মনে আছে বছর আটেক আগে উত্তর কলকাতার অরবিন্দ সরণীতে আয়ুর্বেদিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির এক শিক্ষক-চিকিৎসক আমাদের বলছিলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের উলটো দিকে একটি আয়ুর্বেদিয় ওষুধের দোকান ছিল — নাম বসন্ত ঔষধালয়। তাঁর ধারনা ছিল এটি বসন্ত নামের এক জনের নামে তৈরি। কৌতুহল মেটাতে এই প্রশ্নটা তিনি করে বসেন সে সময়ের দোকানে বসা মানুষটিকে। চিকিৎসক মহোদয়ের ভুল ভাঙ্গিয়ে তাঁর উত্তর ছিল নিষিদ্ধ হওয়ার আগে একদা তাদের পূর্বপুরুষ টিকা দিতেন — সেই সুবাদেই, তার পেশার স্মৃতিতেই দোকানের উপসর্গ হয়েছে বসন্ত। দিন কয়েক আগে গিয়ে দেখলাম, সে দোকান আজ শুধুই স্মৃতি। উঠেগেছে।
মাধ্যমিকস্তরে পড়াশোনা করতে গিয়েই বাঙালি ভদ্রলোকের মেকলের উত্তরপুরুষেরা গায়ে কাঁটা দেওয়া বাক্যবাণে পড়ে জেনে যান কিভাবে জেনার বসন্তের টিকা আবিষ্কার করেন — এবং সেই জন্য তিনি বিশ্বে অমর হয়ে থাকবেন এমন দিব্যবাণীও পাঠ্যপুস্তকে তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয় — কেননা তাঁর আগে বিশ্বে বসন্তের টিকার ধারণাটাই ছিল না — গুটি বসন্ত হলে পটাপট মানুষ মারা যেত।
ইওরোপ সব বিকাশের মূল — তাঁর আগে সক্কলে প্রোটো-বিশ্ববিপ্লবের প্রোটো-মানুষ, এমন একটা, ধারণা চলে এসেছিল স্বাধীনতার পরেও মেকলিয় ভারতে। ইওরোপ ভারতে না এলে সব কিছু ফক্কা এমন ধারণা পোষণা করার প্রচুর মানুষ ভারতে আজও বিরাজমান।
অথচ গোটা ভারত উপমহাদেশেই গুটি বসন্তের টিকে দেওয়ার প্রচলন ছিল প্রাচীন কাল থেকে। সাম্রাজ্যের উদ্যোগে এশিয়ার নানান প্রযুক্তি, নানান জ্ঞানচর্চা ধ্বংস করার কাজ করে ইওরোপিয় আধুনিক প্রযুক্তি, মানবতা, প্রগতি, নব্যজ্ঞানচর্চা, কুসংস্কার দূর করার বাহানায়। ১৮০৩-০৪ সালে ব্রিটিশ সরকার মানবতা রক্ষার নামে এই টিকা প্রয়োগ নিষিদ্ধ করে।
১৭৯৮ সালে ইওরোপেই জেনার এই টিকা ‘আবিষ্কার’ করেন — তার পর থেকেই তাঁকে, এবং তার মত মানুষদের ভগবানের পর্যায়ে উন্নীত করা হয়। এই আবিষ্কারের পর থেকেই এই টিকা ভারতে দেওয়া শুরু হয় — তাই এই ভারতীয় টিকা পদ্ধতির নিষিদ্ধকরণ। এই নিষিদ্ধকরণের ঢাল পড়েছিল ভারতের নানান প্রযুক্তির ওপর, কখোনো সরকারি নিদান বলে আবার কখোনো নিশ্চুপে আবার কখোনো বলপ্রয়োগে।
গুটি বসন্তর টিকা দেওয়ার ইতিহাস ভারতের চিকিৎসা পরম্পরা। এই টিকা হিপোক্রাটিস বা গ্যালেনেরও জানা ছিল না। লেখা পত্তরে যা বোঝা যাচ্ছে এটি খুব সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস। আবু বকর মুহম্মদ ইবন জাকারিয়া অল রিজভি(৮৩৫ — ৯২৩খ্রি)র রচনা কিতাব অলজাদারি ওয়লহাসবা(On the variola and the measles) চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এতে প্রথম লিখিত রয়েছে গুটি বসন্তের বিভিন্ন উপসর্গ এবং তার নিদান। তবে চিনে এর আগেও স্পষ্টভাবে এই রোগের কথা লিখিত হয়েছে। ৩৪০ সনের অসামান্য বৈদ্যক কো হাং-এর চৌ হৌ পেই চি ফ্যাং (Handy therapies for emergencies) এবং ৫০০ সালে নতুন করে সম্পাদনা করেন থাও হাং চিং। অনেকের ধারণা ভারতই চিনের আগে টিকা দেওয়ার প্রচলন শুরু করে।
তবে টিকা দেওয়ার ইতিহাসের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে। কুর্ট পোলক (Kurt Pollack,. The Healers, the Doctor, then and now. English Edition. Pp. 37-8.) অতীতে ভারতে টিকা দেওয়ার প্রচলন ছিল বিষয়ে লিখছেন, preventive inoculation against the smallpox, which was practiced in China from the 11th century, apparently came from India[আসলে বাংলা]।
অতীতে ভারতে গুটি বসন্ত দেবতার আভিশাপ বা অপদেবতার কাজ বা অতিপ্রাকৃতদের কর্মরূপে দেখা হত। সারাভারতে বসন্তের নানান দেবী ছিলেন — তাঁদের পুজার্চনাও হত — দক্ষিণে যেমন পোচাম্মার পুজো হত শ্রাবণ মাসের বৃহস্পতিবার বা শনিবার, বাংলায় শীতলা দেবীর আরাধনা হত — মেদিনীপুর থেকে শুরু করে রাঢ বঙ্গের হাওড়া হুগলিতে এই পুজো প্রচলিত ছিল। আজও পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগর ব্লকে দক্ষিণ শীতলা গ্রামের কালীপদ মিশ্র শীতলা মঙ্গল গান করেন। মুসলমান সমাজও এই অর্চনায় আজও অংশ নেন।
ধরমপালজী ব্রিটিশ সূত্র উল্লেখ করে লিখছেন গুটি বসন্তের টীকা ভারতের বহুকালের পরম্পরা। এক ধরণের ব্রাহ্মণ সূচ জাতীয় যন্ত্র নিয়ে এই টিকা দেওয়ার কাজ করতেন। Operation of inoculation of the smallpox as performed in Bengall from Re. Coult to Dr. Oliver Coult in ‘An account of the diseases of Bengall’ Calcutta, dated February 10, 1731 দেখা যাচ্ছে টিকাকরণের কাজের উল্লেখ।
পূর্বের প্রকাশনায় উল্লিখিত ঈভস লিখছেন, বাংলায় টিকা করণের কাজ করেন স্থানীয়রা। তবে তিনি লিখছেন, ইংলন্ডে যে ধরণের টিকাকরণ করা হয়, এই পদ্ধতি তার তুলনায় অন্যরকম।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কৃতি ছাত্র নবীন চন্দ্র পাল ১৮৭৩ সালে লিখছেন, সব দেশিয় চিকিৎসক হাতুড়ে এই ধারণাটি ভয়ঙ্কর – এবং এই লেখায় তিনি টিকা দেওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখছেন, রোগীকে সুস্থ করে তোলার যে হিন্দু চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল, সেটি কোন অংশে ন্যুন ছিল না। তিনি বলছেন হজম, মধুমেহ, রক্ত আমাশা, পাতলা পায়খানা, কুষ্ঠ, হাঁপানি, বাত, ক্রিমি, ফোঁড়া, আলসার সারাতে দেশিয় চিকিতসকেরা মাহির ছিলেন।
নাথ, দেব, দেবনাথদের ভুলে যাওয়া সামাজিক পেশা
আয়ুর্বেদ, য়ুনানি চিকিৎসার বাইরে গ্রামীন চিকিৎসা নিয়ে নারায়ণ মাহাত গবেষণা করছেন। কিন্তু বাংলার দেশিয় চিকিৎসার ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি কাজ হয় নি।
বিডন স্ট্রিটে যে আয়ুর্বেদিক কলেজের সামনে দোকানের কথা বললাম, দোকানটা খুব কম করে ১৫০-২০০ বছরের। কিন্তু তার ইতিহাস লিখে রাখা হয় নি। সব ইতিহাস হেলায় হারিয়ে যাচ্ছে। পুরোনো আয়ুর্বেদ বৈদ্যদের পরিবারগুলিকে নিয়ে একটা গবেষণা করা দরকার। আর খোঁজা দরকার নাথ, দেব, দেবনাথ উপাধিধারী পরিবারের পুরোনো মানুষদের – এঁরা নাথ পরম্পরার মানুষ। ভবানীপুরের পদ্মপুকর রোডের খালসা বিদ্যালয়ের কাছের একটা গলিতে প্রচুর নাথ পরিবার বাস করেন। এই বৈদ্যদের পরিবারে সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার স্বাস্থ্যের আর চিকিতসাবিদ্যার ইতিহাস।
এই পোস্ট যে সব দেবনাথ, নাথ, দেব, দে, সেন, গুপ্ত পদবীরা দেখবেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন থাকল, তাঁদের কি মনে পড়ে তাদের পূর্বজরা চিকিৎসক ছিলেন? প্রাচীন ভারত ভ্রমণকারীদের লেখায় পাওয়া যাচ্ছে নাথ চিকিৎসকেরা সোরা আর গন্ধক নির্দিষ্ট অনুপানে মিশিয়ে খেয়ে দীর্ঘজীবন লাভ করতেন। দীপঙ্করদা বলছিলেন তাঁর পূর্বজ চিকিৎসক ছিলেন।
এলোপ্যাথির আগে বাংলার চিকিতসাবিদ্যার ইতিহাস লেখা হয় নি। যদি এই পরিবারের মানুষেরা এগিয়ে আসেন পারিবারিক ইতিহাসের ঝাঁকি নিয়ে তাহলে শুধু বসন্ত নয় আরও বাঙালির বহু ভুলে যাওয়া চিকিৎসার ইতিহাস নথিবদ্ধ হতে পারে।
কাল বলব হাড়জোড়া ডাক্তারের কথা।
শেষ প্রশ্ন, ওলাওঠাও গ্যাছে, গুটি বসন্ত গ্যাছে, তাহলে ওলাবিবি আর শীতলা আজও পুজো পান কেন?
দেবতা মানুষের বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে পুজিত হন — তারপরে তাকে মানুষ ভুলে যায় এটা ঔপনিবেশিক সুশীলীয় ইউটিলিটেরিয় ধারণা। মানুষ তার অতীতের স্মৃতি, তার অভ্যেস, তার মনের গহীনে থাকা কৃতজ্ঞতা, সব বহন করে চলে তার সামাজিক ক্রিয়া কর্মে যার একটা অংশ ফুটে ওঠে পুজো আর উৎসবর অনুষ্ঠানগুলোয়। অভদ্রলোক গ্রামীন মানুষ কিছুই ভোলে, ভোলেন না তাঁর দীর্ঘকালের ইতিহাস, জ্ঞানচর্চা, দক্ষতা। তার মত করে সে মনে রাখে।
সে জানে যে লুঠেরা সময়ে বিজ্ঞানের নামে প্রগতির নামে, উন্নয়নের নামে গত আড়াইশ বছর ধরে টিকে আছে, তাকে তার গোষ্ঠীকে দিয়ে যা যা সব করানো হচ্ছে তা কোনোটিই বিশ্বাসযোগ্যও নয় নির্ভরযোগ্যো নয়। আবারও মড়ক ফিরে আসতে পারে — কারণ প্রযুক্তি নির্ভরযোগ্য নয়, মানুষের লুঠের অদম্য স্পৃহা আজও থামে নি — বরং লকলক করে বেড়ে উঠছে। করোনায় সে বুঝেগেছে যে জাতিরাষ্ট্র তাকে বাঁচায় না। সে পুজো মার্ফত সেই অতীতের সেরে ওঠার অর্জিত জ্ঞান, সময় তার মনন তার কৃষ্টি, তার অভিজ্ঞতা, তার জ্ঞানচর্চা ধরে রাখে।
এটাই ছোটলোকদের ইতিহাস এবং জ্ঞানচর্চা উভই। এটাই তার স্বনির্ভরতা সমাজ নির্ভরতা।
জয় বাংলা! বাংলা বাঙালির জয়!