শুক্রবার | ২৫শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১:০৩
Logo
এই মুহূর্তে ::
জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (নবম পর্ব) : বিজয়া দেব চেতনার সমস্যা, সামাজিক অবকাঠামো এবং বলপ্রয়োগ : এরিক ফ্রম, অনুবাদ ফাতিন ইশরাক বারবার ভিলেন সেই বঙ্গোপসাগর : তপন মল্লিক চৌধুরী নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রাখাইন পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের উদ্যোগ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন ‘দানা’ থেকে ভয় পাবেন না, সতর্ক থাকুন, মোকাবিলায় রাজ্য সরকার প্রস্তুত : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সই বা বন্ধুত্ব স্থাপনের উৎসব সয়লা : রিঙ্কি সামন্ত প্রথম পাঠ — “নিশিপালনের প্রহরে” নিয়ে, দুয়েকটি কথা : সোনালি চন্দ বৃহন্নলার অন্তরসত্তা : নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী দুই দশক : শৈলেন মান্না ভরা বর্ষায় জলপ্রপাতের মুখোমুখি… : বিদিশি বসু দামোদর মাউজো-এর অনুবাদ গল্প ‘হরতাল’ বঙ্গে কুবেরের পূজা : অসিত দাস বাংলা সাহিত্যের দেবতারদের দেখা মেলে ওই ঘরেই : অশোক মজুমদার মালবাণকে ছুঁয়ে রূপোলী সমুদ্রসৈকতে : নন্দিনী অধিকরী মার্ক্সবাদ, মনোবিশ্লেষণ এবং বাস্তবতা : এরিক ফ্রম, অনুবাদ ফাতিন ইশরাক সাহিত্যের প্রাণপ্রবাহে নদী : মিল্টন বিশ্বাস এবার দুর্গা পুজোকেও ছাপিয়ে গেল রানাবাঁধের লক্ষ্মীপুজো : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় দেড় হাজার বছর প্রাচীন ঘোষগ্রামের লক্ষীকথা : রিঙ্কি সমন্ত হুতোমের সময় কলকাতার দুর্গোৎসব : অসিত দাস নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘বৈতালিক’ কোজাগরীর প্রার্থনা, বাঙালির লক্ষ্মীলাভ হোক : সন্দীপন বিশ্বাস তারকেশ্বর-বিষ্ণুপুর রেল প্রকল্পের কাজ ভাবাদিঘিতে ফের জোর করে বন্ধ করা হলো : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর — অনেক বিদ্যাসাগর মাঝে তিনি একক : প্রলয় চক্রবর্তী আমেরিকা-ইসরায়েল সম্পর্কের শেকড় অনুবাদ ফাতিন ইশরাক নিয়ম নীতি আচারে লক্ষ্মী পূজার তোড়জোড় : রিঙ্কি সামন্ত আমার প্রথম বই — ঘুণপোকা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘কে জাগ রে’ জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন একটি বিপ্রলম্ভের কবিতা : প্রসেনজিৎ দাস আন্দোলন ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই : তপন মল্লিক চৌধুরী রেখা দাঁ ও বিজ্ঞান আন্দোলন : দীপাঞ্জন দে
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই মহাঅষ্টমীর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

আত্মজীবনীর কাল : ছোটগল্প লিখছেন আফসার আমেদ

আফসার আমেদ / ১৭৩ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২১

উলুবেড়িয়ায় লেভেল ক্রসিং-এর গেট বিকল হওয়ায় ট্রেন আটকে ছিল। মিস্তিরিরা যতক্ষণ না সারিয়ে তুলছে, ততক্ষণ ট্রেন ছাড়বে না। অথচ সুবিদ যাবে কুলগাছিয়া থেকে বাগনান স্টেশন। একটা স্টেশন। স্কুল ফেরতা চৈত্রের শেষের দিকের বিকেলে প্ল্যাটফর্মে সুবিদের এই অপেক্ষমাণতা ক্রমশ অসহ হয়ে উঠছিল। তলানিতে থাকা বসন্তও উধাও। হাওয়া নেই। কোকিলের ডাক নেই। যাত্রীদের ভিড় বাড়ছে। সময়ও ফুরোচ্ছে। একটু পদচারণা করে সুবিদ। তার পর একটু বসার জন্য উন্মুখ হয়। বেঞ্চগুলোতে একটু বসার জায়গা আছে কি না দেখে। নেই। সহসা চোখে পড়ে একটা বেঞ্চে মাঝখানে এক জনের মতো বসার জায়গা আছে। তিন জন যে বসে আছে, তার মধ্যে এক জনই মহিলা, ডান দিক ঘেঁষে তার স্থান। তার পাশেই ফাঁকা জায়গাটা। সুবিদ ভাবে, সে বসবে কি না।

মহিলা বোরখা পরে আছে। মুখও ঢাকা। চোখ দু’টি শুধু দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত এক অনধিকার জাগিয়ে তুলছে সে এই ফাঁকা জায়গাটার প্রতি। সাহস করে কেউ বসছে না। একটু সাহস করে চোখ দু’টি দেখল সুবিদ মহিলার। বেশি বয়স নয়। কিন্তু সুন্দরী কি? বোরখার ভেতর বুঝবে কী করে। হাতের আঙুলগুলি প্রকাশ্য হওয়ায়, বোঝা যায় সুন্দরী হলেও হতে পারে। বেশ ফর্সা রং। কম বয়সের লাবণ্যে ভরা হয়তো-বা। এ সব কল্পনা সুবিদের। তাতেও বেশ থাকা যায়। এই অপেক্ষমাণতার স্বেদে আর এক বসন্ত যেন।

সে খানিকটা একগুঁয়ে হল, এই ফাঁকা জায়গাটাতে বসবেই। বোরখা-নারীর পাশটিতেই। আরও দু’জন পুরুষ তো বসেই আছে। সে না হয় গায়ের পাশে বসল। কাঁধের ঝোলাটা অসহ হচ্ছে। কখন ট্রেন আসবে ঠিক নেই। একটু বসে নেওয়াই শ্রেয়।

অতএব সুবিদ ধাঁ করে বসে পড়ল বোরখা-রমণীর পাশটিতে। যেমন ভাবে কুয়োর ভেতর বালতি নেমে যায়, তেমন সে আবেগ পেল অনুভূতিতে। কোলে ঝোলাটা রাখল। আর অদ্ভুত বোরখা-নারী তাকে আরও একটু সুবিধে দেওয়ার জন্য সরে গেল। আর সুবিদ মুখ ফিরিয়ে চাহনি দিয়ে ধন্যবাদ জানাল। এই মানবিক বিনিময়তা তারা রচনা করল। সুবিদ মনে করল তাবত পৃথিবীর জন্য।

কিন্তু এই মহিলার স্বাভাবিক হয়ে তাকানো, কথা বলাতে যাবে না কেন? এই আবরণের ভেতর এক জন মানুষই তো থাকে। তার বিকেল সন্ধ্যা রাত্রি গোধূলি ভোর তাকে কেমন অভিসারে রাখে। যা নিজের জন্য। তা কি এই আবরণ নিরুদ্দেশ করে দেয়? নাকি কল্পনার রঙে তার বেঁচে থাকাকে সাজিয়ে যায় শুধু। কিছুই জানে না সুবিদ এই নারীটির সম্বন্ধে। শুধু সে ভাষাহীন বসে আছে। চোখের চাহনি কিছু থাকে তার। হয়তো কিছু ভাষাও পাখিদের দেওয়া দানার মতো ঝরে পড়ে।

অপেক্ষমাণতায় সুবিদ খানিকটা শান্ত হয়ে উঠছিল। বোরখা-রমণীর সঙ্গে কীসে কথা বলবে? এমনিতেই পুরুষদের দেখার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে নারীটি বোরখার ঘেরাটোপে আছে। সেই প্রহরা ভেঙে কথা বলবে কী করে। অথচ নিকট-বন্ধুর মতো পাশে বসে আছে মেয়েটি। একটু একটু করে নিজেকে সাজাতে লাগল সুবিদ। বোরখা-রমণীর সঙ্গে কথা বলে উঠবার পরিকল্পনায়। নিজেই আগে জেগে উঠতে চাইল। এখান থেকে দেড় কিলোমিটার হাঁটাপথে তার স্কুল। একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে সে অঙ্কের টিচার। বছর দেড় আগেও সে শুধুই টিউশন করে যেত। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় চাকরিটা পেয়েছে। বিয়ে করেনি। কিন্তু অদ্ভুত প্রেমময়তায় ভোগে। রাতের অনেকটা ইন্টারনেট করে তার কাটে। বছর বত্রিশ বয়েস। মা আছে, বাবা আছে, ভাইবোনও আছে। বাবা ইট-বালির ব্যবসায়ী।

তো এত কিছুর ভেতর দিয়ে কি এই বোরখা-নারীর সঙ্গে একটু কথা বলা যায় না? হয়তো যায়। হয়তো যায় না। সত্যিটা তার কাছে এই মুহূর্তে অধরা। তার পর পাশ ফিরে মহিলার চোখে চাহনি দিল। মহিলা একটু নড়ে উঠল। তাকে উদ্দেশ্য করেই বলে উঠল সুবিদ সহসা, ‘খুব গুমট, না?’

মহিলা পাখির মতো ডানা ঝাপটানোর ভঙ্গিতে দুই হাত দু’দিকে আছড়াল, ‘খুব গরম!’

মহিলার মধ্যে আরও কথা বলার অভিব্যক্তি ফুটে বেরচ্ছে। বোরখার আস্তিনে হাতায় গলায় কাঁধে মুখের আবরণে অস্থিরতার ভঙ্গির ভেতর। এত কিছু আগে ছিল না কিন্তু। হয়তো ছিল, গোপন হয়ে। যা প্রকাশ করছিল না। বলল, ‘কেন যে ট্রেন আসছে না!’

সুবিদ বলল, ‘তার সময়ে আসবে।’

‘বাড়ি ফিরব, দেরি হচ্ছে।’

‘কোথায় যাবেন?’

‘বাগনান।’ এ বার মুখের আবরণটা খুলে ফেলে মেয়েটি।

‘বাগনানের কোথায়?’

‘খাদিনান। আপনি কোথায় থাকেন?’

‘বাগনানেই, মহাদেবপুরে।’

‘আপনাকে দেখেছি।’

‘খাঁ পাড়াতে তো আমি পড়াতে যেতাম। রোজিদের বাড়িতে।’

‘সাইকেলে তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘রোজি তো আমার চাচাতো ননদ।’

‘রোজির ভাল নাম তো নিলুফার।’

‘ওর একটা মেয়ে হয়েছে।’

‘সে খবর তো পাইনি।’

‘ও খুব ভাল। দেড় ঘণ্টা বসে আছি দেখুন না ট্রেন নেই। বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম সেই ভোরে উঠে। দুপুর দুপুর বেরোলাম, কিন্তু এতক্ষণ বসে আছি ট্রেনের দেখা নেই। ছেলেটাকে রেখে এসেছি জা-এর কাছে।’

আরও কথা আছে মেয়েটির আবেগে। মুখের প্রকাশ্যতায় অদ্ভুত এক সখ্য আনন্দ ফুটে উঠছে। সম্ভ্রমের কল্পনা আছে মুখাবয়বে। পাথরের বুক থেকে কুঁদে ওঠা খুব মানবিক মুখ। যার হাতের ছোঁয়ায় বিছানা বালিশ চাদরের স্পর্শ লেগে আছে। থালা বাটি গেলাস, পুকুরঘাট তৈজসের নানা গড়ন গঠনের মধ্য দিয়ে প্রতি মুহূর্তে যার জন্ম হয়, বেঁচে ওঠা হয়। মরণগুলো সে হয়তো চেনে। ডুব দিয়ে গোসল করার শান্তি তার জানা হয়ে গিয়েছে। ঘরের আলোছায়া নিয়েও হয়তো তার অভিজ্ঞান অনেক।

মেয়েটি বলে যেতে লাগল, ‘ট্রেন এত লেট, কেউ কিছু বলছেও না। ট্রেন এলে এত ভিড় হয়ে আসবে যে উঠতে পারা যাবে না!’

‘একটাই বাচ্চা তোমার?’

‘হ্যাঁ, ছেলে, তিন বছরের। পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে বিয়ে হল। সায়েন্স ছিল আমার, সায়েন্স পড়তে আমার খুব ভাল লাগত।’

‘পড়লে না কেন?’

‘আব্বাজি মারা গেল। না হলে খোঁড়ার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়!’ ফিক করে হেসে ফেলল মেয়েটি। মেয়েটির হাসিটি খুব সুন্দর। আত্মধ্বংসী এক স্বাচ্ছন্দ্য আছে।

‘কে তোমার খোঁড়া বর?’

‘ওই যে উলুবেড়ের কোর্টগোড়ায় আতরের দোকান দিয়েছে। খুব ভাল মন তার। দাড়ি রেখেছে, পাঁচ অক্ত নামাজ পড়ে।’

‘জয়নালদা না? খোঁড়া বাদশা?’

আবার হেসে ফেলে মেয়েটি।

‘তোমার নাম কী?’

‘নূরজাহান। ডাক নাম আলতা।’

‘বেশ নাম। তোমার স্বামীকে তো চিনি। বেশ মানুষ।’

‘কারও মনে দুঃখ দিয়ে কথা বলে না। আমাদেরও খুব ভালবাসে।’

‘আমাদের বলতে?’

‘আমাকে আর ছেলেকে।’

‘জানি উনি পরেজগার লোক, উনিই কি তোমাকে বোরখা পরতে বললেন?’

‘না, না। না, এটা বিয়েতে কেউ গিফ্ট দিয়েছিল। আমি এক দিন পরলাম, আমার স্বামী বলল, খুব ভাল লাগছে। সেই থেকে পরি। আর কিছু জানি না, আর কিছু বুঝি না। এই যেমন এখন খুব কষ্ট হচ্ছে, খুলে ফেলতে চাই।’

‘খুলে ফেলছ না কেন?’

‘না থাক, ও ওর মতো করে।’

‘তোমার খুব সহ্যশক্তি না?’

‘জানি না।’

সহসা ঝড় এল। কালবৈশাখী। ওলটপালট একটা ঝড়ই চাইছিল সুবিদ। প্রথমে ধুলোর ঝড়। তার পর চার দিক কালো হয়ে ঝড় ও বৃষ্টির তাণ্ডব। প্ল্যাটফর্মের শেডের নীচে এলোমেলো হয়ে পড়ল সকলে। সবাই শেডের তলায় ছুটে আসছে, মাঝখান খুঁজছে। বৃষ্টির ছাট আর ঝড় বাঁচিয়ে থাকতে চাইছে। হাঁসফাঁস তুমুল গরমের পর এই কালবৈশাখীর দাপট চড়াও হয়ে এল। সমস্ত কিছু বিস্রস্ত করে দিল। কিন্তু হাত ধরা নৈকট্যে আলতাকে ধরে রাখতে পারল সুবিদ। তাদের ঘিরেই লোকজনের এই ঘনসন্নিবেশ যে তারা আরও বেশি নিশ্বাস-নৈকট্য পেল।

এই ঝড়ের বৃষ্টির দাপটের ভেতর সুবিদ মনে করতে পারল আলতা আরও অনেক বেশি কথা বলে চলেছে, নীরবতায়। যেন তার আত্মজীবনীর কাল কখনও শেষ হবে না।

‘আলতা, তুমি ভিজছ?’

‘না।’

‘চোখ বন্ধ রেখেছ তো, বালি পড়তে পারে।’

‘আমি ঠিক আছি। আরাম পাচ্ছি, এই ঝড়পানি আমার ভাল লাগছে।’

‘বাড়ির জন্য মন কেমন করছে?’

‘করছে। আবার ভালও লাগছে।’

‘কী চাও তুমি?’

‘মরে যেতে।’

‘কোথায়?’

‘এখানে।’

‘কেন?’

‘জানি না।’

তার পর আর কোনও কথা বলতে পারে না সুবিদ। যেন বলার অধিকার পায় না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। যেন সমাজ-ইতিহাসের সেও এক জন। সে কখনও মায়া-আয়না খুঁজে দিতে পারেনি। এক জন নিষ্ঠুর অপরাধ-মানব সে। কোনও আলোই সে তার করাঞ্জলিতে ধরে রাখতে পারে না, অন্ধকারের জন্ম দিয়ে চলে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে মাটিতে পড়ে যায় আলোগুলো।

তার পর ট্রেন আসছে ঘোষণা হল। আলতা তার খোকার জন্য উন্মুখ হল। এই ট্রেনই ধরবে, ভিড় সত্ত্বেও। অতএব আলতাকে পাশে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সুবিদ। নির্বোধ সুবিদ। বলল, ‘পারবে?’

আলতা ফিসফিসিয়ে বলল, ‘পারব।’

ট্রেন ধরতে তারা বেশ ভিজেও গেল। আর ভিড় ট্রেনের ভেতর কোনও মতে উঠল। এখন তারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এখন আলতার ঠোঁটে পারঙ্গমতার মিষ্টি হাসি। যেন কত দিনের চেনা সুবিদের।

‘তোমার কি মন খারাপ করছে?’

‘হ্যাঁ, খোকার জন্যে। আর জানলাগুলো বন্ধ হল কি না, বিছানা ভিজল কি না, সোহরের ফিরতে অসুবিধে হবে কি না?’

‘তুমি যে ভিজলে?’

‘আমার ভিজতে ভালই লাগল।’

আলতার কণ্ঠার তিলটা দেখে সুবিদ। আলতাকে খুব রূপময় করে তিলটা। খুব সুন্দর একটা হাসি হাসছে।

ট্রেন চলছে। একটু পরেই গন্তব্য এসে যাবে। বৃষ্টি তেমনই হয়ে চলেছে।

বলতে বলতে বাগনান এসে যায়।

সুবিদের হাত ধরে নামে আলতা। আরও খানিকটা ভেজে। তার পর শেডের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়। বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে হচ্ছে। ঝড়ের দাপট তেমনই প্রবল। সন্ধ্যা নেমেছে। চার পাশ ঝাপসা। অন্ধকার। আলোহীনতায় ভুগছে স্টেশন। এলাকায় লোডশেডিং হয়েছে। জনজীবন বেহাল। ফুটপাথের ব্যবসায়ীদের নাকাল দশা। ঝুপড়ির দোকান লণ্ডভণ্ড। রিকশা-অটোরিকশা-রিকশা ভ্যান সব বন্ধ। মানুষজন এক ঠাঁয়ে মূর্তির মতো। এই ঝড়ে ছাতা অচল। জনজীবন বিপর্যের চরম দশায়।

সুবিদ ভাবল, বাড়ি ফেরার জন্য আলতার মন খুবই উতলা হয়ে চলেছে। খুব বিনম্র প্রাচীন তার মন। খুবই সে শুদ্ধচারী, অন্ধ। তাকে যে ভাবে ঘর রাখতে চায়, সে ভাবে রেখেছে নিজেকে সেও। ফিরে যাওয়ার জন্য উতলা হয়েছে। কানা ভাঙা হাঁড়িতে তার বার বার হাতে ব্যথা এনে দেওয়ার মতো উতলা ফিরে যাওয়া অনুভব করে সে হয়তো।

‘ভিজতে ভিজতে যাবে নাকি? হাঁটতে হাঁটতে?’

‘একটু দেখি না।’

‘কী দেখবে?’

‘এখনই হয়তো বৃষ্টি থেমে যাবে।’

‘এখনই থামবে না।’

‘এখনই থামুক চাইছি না। এ ভাবে থাকতে চাইছি। বেশ না?’

‘তুমি এ ভাবে থাকতে পছন্দ করছ?’

‘ভিজে গিয়েছিল বোরখাটা, আমি তো খুলে ফেলেছি।’

‘ওমা, আমি তো দেখিনি। বেশ তো শাড়িখানা?’

হাসে আলতা। এ বার শব্দ করে হাসে। চার পাশে কালবৈশাখীর ঝড়বৃষ্টি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে আছে, আর তারই পটে আলতা হেসে চলেছে। বৃষ্টিটাও তার হাসির মতো আরও আরও বেড়ে চলেছে।

প্রথম প্রকাশ : আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১ আষাঢ় ১৪১৯ রবিবার ১৫ জুলাই ২০১২


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন