চৈত্র সংক্রান্তিতে শিবের গাজন উপলক্ষে পরিবেশিত হয় ‘অষ্টক’ গান। না, এ গান শাস্ত্রীয় গানের জগতে স্থান পায় নি, স্থান পায় নি নাগরিক গানের ধারাতেও। প্রথম দিকে অষ্টক দলের অধিকারীরা মুখে মুখে এ গান পরিবেশন করতেন। সমস্ত অকৃত্রিম লোকসংগীতের মতো অষ্টকেরও জন্ম মৌখিকভাবে। পরে তা লিখিত রূপ পায়। এক সময়ে সারা বাংলায় এই লোকগীতি পরিবেশিত হলেও বর্তমানে টিকে আছে নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের কিছু অঞ্চলে। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদিয়ায় এটি ‘অষ্টক গান’ নামে পরিচিত; বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলে একে ‘অষ্টগান’ নামে অভিহিত করা হয়। এ শুধু গীত নয়, এর সঙ্গে যুক্ত আছে নৃত্য। তাই ‘অষ্টক’ অনেকটা লোকনাট্যের’ চেহেরা নিয়েছে।
কিন্তু নাম ‘অষ্টক’ কেন? এ বিষয়ে আছে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তনের মতো এ গান অষ্ট প্রহর পরিবেশিত হয়। এ ব্যাখ্যা আমরা গ্রহণ করতে অপারগ। কারণ বাস্তবে দেখা যায় নীলের গাজনের তিন দিন মাত্র এ গান পরিবেশিত হয়। কারও মতে এ গানে অষ্ট চরিত্রের সমন্বয় ঘটেছে। অষ্ট চরিত্র হল : রাধা, কৃষ্ণ, সুবল, বিশাখা, ললিতা, বৃন্দা, বড়িমাই, এবং বলরাম। কিন্তু শেষের দিকে বৈষ্ণব প্রসঙ্গ যুক্ত হলেও প্রথম দিকে এ গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শিবঠাকুর। আবার কারও কারও মতে আটটি অধ্যায়ে ভাগ করে গানটি পরিবেশিত হয় বলে এর এই রকম নাম। কিন্তু অষ্টক গানে আটটি অধ্যায় আমরা দেখতে পাই না। কেউ বলেন, ‘অষ্ট’ শব্দের অর্থ শিব, তাই শিবের গানকে অষ্টক গান বলে। কিন্তু এ গানে শিবের প্রসঙ্গে এলেও কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা, নিমাই সন্ন্যাস এ সবও পরিবেশিত হয়। শুধু মহাভারত, রামায়ণ, পুরাণ নয়; অষ্টক গানে উথ্থা[পিত হয় সমসাময়িক প্রসঙ্গ।
ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাংলার লোকসাহিত্য’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে তিনটি অষ্টক গান সংযোজিত করেছেন। গানগুলি মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে সংগৃহীত। প্রথম দুটি শিব সংক্রান্ত আর তৃতীয়টি সমকালীন সমাজের।
এক.
শিব বলে সুন্দরী
তুই তো বড় রূপসী
আমি একটু হইছি বুড়া
তাতে তোর ক্ষতি কি?
আমি দিব সোনার মুকুট তোর মাথায়
সোনা মল গড়ে দিব পায়
দুই হাতে দুই কঙ্কণ দিব যাতে তোর শোভা হয়।
চিরুণে চুড়িয়া চুল,
খোঁপায় দিয়া, হা রে, চম্পা ফুল।
ফুলের গন্ধে কেড়ে নেয় প্রাণের যুবতীর কুল।
দুই.
ও নারদ কৈলাসে ভবানীকে কয় হেসে
পাগলা মামা ধুতরো খেয়ে
কোচের বাড়ি যায় ঘুরে।
ও মামা! হাসে রসে পান চিবায়,
চিচ চালে কোঁচানির গায়।
কেউ বা মামার মাথা খায়, কেউ বা মামার জট ঘুরায়,
ওরে চুপ—গাজন তায় আলোয়ে, নাগর দিল তুলায়ে।
৩. ওরে ঘোর কলিকাল হরি বল।।
পাপের হল অধিকার—
দিগবিদিক পাবে হল সবই হল একাকার।।
ঘরে সাপ গাছের মাপ গেল
বেহ্মার কচা দর হোইল।
ওরে বউ হইয়াছে রাজরাণী
মা হইয়াছে তার চাকরাণী।।
বধূর কথা মধুর লাগে
জয় কবে সেই সুন্দরী।।
অষ্টক গানের কথা কখনো শুনিনি আগে। ভালো লাগলো এই নতুন ধারার কথা জেনে।