সোমবার | ১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৩:০৬
Logo
এই মুহূর্তে ::
হরিপদ দত্ত-র ছোটগল্প ‘আত্মজা ও পিতা’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : আবদুল মান্নান সৈয়দ নবেন্দু ঘোষ-এর ছোটগল্প ‘ত্রাণ-কর্ত্তা’ অরণি বসু সরণিতে কিছুক্ষণ : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অন্য এক ইলিয়াস : আহমাদ মোস্তফা কামাল খেজুর গাছের সংখ্যা কমছে, গাছিরা চিন্তায়, আসল সুস্বাদু খেজুরগুড় ও রস বাজারে কমছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কেকা অধিকারী-র ছোটগল্প ‘গাছমানুষ’ মনোজিৎকুমার দাস-এর ছোটগল্প ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ মিয়ানমারে চীনের ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল ও রাখাইনে শান্তির উদ্যোগ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন সংসদের শীত অধিবেশনেই ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ বিল পাশ হবে কি : তপন মল্লিক চৌধুরী কুরুক্ষেত্রের কথা : রিঙ্কি সামন্ত কনক ঠাকুরের ছোটোদের কবিতার আকাশ, জলরঙে আঁকা রূপকথা : অমৃতাভ দে শীতের মরসুমে বাজারে সবজি আমদানি হলেও দামের ঝাঁজে গৃহস্থের চোখে জল : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় হাইনরিখ হাইনে : শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত ‘হীরক রাজার দেশে’র একটি স্মরণীয় আউটডোর : রবি ঘোষ বাবরি মসজিদ ভাঙার ‘ঐতিহাসিক যুক্তি’ : ইরফান হাবিব হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি : সুবিমল মিশ্র সর্বনামই যেখানে নাম হয়ে উঠতে পারে : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (শেষ পর্ব) : রহমান হাবিব নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘পূর্ণিমা রাত ও পাটকিলে কুকুর’ মহানাটক শেষ মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হলেন ফড়ণবীস : তপন মল্লিক চৌধুরী বাজার মাতাচ্ছে রাজ্যেরই ড্রাগন ফল, লাভবান চাষিরা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কবিতার শত্রু মিত্র : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (চতুর্থ পর্ব) : রহমান হাবিব মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘রেফারী’ অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (তৃতীয় পর্ব) : রহমান হাবিব কাশ্মীরী মন্দির — অবহেলায় না অনীহায়? অবন্তীস্বামী ও মার্তন্ড মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মমতার স্পষ্ট বার্তা — আগে বাংলার মানুষ আলু খাবে, তারপর বাইরে পাঠানো হবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (দ্বিতীয় পর্ব) : রহমান হাবিব লঙ্কা চাষ বাড়ছে, লাভবান চাষিরা, রপ্তানি বাড়াতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায়
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

অতুলপ্রসাদ সেন: নিজের বেদনাদীর্ণ জীবন, গানে বিমূর্ত হয়েছে : মনোজিৎকুমার দাস

মনোজিৎকুমার দাস / ৩২০ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০২২

বাঙালি মনে রেখেছে আজও অসামান্য সঙ্গীতস্রষ্টা অতুলপ্রসাদ সেনকে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার মিস্টার এ পি সেন, লখনউয়ের অগাধ পসারওয়ালা, প্রতিষ্ঠিত প্রথম শ্রেণির আইনজীবী। একই সঙ্গে সমাজসেবী, উদারপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু অন্তরে প্রবহমান ছিল এক আশ্চর্য এবং দুর্লভ সঙ্গীত প্রতিভার ফল্গুধারা।

উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে, ১৮৬১ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত কালপর্বে বাঙালি পেয়েছে চার জন কিংবদন্তিতূল্য কবি-গীতিকার, সুরকার ও সুরসাধককে— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন এবং অতুলপ্রসাদ সেন। কাজী নজরুলের আগমন আরও প্রায় তিন দশক পরে।

অতুলপ্রসাদ সেনের সঙ্গীত প্রতিভার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তি জীবন ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়েছিল। এ কারণে তার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের উপর আলোকপাত করা প্রয়োজন।

