস মমতা বললেন, এইচএমপি ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে দুষ্টচক্র হু জানাল চিন্তা নেই : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (পঞ্চম পর্ব) : আবদুশ শাকুর পৌষ পুত্রদা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (চতুর্থ পর্ব) : আবদুশ শাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজায় কবিগান ও যাত্রার আসর : অসিত দাস সসীমকুমার বাড়ৈ-এর ছোটগল্প ‘ঋতুমতী হওয়ার প্রার্থনা’ সামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলনে সিনেমা : সায়র ব্যানার্জী নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সুও দুও ভাসে’ বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (তৃতীয় পর্ব) : আবদুশ শাকুর ভিয়েতনামের গল্প (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব নীলমণি ঠাকুরের মেছুয়া-যাত্রা, একটি ঐতিহাসিক পুনর্নির্মাণ : অসিত দাস বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (দ্বিতীয় পর্ব) : আবদুশ শাকুর কাদের প্রশ্রয়ে বাংলাদেশের জঙ্গিরা বাংলার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্রসাহিত্যে কবিয়াল ও কবির লড়াই : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই পৌষ পার্বণ ও মকর সংক্রান্তির শুভেচ্ছা আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (দশম পর্ব) : আবদুশ শাকুর

আবদুশ শাকুর / ১৪ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫

চৌদ্দ

উনিশ-শ সত্তরের দশকের শেষ নাগাদ বাংলা গানে মেলডি হারিয়ে যাবার পরে এর শূন্য আসনে বসে পড়ে ম্যালাডি — অর্থাৎ মধুর সুরের স্থলে বিধুর ব্যাধি। অন্যকথায়, সিম্ফনির বদলে ক্যাকফনি — অর্থাৎ সম্মোহক শব্দসঙ্গতি ও সুরলহরীর বদলে উৎপীড়ক শব্দাশব্দি আর ধস্তাধস্তি। প্রকৃতপক্ষে এই কর্কশ কোলাহলের মধ্যে সামনে এগোতে না পেরেই বাংলা গানকে পিছু হটে অতীতে ফিরে গিয়ে সেকালের গান রিমেকের মাধ্যমে কোনওমতে দিন গুজরান করতে হচ্ছিল।

রিমেক-প্রকল্পের সফল হওয়ার কারণ ‘রিমেড’ গানগুলি ছিল ‘সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী’। এ শব্দবন্ধটি রামতনু অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্ত ব্যবহার করেছিলেন রচনা-সাহিত্যের স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে যে লেখক এবং পাঠকের মধ্যে রসের যোগেই ঘটে হৃদয়-সংযোগ, হৃদয়-সংযোগে জাগে দুটি হৃদয়ের রস-সংবাদ — এই হৃদয়ের সংবাদই সাহিত্যের ‘সাহিত্য’। হৃদয়ের সংবাদ থাকে বলে ‘রচনা’ (essay) ‘সাহিত্য’ হয়। এই হৃদয়ের সংবাদের বদলে মস্তিষ্কের তত্ত্ব থাকে বলেই প্রবন্ধ (treatise) ‘সাহিত্য’ হয় না, ‘আর্টিক্ল’ হয় (প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়)। এই হৃদয়-সংবাদ স্পষ্টতম হয়ে ওঠে পদ্যে লিরিক কবিতায় এবং গদ্যে রচনা-সাহিত্যে। এজন্যই ‘রচনা’কে অনেকে নাম দিয়েছেন ‘গদ্য লিরিক’। (‘বাংলা সাহিত্যের একদিক/রচনা-সাহিত্য’, (পৃ. ২৮-২৯), ওরিয়েন্ট বুক, ১৯৯৩, কলকাতা)।

কথাগুলোকে প্রতিস্থাপন করে বক্ষ্যমাণ প্রসঙ্গে লেখকের স্থলে গায়ক, পাঠকের স্থলে শ্রোতা এবং সাহিত্যের স্থলে সংগীত বসিয়ে আমরা বলতে পারি হৃদয়ের সংবাদই সংগীতের ‘সংগীত’, গানের ‘গান’। বলতে পারি গায়কের রসসৃষ্টির প্রেরণা আর শ্রোতার রসাস্বাদের বাসনা গানকে

‘সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী’ করে তোলে এবং তা হয়ে ওঠে শ্রোতার চিরসখা। তত্ত্ব ও তথ্যের আদান-প্রদানে গায়কের সঙ্গে শ্রোতার বুদ্ধির যোগ ঘটতে পারে, হৃদয়ের যোগ ঘটে না। তাই তারা গানের উপাদান হতে পারে না। তাই তথাকথিত ‘জীবনমুখী গান’ গান হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে বড় জোর স্লোগান; ‘র‌্যাপ গান’ও হৃদিবল্লভ হয়ে হৃদয়ে বসত করে না।

তাই আমার সার কথাটি হল — বাংলা গান থাকুক ‘সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী’ হয়ে। মস্তিষ্কের তথ্যবাহক বা তত্ত্ববিশ্লেষক হওয়া গানের কাজ নয়। সে কাজের জন্য ‘প্রতিবেদন’ আছে। ‘গান’ থাকুক হৃদয়ের সংবাদবাহী হয়ে। অন্যকথায় — হৃদয়বৃত্তিক এই চারুশিল্পটি মস্তিষ্কবৃত্তিক কারুশিল্প হয়ে না উঠুক। তেমনটি হয়ে ওঠার ব্যাপক আলামত দেখেই প্রসঙ্গটার অবতারণা করতে হল।

পনেরো

সম্পূর্ণ বিমূর্ত এই চারুশিল্পটির প্রযুক্তিগত উন্নতি প্রাচীন কাল থেকে এই হাল পর্যন্তই ছিল সুধীর, তবে ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু তাতে এই শিল্পটি অন্যান্য সুকুমার শিল্প তথা সাহিত্যশিল্প, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্যশিল্প প্রভৃতির দ্রুতগতিশীল উন্নতির যাত্রায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়ছিল হাজার হাজার বছর ধরে।

অবশেষে আজ থেকে মাত্র শতাধিক বৎসর পূর্বে সংগীতশিল্প হাতে পেল এমন একটি প্রযুক্তি, যাকে আলাদীনের চেরাগ বললেও কম বলা হয়। চেরাগটির প্রারম্ভিক অবদান হল sound recording technology কিংবা ধ্বনিধারণ প্রযুক্তি।

সংগীতের বিস্ময়কর সম্ভাবনাময় এই প্রযুক্তিটি বিজ্ঞান-শাসিত স্থান-কালের মঞ্চে প্রবেশ পেয়েই হুঙ্কারে আর দাপটে বাকি সব চারুশিল্পকে কোণঠাসা করে ফেলে। তবে এই প্রযুক্তিরই অপরিসীম ক্ষমতা বুমেরাং হয়ে হিতে-বিপরীতরূপে দেখা দিচ্ছে ইতিমধ্যেই। হৃদয়বৃত্তিক এই চারুশিল্পটিকে প্রযুক্তি আজ বুদ্ধিবৃত্তিক কারুশিল্পে পর্যবসিত করার পথে এতখানি এগিয়ে গিয়েছে যে প্রমাদ গুণে আমি আমার অকিঞ্চিৎকর এ লেখাটির মাধ্যমে হৃদয়-সংবাদবাহী এই চারুশিল্পটির বিশেষজ্ঞ মহলের কাছে এর সপক্ষে সোচ্চার হওয়ার অনুরোধ রাখছি।

এই সহস্রাব্দের শুরু থেকেই যুব সম্প্রদায় গত শতাব্দীর ‘জেনারেশন ওয়াই ১৯৮০-১৯৯৭’-এর হাত ধরে ‘ডিজিটাল’ জীবনধারায় অভ্যস্ত হওয়ামাত্র আগেকার ‘অ্যানালগ সাউন্ডট্র্যাক’-এর স্থলে ‘ডিজিটাল সাউন্ডট্র্যাক’-সমৃদ্ধ সংগীতবিশ্বের নাগরিক হয়ে গেল। ফলে আগেকার সাউন্ডট্র্যাকের মিউজিককে পেছনের সারির দিকে চলে যেতে দেখা গেল। ছোটোদের ও তরুণদের জীবনে ভিডিয়ো গেমস, ই-মেল, ইন্সট্যান্ট মেসেজিং, মিউজিক ডাউনলোড, মুভি রেন্টাল, কেব্ল-টেলিভিশন আর ব্লগ ঢুকে পড়ল বেশ জোরেশোরেই। কাজে কাজেই, আগে রেডিয়ো বা টিভি-র মাধ্যমে কেন্দ্রীয় পদ্ধতিতে পাঠানো খবরাখবর দেওয়া এবং গান শোনাবার যে ব্যবস্থা ছিল সে-দুটির আবেদন কমতে দেখা গেল।

১৯৯৮ সালে বিশ্ব ওয়েব-ওয়ার্ল্ডের অবিসংবাদিত নেতা ‘গুগল’ এসে চোখের পলকে প্রযোজক ও ভোক্তাকে প্রায় মুখোমুখি নিয়ে আসে। দুনিয়ার সব ওয়েবসাইটের সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে ইতিমধ্যেই বিশ্বের এক বিলিয়ন নেটবন্ধুদের ফাইল-শেয়ারিঙের প্রযুক্তির জালে জড়িয়ে জগতের ঘরে ঘরে ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপের ভেতরে কোটি কোটি গৎ ও গানের অডিয়ো-ভিডিয়ো লাইব্রেরি সৃষ্টি করে বলতে গেলে — হার্দিক সংগীতকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে এই দানবিক সার্চ-এঞ্জিনটি একাই।

বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সার্চ-এঞ্জিন হিসেবে স্বীকৃত গুগল গানের ভুবনে নেতৃত্ব অর্জনে প্রেরণা পায় বিশেষ একটি ভোক্তা সম্প্রদায়ের কাছে। গোষ্ঠীটির সামাজিক অভিধা ‘সিঙ্গল প্যারেন্ট’, বিশেষত ‘সিঙ্গল উইম্যান’। লক্ষণীয় যে জেনারেশন ‘ওয়াই’-এর গানের শ্রোতাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, যার একটা বড়ো কারণ হল পঁচিশ থেকে চল্লিশ বছরের ‘একলা-নারী’র সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। প্রধানত এদের ভেতর থেকেই ‘সিঙ্গল উইম্যান’ হিসেবে পরিচিত সামাজিক গোষ্ঠীটি দেখা দিচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন নতুন চাহিদা নিয়ে। ‘সিঙ্গল প্যারেন্ট’-এর হার বিস্ময়কর রকম বেড়ে যাওয়ার কারণ — সমৃদ্ধ সমাজে বিবাহবন্ধনের অটুটতা হাস্যকর বলে পরিগণিত হওয়া। প্রতীচ্যের এই প্রভাব বাংলাদেশেও দ্রুত বর্ধমান।

‘সিঙ্গল প্যারেন্ট’ ছাড়াও একালের নাগরিকদের পরম আশ্রয়স্থল হল এমপি-৩ এবং এমপি-৪ ফাইলের যথাক্রমে ডিজিটাল অডিয়ো কিংবা ভিডিয়ো মিউজিক — যেসবের প্রধান প্রোভাইডারের ভূমিকায় সময়মতো আবির্ভূত হল গুগল। এমনকি সংগীতে তাদের পেশাদার অবস্থানকে সংহত করে ইন্টারনেট-বিশ্বে নেতৃত্ব বহাল রাখার উদ্দেশ্যে সংস্থাটি ‘গুগল মিউজিক্যাল সার্ভিস’-শীর্ষক বিশেষ একটি সেবাকেন্দ্রও খুলেছে ২০০৯ সালে এবং এর তৎপরতা দ্রুতগতিতে বাড়িয়ে চলেছে।

গুগলের এই ‘সংগীত পরিষেবা’কে সময়মতো বলছি এ কারণে যে প্রতীচ্য বিশ্বে দিবারাত্রি বিভিন্ন মিডিয়ায়, বিশেষত টেলিভিশনে, সংবাদ পরিবেশন চলতে থাকায় মানুষ হয়ে উঠেছিল তিক্তবিরক্ত। কারণ মিডিয়ার উনুনে রান্না খাবার ক্রমশ অখাদ্য জাঙ্ক ফুডেরও কেরিকেচার হতে শুরু করেছে। সেখানে সবকিছুই হয় কেবল কর্ণগোচর, মর্মদোসর হয়ে ওঠে না কিছুই। মনে দাগ কাটার আশা প্রতিভাত হয় সুদূরপরাহত।

মিউজিককে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে ঘরে এনে দিল কম্পিউটার আর তার সফ্টওয়্যার মোডেম। এখন আরও হাতের মুঠোয় পুরে দিয়েছে ওয়্যারলেস মোডেম। ১৯৯৮ সালে পি-সি আর পোর্টেবল এমপি-৩ এসে গেলে জনসাধারণের প্রায় বিনা খরচায় নিজের মনের মতো গান শোনবার পথ খুলে যায়। শ্রোতারা ফাইল শেয়ারিং করতে থাকলে কনজিউমারিজমের ধারা সম্পূর্ণ পাল্টাতে শুরু করে। মিউজিক কোম্পানি বাজার ধরতে প্রলোভন দেখাতে থাকে। যেমন ‘আই-টিউন’-এ ঘরে বসেই আড়াই কোটি গান শোনার সুযোগ এনে দেয় অ্যাপেল।

ইন্ডাস্ট্রির নতুন গতিপ্রকৃতিতে রেকর্ড-লেবেলের বিক্রির হার দ্রুত কমছে। সিডি-র দাম মিউজিক-শপে যখন ২৫ ডলার, তখন অন-লাইনে মাত্র ২ ডলারেই সেই গান পাওয়া যায়। স্যাম্পলার পাওয়া যায় ফ্রি-ও। এতদিন ডিস্ক জকিরা গান শোনালেও প্রায়ই গায়কগায়িকাদের নাম বা বৃত্তান্ত এবং রেকর্ড কোন্ লেবেলের সে-সব প্রয়োজনীয় তথ্য জানার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। এখন ডাউনলোড করলে সবই পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। হালের ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার সেলফোন কোম্পানিগুলির বিপণিত প্লাগ-অ্যান্ড-প্লে মোডেমের তেলেসমাতি গ্লোবাল মিউজিক্যাল এন্টারটেইনমেন্টটাকে যেন অপার আনন্দের এক বিনিপয়সার ভোজেই রূপান্তরিত করে দিয়েছে।

গান বিক্রি বাড়াবার জন্য আগে যেসব মিউজিক ক্রিটিক বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করত তারা এখন প্রায় বেকার। গান শোনানো এবং শোনার কালচার এখন কোনও ট্রেনারের শিক্ষাধীন ডিসিপ্লিন নয়, অশিক্ষিত কনজিউমারদেরই ইচ্ছাধীন ব্যাপার। তবুও ল্যাপটপ, আইপড বা এমপিথ্রি-র মাধ্যমে এন্তার গান অনায়াসে শোনানোটাই সবাইকে তৃপ্ত করবে না। তার থেকে উন্নতমানের ক্রোমাটিক সাউন্ডের গান শোনার আগ্রহে যাদের এখনো ভাটা পড়েনি, তারা আরও ভালো যন্ত্রের মদির ধ্বনির আশায় নিশ্চয়ই পথ চেয়ে অপেক্ষা করবে।

তাই বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর নজর সেদিকেও থাকবে বইকি। একটা নতুন ‘জাগরণ’ যা বিগত শতাব্দী তামাদি না-হতেই টফলারের হাত ধরে উপস্থিত হয়েছিল, সেটি ছিল একটি পোর্টম্যান্টো-ওয়ার্ড বা জোড়কলম শব্দ ‘প্রসিউমার’। প্রডিউসার ও কনজিউমার শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত শব্দটি যুগোপযোগী পরিভাষা হিসাবে সংগীতগঞ্জের সকল গলিঘুঁজি-অন্ধিসন্ধির চাহিদাদিও উদ্যোক্তা পক্ষকে স্মরণ করিয়ে যাবে নিশ্চয়।

এদেশে আমাদের মতো কিছু গড্ডল এখনো গ্রামোফোন, ইপি, এলপি, স্পুল, টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করে। আমরা এখনো রেডিয়োতে, বিশেষত এফএম-এতে গান শুনি, টেলিভিশনে নাচগান দেখাশোনাও ছাড়িনি। এসব খোঁয়ারি আমরা উপভোগ করি — ওয়াকম্যান, আইপড, ডিভিডি, এমপিথ্রি প্রভৃতির দ্রুত অনুপ্রবেশের পরেও। ঘরে ঘরে ‘হোম থিয়েটার সিস্টেম’ গড়ে তোলার পরেও — ফাইভ-ইজ-টু-ওয়ান সাউন্ড ব্লাস্টার সমৃদ্ধ পিসি-তে গান শোনার ব্যবস্থা আমাদের সমাজে কমছে না।

কারণ ডেস্কটপ-ল্যাপটপ আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। গান শোনার জন্য এদের আসঙ্গ ছেড়ে ক্ষণেকের তরেও অন্য যন্ত্রের অঙ্গনে যেতে মন চায় না। মূলে ১৯৯০-এর দশকে ইন্টারনেট বিপ্লব শুরু হবার কারণেই বাণিজ্যিক মিউজিকের পরিস্থিতি ওলট-পালট হতে থাকে। সংগীতের বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো হাইব্রাউ কালচারকেও বাগে আনবার চেষ্টা করবে সম্ভবত আমাদের মতো অতীত-আর্তজনের জন্যেই।

অ্যাংলোস্যাক্সন রক মিউজিক এখন করণশালা ছেড়ে শয়নশালাতে বসে কম্পোজ করাই সহজ। ইন্টারনেটের মাধ্যমে রকব্র্যান্ডের মতো অন্য সব জাতের মিউজিকও আজ ঘরে বসেই করা সম্ভব। ইন্টারনেটে মিউজিকের ফাইল লোড করে দেশের কি বিদেশের বিভিন্ন শহরে বসে একটা রক গ্র“প তাদের ব্যান্ড তৈরি করতে পারে। গিটার, বেস গিটার, ড্রাম, অন্যান্য বিটযন্ত্র এবং ভোকালিস্ট নিজের আস্তানায় বসে মিউজিক তৈরি করে তাদের স্টুডিয়ো-সাইটে পাঠিয়ে দেয়। সবার মিউজিক একত্রিত করে সফ্টওয়্যার ও হার্ডওয়্যারে রাখা হয়। স্টুডিয়ো থেকে সাউন্ড মিক্স করে মিউজিক-মেকিঙের সম্পূর্ণ কর্মই এভাবে সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে। হলে পরে সেই মিউজিক ই-মেইলে ‘সেন্ড’ও করা যায়, সিডিতে ‘বার্ন’ও করা যায়, অন-লাইনে ‘সেল’ও করা যায়।

ভারতের প্রখ্যাত শল্যচিকিৎসক ও সংগীত বিশেষজ্ঞ ডা. সমীরকুমার গুপ্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে প্রযুক্তিপুষ্ট সাম্প্রতিক সংগীতের এরকম বিশ্বায়নের ওপর সংক্ষেপে বেশ স্বচ্ছ আলোকপাত করেছেন :

‘গত শতকের শেষ দশকে কলকাতায় কলেজ-কালচার থেকে ব্যান্ড মিউজিক সিন্ডারেলার মতো উঠে এসে অল্পবয়সী শ্রোতাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে আদৃতি লাভ করেছে। প্রথম দিকের একটি গ্রুপ ‘মিডাস টাচ’ কলকাতায় রক মিউজিক বাজাত ও কম্পোজ করত। তাদের শিল্পীরা — রাজীব, চার্লি, বাপি, রাজা, সুমিত, অমিত, আনন্দরূপ, মিলি এখন দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আনন্দরূপ এখন কানাডার ক্যালগ্যারি থেকে একটা নতুন দল করে মিউজিক কম্পোজ করছে। তার সঙ্গী শিল্পীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইংল্যান্ডের নরফোকে, কানাডার নানা শহরে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটে। তাদের সৃষ্ট রক মিউজিক পৃথিবীব্যাপী ইন্টারনেটে শোনার যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনি রয়েছে কেনার সুযোগও। আমি এখন বাড়িতে বসেই পিসি-তে তাদের পারফরমেন্স দেখতে ও শুনতে পাই। বোঝা যাচ্ছে মিউজিক পরিবেশন ধনতান্ত্রিক রূপ ছেড়ে গণতান্ত্রিক রূপ নিতে শুরু করেছে।’ [পৃ. ৩১২-৩১৩, মিলেমিশে, শারদীয় সংখ্যা ১৪১৬, কলকাতা]। [ক্রমশ]


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন