কফি হাউসের নতুন শাখা খুলছে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া নাম হীরা বন্দর, ডায়মন্ড হারবারে। বাংলার কফি পায়ীদের নতুন কফি হাউসে স্বাগত জানালাম। এই প্রবন্ধ লেখক নয়ের দশক থেকে বই পাড়ার কফিহাউস এডিক্ট। পুরোনো কফি হাউস প্রেম, তার সঙ্গে এশিয়ার কফি ইতিহাস নিয়ে কিছু বাক্য ব্যয় করা গেল। আশাকরি পাঠক বাচালতা মার্জনা করবেন।
যারা মনে করেন কফি হাউসের প্রচলন ইওরোপে তারা প্রত্যেকেই ভুল তথ্য জানেন। যে সব বিষয়কে আমরা ইওরোপিয় আধুনিকতার চিহ্ন হিসেবে গণ্য করি যেমন বহুতল বাড়ি, যেমন পাসপোর্ট, যেমন কাগজি মুদ্রা, যেমন ফুটবল খেলা, যেমন বীজগণিত, যেমন দোনলা প্যান্ট, সুতির পরিধেয়, কাঁটা চামচে খাওয়া — তার একটাও ইওরোপের দান নয় হয় এশিয়া, না হয় আফ্রিকা বা আমেরিকার দান। কফি দানা এবং কফি হাউস দুটোই ইওরোপের দান নয়, এশিয়ার দান। বিশ্বকে কফি পান এবং কফি হাউসে মজায় আড্ডা দিতে দিতে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গুষ্টিসুখ উদযাপন করে কফি কটু স্বাদ নিতে শেখান তুর্কিরা।
লন্ডনের কফিহাউস
মুঘল আমলের শেষের দিকে কফি দক্ষিণে আসে সন্ত বাবা বুদানের হাত ধরে। বাবা বুদানকে নিয়ে সাহিত্যিক শামীম আহমেদ লিখছেন, “বাবা বুদান ছিলেন অধুনা কর্ণাটকের একজন সুফি সাধক। ‘সুফি’ বলতে আমরা সাধারণত ইহজগত-বিচ্ছিন্ন সাধু বা ফকিরকে বুঝি। দ্বাদশ শতাব্দীতে স্পেনের ইবনে আরাবি সুফি মতকে দার্শনিকভাবে সংহত করেন। ইবনে আরাবির মতবাদটির নাম সুফিস্টিক প্যানথেয়িজম বা প্যান্থেইস্টিক সুফিজম। সৃষ্টি ও স্রষ্টার অভিন্নতা প্রতিপাদন এই মতের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। বাবা বুদান ছিলেন ষোড়শ শতকের সুফি, যাঁকে হিন্দু ও মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ মান্য করতেন। … মক্কায় হজ সেরে সুফি সাধক বাবা বুদান ইয়েমেনের মোচা বন্দর থেকে যখন ফিরছেন তখন তিনি সাতটি কফির দানা দাড়ির ফাঁকে লুকিয়ে এনেছিলেন। কারণ সে সময় অন্য দেশে যে কফি রপ্তানি করা হত, তা ছিল ভাজা অথবা সেঁকা, যা থেকে কফির গাছ হওয়া সম্ভব নয়। তাপে কফি বীজের কূর্বদ্রুপকতা নষ্ট হয়ে যায়। ইয়েমেনিরা কফি ব্যবসায় তাদের একচেটিয়া বাজার ধরে রাখার উদ্দেশে এমন ব্যবস্থা করেছিল। মোচা বন্দরে কফি বীজ আনলেই ধরা হত, তাই বাবা বুদান তাঁর নুরের মধ্যে লুকিয়ে এনেছিলেন কফি বীজ। হ্যাঁ, সাতটি — কারণ সাত সংখ্যা ইসলামে পবিত্র — সাত আসমান তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ইসলামে অবশ্য ‘সাত’ মানে বহু। সে নিয়ে অনেক কথা আছে”।
অটোমান কফি হাউস
পৃথিবীর প্রথম কফি হাউস তুরস্কের কনস্টান্টিনোপলে, ১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে। সিরিয়া, তুরস্ক, পারস্য, মিশরের মতো দেশগুলোতে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কফি হাউস। ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্তাম্বুলে কফি হাউস ছ-শো ছাড়িয়েছিল। ভারতে চায়ের আগে আসে কফি — এবং অবশ্যই এক সন্ত’র উৎসাহে।
গবেষক মুনিস ফারুকি দাবি করছেন আওরঙ্গজেব কফি এডিক্ট ছিলেন — সকালে উঠে তার এক পেয়ালা কফি না হলে নিত্যকৃত্য হত না। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক এবং অসামান্য অনুবাদক বন্ধু আল মারুফ বলেছিলেন ব্রিটিশপূর্ব সময়ের মুর্শিদাবাদেও কফির চল ছিল, আলিবর্দি খান কফি পান করতেন। তিনি আমায় লিখেছিলেন, “জমিদার কালী নারায়ণের চা ও কফি চাষের উদ্যোগ বা নদীর ওপারে (সম্ভবত হাসনাবাদ বা কামরাঙ্গীর চরে) ইংরেজদের কফি চাষের উদ্যোগ একেবারে আলাপহীন হয়ে থাকে। এমনকি উইলিয়াম হেজেস সাব (কোম্পানির গভর্নর) ১৬৮২ সালে ঢাকায় রাজস্ব সংক্রান্ত আলোচনায় এলে তাকে ঢাকার দারোগা তার ছাদে নদী দেখাতে দেখাতে কফি পিলাইসিলেন, তাও কেউ কয় না।” তার লেখার উত্তরে আমার পাল্টা উত্তর ছিল অর্থাৎ কফিতে আসক্ত আওরঙ্গজেবের আমলে বাংলার ঢাকায় সরকারি স্তরে কফি সেবন সাধারণ ঘটানা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। আমরা এর পরে আলিবর্দিকে কফিপানে আসক্ত দেখি।
তুর্কি কফি তৈরি প্রক্রিয়া
কলকাতায় কফি হাউস
বই পাড়ার আইকনিক কফিহাউস কলকাতায় শুরু হয় এলবার্ট হলে, কলেজ স্ট্রিটে ১৯৪১-এ। শুরুতে কফি হাউসের অভিভাবক ছিল ইণ্ডিয়ান কফি বোর্ড। বঙ্গ ভদ্রবিত্তের কাছে ধর্মতলার একদা সিনেমাপাড়ার কফিহাউসের নাম ছিল হাউস অব লর্ডস আর কলেজস্ট্রিটের কফিহাউসের অভিধা ছিল হাউস অব কমস। উপনিবেশ চলে গেলেও রসিক শিক্ষিত ইওরোপমন্যরা ব্রিটিশ রাজনৈতিক পরিবেশে নিজেদের সেঁকে নিতে দ্বিধা সেদিনও করেন নি, আজও করেন না।
পরে ১৯৫৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর হস্তক্ষেপে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সহায়তায় কফি হাউস পরিচালনার ভার নেয় কর্মচারী সমবায়। সেই থেকে আজ অবধি হাল ধ’রে রেখেছেন তাঁরাই।
কোভিড-উত্তর ঝড়-ঝাপ্টা সামলে কফিহাউস আবার স্বমহিমায়। এবার ইনফিউশনের স্বাদ পেতে চ’লেছে ডায়মণ্ড হারবার। প্রায় ৩৫০০ স্কোয়ার ফিট জায়গাজুড়ে NH-17-র ওপর ডায়মণ্ড হারবার থানার সংলগ্ন এই নতুন সংযোজন। গঙ্গার তীরে কফির আমেজ পেতে তাই তৈরি ডায়মণ্ড হারবারের তাবড় বুদ্ধিজীবী মহল, কলেজ পড়ুয়ারা।
‘ইন্ডিয়ান কফি ওয়ার্কার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি’র নবনির্বাচিত সম্পাদক সরফরাজ আহমেদ বলছিলেন, “কিছুটা লাভের মুখ দেখছি বলেই নতুন শাখার কথা ভাবতে পারছি! কফিহাউস রক্ষার এটাই রাস্তা।” কফিহাউসের তেতলায় কিছু টেবিল বাড়িয়ে প্রায় শ’খানেক টেবিল বসিয়েছেন সরফরাজ। ভবিষ্যতে কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসের কিছু অংশে অন্তত এসি বসানোর ইচ্ছে আছে। কিন্তু যাদবপুর কফিহাউস চলছে কোনও মতে। শ্রীরামপুরে কফিহাউস শুরু হয়েছে গত ডিসেম্বরে।
ডায়মন্ড হারবার কফিহাউস শুরু হচ্ছে খান ৩০ টেবিল নিয়ে। নতুন শাখার সঙ্গে লভ্যাংশ ভাগ করবে কলেজ স্ট্রিট কফিহাউস। তাদের তিন হেঁশেল কর্মী ডায়মন্ড হারবারে রান্না শেখাচ্ছেন। ডায়মন্ড হারবার থানার পাশে তেতলায় কফিহাউসে এসি অংশ থাকছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে নতুন কফিহাউসের পথ চলা শুরু।
যুবা কবি, রাজনৈতিক বিশ্লেষক কফিহাউস-খোর অত্রি ভট্টাচার্য জানালেন তিনি অবশ্যই একদিন নতুন কফি হাউসে যাবেন। “উদ্যোক্তারা একটু সামলে নিলে বন্ধুদের নিয়ে একদিন অত্যাবশ্যকভাবে ঢুঁ দেব”। প্রকাশক গবেষক বহ্নিহোত্রী হাজরা বললেন তার পক্ষে গবেষণা বা প্রকাশনা সামলে ডায়মন্ড হারবারে যাওয়া সমস্যার, কিন্তু তাঁরও একদিন যাওয়ার ইচ্ছে আছে। কয়েক দিন আগে কলকাতায় ঘুরে গেলেন ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান এবং উপনিবেশ বিরোধী চর্চার অন্যতম উদ্যোক্তা সম্পাদক মিল্টন বিশ্বাস। তিনি নিউটাউন কফি হাউস এবং কলেজস্ট্রিট কফি হাউসে নিয়মিত আড্ডা দিয়েছেন বন্ধুদের সঙ্গে। তিনিও নতুন কফিহাউসের সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করলেন। এই রিপোর্তাজ লিখতে লিখতেই সংবাদ পেলাম মাটির বাড়ির আর দেশিয় প্রযুক্তির গবেষক, হজরত শাহজালাল মহিলা কলেজের অধ্যাপক মো শাহিনুর রশীদ (টুটুল) বাঁকুড়া, বীরভূম ঘুরে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার আগে কলকাতায় এসেছেন। তিনিও বুধবার বৃহস্পতিবার সারাদিন বই পাড়া আর কফি হাউসে কাটিয়েছেন। তিনিও উৎসাহী। কলকাতার বাইরের ব্যারাকপুরবাসী অধ্যাপক দেবত্র দেও এই সংবাদে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন।
উপনিবেশ বিরোধিতা যাপন করতে একটি ছুটির দিন অবশ্যই চলে আসুন বাঙ্গালীর হিরা বন্দরের কফি হাউসে।
বিশ্বেন্দু’দা আমারে কফি গিলানোর দাওয়াত দিলি পরে আসতি পারি। 😛
তয় বিশেষণগুলো দিয়ে লজ্জায় ফেলে দিলেন আরকি।
আসেন, যে কোনও দিন আসেন। দাওয়াত থাকল ভাই