প্রায় সব সাংসদরাই বলে থাকেন, তাদের পেশা একটাই, সেটি হল রাজনীতি। এক কথায় তারা নিজেরাই নিজেদের সমাজসেবী বলে দাবী করেন! অথচ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশের ৫০ ভাগ মানুষের হাতে রয়েছে দেশের মোট সম্পদের মাত্র ৩ ভাগ অন্যদিকে দেশের সংসদ প্রতিনিধিদের সাড়ে সাতাশি শতাংশ কোটিপতি। প্রশ্ন হল সমাজসেবাই যেখানে সাংসদদের একমাত্র পেশা সেখানে তারা বিপুল সম্পদের অধিকারী কী ভাবে হচ্ছেন? পাশাপাশি এই প্রশ্ন কি এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হবে যে দেশের এই সব সাংসদদের কি সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধি বলা যায়?
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ২০২৩ সালের হিসাব জানিয়েছিল, ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১১। তার আগের বছর ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ১০৭। অর্থাৎ এক বছরে আরও চার ধাপ পতন ঘটেছে। পড়শি দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল এমনকি শ্রীলঙ্কারও নীচে জায়গা পেয়েছে ভারত। তবে ভারতের লজ্জাজনক এই স্থানার্জনকে দিল্লি কোনোভাবেই মানতে নারাজ। তাদের মত, ইন্ডিয়া অন গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্সের এই সমীক্ষা হিসাব সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ। কেন্দ্র সরকার এই হিসাবকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন, ভারতে অনাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা যে অত্যন্ত উদ্বেগজনক তা ভারতে অপুষ্টির হার ১৬.৬ শতাংশ আর অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুদের মৃত্যুর হার ৩.১ শতাংশ, পাশাপাশি ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি মহিলাদের মধ্যে ৫৮.১ শতাংশ রক্তাল্পতায় তা প্রমাণ করে দেয়। প্রশ্ন, দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা যখন হু হু করে বাড়ছে, সবথেকে কম ওজনের, রুগ্ন-অপুষ্ট শিশুর সংখ্যায় ভারত যখন গোটা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান দখল করেছে, স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে যে দেশের মানুষ বঞ্চিত, কর্মসংস্থানে যে দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ সঙ্কটে, আরও তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট– সেই সময় নির্বাচনে বিপুল খরচ বড়ই বেমানান। দেশের এই সঙ্কটের ছবি নিয়ে কোটিপতি সাংসদেরা কি আদৌ চিন্তা করেন? দেশের জনগণের দুর্দশা নিয়ে যদি আদৌ তারা চিন্তিত হন তাহলে কিভাবে নির্বাচনে জিততে তারা স্রোতের মতো টাকা ঢালেন?
অষ্টাদশ লোকভা ভোটের আগেই নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতি দেখিয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির সিন্দুক ভরে পুঁজিপতিদের সৌজন্যে। যে পুঁজিপতিরা নিজেদের বেআইনি এবং দুর্নীতিকে আড়াল করতে শাসক দল নেতা, মন্ত্রী, সাংসদদের দু’হাত ভরিয়ে দেন। বিনিময়ে অবাধে বেআইনি লটারি চলতেই থাকে, বিদ্যুৎ-ওষুধের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে, সরকারি বরাত সহজেই হস্তগত হয়, অন্যদিকে শাসকদল এবং নেতাদের পকেট ভারী হয়ে ওঠে। সম্পদশালী সংসদদের ক্ষমতা এইভাবে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্ষমতা পরিসর যেমন সঙ্কুচিত হয়েছে সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বলার জনপ্রিধিনিদের সংখ্যাও কমেছে দ্রুত গতিতে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের জন্য নীতি-নির্ধারণ করার সাংসদের সংখ্যা সংসদের মধ্যে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া কোটিপতি সাংসদরা শ্রেণিগত কারণেই সাধারণ বা গরিব মানুষের প্রতিনিধি হতে পারেন না। কারণ, এইসব সাংসদদের যারা পৃষ্ঠপোষক যারা দেশের নীতি নির্ধারণ হবে তাদের স্বার্থেই। এই সাংসদরা পৃষ্ঠপোষকদের স্বার্থরক্ষা করতেই জনস্বার্থবিরোধী নীতি-আইন পাশ করান, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক সরিয়ে দিয়ে শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী আইনকে পাশ করান।
একদিকে সাংসদের সম্পদ বাড়ে অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্দশা বাড়তেই থাকে। অর্থাৎ কোনও দল বা সাংসদের নীতি আদর্শ বলতে পৃষ্ঠপোষক পুঁজিপতিদের স্বার্থ দেখা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৭টি লোকসভা নির্বাচন হয়েছে (১৮ বারের নির্বাচন চলছে), কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে শাসকের আসনে বসুক না কেন, এমনকি বিরোধী দলের প্রতিনিধি হিসেবেও কিন্তু সাধারণ মানুষের খাদ্য-কাজ-শিক্ষা-স্বাস্থের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সংসদে বিপুল বিতর্ক করেছেন এমন সাংসদের দেখা মিললেও তিনি যে সাধারণ মানুষের জন্য গলা ফাটিয়ে সফল হয়েছেন এমন উদাহরণ অল্লাশি করে কটা মিলবে? পরাধীন দেশের এমনকি স্বাধীনতার কয়েক বছর পরও দেশবাসী রাজনৈতিক নেতা বলতে বুঝত স্বার্থহীন, দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির একজন মানুষের কথা, যার জীবনের ব্রত ছিল সাধারণ মানুষের কল্যাণ করা৷ কিন্তু আজ যারা দেশের আইনসভা আলোকিত করেন তারা কেবলমাত্র কর্পোরেট পুজিপতিদের সবার্থ দেখতেই ব্যস্ত৷ এই সাংসদদেরই কি আমরা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি বলবো?