১৮৭১ সালে ২০ অক্টোবর ঢাকায় মাতুলালয়ে এক বৈদ্য পরিবারে অতুলপ্রসাদ সেনের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম রামপ্রসাদ সেন এবং মায়ের নাম হেমন্তশশী দেবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ বিক্রমপুরের মগরা গ্রামে।

তাঁর দাদু কালীনারায়ণ গুপ্তই তাঁকে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র এবং ভক্তিগীতিতে আগ্রহী করে তোলেন। তাঁর বাবা রামপ্রসাদ সেন রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য ছিলেন। মহর্ষির বদান্যতায় রামপ্রসাদ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। বাল্যকাল থেকে অতুলপ্রসাদ বাড়িতে ব্রাহ্ম পরিবেশে বড় হয়েছেন। বাবা রামপ্রসাদ সেন নববিধান ব্রাহ্মসমাজ এবং দাদু কালীনারায়ণ সেন ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ছিলেন। দাদুর কাছেই তিনি জাত-পাতের সংস্কার ভাঙতে শিখেছেন। রামপ্রসাদের মৃত্যু হলে তাঁর মা হেমন্তশশী ৪৩ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন ব্রাহ্মনেতা দুর্গামোহন দাশকে।

অতুলপ্রসাদ আত্মজীবনী অথবা দিনলিপি লিখে রেখে যাননি। তবে তাঁর বিষাদাচ্ছন্ন জীবনের যাপনকথা ছড়িয়ে রেখেছেন স্বরচিত গানে। ব্রাহ্ম পরিবারের ছেলে অতুলপ্রসাদ কৈশোরে পিতৃহীন হয়ে সান্নিধ্য পেয়েছিলেন মাতামহ কালীমোহন গুপ্তের, সে যুগের বিখ্যাত গীতিকার ও গায়ক। বাবা রামপ্রসাদ সেনও ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ। অতুলপ্রসাদের চেতনায় গান এসেছিল সেই সূত্রে। এক মামাতো বোন, বিখ্যাত গায়িকা সাহানা দেবীর কথা অনুযায়ী, অতুলপ্রসাদ প্রথম গান লেখেন চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সে। গানটি ছিল ‘তোমারি উদ্যানে তোমারি যতনে উঠিল কুসুম ফুটিয়া’। প্রথম যৌবনে কঠিন আঘাত পেয়েছিলেন মায়ের কাছে। তেতাল্লিশ বছরের বিধবা মা হেমন্তশশী বিয়ে করলেন ব্রাহ্ম নেতা দুর্গামোহন দাশকে।

অভিমানী অতুলপ্রসাদ বিলেত গেলেন ব্যারিস্টারি পড়তে। সালটা ১৮৯২। সেখানে থাকাকালীন বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত সেখানে যান। অতুলপ্রসাদ প্রেমে পড়লেন মামাতো বোন, সুন্দরী, সুগায়িকা হেমকুসুমের। সমাজ-নিষিদ্ধ সম্পর্কে বিয়ের জন্য প্রতিবন্ধকতা এল যথেষ্ট। অতুলপ্রসাদ তার সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। আইনজ্ঞ অতুলপ্রসাদ তাঁর কর্মগুরু সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের পরামর্শক্রমে স্কটল্যান্ড চলে যান। সেখানকার আইনে এ রকম বিয়েতে বাধা ছিল না। সেখানে ১৯০০ সালে মামাতো বোন হেমকুসুমকে বিয়ে করেন অতুলপ্রসাদ।

সকলের অমতে স্কটল্যাণ্ডের এক গ্রামীণ গির্জায় গিয়ে খ্রিস্টমতে বিবাহ করেন অতুলপ্রসাদ।

বিলেতবাসে ভাগ্যের সহায়তা মেলেনি। সেখানে পসার জমাতে পারেননি অতুলপ্রসাদ। তীব্র অর্থকষ্ট হয়ে ওঠে নিত্যসঙ্গী। সেখানে তাঁদের দু’টি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়, যাদের মধ্যে এক জন খুব কমবয়সেই মারা যায়। ১৯০২ সালে জীবিত পুত্রকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন অতুলপ্রসাদ। তখন আত্মীয়-স্বজন কেউ তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি।

মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে মন থেকে এই ঘটনা মেনে নিতে পারেননি আর তাই এই ঘটনার পর থেকেই কলকাতায় মামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তের বাড়িতে অভিমানে থাকতে শুরু করেন তিনি। মায়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে চাইতেন না। এই মামার মেয়ে হেমকুসুম তাঁকে দুঃখে সান্ত্বনা দিতেন, মনোবল জোগাতেন।

১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন অতুলপ্রসাদ সেন। ঐ বছরই দুর্গামোহন দাশের সহায়তায় ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যাণ্ড যাত্রা করেন তিনি। ইংল্যাণ্ড যাবার পথে ভেনিসের কাছে জাহাজে বসেই একটা বিদেশি গানের সুরে মোহিত হয়ে ঐ সুরকে মাথায় রেখে অতুলপ্রসাদ প্রথম লিখে ফেলেন একটি বিখ্যাত গান – ‘ওঠ গো ভারতলক্ষ্মী’। লণ্ডনের মিডল টেম্পলে ব্যারিস্টারি পড়াকালীন ব্রিটিশ মিউজিয়াম ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয় তাঁর। চিত্তরঞ্জন দাশ, সরোজিনী নাইডু, অরবিন্দ ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখদের সঙ্গে লণ্ডনেই সাক্ষাৎ ঘটে তাঁর। ব্যারিস্টারি পড়ার পাশাপাশি পাশ্চাত্য সঙ্গীত, নাটক, অর্কেস্ট্রা ইত্যাদি শুনতে শুনতে গানের ভিত তৈরি হয় তাঁর মনে।

গানের সংখ্যায় তিনি বাকি তিন জনের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে। কিন্তু তাঁর সঙ্গীতকীর্তির অন্তর্লীন মায়া এবং মগ্নতা তাঁকে সকলের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশি বছরের জীবনকালে লিখেছেন প্রায় দু’হাজার গান, পঞ্চাশ বছরের জীবনে ৫০০টি গান লিখেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল, এর মধ্যে বেশির ভাগ নাটকের গান। স্বল্পায়ু রজনীকান্ত সেনের মোটামুটি ২৯০টি গানের হিসেব পাওয়া যায়। আর তেষট্টি বছরের পার্থিব জীবনে অতুলপ্রসাদ লিখেছেন সাকুল্যে ২০৮টি গান। তাও বাংলার বাইরে বসে, ব্যস্ত কর্মজীবনের ফাঁক-ফোকরে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে লখনউতে তাঁর আবক্ষ-মূর্তি উন্মোচনের সময় উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল সরোজিনী নাইডু শ্রদ্ধা-সমাচারে লিখে পাঠিয়েছিলেন, “হি চোজ় ল ফর হিজ় ব্রেড, বাট পোয়েট্রি ওয়াজ় হিজ় নার্সিসাস ফ্লাওয়ার, ফুড ফর হিজ় সোল।”

সেখান থেকে লখনউ চলে যান তাঁরা। এই পর্বে দ্বিতীয় স্বামী দুর্গামোহনের মৃত্যুর পর তাঁদের সংসারে ফিরে আসেন অতুলপ্রসাদের মা হেমন্তশশী। শাশুড়ি হিসেবে তিনি ছিলেন বধূকণ্টকী প্রকৃতির। শাশুড়ি-বৌমার তীব্র বিসম্বাদ নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে ওঠে। হেমন্তশশী ও হেমকুসুমের দ্বন্দ্ব মেটেনি কখনও। হেমন্তশশীর মৃত্যুর পর ঘরে তাঁর ছবি টাঙানো ছিল। তা সরিয়ে ফেলার দাবি তোলেন হেমকুসুম। মায়ের ছবিকে অসম্মান করতে নারাজ হলেন অতুলপ্রসাদ। তীব্র বিরাগে হেমকুসুম চিরকালের জন্য স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে যান, আর কখনও ফেরেননি। পারিবারিক সংঘাতে দীর্ণ অতুলপ্রসাদকে মেনে নিতে হল ব্যর্থ দাম্পত্যের অভিশপ্ত জীবন। স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করা হল না। প্রিয়-বিরহের পথ ধরে জীবনে গান এল আরও প্রবল ভাবে। গান হয়ে উঠল তাঁর নিত্য সহচর। অন্তর-মথিত করা অব্যক্ত এক বেদনা হয়ে উঠল তাঁর গানের আধার।

বিলেতফেরত নামী ব্যারিস্টার। বাংলা সাহিত্যের পঞ্চকবির অন্যতম, সমাজসেবী ও মানবদরদি হয়েও মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে, স্ত্রীর সংসার ত্যাগ, ছেলের মৃত্যুতে বার বার এসেছে আঘাত। সেইসব আঘাত থেকেই তিনি মনোবেদনা অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন তিনি তাঁর গানের মাধ্যমে,যার অনেকগুলোই ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত।

মাত্র ২০৮টি গানের সম্পদ দিয়ে শান্ত, লাজুক, নিরহঙ্কার মানুষটি বাংলা গানের ভুবনকে দিয়ে গেছেন অপার ঐশ্বর্য। প্রকৃতির গান, স্বদেশচেতনার গান, ঈশ্বর-নিবেদিত সঙ্গীত, প্রেমগীতি এবং বিবিধ— এ ভাবেই স্বচ্ছন্দে তাঁর গানের বিষয় বিভাজন করা যায়। গানের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের মতো গোছানো মানুষ ছিলেন না অতুলপ্রসাদ। তাই আসরে তাঁর গান গাওয়া হলে অনেকেই ভুল করে ভাবতেন রবীন্দ্রগান। লাজুক গীতিকবির জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে ১৯২৫ সালে প্রথম গ্রন্থিত হল তাঁর ‘কয়েকটি গান’। পরে ১৯৩১ সালে ‘গীতিগুঞ্জ’, আরও পরে স্বরলিপিসমৃদ্ধ ‘কাকলি’।

অতুলপ্রসাদ সেনের কয়েকটি বিখ্যাত গান হল মিছে তুই ভাবিস মন, সবারে বাস রে ভালো,বঁধুয়া, নিঁদ নাহি আঁখিপাতে, একা মোর গানের তরী, কে আবার বাজায় বাঁশি, ক্রন্দসী পথচারিণী ইত্যাদি। তার রচিত দেশাত্মবোধক গানগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী, বলো বলো বলো সবে, হও ধরমেতে ধীর। তার মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! গানটি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অণুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। অতুলপ্রসাদের গানগুলি দেবতা, প্রকৃতি, স্বদেশ, মানব ও বিবিধ নামে পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন।

সাময়িক বছরখানেকের বিরতি বাদ দিলে ১৯০২ সাল থেকে আমৃত্যু অতুলপ্রসাদ ছিলেন লখনউয়ের মানুষ। সেই সুবাদে উত্তরপ্রদেশের সঙ্গীত-সংস্কৃতি উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন তাঁর গানে। বাংলা গানে ঠুংরি, গজলের আমদানি মূলত তাঁর হাত ধরে। বাংলা কথাচিত্রে গজলের মধুর-করুণ রসের স্বাদ বাঙালি এর আগে পায়নি। এ ধারায় উল্লেখ করার মতো গান— ‘ভাঙ্গা দেউলে মোর কে আইলে এলো হাতে’, ‘কে তুমি ঘুম ভাঙালে’, ‘তব অন্তর এত মন্থর’, ‘ক্রন্দসী পথচারিণী’ ইত্যাদি। ঠুংরি-ঘরানার গান ‘শ্রাবণ-ঝুলাতে বাদল রাতে আয় কে গো ঝুলিবি আয়’ অথবা কাফি-খাম্বাজের মিশ্রণে ঠুংরি চালের ‘বাদল ঝুম ঝুম বোলে’ বা ‘বঁধু ধরো ধরো মালা পরো গলে’-র মতো সব আসর জমানো গান। গীতিকবিতায় উত্তরপ্রদেশের লোকগান, যেমন কাজরি, লাউনি ইত্যাদির সার্থক প্রয়োগ করে গানের মধ্যে সুরবৈচিত্র এনেছেন। লাউনি ছাঁদের গান ‘কে গো গাহিলে পথে’ আর ‘কেন এলে মোর ঘরে’ শ্রোতাদের বরাবর মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। কাজরি চলনের একটি গান ‘জল বলে চল, মোর সাথে চল’ অতুলপ্রসাদি গায়ক-গায়িকাদের অন্যতম পছন্দের গান। গানের স্রোতে ভেসে বাংলা গানে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন খেয়াল, দাদরা নানা ধরনের হিন্দুস্থানি রাগপ্রধান গানের, তারই ফলশ্রুতি ‘সে ডাকে আমারে’, ‘যাব না যাব না ঘরে’, ‘আমার বাগানে এত ফুল’ প্রভৃতি গান। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গাঁধী থেকে শুরু করে সমকালের শাস্ত্রীয়-সঙ্গীতের বহু সুরসাধক।

জীবনের বেশির ভাগ সময় বাংলার বাইরে থেকেও ভোলেননি দেশজ বাউল-কীর্তন, ভাটিয়ালি গান। বাউল গান রচনায় সিদ্ধহস্ত লিখলেন, ‘আর কতকাল থাকব বসে’ অথবা ‘মনরে আমার তুই শুধু বেয়ে যা দাঁড়’। আবার কীর্তনধারার গানেও বিলিতি ব্যারিস্টার সমান স্বচ্ছন্দ। এ তালিকায় স্মরণ করা যেতেই পারে ‘যদি তোর হৃদযমুনা হল রে উছল ভোলা’ কিংবা ‘ওগো সাথী মম সাথী’-র মতো আকুল করা গান। ধ্রুপদাঙ্গের গান তুলনায় কম রচনা করলেও তার ঐশ্বর্য বড় কম নয়, এ রকমই একটি গান ‘ক্ষমিও হে শিব আর না কহিব, দুঃখ বিপদে ব্যর্থ জীবন মম’। গত শতকের অনেক চলচ্চিত্রে সার্থক ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল তাঁর গান। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখ দাবি করে ‘একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলেম নয়নজলে’ গানটি। নিজের গানে বেশি ওস্তাদি তান-ঢং লাগানো পছন্দ করতেন না। তরুণ পাহাড়ী সান্যালকে এ কারণে বহু বার নিষেধও করেছিলেন। গান রচনা করতে পারতেন যে কোনও পরিবেশে, আদালতে কাজের ফাঁকে দিব্যি লিখেছেন, ‘ওগো আমার নবীন শাখী’-র মতো প্রেমের গান।

রবীন্দ্রযুগে বাস করে, রবি-অনুরাগী হয়েও তাঁর গান ছিল রাবীন্দ্রিক প্রভাবমুক্ত, সে প্রভাব ছিন্ন করতে পারেননি আর এক সেন-বংশীয় সুরসাধক, রজনীকান্ত সেন। রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে অতুলপ্রসাদ লিখেছেন দু’টি বিশেষ গান, ‘প্রভাতে যারে নন্দে পাখি’ এবং ‘জয়তু জয়তু কবি’।

বিশিষ্ট আইনজীবী এবং অবসরে সুরসাধক— এটুকু বললে, অতুলপ্রসাদের ব্যাপকতর পরিচয় প্রকাশিত হয় না। নিজের প্রবাসী পরিচয় মিথ্যে করতে বার বার তাঁর কলমে, সুরে তুলে এনেছেন মনকাড়া দেশাত্মবোধক গান ‘বলো বলো সবে’, ‘প্রবাসী চল রে দেশে চল’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ভাষাকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধাদের অন্যতম প্রাণের গান হয়ে উঠেছিল ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’। বাংলা ভাষা আর স্বদেশ, এই দুইয়ের ওপর তাঁর ছিল নাড়ির টান। প্রথম যৌবনে ভেনিসে গন্ডোলা-চালকের গানের সুরে মোহিত অতুলপ্রসাদ স্বদেশের কথা ভেবে লিখলেন কালজয়ী গান ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’। প্রবাসে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে গড়ে তুললেন ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলন’, প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হয়ে সম্মিলনের মুখপত্র ‘উত্তরা’ প্রকাশে তাঁর ভূমিকা হল সর্বার্থেই বিশিষ্ট। উর্দুচর্চার পীঠস্থান উত্তরপ্রদেশ, বিশেষ করে লখনউয়ের বহু স্কুলে বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য দানের ঝুলি উপুড় করে দিলেন।

বেহাগ, সিন্ধু, কাফি, পিলু, ভৈরবী, সাহানা, হাম্বীর, আশাবরী অজস্র হিন্দুস্থানি রাগের আধারে রচিত গানের ভেতর দিয়ে সুরসাধক অতুলপ্রসাদের চির-বৈরাগী, ঈশ্বর-সমর্পিত মনটিকে স্পষ্ট চিনে নেওয়া যায়। বাস্তবেও তাঁর সমকালের মানুষ চিনতে ভুল করেননি গুণী মানুষের সঙ্গকাঙাল, উদারচিত্ত, বন্ধুবৎসল ব্যারিস্টার সেনসাহেবকে। তাঁর মৃত্যুর খবরে স্তম্ভিত রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “তিনি এক সুরলোক থেকে অন্য সুরলোকে গমন করেছেন।” সেই সঙ্গে অসঙ্কোচে অতুলপ্রসাদের মানব-হিতৈষণার পরিচয় দিয়েছেন কবিতায়— ‘ছিল তব অবিরত/ হৃদয়ের সদাব্রত/ বঞ্চিত করোনি কভু কারে/ তোমার উদার মুক্ত দ্বারে…’।

১৯৩৪ সালের ২৬ অগস্ট তাঁর মৃত্যুর পর চিতাভস্মের কিছু অংশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়। ঢাকা সাব-ডিভিশনের গাজীপুর জেলায় কাউরাইদ গ্রামে, সুতিয়া নদীর তীরে এক ব্রাহ্মমন্দির সংলগ্ন সমাধিস্থলে সমাহিত হয় চিতাভস্ম। স্মৃতিফলকে লেখা হয়েছিল বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালবাসার কথা, ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।’ অতুলপ্রসাদের মাতামহ ভাওয়ালের জমিদার কালীনারায়ণ গুপ্তর কাছারি বাড়ি ছিল কাউরাইদ গ্রামে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাক সেনা আক্রমণে সে ফলক চূর্ণ হয়ে গেলে পরবর্তী পর্যায়ে নতুন ফলকে এল অন্য গানের কথাচিত্র, ‘আমার যে শূন্য ডালা তুমি ভরিও/ শুধু তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিও’। দেশপ্রেম এবং মাতৃভাষায় আমৃত্যু নিবেদিতপ্রাণ অতুলপ্রসাদের সমাধিতে জাদুঘর নির্মাণ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার প্রশাসন।

লখনউ শহরের সারস্বত-সমাজ জানত, বিলেতফেরত ব্যারিস্টার সেনসাহেবের মনের তারগুলো বড় মমতায় বাঁধা। দেশের মাটিতে, দেশের দরিদ্র, অসহায় মানুষের সেবায় ভালবেসে অকাতরে দানধ্যান ছিল তাঁর জীবনব্রত। সেই সাধনার কথাই সহজিয়া ভঙ্গিতে বলে গেছেন তাঁর গানে— ‘সবারে বাসরে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে’। ঈশ্বর-আশ্রয়ী অসাম্প্রদায়িক মানুষটি চেয়েছিলেন, চিতায় শুয়ে সকলকে হাসিমুখ দেখিয়ে চোখ বুজবেন।

ভালবাসার দীক্ষা যিনি এমন করে দিয়ে গেছেন তাঁকে কি ভোলা যায়?

তথ্যঋণ: অতুলপ্রসাদ— মানসী মুখোপাধ্যায়; স্মৃতির খেয়া— সাহানা দেবী; অতুলপ্রসাদ— সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী

মনোজিৎকুমার দাস, প্রাবন্ধিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন