আশাপূর্ণা দেবী অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাংলাভাষা ও সাহিত্যের একজন মনস্তাত্বিক কথাশিল্পী। তিনি সাধারণ মেয়েদের সংসার জীবনের ভাঙাগড়া ও যাপিত জীবনের কাহিনি মনস্তাত্ত্বিক অনুষঙ্গে চিত্রায়িত করেছেন তাঁর লেখায় গভীর মমতায়। আশাপূর্ণা দেবী নিতান্তই এক আটপৌরে মা ও গৃহবধূ হয়েও অসাধারণ দক্ষতায় সংসার জীবনের হাসিখেলা, প্রেমবিরহ, দুঃখবেদনা, জন্মমৃত্যু, দ্বন্দ্ব সংঘাতের গল্প শুনিয়েছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। প্রথাগত শিক্ষালাভ না করেও তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ শক্তির বলে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকের আসন লাভ করেন। প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না গ্রহণ করেও অনেক মানুষ স্বকীয় প্রতিভার আলোকে জ্ঞানীগুণী হবার ইতিহাস বিরল নয়। আশাপূর্ণা দেবী এই শ্রেণির মানুষ যিনি নিজের সময়ের থেকে অনেক দূর এগিয়ে ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন ‘আমি মনের জানলা খোলা রেখেছিলাম।’ তার গল্প উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলোকে তিনি বাস্তব অভিজ্ঞার আলোকে চিত্রায়িত করেছেন। তিনি তাঁর মনের দরজা খোলা রেখেছিলেন বলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল।
তাঁর লেখা ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’ ও ‘বকুলকথা’ উপন্যাসত্রয়ী বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম বলে বিবেচিত। তাঁর জন্ম ১৯০৯-এর ৮ই জানুয়ারি, উত্তর কলকাতায়, মাতুলালয়ে। পিতা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত। আশাপূর্ণার সাহিত্য-সংস্পর্শের প্রথম প্রেরণা ছিলেন মা সরলাসুন্দরী। তাঁর নিজের কথায় “হিসেব মতো আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে সংসার ঊর্ধ্বের একটি স্বর্গীয় জগতে। বই পড়াই ছিল দৈনিক জীবনের আসল কাজ।” বিবাহ ১৯২৪-এ ১৫ বছর ৮ মাস বয়সে কৃষ্ণনগর নিবাসী কালিদাস গুপ্তের সঙ্গে । আশাপূর্ণাকে চলে যেতে হয় সাহিত্যগন্ধহীন শ্বশুরবাড়িতে।
তার একাধিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। দেড় হাজার ছোটোগল্প ও আড়াইশো-এর বেশি উপন্যাসের রচয়িতা আশাপূর্ণা সম্মানিত হয়েছিলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার-সহ দেশের একাধিক সাহিত্য পুরস্কার, অসামরিক নাগরিক সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে প্রদান করেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সম্মান রবীন্দ্র পুরস্কার। ভারত সরকার তাকে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমি ফেলোশিপে ভূষিত করেন। আশাপূর্ণার বাবা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন কমর্শিয়াল আর্টিস্ট। সেযুগের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকাগুলিতে ছবিও আঁকতেন। উদারপন্থী ছিলেন তাঁর মা সরলাসুন্দরী দেবী। সাহিত্যপাঠই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ‘পরমার্থ’। রাজনৈতিক আদর্শে ছিলেন কট্টর ব্রিটিশ-বিদ্বেষী স্বদেশী।
আশাপূর্ণা প্রথম নারী হিসেবে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ পান। অথচ অদ্ভুত কথা হল তিনি কোনোদিন স্কুলে পড়েননি। হ্যাঁ এটাই সত্যি। কারণ বাড়ির বারণ ছিল। তাঁর মা সরলাসুন্দরী দেবী কিন্তু স্কুলে পড়া বিদুষী ছিলেন। মা খুব চেষ্টা করেছিলেন তাঁর মেয়েরা স্কুলে পড়ুক। কিন্তু তাঁর শাশুড়ির অনমনীয় জেদের কাছে হার মেনে যান। আশাপূর্ণা দেবীর ঠাকুমা শেষমেশ মত দেননি।
গুপ্ত-পরিবারের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার বেগমপুরে। যদিও আশাপূর্ণা দেবীর জীবনের সঙ্গে ওই অঞ্চলটির কোনও প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। তাঁর ছোটোবেলা কেটেছিল উত্তর কলকাতাতে ঠাকুরমা নিস্তারিনী দেবীর পাঁচ পুত্রের একান্নবর্তী সংসারে। পরে হরেন্দ্রনাথ যখন তার আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড) নিজস্ব বাসভবনে উঠে আসেন আশাপূর্ণার বয়স তখন সাড়ে পাঁচ বছর। কিন্তু ছোটবেলার ওই কয়েকটি বছর তাঁর মনে গভীর ছাপ রেখে যায়। পরবর্তীকালে সাহিত্যেও নানা ভাবে এঁকেছিলেন দেহে ও মনে অসম্ভব একগুঁয়ে তাঁর সেই ঠাকুরমার ছবি।
পরবর্তী জীবনে এক স্মৃতিকথায় এই প্রসঙ্গে আশাপূর্ণা বলেছিলেন, ‘…ইস্কুলে পড়লেই যে মেয়েরা… বাচাল হয়ে উঠবে, এ তথ্য আর কেউ না জানুক আমাদের ঠাকুমা ভালোভাবেই জানতেন, এবং তার মাতৃভক্ত পুত্রদের পক্ষে ওই জানার বিরুদ্ধে কিছু করার শক্তি ছিল না।’
তবে এই প্রতিকূল পরিবেশেও মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে দাদাদের পড়া শুনে শুনে শিখে গিয়েছিলেন পড়তে। বর্ণপরিচয় আয়ত্ত করেছিলেন বিপরীত দিক থেকে। মা সরলাসুন্দরী ছিলেন একনিষ্ঠ সাহিত্য-পাঠক। সেই সাহিত্যপ্রীতি তিনি তার কন্যাদের মধ্যেও সঞ্চারিত করেছিলেন।
সাধনা, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সবুজপত্র, বঙ্গদর্শন, বসুমতী, সাহিত্য, বালক, শিশুসাথী, সন্দেশ প্রভৃতি ১৬-১৭টি পত্রিকা এবং দৈনিক পত্রিকা হিতবাদী তো বাড়িতে আসতই, তাছাড়াও সরলাসুন্দরী ছিলেন স্বনামধন্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, জ্ঞানপ্রকাশ লাইব্রেরি ও চৈতন্য লাইব্রেরির সদস্য। বাড়িতে সে যুগের সকল প্রসিদ্ধ গ্রন্থের একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডারও ছিল। এই অনুকূল পরিবেশে মাত্র ছয় বছর বয়স থেকেই পাঠ্য ও অপাঠ্য নির্বিশেষে পুরোদমে আশাপূর্ণা পড়াশোনা শুরু করে দেন।
পরবর্তীকালে কৈশোরের কথা তিনি বলেছিলে এভাবে— ‘হিসেব মতো আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে, সংসার ঊর্ধ্বের একটি স্বর্গীয় জগতে। বই পড়াই ছিল দৈনিক জীবনের আসল কাজ।’
ছেলেবেলার দিনগুলি সম্পর্কে আশাপূর্ণা আরো বলেছেন, ‘…খুব ডাকাবুকো ছিলাম। ছেলেবেলায় ঘুড়ি ওড়াতাম, মারবেল খেলতাম। ক্যারাম খেলতাম দাদাদের সঙ্গে।’
অন্যদিকে, পিতামাতার সবচেয়ে বাধ্য মেয়ে হওয়ার জন্য তাদের সবচেয়ে প্রিয়পাত্রীও তিনি হয়ে উঠেছিলেন। সেদিনের নির্মীয়মান কলকাতা মহানগরী ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। আর প্রিয় ছিলেন দিদি রত্নমালা ও বোন সম্পূর্ণা। তারা তিনজনে ছিলেন, আশাপূর্ণার ভাষায়, ‘…একটি অখণ্ড ট্রিলজির অংশ। এক মলাটে তিনখানি গ্রন্থ।’
আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড) নতুন বাড়িতে উঠে আসার কিছুদিনের মধ্যে এই অখণ্ড আনন্দে বিচ্ছেদের সুর বাজে। বিয়ে হয়ে যায় দিদি রত্নমালার। সেই নিঃসঙ্গতা দূর করতে একদিন আশাপূর্ণা ও সম্পূর্ণা করে ফেলেন এক দুঃসাহসিক কাজ। দুই বোনের জবানীতে চিঠি পাঠান রবীন্দ্রনাথকে। আবদার, ‘নিজের হাতে আমাদের নাম লিখে একটি উত্তর দেবেন।’ সেই চিঠির কাঙ্ক্ষিত উত্তর আসতে দেরি হয় না। আর এর পরেই দেশেবিদেশে আত্মপ্রকাশ ঘটে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত স্বশিক্ষিত গৃহবধূ’র।
১৯২৬ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে একমাত্র কন্যা পুস্পরেণু ও দুই পুত্র প্রশান্ত ও সুমান্তের জন্ম হয়। তার লেখক ও পারিবারিক জীবন ছিল অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। সাংসারিক নানা ব্যস্ততায়ও তিনি তার লেখক স্বত্তা রক্ষা করতে পেরেছিলেন সফলভাবে। একজন সুগৃহিনীর পক্ষে একজন সুলেখক হওয়া যে সম্ভব তা তিনি প্রমাণ করেন তাঁর লেখা গল্প উপন্যাসের মাধ্যমে।
এখন তাঁর লেখা ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, ও ‘বকুলকথা’ এই তিনটি উপন্যাস আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনার মর্যাদা পেয়েছে। আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্যের ভাষা সহজ, সরল কিন্তু গভীর তাৎপর্যময়। জীবনকে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন কর্মের মধ্যে, সংগ্রামের মধ্যে, বিপর্যয়ের মধ্যে, বিপর্যয় থেকে উঠে দাঁড়াবার অদম্য প্রয়াসে— এক কথায় জীবনের নিরন্তর গতিশীলতার মধ্যে। তার রচনা স্বদেশচিন্তা ও সমাজ ভাবনা আশ্রিত, মননশীলতায় ঋদ্ধ।
তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছোটগল্প— পাতাচাঁপা, সর্ষে ও ভূত, ডেইলি প্যাসেজ্ঞার, কামধেনু, শুনে পুণ্যবান, অভিনেত্রী, ক্যাকটাস্ ইত্যাদি ।
১৯৯৫ সালের ১৩ জুলাই আশাপূর্ণা দেবী প্রয়াত হন। সাধারণ মেয়েদের জীবনধারা ও জীবনযাপনই ছিল তাঁর রচনার মূল অবলম্বন। প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও তার গভীর দূরদর্শীতা, অন্তদর্শন ক্ষমতা ও নিরীক্ষণ শক্তিই তাঁকে অন্যতম লেখিকা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ঠাকুরমা নিস্তারিণী দেবীর কঠোর অনুশাসনে তাঁর প্রথাগত শিক্ষা লাভ হয়নি। কিন্তু অন্যদিকে তার মা সরলাসুন্দরী ছিলেন একনিষ্ঠ সাহিত্য অনুরাগী। সরলাসুন্দরী দেবী তার সাহিত্য প্রীতি কন্যাদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন। প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাস অবলম্বনে দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় একটি বাংলা সিনেমা তৈরী হয় ১৯৭১ সালে। ‘সুবর্ণলতা’ এক বন্ধন জর্জরিত মুক্তিকামী নারীর আখ্যান। বিজয় বসু পরিচালিত চলচ্চিত্র সুবর্ণলতা নির্মিত হয় ১৯৮১ সালে। এরপর ২০১০ সালে সুবর্ণলতা সিরিয়াল তৈরি হয় একটি বাংলা চ্যানেলে বিষ্ণুপদ মাইতি ও অমিতাভ ভট্টাচার্যের পরিচালনায়। সাহিত্যের পাঠক ব্যতিক্রমী এই কথাশিল্পীকে চির অমর করে রাখবেন।
মনোজিৎকুমার দাস, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।