অনেকদিন আগে টিউশনের এক ছাত্রের কাছে প্রশ্নবাণে আমি বিদ্ধ হয়েছিলাম — জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতাটি কীভাবে একটি শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা হল?এর মধ্যে প্রেম কোথায়? তাকে আমার মত করে বুঝিয়ে ছিলাম, এই কবিতার মধ্যে প্রেম কোথায়। শুধু এটুকু বলা বাকি ছিল যে এই কবিতাটিকে নিছক প্রেমের কবিতা বললে এর প্রতি বেশ অনেকটাই অবিচার করা হবে। এর পিছনে আছে এক সুগভীর ঐতিহাসিকতা যা কবিতাটিকে মহিমান্বিত করে তুলেছে। নিছক প্রেমের কবিতা নয় ‘বনলতা সেন’ বরং একে ‘বিপ্রলম্ভের কবিতা’ (‘জীবনানন্দ দাশ : কবি ও কবিতা’ — দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়) বললে হয়তো এর প্রতি সুবিচার হবে।
বনলতা সেন জীবনানন্দ দাশের বহুল পঠিত কবিতাগুলির মধ্যে একটি। কবিতাটির ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা। এটি তাঁর তৃতীয় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। এর প্রকাশকাল ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ। ‘কবিতা ভবন’ প্রকাশিত ‘এক পয়সার একটি’ গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত। পরে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ‘সিগনেট প্রেস’ থেকে এর পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এর প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন সত্যজিৎ রায়। কবিতাটি প্রথম প্রকাশ করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে।
এবার আসি মূল আলোচনায়। কে এই বনলতা সেন? তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমরা একাধিক নারীকে খুঁজে পাই। কখনো বনলতা সেন, কখনো সুচেতনা, কখনো সুজাতা, কখনো অরুণিমা সান্যাল বা শেফালিকা বোস বা কখনো সুরঞ্জনা বা অমিতা সেন। একাধিক নারী চরিত্রের ভিড়ে বনলতা সেন কিন্তু এক এবং অদ্বিতীয়। সুচারু এক রোমান্টিকতায় যেভাবে কবি কবিতাটির অবয়ব নির্মাণ করেছেন তা আধুনিক পাঠককেও মোহিত করে। “পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন” যেন চকিতে মনের কোনে দাগ কেটে যায় নবীন প্রেমিক প্রেমিকার মনে। এই বনলতা সেন যেন হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা এক ক্লান্ত পথিকের দু’দণ্ড শান্তির আশ্রয়স্থল। শুধু তাই নয় এই কবিতাটির মধ্যে আছে এক সুগভীর ঐতিহাসিকতা ও চিত্রকল্পের আশ্চর্য মেলবন্ধন। সিংহল সমুদ্র, মালয় সাগর থেকে কবি চকিতেই চলে যান বিম্বিসার অশোকের ধূষর জগতে কিংবা বিদর্ভনগরে। এই ইতিহাসচেতনা কবি মননকে প্রসারিত করেছে, সংকীর্ণতা থেকে দিয়েছে মুক্তি। আবার “সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা নামে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল” কিম্বা শ্রাবস্তির কারুকার্য করা মুখের তুলনা আমাদের সত্যিই অভিভূত করে। তিনি ‘চিত্ররুপময় কবি’। কবিতার মধ্যে তিনি এমন এক চিত্রকল্পের জন্ম দেন যেন পাঠকের চোখের সামনে কবিতাটি ছবি হয়ে ভাসে। তখন বিম্বিসার — অশোকের ধূষর জগৎ কিংবা বিদর্ভ বা শ্রাবস্তী নগরীও যেন ধরা দেয় আপন মনের টানে।
এই বনলতার নামটি আমরা প্রথম দেখতে পাই তাঁর ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে। উপন্যাসিক বলেছেন — “কিশোর বেলার যে কালো মেয়েটিকে ভালোবেসেছিলাম কোন এক বসন্তের ভোরে, বিশ বছর আগে যে আমাদেরই আঙিনার নিকটবর্তিনী ছিল, বহুদিন যাকে হারিয়েছি —” এই কালো মেয়েটিই যে বনলতা, তা আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না। কারণ পরক্ষণেই কবি এতে উল্লেখ করেছিলেন, — “সেই বনলতা — আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত সে।”
আবার বলেছেন, — “বছর আষ্টেক আগে বনলতা একবার এসেছিল। দক্ষিণের ঘরের বারান্দার চালের বাতায় হাত দিয়ে মা ও পিসিমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললে সে। তারপর আচলে ঠোঁট ঢেকে আমার ঘরের দিকে আসছিল। কিন্তু কেন যেন অন্যমনস্ক নত মুখে মাঝপথে গেলে থেমে। তারপর খিড়কির পুকুরের কিনারা দিয়ে শামুক-গুগলি পায়ে মাড়িয়ে, বাঁশ জঙ্গলের ছায়ার ভেতর দিয়ে চলে গেল সে। নিবিড় জামরুল গাছটার নিচে একবার দাঁড়াল, তারপর পৌষের অন্ধকারের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর তাকে আর আমি দেখিনি।”
কেন দেখা হল না? উত্তর অনেক। হয়তো তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অন্য কারো সাথে অথবা তার মৃত্যু হয়েছিল। কবি অনেক খুঁজেছেন বনলতাকে, তার সেই স্বপন পসারিনীকে। তাই হয়তো মাঝে মাঝেই তাকে স্বপ্নে দেখা দেন তার সেই প্রেমাস্পদা। তাই তো ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে দেখি, — “অনেকদিন পরে আজ আবার সে এল; মনপবনের নৌকায় চড়ে, নীলাম্বরী শাড়ি পরে, চিকন চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আবার সে এসে দাঁড়িয়েছে; মিষ্টি অশ্রু মাখা চোখ, ঠান্ডা, নির্জন দুখানা হাত, ম্লান ঠোঁট, শাড়ির ম্লানিমা, সময় থেকে সময়ান্তর, নিরবচ্ছিন্ন, হায় প্রকৃতি, অন্ধকারে তার যাত্রা —”।
হয়তো সেই বনলতা সেনকে খোঁজার জন্যই কবির যাত্রা। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা আবার “আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন” — এই অমোঘ সত্য উচ্চারণ দেখে মনে হয় এই বনলতা সেন কবির পূর্ব পরিচিত, না হলে কেউ এসে এত বিশ্বস্ত প্রশ্ন করতে পারত না কবির কাছে, — “এতদিন কোথায় ছিলেন?” তাইতো বারবার তিনি বনলতাকে খুঁজেছেন প্রাণের টানে, প্রেমের অমোঘ আকর্ষণে ছুটে গেছেন পৃথিবীর পথে, যে পথে রাঙা রাজকন্যার দেখা পাবেন কবি। শুধু তাই নয়, সিংহলসমুদ্র থেকে সেই নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগর পর্যন্ত।সেখান থেকেই কবি ঢুঁ মেরেছেন বিম্বিসার অশোকের ধূষর জগতে, বিদর্ভনগরে, শ্রাবস্তী কিংবা দারুচিনি দ্বীপ অর্থাৎ শ্রীলঙ্কাতেও। খুঁজে বেড়িয়েছেন তার সেই প্রিয় নারীকে, যদি তার সাথে একবার দেখা হয়। তাইতো তার আক্ষেপ, —
“জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার —
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার,”
(‘কুড়ি বছর পরে’, ‘বনলতা সেন’, জীবনানন্দ দাশ)
এডগার অ্যালান পোর ‘To Helen’ কবিতাটির সঙ্গে এই কবিতার সাদৃশ্য থাকায় অনেকে দাবি করেছেন এই কবিতাটি অনুসরণ করেই জীবনানন্দ দাশ ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি রচনা করেন। কিন্তু এই দুটি কবিতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, যা সচেতন পাঠকের চোখ এড়ায় না। কবিতাদুটি আমি পাশাপাশি তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
To Helen
Edgar Allan Poe
“Helen, thy beauty is to me
Like those Nicean barks of yore, That gently, o’er a perfumed sea, The weary, way-worn wanderer bore To his own native shore.
On desperate seas long wont to roam Thy hyacinth hair, thy classic face, Thy Naiad airs have brought me home
To the glory that was Greece.
And the grandeur that was Rome.
Lo! in yon brilliant window-niche How statue-like I see thee stand!
The agate lamp within thy hand, Ah! Psyche, from the regions which Are Holy Land!”
বনলতা সেন
জীবনানন্দ দাশ
“হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
‘বনলতা সেন’ কবিতাটির সঙ্গে ‘টু হেলেন’ কবিতাটির সাদৃশ্যটা মূলত বাহ্যিক। পো তাঁর কবিতায় তাঁর স্বপ্নের নায়িকা হেলেনের চুল ও মুখের বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে—
“Thy hyacinth hair, thy classic face,”
তেমনি জীবনানন্দ দাশও বনলতার চুল এবং মুখের বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবেই —
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;”
তাছাড়া “হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা”-র সাদৃশ্য পাওয়া যায়—
“The weary, way-worn wanderer bore To his own native shore. On desperate seas…”-এর মধ্যে দিয়ে।
কিন্তু এদের পার্থক্যটা কবিতা পাঠক নিশ্চয়ই বুঝবেন। বনলতা সেন কবিতাটিতে এক সুদুর ঐতিহাসিকতা যেন স্থান করে নিয়েছে। প্রেমের কবিতা হলেও বনলতা সেন আসলে বিপ্রলম্ভের বা নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদের কাব্য। আর সেই বিপ্রলম্ভের নায়িকা স্বয়ং বনলতা সেন।
এবার ছোট করে আলোচনা করা যাক বিপ্রলম্ভ আসলে কী? বৈষ্ণব পদাবলীতে বলা হচ্ছে — নায়ক ও নায়িকার যুক্ত বা অযুক্ত অবস্থায় পরস্পরের অভীষ্ট আলিঙ্গনাদির অপ্রাপ্তিতে যে ভাব দেখা যায় তাকে বিপ্রলম্ভ বলে। অর্থাৎ বিপ্রলম্ভ হল মিলনের বিপরীত অবস্থা। মিলনের আনন্দকে প্রগাঢ় করার জন্য বৈষ্ণব সাহিত্যে বিপ্রলম্ভের বড় গুরুত্ব রয়েছে। কথায় বলে, — “বিরহ না আসলে প্রেমে মিলন আসে না।” — এই বিচ্ছেদ, হতাশা, আক্ষেপ সবটা মিলনের ইচ্ছাকে সুদৃঢ় করে তোলার জন্য কিনা জানিনা। তবে বিপ্রলম্ভের নায়িকা হলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবি তার জন্য অপেক্ষা করেছেন —
“পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী — ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
আবার বলেন —
“আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!”
এই রোমান্টিকতা, না পাওয়ার আক্ষেপ রয়েছে কবিতা জুড়ে। পাশাপাশি পরাবাস্তবতা বা সুরিয়ালিজম এর একটা নরম দোলা কবি দিয়ে গেছেন সকলের অজান্তেই। এভাবেই সমগ্র কবিতাটি হয়ে উঠেছে বিস্তৃত পাঠক সমাজের কাছে সুখপাঠ্য ও বারবার আলোচিত বহুল পঠিত একটি কবিতা।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী :
১) ‘জীবনানন্দ দাশঃকবি ও কবিতা’ — দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২) ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ — তপন কুমার চট্টোপাধ্যায়।
৩) “আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়’ — দীপ্তি ত্রিপাঠী।
৪) উইকিপিডিয়া।
পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত